শিশুদের ভারী স্কুল ব্যাগে রয়েছে ৪টি স্বাস্থ্যঝুঁকি

স্কুল-কোচিং-পরীক্ষার সিরিয়াসনেসের অন্তরালে শিশুর মানসিক ও শারিরীক বিকাশ ঠিক মত হচ্ছে কিনা তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবহেলা করা হয়ে থাকে। এই সম্পর্কিত একটি উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে বাচ্চাদের ভারী ব্যাগ তাদের গঠনগত ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা তৈরি করতে পারে। আসুন জেনে নেই অতিরিক্ত ভারী ব্যাগের সমস্যাগুলো, শিশুর ব্যাগের কতটুকু ওজন হওয়া উচিত ও এ সম্পর্কিত অন্যান্য তথ্যবলি।

অন্যান্য সকল প্রাণিদের চেয়ে মানব শিশুর বেড়ে ওঠা বেশ আলাদা। হরিণ শাবক জন্মেই দৌড়ানো শুরু করে, তবে সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণি হওয়ায় আমাদের জীবনের প্রায় এক চতুর্থাংশ সময় চলে যায় মস্তিস্কের বিকাশে। স্কুল-কলেজ-পড়ালেখা আমাদের এই মস্তিস্কের শুষ্ঠ বিকাশ নিশ্চিত করার একটি মাধ্যম। অন্তত এর মূল উদ্দেশ্যটুকু তাই। 

কিন্তু আমাদের দেশে পড়ালেখা যেন ভালো মার্ক পাওয়া আর কার বাচ্চা কত ভালো নাম্বার পেলো সেই অসুস্থ্য প্রতিযোগীতা ও গর্ববোধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দেশের প্রেক্ষাপটে প্রতিটি বাবা মায়ের কাছে সন্তানের পড়ালেখা যেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাচ্চা ঠিক মত পড়ছে কিনা, পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পাচ্ছে কিনা নিশ্চত করতে বাবা মায়ের চিন্তার শেষ নেই।

সেই ভালো মার্কটুকু পেতে কি এমন আছে যা আমাদের বাবা-মা করেন না? পাঠ্য বইতো আছেই, সেই সাথে মোটামোটা গাইড বই, একের ভেতর সব, প্রত্যক বিষয়ে আলাদা আলাদা খাতা, কোচিং, ব্যাচ প্রাইভেট আরো কতো কি! এর মাঝে যেন শিশুর সুস্থ্য শৈশবটাই ফিকে হয়ে যায়। এ নিয়ে অনেক সমস্যার কথা বলা যায়, তবে যে দিকটা আজ আলোচনা করব তা হলো, শিশুদের ভারী ব্যাগ ও এর ফলে সৃষ্টি হওয়া স্বাস্থ্য সমস্যা ও দূর করায় করনীয়।

শিশুর স্বাস্থ্যে ভারী ব্যাগের প্রভাব

অধিক সময় অতিরিক্ত ওজন বহন করা শিশুদের স্বাস্থ্যে ও শারিরীক গঠনে সমস্যা তৈরি করে। আসুন কিছু সমস্যা গুলো চিহ্নিত করি।

১. শিশুর জন্য কষ্টকর

প্রথমেই সবচেয়ে প্রাথমিক সমস্যাটি নিয়ে কথা বলা যাক। আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থায় দৈনিক ৬-৮ টি ক্লাস হওয়া খুব সাধারণ। এই পরিমান বই, সবগুলোর জন্য আলাদা খাতা, গাইড ইত্যাদি মিলিয়ে ব্যাগের ওজন শিশুর ওজনের ২০-৩০ ভাগ পর্যন্ত হয়ে যাওয়া একেবারেই স্বাভাবিক।

এই পরিমান ওজন অতিরিক্ত সময় বহন করা অত্যন্ত কষ্টকর। এতে কাঁধে, পিঠে ও পায়ে ব্যথা হয় যা শিশুর জন্য সহ্য করা সহজ নয়।

