দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ (CKD) সম্পর্কে আপনার যা জানা উচিৎ

দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ কেন এত ভয়ঙ্কর! এর কারণ এবং উপসর্গগুলি কি কি? এই রোগ থেকে বাঁচতে আপনার কিডনিকে কোন উপায়ে ভালো রাখবেন? আজকের আর্টিকেলে আপনি এসবই জানতে পারবেন।

  • দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বা ক্রোনিক কিডনি ডিজিজ (CKD) এমন একটি রোগ যা কিডনির কার্যক্ষমতা হ্রাস করে।

  • এটি যেকোন বয়সের বা স্থানের মানুষেরই হতে পারে, তবে  কালো বা দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত মানুষের মধ্যে বেশি দেখা যায়। 

  • সাধারণত বয়স্ক মানুষেরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন।

  • CKD সময়ের সাথে খারাপ হতে থাকে পারে এবং কিডনি সম্পুর্ণ বিকলও হতে পারে। 

  • প্রাথমিক সনাক্তকরণ কিডনি রোগ ধরা পড়লে এ রোগ অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো করা যায়।

  • কিডনি সম্পুর্ণ বিকল হলে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের বিকল্প নেই।

তবে আশার কথা হলো CKD আক্রান্ত অনেক মানুষ এই অবস্থার সাথে দীর্ঘ জীবনযাপন করতে সক্ষম। চলুন তবে রোগটি সম্পর্কে জানা যাক।

দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ (CKD) কি?

দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে এমন কিছু শারিরীকক সমস্যা হয়ে থাবে যা আপনার কিডনিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং যার ফলে শরীরের বজ্র নিষ্কাসন হ্রাস পায়, যা রোগীকে বিভিন্ন অসুস্থ্যতার কারণ হয়ে ওঠে। আপনার শরীরে উচ্চ রক্তচাপ, রক্তাল্পতা (রক্তের নিম্ন গণনা), দুর্বল হাড়, দুর্বল পুষ্টি স্বাস্থ্য এবং স্নায়ুর ক্ষতির মতো জটিলতা তৈরি হতে পারে। এছাড়াও, কিডনি রোগ হৃদরোগ এবং রক্তনালীর রোগ হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। এই সমস্যাগুলি দীর্ঘ সময়ের জন্য ধীরে ধীরে ঘটতে পারে ও প্রাথমিক অবস্থায় রোগের উপস্থিতি বুঝতে পারা বেশ কঠিন। 

দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং অন্যান্য রোগের কারণে হতে পারে। প্রাথমিক সনাক্তকরণ এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ না করলে প্রায়শই দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগকে আরও খারাপ হতে পারে। কিডনি রোগ আরো খারাপ আকার ধারণ করলে জীবন রক্ষার জন্য ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয় যা বেশ খরচ সাপেক্ষ।

কি কারণে CKD হয়?

  • দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের দুটি প্রধান কারণ হল ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ, যা দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে দায়ী।

  • ডায়াবেটিস তখন হয় যখন আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা খুব বেশি থাকে, যার ফলে আপনার শরীরের অনেক অঙ্গ, যেমন কিডনি এবং হার্ট, সেইসাথে রক্তনালী, স্নায়ু এবং চোখের ক্ষতি হয়। 

  • উচ্চ রক্তচাপ তখন ঘটে যখন আপনার রক্তনালীর দেয়ালের বিরুদ্ধে আপনার রক্তের চাপ বৃদ্ধি পায়। যদি অনিয়ন্ত্রিত, বা দুর্বলভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, উচ্চ রক্তচাপ হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের একটি প্রধান কারণ হতে পারে। এছাড়াও, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি করতে পারে।

  • গ্লোমেরুলোনফ্রাইটিস, রোগের একটি গ্রুপ যা কিডনির ফিল্টারিং ইউনিটগুলির প্রদাহ এবং ক্ষতি করে। এই রোগগুলি কিডনি রোগের তৃতীয় সর্বাধিক সাধারণ প্রকার।

  • উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত রোগ, যেমন পলিসিস্টিক কিডনি রোগ, যা কিডনিতে বড় আকারের সিস্ট তৈরি করে এবং আশেপাশের টিস্যুকে ক্ষতি করে।

  • কিডনিতে পাথর, টিউমার বা পুরুষদের বর্ধিত প্রোস্টেট গ্রন্থির মতো সমস্যার কারণে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতাও কিডনি রোগের জন্য দায়ী হতে পারে।

  • বারবার প্রস্রাবের সংক্রমণ কিডনি রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে বাড়িয়ে তোলে।

CKD এর উপসর্গ কি?

