বাচ্চার ওজন কমানোর কার্যকরী ১০ টি উপায়!
আপনার শিশু’র সুস্থতা আপনার কাছে। আপনার সন্তান কী শুধু মোটাই হবে নাকি সু-স্বাস্থ্যবান হবে তা আপনার উপরই নির্ভর করে।
মোটা-সোটা, নাদুস-নুদুস শিশুটি যখন ঘরময় ঘুরে বেড়ায় তখন বাবা-মা অনেকটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে চোখ বন্ধ করে স্বাস্থ্যবান শিশুর সুস্বাস্থ্য নিয়ে নিশ্চিন্ত হন। বাবা-মা শিশুদের সুস্বাস্থ্য নিয়ে যারপরনাই চিন্তিত থাকেন। কবে তার শিশু সন্তান একটু মোটা হবে, কবে শিশুটিকে দেখতে একটু বড়সড় লাগবে এই চিন্তায় বাবা-মা ‘র যেন ঘুম নষ্ট হবার উপক্রম। এবং এটাই স্বাভাবিক। বাবা-মা’রা এটাই চান। আর এমনটা চাওয়া তো দোষের কিছু না। বাচ্চারা সুন্দর ও স্বাস্থ্যবান হবে এটাই তো উচিৎ। একটি সু-স্বাস্থ্যবান বাচ্চা একটি পরিবার, একটি ঘরের সৌন্দর্য।
বাচ্চাদের স্বাস্থ্য যখন হ্যাংলা, ছিপছিপে হয় তখন বাবা-মা হয়ে পড়েন চিন্তিত,ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন বাচ্চাকে খাওয়াতে। মোটা-সোটা, স্বাস্থ্যবান শিশু’র চিন্তায় বাবা-মা যখন বিভোর থাকেন তখন কখনো কখনো ঘটে যায় কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। অতিরিক্ত স্বাস্থ্যের চাপে শিশু বাচ্চাটি হয়ে পড়ে অসুস্থ্য, আক্রান্ত হয় নানা রকম জটিল রোগে।
শিশু’র স্থুলতা
শিশু’র স্থুলতা বলতে শিশু’র এমন একটি স্বাস্থ্য যা সাধারণ অবস্থার চেয়ে অতিরিক্ত। যে স্বাস্থ্য তার বয়স এবং উচ্চতার সাথে অসামঞ্জস্য এবং বেশি। যে স্বাস্থ্যের ভার শিশু বহন করতে পারছে না। শিশু’র উচ্চতার সাথে মানানসই স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে শিশু হয়ে পড়বে অতিরিক্ত স্বাস্থ্যের অধিকারী। যা শিশু’র শরীরে নানা রকম রোগ বালাই বাসা বাধতে সহায়তা করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর তথ্য মতে জানা যায় সারা বিশ্বে ১৯৯০ সালে (০-৫) বছর বয়সী মোটা শিশুর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ২০ লক্ষ। যা ২০১৬ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৩ কোটি ৪০ লক্ষ হয়েছে। আমাদের দেশের মত স্বল্প উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের মধ্যে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মোটা হওয়া বা মেদবহুল স্বাস্থ্য হওয়ার প্রবণতা বেশি। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার মতে যা একটি উন্নত দেশের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি। ২০১৯ সালের একটি গবেষনায় দেখা যায় সারা বিশ্বে ৩ কোটি ৮০ লক্ষ এর বেশি শিশু রয়েছে যারা স্থুল স্বাস্থ্যের অধিকারী এবং তাদের বয়স ৫ বছর এর কম। আর এই শিশুদের অর্ধেক এর বসবাস আমাদের এশিয়া মহাদেশে। আর এমন শিশু বা বাচ্চারা তাদের কৈশোর থেকে যুবক বয়সেও অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবান হবার প্রবণতা ধরে রাখে।