অতিরিক্ত ওজন বহন করতে অতিরিক্ত ক্যালরিও প্রয়োজন হয়। এতো শিশুরা দ্রুত ক্ষুধার্ত হয়, ক্লান্ত হয়ে পড়ালেখায় অমনোযোগী হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়।

ব্যক্তিগত জায়গা থেকে কথা যদি বলি, আমার ক্ষেত্রে স্কুলে বৃহষ্পতিবার সবচেয়ে প্রিয় ছিলো কারণ সেদিন কম বই বহন করা লাগতো। আমরা সবাই এই শিক্ষা কাঠামো পার করে আসি, এর সমস্যা জানি, কিন্তু আমাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে সব বেমালুম ভুলে যাই।

২. কাঁধে ও পিঠে ব্যথা

অধিক সময় ভারী ব্যাগ বহন করার ফলে কাঁধে ও পিঠে ব্যথা হতে পারে। ভারী ব্যাগ বহন করার সময় যে ব্যথা হয় তেমন তো আছেই, সেই সাথে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথাও হতে দেখা যায়। অতারিক্ত ওজন বহন করতে গিয়ে কাঁধে ও পিঠের পেশির উপর একটানা অনেক্ষন চাপ পড়ে, যার ফলে পেশি ক্লান্ত হয়ে এরূপ ব্যথার সৃষ্টি করে। 

এর সাথে মেরুদন্ডে সমস্যাও পিঠে ব্যথার সৃষ্টি করতে পারে যা আরো বেশি উদ্বেগজনক। অনেক বাচ্চা ব্যথার কথা বলে না, আবার বললেও অনেক বাবা-মা ভাবেন বাচ্চা ছেলে ঠিক হয়ে যাবে।

শিশুরা প্রায়সয়ই বলে না তার ব্যাগ বহন করতে কষ্ট হয়। ভারী ব্যাগ, পড়ালেখার চাপ, টিচারের বকার ভয় সব মিলিয়ে তারা বলে তাদের স্কুলে যেতে ভালো লাগে না। বাবা-মা হিসেবে এই ব্যপার গুলোতে একটু যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন।

৩. মেরুদন্ডের জটিলতা

বাচ্চাদের ভারী ব্যাগ বহনের সবচেয়ে বড় জটিলতা হচ্ছে মেরুদন্ডে সমস্যা তৈরি হওয়া। বাচ্চাদের শরীর খুব দ্রত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, ফলে তাদের হাড় প্রাপ্ত বয়স্কদের মত শক্ত ও সুগঠিত নয়। দীর্ঘ সময় অতিরিক্ত ওজন বহন করলে মেরুদন্ড বেঁকে যাওয়ার মত সমস্যা তৈরি হয়। বেঁকে যাওয়া অনেক রকম হতে পারে যেমন-

  • Scoliosis বা মেরুদন্ড যে কোন এক পাশে বেঁকে যাওয়া।

  • Kyphosis বা কুঁজো হয়ে যাওয়া।

  • অন্যান্য স্নায়ু ঘটিত সমস্যা।

বেঁকে যাওয়া মেরুদন্ড চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ্য করা সম্ভব কিন্তু সমস্যা তখন হয় যখন মেরুদন্ডের সামান্য বেঁকে যাওয়া খেয়াল করা যায় না ও শিশু বেড়ে উঠতে থাকে। সামান্য বেঁকে যাওয়া মেরুদন্ড বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে আরো বেশি বাঁকতে থাকে ও বয়সের সাথে সাথে শারিরীক গঠন খারাপ হতে থাকে। 

৪. স্নায়ুবিক জটিলতা

দেহের সব স্নায়ু আমাদের মেরুদন্ডের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কে পৌছায়। পিঠ ও মেরুদন্ডে অতিরিক্ত চাপ স্নায়ুবিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। যদিও আশার কথা হলো ভারী ব্যাগ থেকে স্নায়ুবিক জটিলতা খুব বেশি দেখা যায় না। তবু এটিকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

সমস্যার উৎসটি কোথায়?