অধিকাংশ লোকের কিডনি রোগ বেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত কোনো গুরুতর উপসর্গ নাও থাকতে পারে। তবে নিচের উপসর্গ গুলো জানলে এ রোগ থেকে সতর্ক থাকতে পারেন।

  • বেশি ক্লান্ত বোধ করা এবং দুর্বল লাগা

  • মনোনিবেশ করতে সমস্যা হওয়া

  • ক্ষুধা কম

  • ঘুমাতে সমস্যা হয়

  • রাতে পেশী খিঁচুনি হয়

  • পা এবং গোড়ালি ফুলে গেছে

  • আপনার চোখের চারপাশে ফোলাভাব আছে, বিশেষ করে সকালে

  • শুষ্ক, খিটখিটে ত্বক আছে

কিছু লোকের কিডনি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় বেশি। আপনার কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে যদি আপনার-

  • ডায়াবেটিস আছে

  • উচ্চ রক্তচাপ আছে

  • কিডনি বিকল হওয়ার পারিবারিক ইতিহাস আছে

  • বয়স্ক

কখন ডাক্তার দেখাবেন?

আপনার কিডনি রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ থাকলে আপনার ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করুন। প্রাথমিক সনাক্তকরণ কিডনি রোগকে কিডনি বিকল হওয়া থেকে বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে।

যদি আপনার কোন মেডিকেল কন্ডিশন থাকে যা কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, আপনার ডাক্তার অফিস ভিজিটের সময় প্রস্রাব এবং রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে আপনার রক্তচাপ এবং কিডনির কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করতে পারে। আপনার ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করুন এই পরীক্ষা গুলি আপনার জন্য প্রয়োজনীয় কিনা।

কিডনি ভালো রাখার কিছু উপায়

১. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ 

যেসব রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, তাদের নিয়মিত রক্তচাপ মাপা উচিত। অনেক রোগীই প্রেসক্রিপশন নিয়ে বাড়ি যাবার পর পুনরায় ফলো আপে আসেন না। কিংবা রক্তচাপ আদৌ নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা তা মেপে দেখার প্রয়োজন বোধ করেন না। 

আজকাল গ্রাম গঞ্জেও ফার্মেসি কিংবা দোকানপাটে ব্লাড প্রেশার মাপার ব্যবস্থা থাকে। নিয়মিত ওষুধ খাবার পাশাপাশি সপ্তাহে অন্তত একবার ব্লাড প্রেশার মেপে দেখতে হবে। পরপর দুইবার যদি ১৩০/৯০ বা এর বেশি রিডিং পাওয়া যায়, তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। 

২. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ 

হাইপারটেনশনের মতই ডায়বেটিসও এমন একটি অসুখ যা আপনার কিডনির ক্ষতি করার জন্য যথেষ্ট। বেশির ভাগ কিডনিজনিত রোগের হিস্ট্রি খুঁজলে অনিয়ন্ত্রিত প্রেশার কিংবা অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস পাওয়া যায়। তাই নিয়মিত রক্তের সুগারের মাত্রা পরীক্ষা করতে হবে। 

৩. প্রেসক্রিপশন ছাড়া ব্যথার ওষুধ খাবেন না

ডাইক্লোফেনাক জাতীয় ব্যথার ওষুধ নেফ্রোটক্সিক হিসেবে কাজ করে। খুব প্রয়োজন না হলে বিশেষত রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ব্যথার ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ এ ক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। 

৪. ধূমপান মদ্যপান যতটা সম্ভব পরিহার করুন 

একটা লম্বা সময় ধরে মানুষ ভাবত ধূমপান শুধুমাত্র ফুসফুসের ক্ষতি করে। আর মদ বা অন্যান্য মাদক লিভারের। কিন্তু আসলে ধূমপান ও মদ্যপান দেহের সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ক্ষতি করে। দীর্ঘদিন ধূমপান করার ফলে কিডনিতে রক্ত চলাচল কমে যায় এবং কিডনির কর্মক্ষমতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। 

৫. যাদের পরিবারে কিডনি রোগী আছেন বা ছিলেন তাদের নিতে হবে অতিরিক্ত সতর্কতা

যাদের পরিবারে কেউ কিডনি জনিত জটিলতায় ভুগছেন, তাদের প্রত্যেকের বছরে অন্তত একবার কিডনি সংক্রান্ত যাবতীয় পরীক্ষা করানো উচিত। পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ (PCKD) সহ কিছু রোগে পজিটিভ ফ্যামিলি হিস্ট্রি পাওয়া যায়। 

