ডাউন সিনড্রোমঃ দরকার সচেতনা ও ভালোবাসা

ডাউন সিনড্রোম নামটি আপনার কাছে অচেনা হতে পারে, তবে আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী, হাবাগোবা কিংবা অটিস্টিক নামে পরিচিত বেশির ভাগ শিশুই আসলে ডাউন সিনড্রোম নামক রোগে আক্রান্ত।

  • বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০০০ বাচ্চার জন্মের মধ্যে ১ জন বাচ্চার ডাউন সিনড্রোম হয়ে থাকে।

  • প্রতি বছর, প্রায় ৩০০০ থেকে ৫০০০ শিশু এই ক্রোমোজোম ব্যাধি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।

  • তবে সঠিক পরিচর্যা এবং উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে জীবনমানের উন্নয়ন করা সম্ভব।

  • উন্নত বিশ্বে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগী ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে সক্ষম।

ডাউন সিনড্রোম কি?

ডাউন সিনড্রোম শিশুদের একটি জেনেটিক বা জিনগত (ক্রোমোজম ঘটিত) অসুখ যা ট্রাইসোমি ২১ নামেও পরিচিত। অর্থাৎ এই রোগ নিয়ে জন্ম নেয়া মানুষের ক্রোমোজোমের গঠন সাধারণ মানুষের ক্রোমোজমের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন হয়ে থাকে। জন ল্যাংডন ডাউন নামের একজন ব্রিটিশ ডাক্তার ১৮৬৬ সালে এই রোগটি সম্পর্কে প্রথম বিশদভাবে বর্ণনা দেন। তাই তার নাম অনুসারে একে ডাউন সিনড্রোম বলা হয়। ডাউন সিনড্রোম রোগে আক্রান্ত মানুষের মধ্যে মৃদু বা মাঝারি স্তরের বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা, বেড়ে ওঠায় বিলম্ব বা অন্য কিছু শারীরিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।

ডাউন সিনড্রোম কেন হয়?

এই রোগে আক্রান্ত শিশুর ক্রোমোজমের গঠন স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা আলাদা হয়। মানুষের কোষে মোট ২৩ জোড়া অর্থাৎ ৪৬ টি ক্রোমোজম থাকে৷। এর মধ্যে ২২ জোড়া অটোসোম এবং ১ জোড়া সেক্স ক্রোমোজম। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির ২১ নাম্বার ক্রোমোজমে দুইটির বদলে তিনটি কপি থাকে। অর্থাৎ এদের মোট ক্রোমোজম সংখ্যা হয় ৪৭ টি। এজন্যই একে ট্রাইসোমি বলা হয়৷ এই এক্সট্রা এক কপি ক্রোমোজমই যাবতীয় শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের জন্য দায়ী।

ডাউন সিনড্রোম কত প্রকার?

মোট ৩ ধরনের ডাউন সিনড্রোম রয়েছে। এর মধ্যে ৯৫% হচ্ছে কেসইট্রাইসোমি ২১। অন্য দুটি ধরনের মধ্যে রয়েছে ট্রান্স লোকেশন ডাউন সিনড্রোম (৩-৪%) এবং মোজাইক ডাউন সিনড্রোম (১-২%)।

ডাউন সিনড্রোম ক্রোমোজম ঘটিত ডিসঅর্ডারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কমন। বিশ্বে প্রতি ৭০০ থেকে এক হাজার জন শিশুর মধ্যে ১ জন ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত। ঠিক কি কারণে এই রোগ হয় অর্থাৎ ঠিক কি কারণে ২১ নাম্বার ক্রোমোজমে এক্সট্রা একটি কপি যুক্ত হয় তা এখনো সঠিক জানা যায় নি। তবে মায়ের বয়স এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী, Advanced maternal age অর্থাৎমায়ের বয়স ৪০ থেকে ৪৫ বা তার বেশি হলে গর্ভের সন্তানের ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।

ডাউন সিনড্রোম লক্ষণ

যেকোনো হাবাগোবা কিংবা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা মানেই যে সে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত বিষয়টা সেরকম নয়। ডাউন সিনড্রোমের সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষণ আছে।

  • এসব বাচ্চাদের চোখের কোণা উপরের দিকে উঠানো, ফোলা ফোলা নাক মুখ, লো মাসল টোন, ছোট নাক, কম উচ্চতা ইত্যাদি শারীরিক বৈশিষ্ট্য থাকে।