ভারী ব্যাগ জনিত সমস্যা গুলোর সমাধান করার আগে চলুন এই সমস্যার উৎসের খুঁটিনাটি আলোচনা করা যাক। অনেক শিক্ষকই আছেন যারা স্কুলে গাইড বই আনতে বলেন। গাইড বই সাধারণ বই এর থেকে অনেকাংশে ভারী। যার ফলে ব্যাগের ওজন স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়। শুধু গাইড বই না, মডেল টেস্ট, মোটা গ্রামার বই সহ আলাদা আলাদা বিভিন্ন বই কেনার ও স্কুলে আনার জন্য শিক্ষকেরা বলে থাকেন। 

অনেক ক্ষেত্রে কেন কোম্পানির বই কিনতে ছাত্রদের বলারর জন্য কোম্পানী থেকে শিক্ষকেরা বিশেষ সুবিধা পান। 

সেই সঙ্গে প্রত্যেক বিষয়ে আলাদা খাতা তৈরি করার জন্য শিক্ষকেরা চাপ প্রদান করেন। সব মিলিয়ে শিশুদের ব্যাগ যেন পড়ালেখার জিনিসপত্র বহন করার চেয়ে শিক্ষকদের সন্তষ্ট করার ভারী বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

শিশুদের ব্যাগের ওজন কত হওয়া উচিত?

  • সাধারণ ক্ষেত্রে শিশুদের ব্যাগের ওজন হওয়া উচিৎ শিশুর ওজনের ৫-৭ ভাগ, 

  • এবং এই ওজন কোনভাবেই শিশুর ওজনের ১০ ভাগ এর বেশি হওয়া উচিত নয়। 

৬ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে বিষয়টি আদালতে ওঠে ও আদালতের রায় অনুসারে বাচ্চাদের ব্যাগের ওজন ১০ ভাগ এর বেশি হতে পারবে না। তবে আইন হলেও যে তার প্রয়োগ নেই তা নিঃসন্দে বলা যায়।

এই পরিমাণ ওজন বহন করলে ভারী ব্যাগ জনিত সমস্যা গুলো এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। বয়স অনুসারে বাচ্চাদের ওজন কম বেশি হয়, সে অনুযায়ী ব্যাগের ওজন বহন করার ক্ষমতাও কম বেশি হয়ে থাকে। আসুন জেনে নেই বয়স ও শ্রেণি ভেদে শিশুর ব্যাগের ওজন কত হওয়া উচিত।

  • প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুদের ব্যাগ ১ কেজির বেশি হওয়া উচিত নয়।

  • তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া শিশুদের ব্যাগ হতে হবে ২ কেজি বা তার কম।

  • পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণির শিশুদের পিঠে ৪ কেজির বেশি ওজনের ব্যাগ চাপানো উচিত নয়।

  • অষ্টম শ্রেণির উপরের ছাত্র-ছাত্রিদের ব্যাগের ওজন ৫ কেজির বেশি হওয়া উচিত নয়

শিশুদের ব্যাগের আদর্শ ওজন না-হয় জানা গেল, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবে এটা নিশ্চিত করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তবে এর সমাধান গুলোও বেশ চমকপ্রদ। 

যেভাবে ব্যাগের ওজন ঠিক রাখবেন

সৌভাগ্যবসত এমন একটি স্কুলে আমি পড়ালেখা করি যেটি পরিচালিত হতো জাপানী ধ্যান-ধারণায়। সেখানে শিক্ষকেরা পুরোটুকু না পারলেও শিশুদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ একটি অবস্থান তৈরি করতেন। শিশুদের এরকম সমস্যা গুলোও সমাধান করতে তাঁরা সচেষ্ট ছিলেন। 