বাচ্চার স্বাভাবিক বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা যেভাবে বুঝবেন
বাচ্চা ১ম বছরে ৭৫ সেঃমিঃ বাড়ে। পরবর্তি ৪ বছর ১০০ সেঃমিঃ করে এবং (৪-১০) বছর পর্যন্ত আনুমানিক (৫-১০) সেঃমিঃ করে বাড়ে। তা ছাড়া বাচ্চার সঠিক ওজন নির্নয় এর জন্য বাচ্চার বয়সের সাথে ৪ যোগ করে ২ দিয়ে গুন করুন। যেমন কোনো বাচ্চার বয়স ৫ বছর হলে তার ওজন হবেঃ (৫+৪)*২=১৮ কেজি। এটি প্রথাগত ‘এপিএলএস সূত্র’ (APLS formula) নামে পরিচিত।
স্থুলকায় শিশুদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা
স্থুলকায় বা অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবান শিশুরা যেসব জটিলতর শারীরিক সমস্যায় পড়ে তার মধ্যে অন্যতম হল-
-
কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (প্রধানত হার্টের রোগ)।
-
টাইপ ২ ডায়াবেটিস।
-
ব্রেস্ট ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার, কিডনি, ওভারি এবং এনডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার।
-
হাঁপানি বা শ্বাস কষ্ট।
-
উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরল
-
জয়েন্ট সমস্যা, ফ্যাটি লিভার ডিজিজ এবং গ্যাস্ট্রিক সমস্যা
-
বাত ও নানা রকম শারীরিক অক্ষমতা
-
বিষণ্ণতা
-
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হবার প্রবণতা।
স্থুলকায় শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষায় বাবা-মা’র ভূমিকা
শিশুদের স্থুলতার হাত থেকে রক্ষার জন্য বাবা-মা’র ভূমিকা অনেক। একটি শিশু জন্ম গ্রহণ করার আগেই তার উপর তার বাবা-মা’র প্রভাব লক্ষ্যনীয়। গবেষনায় দেখা যায়, যে সব শিশু’র বাবা-মা স্থুলকায়, তাদের সন্তানরাও এমন স্বাস্থ্যের হয়। তাছাড়া শিশু জন্ম গ্রহণ করার পর মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর উপরও শিশু’র স্বাস্থ্য নির্ভর করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা মতে, যে সব শিশু জন্মের প্রথম ৬ মাস শুধু বুকের দুধ খায় তাদের মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা অপেক্ষাকৃত কম।
বাচ্চাদের ওজন ঠিক রাখার ১০ টি উপায়
১) জন্মের পর থেকে শিশুকে সুষম খাদ্য খাওয়ানো
শিশু জন্ম গ্রহন এর পর প্রথম ৬ মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো এবং পরবর্তি সময়ে অন্যান্য স্বাভাবিক খাবার এর সাথে ২ বছর পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার। স্বাভাবিক খাবার এর তালিকায় রঙ্গিন শাক-সবজি, ছোট মাছ, ডিমের কুসুম, মুরগির কলিজা রাখতে হবে শিশুদের খাদ্য তালিকায়।
শিশু’র বয়স ২ বছর পার হবার পর শিশু খাদ্য তালিকায় কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। তার খাবার এর তালিকায়, মাছ, মাংস, দুধ, ডিম,শাক-সবজি রাখতে হবে। তাছাড়া বাচ্চাকে এই বয়সেই ফলমুল খাওয়ানোর অভ্যাস তৈরি করে দিতে তাকে অন্যান্য খাবার এর সাথে ফল খেতে দিতে হবে। মোট কথা বাচ্চার জন্য একটি সুষম খাবার এর তালিকা তৈরি করতে হবে এবং এই তালিকায় শিশুকে অভ্যস্ত করতে হবে।
