যেভাবে শিশুর বডি ম্যাসাজ করবেন
শিশুর সঠিক বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন শরীর ম্যাসাজের। কিন্তু কি দিয়ে করবো, কখন করবো, কি পদ্ধিতিতে করবো ইত্যাদি অনেক প্রশ্নই আপনাকে চিন্তিত করে ফেলে! আর আপনার জন্যই এই সব প্রশ্নের সমাধান থাকছে আজকের প্রবন্ধে।
পরিবারে এসেছে নতুন অতিথি, সবাই খুব খুশি। সমস্যা হল ছোট্ট অতিথির শরীর ভালো নেই, তার খাবার ঠিক্ঠাক হজম হচ্ছে না, ফলে বৃদ্ধিও হচ্ছে না ঠিক মত। এমন পরিস্থিতিতে ডাক্তার দিলেন সবচেয়ে সহজ পরামর্শ। শিশুটির প্রয়োজন নিয়মিত শরীর মালিশের। কিন্তু কেন!
শিশুর শরীর ম্যাসাজ বা মালিশ যুগ যুগ ধরে চলে আসা শিশু লালন পালনের একটি গুরুত্বপূর্ন ধাপ। সঠিক উপকরণ এবং সঠিক পদ্ধতিতে যদি মালিশ করা হয় তাহলে তা শিশুর ক্ষুধা বৃদ্ধি করে, ঘুম ভালো হয়, শরীর মজবুত করে এবং অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি রোধ করে। আপনার পরিবারের ছোট্ট শিশুটির শরীর ম্যাসাজ বা মালিশ কি দিয়ে করবেন, কিভাবে করবেন, কেন করবেন, ইত্যাদি নানাবিধ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের আর্টেকেলটি।
ম্যাসাজ এর প্রয়োজনীয়তা কি?
শিশুর শরীর ম্যাসাজ নতুন কোন বিষয় নয়। প্রাচীন ভারতে মালিশকে এক অসামান্য আয়ুর্বেদিক মেডিসিনে হিসেবে বলা হয়েছে। কারন ১০০টিরও বেশী গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে নবজাতক বিশেষ করে কম ওজনের শিশুদের নিয়মিত মালিশ করলে তাদের হজম প্রক্রিয়া উন্নত হয়, শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় এবং শরীরের সামগ্রিক উন্নতি হয়। চলুন দেখি শিশুর শরীর ম্যাসাজের চমৎকার সব উপকারিতাগুলো কি কি-
শিশুর ওজন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে
গবেষণায় দেখা গেছে যে, ‘টাচ থেরাপি’ অর্থাৎ নিয়মিত শরীর মালিশ করা শিশুদের মালিশ না করা শিশুদের তুলনায় ৪৭ শতাংশ ওজন বেড়েছে। এমনকি সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে নিয়মিত শরীর ম্যাসাজ শিশুদের হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতেও সাহায্য করে।
জন্ডিসের সম্ভাবনা কমায়
সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে যে শিশুর ম্যাসাজ রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা কমাতে পারে। একই সাথে মলত্যাগের পরিমান বাড়িয়ে শরীর থেকে অতিরিক্ত বিলিরুবিন বের করে দিতে সাহায্য করে।
মানসিক চাপ কমায়
অনেক গবেষণায় এটা প্রমান করেছে যে, মানুষের স্পর্শ সময়ের আগেই জন্ম নেয়া শিশুদের জন্য জীবনরক্ষাকারী হতে পারে। বিভিন্ন গবেষণা এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমান করেছে যে, সঠিক উপায়ে করা শরীর মালিশ শিশুদের লক্ষনীয় মাত্রায় মানুষিক চাপ কমায়।
শিশুর ম্যাসাজ কোলিক বা পেট ব্যথা কমায়
আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন কেন শিশুদের বেশীরভাগ রকার বা দোলনায় ভাইব্রেটিং ফিচারটি দেয়া থাকে? এর কারণ হল ভাইব্রেশন আসলে শিশুদের কোলিক উপশম করতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে রকার বা দোলনার ভাইব্রেশনের চেয়ে শিশুর বডি ম্যাসাজ একটি কোলিক শিশুর জন্য অনেক বেশী আরামদায়ক।
শিশুর ম্যাসাজ ঘুমের পরিমান বাড়ায়
ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে যে শিশুর ম্যাসাজ স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা কমায় এবং মেলাটোনিন উৎপাদনকে বাড়ায়। যেহেতু মেলাটোনিনের প্রধান কাজ হল ঘুম নিয়ন্ত্রণ করা, তাই ম্যাসাজ শিশুদের দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে এবং বেশিক্ষণ ঘুমাতে সাহায্য করে।
মায়ের সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনে সাহয্য করে
শারিরীক স্পর্শ শিশুর মায়ের সাথে সম্পর্ক আরো মজবুত করে তোলে। অন্যান্য গবেষণা থেকে জানা যায় যে, শিশুকে মালিশ মায়ের প্রসব পরবর্তি ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি দিতে পারে এবং শিশুর সাথে বন্ডিং আরো গাঢ় করে তোলে।
শিশুর শরীর মালিশ কি দিয়ে করবেন?