  • অনেক শিশুই সারাক্ষণ জিহবা বের করে রাখে, এদের হাতের তালুতে সাধারণত অনেক গুলো রেখার বদলে একটি মাত্র রেখা অর্থাৎ সিঙ্গেল ক্রিজ থাকে। একে সিমিয়ান ক্রিজও বলা হয়।

  • পায়ের বুড়ো আঙুল ও দ্বিতীয় আঙুলের মধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ফাঁকা থাকে।

  • এছাড়াও এসব বাচ্চাদের মধ্যে অনেকেই কনজেনিটাল বা জন্মগত বিভিন্ন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। যেমন, এট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট (ASD), পেটেন্ট ডাক্টাস আর্টেরিওসাস (PDA) এবং ফ্যালোট'স টেট্রালজি।

  • এসব বাচ্চাদের থাইরয়েড জনিত সমস্যা, লিউকেমিয়া বা আলঝেইমার্স ডিজিজে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত বেশি হয়।

  • আবার অনেকের মধ্যে কানে কম শোনা বা চোখে ভালো না দেখার মত সমস্যাও থাকতে পারে।

এ তো গেল শারীরিক সমস্যার কথা।

  • ডাউন সিনড্রোম আমাদের মানসিক বুদ্ধিবৃত্তিকেও প্রভাবিত করে। তবে ইন্টেলেকচুয়াল ডিজএবিলিটির পরিমাণ কারো মধ্যে কম, কারো মধ্যে বেশি হয়।

  • এই শিশুদের বুদ্ধিমত্তা এবং কর্মক্ষমতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়।

  • এই রোগে আক্রান্ত একজন পূর্ণ বয়স্ক ব্যক্তির আইকিউ ৫০ বা এর আশেপাশে হয়।

ডাউন সিনড্রোম প্রতিরোধ করা কি সম্ভব?

এক কথায় যদি বলি, তাহলে এই প্রশ্নের উত্তর হবে 'না'। পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এই সমস্যার সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না, তবে মায়ের বয়স এবং শুক্রাণু ডিম্বাণু জনিত কিছু ফ্যাক্টর রয়েছে। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটা মনে রাখা জরুরি, ডাউন সিনড্রোম মা বাবার কোনো 'দোষ' বা অসুখের কারণে হয় না। এটি একটি জেনেটিক রোগ। ক্রোমোজমের বিন্যাসের ভুলে এ রোগ হয়। এ ভুল ইচ্ছাকৃত নয়। সন্তানের মা বাবা কিংবা অন্য কারো এতে হাত থাকে না।

এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় তবে সন্তান গর্ভে আসার পর কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করা যেতে পারে। এসব পরীক্ষা থেকে সন্তানের ডাউন সিনড্রোম আছে কিনা সেটা জানা যায়। মায়ের সেরাম স্ক্রিনিং, কোরিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং (CVS), নন ইনভেসিভ প্রিনেটাল টেস্টিং - এইসব পরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভের সন্তান ভবিষ্যতে ডাউন সিনড্রোম কিংবা অন্য কোনো ক্রোমোজমাল রোগে আক্রান্ত হবে কিনা সেটা জানা যায়। এইসব পরীক্ষা বাংলাদেশেই করা যায়। তবে কিছুটা ব্যয়বহুল এবং এখনো দেশের সর্বত্র  সহজলভ্য হয়নি বলে এ সম্পর্কে অনেকেই এখনো জানেন না।

ডাউন সিনড্রোম চিকিৎসা

ডাউন সিনড্রোম নিরাময়ের উপায় কি? আসলে ডাউন সিনড্রোম একেবারে নিরাময় করা সম্ভব নয়। জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি এই সমস্যা চিহ্নিত করা যায়, ততই ভালো। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্তদের জীবনযাত্রা সহজ করার জন্য নানা রকম থেরাপি, সাপোর্ট সিস্টেম ও বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে বিশেষ ধরনের স্কুল ও ভোকেশনাল শিক্ষা ব্যবস্থা।

এখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় একদম ছোটো বাচ্চাদের জন্য বিশেষ স্কুল রয়েছে যেখানে স্পিচ থেরাপিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্টও স্পেশাল চাইল্ডদের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষক রয়েছেন। বাচ্চাদের মোটর স্কিল, কমিউনিকেশন স্কিল, সামাজিক ও মানসিক উন্নতির জন্য এনারা কাজ করে যাচ্ছেন।