২) ঘরেই রান্না করুন এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারগুলি এড়িয়ে চলুন
ঘরে তৈরি খাবার এ শিশুকে অভ্যস্ত করতে হবে। তার জন্য বাসায় সুস্বাদু ও নতুন নতুন খাবার তৈরি করতে হবে। যে করেই হোক তাকে বাইরের খাবার (ফাস্ট ফুড) থেকে দূরে রাখতে হবে। কারন ফাস্ট ফুড টাইপের খাবার শিশু’র মুটিয়ে যাবার অন্যতম কারণ।
বাচ্চাকে কোল্ড ড্রিংস খেতে অভ্যস্ত করা যাবে না। কোল্ড ড্রিংস শিশুদের মুটিয়ে যাওয়ার একটি প্রধান কারণ। বাচ্চাকে তরল খাবার এর পরিবর্তে চিবিয়ে খাওয়া যায় এমন খাবার বেশি খেতে দিতে হবে।
৩) বাচ্চাদের শরীরচর্চায় উৎসাহিত করতে হবে
বাসায়, স্কুলে,পার্কে বা খেলার মাঠে শিশুকে খেলাধুলা করার, দৌড়াদৌড়ি করার সুযোগ করে দিতে হবে। এতে করে বাচ্চার শরীরে জমে থাকা অতিরিক্ত চর্বি পুড়বে। বাচ্চার শরীর ভালো থাকবে। বাচ্চা একটি নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন এ অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। বাচ্চা স্থুলকায় জীবন থেকে মুক্ত থাকবে।
৪) বাচ্চাদের যখন ক্ষুধা লাগবে তখনই খাবার দিতে হবে, পেঠ ভরা অবস্থায় নয়
বাচ্চাদের খাবার খাওয়ানোর ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন থাকতে হবে বাবা-মা’কে। বাচ্চাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস করতে হবে। বারবার খাওয়ানো যাবে না বা অতিরিক্ত খাওয়ানো যাবে না। যখন বাচ্চার পেট ভরা থাকবে তখন খাওয়ানো যাবে না বা খাওয়ার কথা বলা যাবে না। যখন বাচ্চার ক্ষুধা লাগবে তখন খাবার দিতে হবে। এতে করে বাচ্চা খাবার গ্রহণে একটি শৃঙ্খল ব্যবস্থার মধ্যে বেড়ে উঠবে। বাচ্চা সু-স্বাস্থ্যবান হবে এবং স্থুলতা থেকে মুক্তি পাবে।
৫) বাচ্চাদের রান্নাঘর এবং স্বাস্থ্যকর খাবার সম্পর্কে ধারণা দিন
বাসায় তৈরি বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যকর খাবার সম্পর্কে শিশুকে জানাতে হবে। তাকে ভাল খাবার সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। খাবার পছন্দ করতে শিখাতে হবে। বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবার তাকে নিয়ে তৈরি করে খেলে শিশু ঘরোয়া খাবার এবং কাজ এ আগ্রহী হবে। শিশু শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ্য থাকবে।
৬) সন্তানকে খাবার নিয়ে জোর করবেন না
অতিরিক্ত খাওয়ানো যাবে না। অর্থাৎ খাবার নিয়ে বাচ্চাকে জোর করা যাবে না। এতে বাচ্চার খাবার এর প্রতি ভীতি সৃষ্টি হবে। বরং শিশু যখন খেতে চাইবে তখনই তাকে খেতে দিতে হবে। শিশু’র খাবার এর তালিকা থেকে অতিরিক্ত চিনি ও অতিরিক্ত লবন সমৃদ্ধ খাবার বাদ দিতে হবে।
৭) বাচ্চাদের নতুন খাবার বারবার পরিবেশন করুন
আমাদের নতুন খাবারের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করতে হয়। সুতরাং আপনি যখন নতুন কোন উপাদান তৈরি করছেন, আপনার শিশু যদি তাৎক্ষণিকভাবে এটি পছন্দ না করে তবে হতাশ হবেন না। নতুন খাবারটিকে মূল খাবার হিসেবে না ধরে অন্য খাবারের সাথে একটি অংশ করুন এবং আপনার শিশুটিকে এটি খেতে দিন। যদি সে পছন্দ না করে তবে তাকে বা এটি খেতে জোর করবেন না, তবে এটি পরিবেশন করা চালিয়ে যান। অবশেষে, দেখা যাবে আপনার বাচ্চাটি ঠিকই খাবারটি পোছোণ্ড করছে।
৮) শিশুকে টিভি বা মোবাইল ফোন দেখিয়ে খাওয়াবেন না
শিশু যখন খাবে তখন তাকে টিভি, মোবাইল ফোন চালাতে দেওয়া যাবে না। সে যখন খাবে তখন শুধু খাবে। তার সম্পূর্ণ মনোযোগ খাবার খাওয়ার দিকে থাকবে। এতে করে শিশু পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে খাবে এবং খাবার ভালো করে চিবিয়ে খাবে। যা শিশু কে মুটিয়ে যাওয়া থাকে রক্ষা করবে।
৯) বাচ্চার আবদার গুলো সীমাবদ্ধ করুন
বাচ্চা যখন তখন নানা ধরনের খাবার এর বায়না করলেই তাকে সেসব খাবার এর যোগান দেওয়ার প্রবণতা ত্যাগ করতে হবে। অসময়ে, অতিরিক্ত বা বেশি খাবার খেতে তাকে কোনো ভাবেই উৎসাহীত করা যাবে না। তাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় খেতে শিখাতে হবে। এতে করে তার শারীরিক চাহিদা মত খাবার খেতে শিখবে।
১০) একটি স্বাস্থ্যকর পারিবারিক পরিবেশ তৈরি করুন
বাবা-মা মিলে ঘরে একটি সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করতে হবে। শিশু যেন বাবা-মা’র সাথে একটি আনন্দময় সময় কাটাতে পারে। তা না হলে শিশু টিভি, মোবাইল এর মত ক্ষতিকর উপকরনে আসক্ত হয়ে পরবে। সারা দিন অলস বসে থেকে টিভি, মোবাইল দেখবে। পক্ষান্তরে শিশু হয়ে পরবে স্থুলকায় ও নানা রোগের বাহক।
সতর্কতা
অতিরিক্ত খাবার খাওয়া বা খেলাধুলা না করার কারণে বাচ্চারা স্থুলকায় হয়ে যায়। তবে এ ছাড়াও আরও কিছু কারণ রয়েছে বাচ্চাদের মোটা হয়ে যাওয়ার। যেমনঃ যদি কোনো বাচ্চার হাইপো থাইরয়েডে সমস্যা থাকে বা বাচ্চা কোনো কারণে ডিপ্রশনে থাকে তবে বাচ্চা স্বাভাবিক এর চেয়ে অনেক বেশি মোটা হয়ে যায়। তাছাড়া রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, এলার্জির ঔষধে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা বাচ্চাকে মুটিয়ে তুলতে পারে সহজেই। বাবা-মা কে অবশ্যই এসব বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
সর্বোপরি বাবা-মা’র সচেতনতাটাই আসল। শিশু’র জীবনের ভূত-ভবিষ্যৎ বাবা-মা’র সচেতনতার উপরই নির্ভর করে। (০-৫) বছর বয়সী একটি শিশু বা ১০ বছর বয়সী স্কুল পড়ুয়া শিশু ; এদের শারীরিক সুস্থতা যেমন জরুরী তেমনি এদের প্রতি একটি সুস্থ্য এবং কার্যকরী সচেতনতা মূলক পদক্ষেপ নেওয়াও বাবা-মা’র জন্য জরুরী। এদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। তারা কি কি খাচ্ছে, কি খাচ্ছে না। খেলাধুলা করছে কিনা, অতিরিক্ত সময় টিভি, মোবাইল দেখছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে। তাছাড়া তারা অন্য কোনো শারীরিক অসুস্থতায় ভূগতেছে কিনা তাও খেয়াল রাখতে হবে। আর এভাবেই একটি সুস্থ্য ও সু-স্বাস্থ্যবান শিশু আমাদের ঘরে বেড়ে উঠবে।