শিশুর শরীর মালিশের জন্য কি তেল প্রয়োজন? যদিও মালিশ মানেই যে তেলের ব্যবহার তা নয় তবে তেল বা লোশন যাতীয় তরল মালিশে ব্যবহার করলে শিশুর জন্য আরামদায়ক হয়।
ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানচেস্টারের শিশুর মালিশের তেলের উপর করা একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, জলপাই তেল এবং সূর্যমুখী তেল শিশুর ত্বকের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। কারন শিশুর ত্বক যদি সংবেদনশীল হয় তবে এই তেলগুলি দিয়ে মালিশ করা হলে অ্যাকজিমার মত বড় কোন ক্ষতি ত্বকের হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাহলে জেনে নেই কোন তেল ব্যবহার করা যেতে পারে-
নারিকেল তেল
বিশুদ্ধ নারিকেল তেল শিশুর ত্বকের জন্য এককথায় একটি চমৎকার উপাদান। নারকেল তেল অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি-ফাঙ্গাল এবং অ্যান্টিভাইরাল। ত্বকের জন্য ভীষন উপকারী এই তেল আপনি শিশুর ডায়াপার ক্রীম হিসেবেও ব্যবহার করতে পারেন।
নারিকেল তেলের সাথে হুইপড শিয়া বাটার
আপনার শিশুর ত্বক যদি শুষ্ক হয় তাহলে হুইপড শিয়া বাটার নারিকেল তেলের সাথে মিশিয়ে মালিশ করতে পারেন। কারন শিয়া বাটার ত্বককে হাইড্রেট করতে এবং আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
সুগন্ধি তেল
বর্তমানে বাজারে নানা কোম্পানীর সুগন্ধি তেল পাওয়া যায়। কিন্তু সুগন্ধি তেল ঘন হতে পারে আর সেটা শিশুর নরম ত্বকে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া, অথবা ত্বকের জ্বালাপোড়া বা র্যাস সৃষ্টি করতে পারে। তাই শিশুর ত্বকের জন্য অপেক্ষাকৃত পাতলা ও প্রাকৃতিক তেল নির্বাচন করুন।
সরিষার তেল দিয়ে ম্যাসাজ দেয়া যাবে কি?
বিবিধ গবেষণায় শিশুর ত্বকে সরিষার তেল ব্যবহারের পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছে।
সৌদি আরবের জিজান জেনারেল হাসপাতালের সাবেক চিকিৎসক ডাঃ খন্দকার মোঃ আনোয়ারুল হক এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে শিশু এবং বয়স্ক সকলের জন্যই সরিষার তেল বেশ উপকারী। বিশেষ করে শীত মৌসুমে ঠান্ডাজনিত সমস্যাগুল থেকে রেহাই পেতে এই তেলের ব্যবহার বেশ উপকারী।
রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে
সরিষার তেল শরীরে রক্ত সঞ্চালন এবং শিশুর সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে অসাধারন ভুমিকা রাখে। তাই সরিষার তেল দিয়ে নিয়মিত মালিশ করলে আপনার শিশু সুস্থ ও সবল থাকবে।
শরীরকে উষ্ণ রাখতে সাহায্য করে
সরিষার তেল শরীরকে উষ্ণ রাখতে খুবই কার্যকরী এবং এটি শরীরে তাপ ধরে রাখতে সাহায্য করে। এই কারণেই, বাচ্চাদের উষ্ণ এবং আরামদায়ক রাখতে শীত প্রধান অঞ্চলে সরিষার তেল অত্যন্ত জনপ্রিয়।
সাধারন সর্দি কাশির ঔষধ হিসাবে কাজ করে
যদি সরিষার তেলে কয়েকটি রসুনের কোয়া দিয়ে গরম করা হয় এবং ঠান্ডা করে শিশুর বুকে মালিশ করা হয় তবে সাধারন কাশি এবং সর্দি থেকে শিশুকে অনেকটায় রক্ষা করা যায়।
ত্বকের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে
সরিষার তেলে অ্যান্টি-ফাঙ্গাল এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান রয়েছে তাই এই তেল দিয়ে আপনার শিশুকে মালিশ করলে আপনার শিশুর ত্বকে সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
চুলের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে
শিশুর চুলের ঘনত্ব বৃদ্ধিতে সরিষার তেল খুবই কার্যকরী। শিশুদের মাথার ত্বকে খুব কম চুল থাকে এবং সরিষার তেল দিয়ে নিয়মিত মাথা ম্যাসাজ করলে চুলের বৃদ্ধি নিশ্চিত হয়।
মশা এবং অন্যান্য পোকামাকড় থেকে শিশুকে রক্ষা করে
সরিষার তেলে তীব্র এবং ঝাঁঝালো গন্ধের কারনে মশা এবং পোকামাকড় দূরে থাকে। তাই গ্রীষ্ম এবং বর্ষাকালে মশার কামড় থেকে শিশুকে রক্ষা করতে এই তেল অনেকটাই কার্যকর।
শিশুর বডি ম্যাসাজ কীভাবে করবেন?