যেসব বাচ্চা জন্ম থেকেই নানা জটিল রোগে আক্রান্ত, তাদের ক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়িসম্ভব রোগ ডায়াগনোসিস করা এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু করা খুব জরুরি।

এসব বাচ্চাকে স্বাবলম্বী করে তোলার জন্য শুধুমাত্র স্কুলে পাঠানো এবং ডাক্তার দেখানোই যথেষ্ট নয়। তারা যেন সমাজের বাকি সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে, এজন্য বেসিক লাইফ স্কিল যেমন নিজে নিজে খাবার খাওয়া, নিজের কাপড় পড়তে শেখা, একা একা রাস্তায় চলাফেরা করতে পারা এসব জিনিসও শেখাতে হবে। আর এরজন্য মা বাবা এবং পরিবারের বাকি সবার একান্ত সহযোগিতা প্রয়োজন। বেশির ভাগডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত একজন মানুষের মনোজগত একটা ৮-১০ বছরের শিশুর মত। তাই ধৈর্য হারানো চলবে না।

দেশে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি নামক একটি সহায়তা প্ল্যাটফর্ম গঠিত হয়। মূলত ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত বাচ্চাদের অভিভাবকদের উদ্যোগে এই প্ল্যাটফর্মটি গড়ে ওঠে। আপনার পরিবারে বা আশেপাশে এ ধরনের শিশু থাকলে আপনি তাদেরকে এই সোসাইটি সম্পর্কে জানাতে পারেন। এখানে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য সব ধরণের সহায়তা করা হয়।

সামাজিক ধ্যানধারণা

আগেই বলেছি ডাউন সিনড্রোম একটি ক্রোমোজম ঘটিত সমস্যা। এক কপি এক্সট্রা ক্রোমোজমের কারণেই এই সমস্ত সমস্যা তৈরি হয়৷ কিন্তু এই এক্সট্রা ক্রোমোজমের দায়ভার কারোর নয়। আমাদের সমাজে সন্তানের যেকোনো অক্ষমতার জন্য মাকে দায়ী করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দায়টা বাবার উপরেও বর্তায়। মা বাবার পাপের ফল কিংবা মায়ের কোনো গোপন রোগের ফলে ডাউন সিনড্রোম হয় না। মায়ের বয়স একটি প্রধান ফ্যাক্টর হলেও আমাদের আশেপাশে এমন প্রচুর মা আছেন যারা বেশি বয়সে সুস্থ স্বাভাবিক সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। অনেক অঞ্চলে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত বাচ্চাদের অশুভ বলে মনে করা হয়। 

ডাউন সিনড্রোম আর অটিজম কি এক?

ডাউন সিনড্রোম হলেই বাচ্চা হাবাগোবা হবে ধরে নেয়া হয়। আরো একটা মজার ব্যাপার হল, ডাউন সিনড্রোম এবং অটিজমকে এক করে দেখা। আসলে ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত মানেই যে অটিজমের শিকার, তেমনটিও সবসময় সত্যি নয়। সবকিছু মিলিয়ে এখনো ডাউন সিনড্রোম নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে।

 

ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুরা আমাদের বোঝা নয়। সাধারণ শিশুদের চেয়ে এরা একটু আলাদা, তবে এরা যেন স্বাভাবিক জীবন পায় এজন্য আমাদের সবার চেষ্টা করা উচিত। প্রতি হাজারে অন্তত একজন শিশু এই রোগে আক্রান্ত। সে হিসেবে সংখ্যাটা একেবারে কম নয়। এই জনগোষ্ঠীকে বাইরে না রেখে বরং তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাজের মূল ধারার উপযোগী করে তুলতে হবে। আর এই দায়িত্ব সমাজের একজন হিসেবে আমাকে এবং আপনাকেও নিতে হবে।

Default user image

ডাঃ ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী। বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অল্প স্বল্প লেখালেখি করতে ভালো লাগে। আস্থা লাইফের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্লগগুলি মানুষের মধ্যে একটু হলেও সচেতনতা তৈরি করবে বলে আমার বিশ্বাস। ভালো লাগে ঘুমাতে, গান শুনতে, নানা রকম খাবার খেতে আর সবচেয়ে ভালো লাগে কথা বলতে।

Related Articles