ব্যাগের ওজন কমানোর জন্য তারা মোটা মোটা বই গুলো কয়েক ভাগে কেটে মলাট করে দিতেন, যাতে শুধু প্রয়োজনীয় অংশটুকু স্কুলে নিয়ে আসা যায়। শুধুমাত্র এই পদক্ষেপেই ব্যাগের ওজন যথেষ্ট আরামদায়ক হয়ে ওঠে। এছাড়াও ব্যাগের ওজন ঠিক রাখতে নিচের পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে।

  • শিশুদের পাতলা ও কম পৃষ্ঠার খাতা দিন। এতে অনেক গুলো খাতা নিলেও ওজন স্বাভাবিক থাকবে।

  • যেদিন যে যে ক্লাস সে ক্লাসের বই নিয়ে যেতে শেখান, অনেক শিশুই অতিরিক্ত বই নিয়ে স্কুলে চলে যায়।

  • চওড়া বেল্টের আরামদায়ক ব্যাগ ব্যাবহার করতে দিন। এতে কাঁধে চাপ কম পড়বে ও ব্যথা কম হবে। ব্যাগের বেল্ট কমপক্ষে দুই আঙ্গুল চওড়া হওয়া উচিত।

  • ব্যাগ যেন শিশু ঝুলিয়ে না পড়ে সে দিকে খেয়াল রাখবেন। ব্যাগ কাঁধের সাথে এটে লেগে থাকা উচিত। এক কাঁধে ব্যাগ নেওয়া বেশি ক্ষতিকর হতে পারে।

  • ছোট পানির বোতল দিবেন ও স্কুলে সুপেয় পানির ব্যাবস্থা আছে কিনা নিশ্চিত করবেন।

  • বেশি প্রকষ্ট সমৃদ্ধ ব্যাগ ওজনকে ভালোভাবে ছড়িয়ে দেয় ফলে ওজন কম বোধ হয়।

  • খেয়াল রাখবেন খুব বেশি পথ যেন শিশুকে হেঁটে বা দাঁড়িয়ে স্কুলে যেতে না হয়।

বাচ্চার পিঠে-কাঁধে ব্যাথা হলে কি করবেন?

বাচ্চার পিঠে ও কাঁধে ব্যাথা হলে প্রাথমিক অবস্থায় ব্যাগের ওজনের দিকে খেয়াল করুন। ব্যাগের ওজন কমিয়ে দিলে ব্যাথা স্বাভাবিক ভাবে পুনরাবৃত্তি হবে না। তবে ব্যাথা বেশি বা স্থায়ী হলে অর্থপেডিক্স, স্পাইন সার্জন বা ফিজিক্যাল মেডিসিন ডাক্তার দেখানোটা গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে জটিলতার ঝুঁকি থাকবে না ও সঠিক চিকিৎসা পাওয়া যাবে।

শিশুর ব্যাগ বাবা-মা বহন করা কি উচিত?

সাধারণ ক্ষেত্রে উচিত নয়। ব্যাগের ওজন ঠিক হলে শিশুরা সহজেই তা বহন করতে পারবে ও এটি তাদের শারিরীক ব্যায়ামের মত কাজ করবে। বাচ্চাকে একেবারে খাটতে না দিলে ওজন বৃদ্ধির মত সমস্যা তৈরি হতে পারে। তবে দীর্ঘ সময় বা অতিরিক্ত ভারী ব্যাগ কাঁধে রাখতে দেওয়া উচিত নয়। সেক্ষেত্রে বাবা-মা শিশুর ব্যাগ বহন করতে পারেন।

শেষকথা

অতিরিক্ত ভারী ব্যাগ শিশুর পিঠে-কাঁধে ব্যথা ছাড়াও মেরুদন্ড বেঁকে যাওয়া ও কুঁজো হয়ে যাওয়ার মত ঝুঁকি তৈরি করে। শিশুর ওজনের ১০ ভাগের বেশি ওজনের ব্যাগ বহন করা উচিৎ নয়। মানসম্মত ব্যাগ শিশুর জন্য আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যসম্মত।

আরও জানুনঃ

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles