শিশুদের খাদ্য তালিকাঃ কি খাওয়াবেন, কি খাওয়াবেন না (পর্ব ১)

শিশুদের সুস্থ, শক্তিশালী এবং স্মার্ট হয়ে উঠতে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন। প্রায় ৬ মাস বয়স থেকেই আপনার শিশু দ্রুত বেড়ে উঠছে এবং তার জীবনের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি শক্তি এবং পুষ্টির প্রয়োজন। কিন্তু আপনি কি জানেন তাকে কি খাওয়াতে হবে এবং কীভাবে খাওয়াতে হবে? এসব জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।

প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি কেবলই অনুধাবন করার, প্রকাশের অতীত। সে অনুভূতি কেবল মা'ই জানেন। এই স্বপ্নের সময়টি পার করার পাশাপাশিই শুরু হয়ে যায় মায়ের মানসিক এবং শারীরিক যুদ্ধ। হাজারো প্রতিকূলতা, প্রশ্ন, কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা। আর  রয়েছে সহস্রাধিক কুসংস্কার। এতোকিছুর মাঝে কোথায় পাবে সে তার প্রশ্নের উত্তর?  

পৃথিবীর সকল মা'ই চান তার সন্তানের জন্য সর্বোৎকৃষ্ঠ কাজটি করতে। কিন্তু নতুন মায়েরা জানেনই না আসলে কোনটি তার সন্তানের জন্য সঠিক বা কোনটি বেঠিক। 

মায়েরা যে প্রশ্নগুলোর উত্তর খোজার চেষ্টা করেন

  • আমার সন্তান ছয় মাস বয়স হওয়ার আগেই বুকের দুধ ছেড়ে দিয়েছে, এখন কি করণীয়?

  • ছয় মাস বয়স হলে তাকে কোন খাবারগুলোর সাথে পরিচিত করিয়ে দেওয়া উচিত? 

  • কোন বয়সে দিনে কতোবার এবং কি পরিমান  খাওয়াতে হবে?

  • আমার সন্তানের কোষ্টকাঠিন্য। এক্ষেত্রে তাকে কোনটা খাওয়ানো যাবে, কোনটা যাবেনা?

  • আমার সন্তানের শরীরে ডায়রিয়ার প্রবনতা বেশী। হজম শক্তি দুর্বল। এক্ষেত্রে কোন খাবারটি পরিত্যাগ করব এবং কোনটি খাওয়াবো। কীভাবেইবা খাওয়াবো?

  • খাবারের রুটিনটা কেমন হতে পারে? 

এছাড়াও হাজারটি প্রশ্ন। এবং কোন প্রশ্নই অমূলক নয়। হ্যা, আমাদের আশেপাশে পরামর্শ দেওয়ার জন্য অবশ্যই অনেকে থেকে থাকবেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিপত্তি হয় তখনই, যখন আমরা বুঝতে পারিনা আসলে কার পরামর্শ সঠিক। কোনটা গ্রহন করা যেতে পারে। 

মায়েদের এমন অসহায় অবস্হার কথা চিন্তা করেই আস্থা ব্লগের বিশেষ আয়োজন।  সিরিজ আকারে আমরা এসকল প্রশ্ন সহ আরো অনেক প্রশ্নের উত্তর এবং পরিপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিয়ে যাবো শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী।

পরামর্শ দিয়েছেন

ডাঃ রানা কুমার বিশ্বাস

এমবিবিএস(ডিইউ), এফসিপিএস(শিশু)

এমডি(শিশু গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি)  (পিজি হাসপাতাল)

শিশুরোগ, শিশু গ্যাস্ট্রোলিভার ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ, 

সিনিয়র কনসালট্যান্ট (শিশু)

২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল, খুলনা। 

তাঁর মতে-

খাবার শুধু খাওয়ালেই হবেনা। একই খাবার  একই বয়সের দুজন আলাদা শিশুর জন্য উপকারী বা অপকারী হতে। প্রত্যেকের শরীর বলে দেবে কার জন্য কোনটি প্রযোজ্য। তাই আমরা একটি সার্বিক ধারনা দেয়ার চেষ্টা করছি। 

০-৫ মাস বয়সী শিশুর খাদ্য

০-৫ মাস বয়সী শিশুর একমাত্র খাদ্য অবশ্যই মায়ের বুকের দুধ। তবে কোন কারণে যদি শিশু দুধ না পায় বা টেনে না খায় তবে অনতিবিলম্বে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে এবং ডাক্তার শিশুকে পর্যবেক্ষণ করে বলবেন তার জন্য কোন ফর্মূলা মিল্ক বা কৌটাজাত দুধ প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে আশেপাশে কারো পরামর্শ শোনা যাবেনা কারণ সব শিশু একই রকম শারীরিক অবস্থায় থাকেনা। তাই কেবলমাত্র বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই এই পরামর্শ দিতে পারবেন। 

৬-৮ মাস বয়সী শিশুর খাদ্য

৬ থেকে ৮ মাস বয়সেও শিশুর প্রধান খাদ্য মায়ের বুকের দুধ। পাশাপাশি তাকে কিছু পুষ্টিকর খাবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। 

যেমন ফল, সব্জি এবং শষ্যের গুড়ো বা সুজি (চাল, গম, ভুট্টা)  

এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেয়া যাক।

রুটিনটা কেমন হবে?

এ বয়সে দুধের পাশাপাশি চার বার বাইরের খাবার খাওয়ানো যেতে পারে।

প্রথমবার

সকাল থেকে এক ঘন্টা/দু'ঘন্টা পর পর মায়ের দুধ। শিশুর চাহিদানুযায়ী।  

দ্বিতীয়বার

  • ১১ টার দিকে সম্পূর্ণ পিষে নেওয়া নরম কোন ফল। যেমন, সফেদা, পাকা পেপে, পাকা কলা, খেজুর। 

  • পরিমান হবে এক /দুই চা চামচ। খেয়াল রাখতে হবে সফেদার কারণে শিশুর পেটে গ্যাস তৈরী হচ্ছে কিনা বা পায়খানা অতিরিক্ত পাতলা হচ্ছে কিনা। তেমন হলে বন্ধ করে দিতে হবে। 

  • শিশুর যদি বুকে কফ থাকে তবে সেটা নির্মূল হওয়া পর্যন্ত পাকা কলা খাওয়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। 

  • ফলটি অবশ্যই দুপুর ১১- ০১ টার মধ্যে খাওয়াতে হবে কারণ এসময়ে খাবার ভালো হজম হয়। এই বয়সে শিশু নতুন খাবারের সাথে পরিচিত হয় তাই তাদের হজম প্রক্রিয়া দুর্বল থাকে। তাই সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। 

  • এ বয়সী শিশুকে দিনে দুটো আলাদা ফলের বেশী খাওয়ানো যাবেনা।  খেয়াল রাখতে হবে যেন একবারে মুখে বেশী খাবার না দেওয়া হয়। এ বয়সে খাবার তাদের গলায় আটকে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।  তাছাড়াও কমপক্ষে দু ঘন্টার ব্যবধান রেখে এসব খাবার খাওয়ানো উচিত। কারণ অতিরিক্ত খাওয়া ছোট্ট শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। 

তৃতীয়বার

  • দুপুরের পর বুকের দুধের পাশাপাশি সেদ্ধ করা সব্জি সম্পূর্ণ পিষে খাওয়ানো যেতে পারে। এসময়ে দুটো সব্জি দিয়ে নরম খিচুড়ী রান্না করে খাওয়ানো যেতে পারে যেখানে তেল, হলুদ, লবন, একটু রসুন থাকতে পারে।

  • ডাল এবং চালের পরিমান কম থাকবে এবং একবারে দু চামচের বেশী খাওয়ানো যাবেনা। তবে লবন দিতে হবে অতি সামান্য, এক চিমটির কম। কারণ এ বয়সে শিশুর কিডনী লবনকে প্রক্রিয়া করণের জন্য প্রস্তুত হয়না। 

  • এই খিচুড়িতে একবারে দুয়ের অধিক প্রজাতির সব্জি ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। 

  • সহজপাচ্য সব্জি ব্যবহার করুন যেমন কুমড়ো, আলু, গাজড়, কাঁচা পেপে, লাউ ইত্যাদি। 

  • শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে খিচুড়ীতে কাঁচা কলা ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন। 

  • এই খিচুড়িতে চালে কার্বহাইড্রেট, ডালে শর্করা এবং আমিষ,  তেলে প্রয়োজনীয় ফ্যাট, হলুদে এন্টিসেপ্টিক এবং সব্জিতে প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং মিনারেলস থাকে বিধায় এ খাবারটি দুপুরের খাবার হিসেবে একদমই উপযোগী। 

চতুর্থবার

  • বিকেলের দিকে শিশুকে শষ্যের গুড়ো বা সুজি দেয়া যেতে পারে তবে সবার জন্য এক নয়। অনেক শিশুর জন্য এগুলো এলার্জিক। অনেকের পেটে গ্যাস তৈরী হয়। সেক্ষেত্রে অবশ্যই এড়িয়ে যেতে হবে।

  • আর যে শিশুর এধরনের সমস্যা নেই তাকে অবশ্যই পানিতে সামান্য লবন দিয়ে রান্না করে দেয়া যাবে।