৬. প্রস্রাবের রঙ খেয়াল করুন

নিয়মিত প্রস্রাবের রঙ খেয়াল করুন। লালচে রঙের প্রস্রাব একটি 'এলার্মিং সাইন'। যদি মনে করেন প্রস্রাবে রক্ত যাচ্ছে কিংবা বেশি হলুদ হয়ে গেছে তাহলে দেরি না করে একজন নেফ্রোলজিস্ট বা ইউরোলজিস্ট এর সাথে যোগাযোগ করুন। এছাড়াও প্রস্রাবের পরিমাণ যদি অনেক দিন ধরে অতিরিক্ত বেশি কিংবা চোখে পরার মত কম হয় তাহলেও ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। 

কিডনি বিকল হয়ে গেলে আমাদের করণীয়

খাবার দাবার নিয়ন্ত্রণ

কনট্রোলড ডায়েট বা নিয়ন্ত্রিত আহার হচ্ছে প্রথম উপায়। এর মধ্যে রয়েছে প্রোটিন, সল্ট, ফ্লুইড ও পটাশিয়াম রেস্ট্রিকশন অর্থাৎ কম পরিমাণে আমিষ গ্রহণ করতে হবে, নিয়ন্ত্রিত পানি ও লবণ গ্রহণ করতে হবে যেন প্রস্রাবের পরিমাণ বেশি না হয় এবং কম পরিমাণে পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।

ডায়ালাইসিস

ডায়ালাইসিস এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে কৃত্রিম একটি অবস্থা তৈরি করে এর মাধ্যমে কিডনির স্বাভাবিক কাজ সম্পন্ন করা যায়। সাধারণত এন্ড স্টেজ কিডনি ডিজিজ অর্থাৎ কিডনি ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ বিকল হয়ে গেলে তখন ডায়ালাইসিস করানো হয়। গ্লোমেরুলার ফিল্ট্রেশন রেট ১৫ বা তার নিচে নেমে গেলে চিকিৎসক ডায়ালাইসিস করানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। 

নিয়মিত ডায়ালাইসিস এর ফলে মিনিমাম ৫ থেকে ১০ বছর রোগীরা ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারে। অনেক রোগীই ২০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে ডায়ালাইসিস করে বেঁচে আছেন। তবে ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় এবং বার বার একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় বলে অনেকেই দীর্ঘদিন ডায়ালাইসিস এর বদলে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে আগ্রহী হয়ে থাকেন। 

কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট

কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট একটি সার্জিকাল প্রক্রিয়া। যেখানে জীবিত বা মৃত ব্যক্তির সুস্থ কিডনি একজন রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়। দীর্ঘকালীন সমস্যা সমাধানে বার বার ডায়ালাইসিসের চেয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করাই উত্তম। তবে কিডনি দেবার মত উপযুক্ত ডোনার পাওয়া বেশ বড়সড় একটা চ্যালেঞ্জ। কিডনিদাতা জীবিত হোক কিংবা মৃত, সংগ্রহের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়। একজন মানুষের শরীরে কিডনি প্রতিস্থাপনের পর আজীবন তাকে নিয়মিত চেক আপ ও ফলো আপের মধ্যে থাকতে হয়। এর মাধ্যমে দশ থেকে পনেরো বছর মানুষ ভালোভাবে কোনো সমস্যা ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে। 

শেষ কথা

এক সময় ধরে নেওয়া হত, কিডনির কাজ শুধুমাত্র প্রস্রাব তৈরি করা। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ও তার সহজলভ্যতার কারণে এখন আমরা জানি কিডনি মূত্র উৎপাদন ছাড়াও শরীরের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। তাই কিডনি সংক্রান্ত যেকোনো জটিলতা হালকা ভাবে নেবার কোনো সুযোগ নেই। স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, রক্তে শর্করার মাত্রা ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি যেকোনো অসুবিধা, যেকোনো সমস্যায় ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।

Default user image

ডাঃ ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী। বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অল্প স্বল্প লেখালেখি করতে ভালো লাগে। আস্থা লাইফের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্লগগুলি মানুষের মধ্যে একটু হলেও সচেতনতা তৈরি করবে বলে আমার বিশ্বাস। ভালো লাগে ঘুমাতে, গান শুনতে, নানা রকম খাবার খেতে আর সবচেয়ে ভালো লাগে কথা বলতে।

Related Articles