  • তবে কোনভাবেই গরুর দুধ নয়। এক বছর বা কোন কোন ক্ষেত্রে দু বছর বয়সের আগে শিশুকে গরুর দুধ দেয়া থেকে বিরত থাকার কথা বিশেষভাবে বলেছে ইউনিসেফ। এতে করে ল্যাক্টো এলার্জি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে আপনার সন্তান। এছাড়াও তার হজমতন্ত্র ফুল ফ্যাট বা পূর্ণ ননীযুক্ত দুধ প্রক্রিয়া করণের জন্য প্রস্তুত নয়। 

  • সুজি রান্নায় মিষ্টি হিসেবে চিনি ব্যবহার না করে খেজুর ব্যবহার করুন। চিনি শিশুদের জন্য ক্ষতিকারক।  

  • বিকেলের এ খাবারটিও দু চামচের বেশী নয়। 

  • আর যাদের শষ্যের গুঁড়োতে এ্যালার্জি তাদের পিষে নেয়া সেদ্ধ ভাতের সাথে সেদ্ধ সব্জি বা কেবল নরম কোন সব্জি বিকেল এবং রাতের খাবার হিসেবে দেওয়া যেতে পারে।

  • শিশুর খাবার রান্নায় কখনোই ফর্মূলা বা ফরটিফাইড মিল্ক ব্যবহার করা যাবেনা। এই দুধ জ্বালানো থেকে বিরত থাকতে হবে। সুতরাং শিশুর খাবার রান্নায় এ বয়সে কোন দুধ নয়। তাছাড়া দুধ ভাত খাওয়াতেও ফর্মূলা মিল্ক সরাসরি ব্যবহার করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

  • নির্দিষ্ট অনুপাত অনুযায়ী পানিতে মিশিয়ে ছাড়া এই দুধ শিশুকে খাওয়ানো যাবেনা এবয়সে এবং কখনোই।

শিশুদের কি খাওয়ানো যাবে না

এবার কথা বলবো কোষ্টকাঠিন্য বা হজমে সমস্যা হলে এ বয়সী শিশুদের খাবারে কি কি গ্রহন বা বর্জন করা যেতে পারে। 

কোষ্টকাঠিন্য

  • কোষ্টকাঠিন্য থাকলে চেষ্টা করতে হবে অবশ্যই ফল হিসেবে পাকা কলা রাখতে। (যদি কফের সমস্যা না থাকে) 

  • ফলের রস হিসেবে আনার, বেদানা বা ডালিম অবশ্যই বর্জন করতে হবে। কারণ এ ফলে অতিরিক্ত আয়রণ রয়েছে। 

  • সব্জির মধ্যে পুঁইশাক বা কলমি শাক রাখা যেতে পারে। তবে অবশ্যই বার বার ভালো করে ধুয়ে কমপক্ষে  ৯০° সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ৮-১০ মিনিট জ্বাল করে। কারণ শাকে বিভিন্ন সময়ে কৃমির জীবানু থাকে। 

  • সব্জি হিসেবে কাঁচা কলা বর্জন করতে হবে। 

ডায়রিয়ার প্রবণতা থাকলে

সাধারণ ভাষায় আমরা বলি পেট নরম হওয়া বা ডায়রিয়ার প্রবনতা থাকা। এক্ষেত্রে-

  • শাক কম খাওয়াতে হবে।

  • কাঁচা কলা খাওয়ানো যেতে পারে।

  • বেদানা খাওয়ানো যাবে। 

এছাড়াও সর্বোপরি তার প্রধান খাদ্য হিসেবে বুকের দুধকেই প্রাধান্য দিতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। আর অবশ্যই খাবার খাওয়ানোর পূর্বে ভালোকরে খাবার পরিষ্কার করতে হবে, পাত্র পরিষ্কার করতে হবে এবং নিজের হাত পরিষ্কার করে খাবার প্রস্তুত করতে হবে ও খাওয়াতে হবে। 

এ পর্বে আমরা চেষ্টা করেছি ০-৮ মাসের শিশুর খাদ্য তালিকা, পরিমান, রুটিন, গ্রহণীয়,  করণীয় এবং বর্জনীয় সম্পর্কে একটি সার্বিক ধারনা দিতে। আশা করছি এটুকু ধারনা একজন নতুন মা'কে অনেকটাই সাহায্য করবে। পরবর্তী পর্বগুলোতে আমরা ধাপে ধাপে চেষ্টা করব ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর খাদ্য নিয়ে আলোচনা করতে।

Default user image

মিল্কি রেজা, লেখক, আস্থা লাইফ

পড়াশুনা ইংরেজী সাহিত্যে। শিল্পচর্চা আমার নেশা, আর লেখাটা নেশা থেকে এখন পেশা। সৃষ্টিশীলতার মধ্যে থাকতে পছন্দ করি। ভালো এবং আরো ভালো লিখতে চাই।

Related Articles