শিশুর শরীর মালিশ মোটেও কোন সহজ কাজ নয়। আপনার সামান্য ভুলে শিশুর মারাত্বক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাই মালিশের সঠিক পদ্ধতিটি আমরা নিচে আলোচনা করলাম।
১ম ধাপঃ মালিশের প্রস্তুতি নিন
শিশু শান্ত মুডে আছে কিনা দেখুন। মালিশের স্থান প্রস্তুত করুন। নরম তোয়ালে বা কাপড় বিছিয়ে তার ওপর শিশুকে শোয়ান। তার সাথে কথা বলতে বলতে পোশাক খুলুন। হাতের তালুতে সামান্য তেল নিয়ে কানের লতিতে দিন। এতে শিশু মালিশের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।
২য় ধাপঃ ধীরে ধীরে শুরু করুন
পা থেকে ধীরে ধীরে মালিশ শুরু করুন। হাতের তালুতে সামান্য তেল নিয়ে শিশুর পায়ের তলায় আঙ্গুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মালিশ করুন। পায়ের গোড়ালি থেকে আঙ্গুল পর্যন্ত হালকা হাতে তেল লাগান। এবার ধীরে ধীরে পায়ের উপরের দিকে উঠুন।
পুরো শরীরেই তেল লাগিয়ে ঘষে ঘষে মালিশ করে যান। বুক ও পেটে ঘড়ির কাটার অনুসারে আঙ্গুল ঘুরিয়ে মালিশ করুন। শিশুর তেল মালিশে তাড়াহুড়া করা যাবে না।
৩য় ধাপঃ পুরাবৃত্তি করুন
আপনার শিশু যদি মালিশটি উপভোগ করে তবে আরো একবার পুরো প্রক্রিয়াটির পুনরাবৃত্তি করা। এবার পা থেকে শুরু না করে মাথা থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত যান।
৪র্থ ধাপঃ শিশুর সাথে কথা বলুন
আপনার মালিশকে শিশুর কাছে উপভোগ্য করার জন্য তার সাথে কথা বলা চালিয়ে যান। সুন্দর সুন্দর ছড়া বা গান বলে শিশুকে শান্ত রাখুন।
৫ম ধাপঃ শিশুর তেল নির্বাচনে সচেতন হোন
সব তেল সব শিশুর জন্য উপযোগী নয়। তাই আপনার শিশুর ত্বকের জন্য কোন তেল উপযোগী হবে তা আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখুন।
সরিষার তেল দিয়ে কীভাবে মালিশ করবেন?
শিশুর মালিশে যুগ যুগ ধরে সরিষার তেলের ব্যবহার হয়ে আসছে। চলুন দেখি কিভাবে এই তেল দিয়ে শিশুকে মালিশ করবেন।
-
প্রথমে পরিমানমত তেল নিন এবং এর সর্বোচ্চ গুনাগুন পেতে একে গরম করে নিন। আপনি তেলটিকে ফুটিয়েও নিতে পারেন কারন তেল ফুটিয়ে নিলে অনেকটায় মসৃন হয় এবং ঘনত্ব কমে যায়।
তবে ব্যবহারের পূর্বে তেল পুরোপুরি ঠান্ডা করে নিতে হবে।
-
সরিষার তেলের গুনাগুনকে বৃদ্ধি করতে হলে কয়েক কোয়া রশুন যোগ করতে পারেন। অথবা এক চা চামুচ পরিমান আজওয়াইন এর দানাও তেলে দিয়ে গরম করে নিতে পারেন। এই তেল শিশুর নরম ত্বকের জন্য অনেক বেশী উপরকারী।
-
শীতকালে সরিষার তেলে কয়েকটি তুলসি পাতা যোগ করে গরম করে নিতে পারেন। এই তেল শিশুর শরীরে চমৎকার উষ্ণতা ও আরামদায়ক অনুভূতি এনে দিবে।
পরিশিষ্ট
আপনার ছোট্ট সোনামনির শরীর ম্যাসাজ সংক্রান্ত জরুরি বেশ কিছু তথ্য নিয়ে আজকের আর্টিকেলে আলোচনা করলাম। আসাকরি আপনি নতুন মা হলে এই তথ্যগুলী আপনার ও আপনার শিশুর জন্য অনেক উপকারী হবে। মনে রাখবেন, শুধু মালিশ নয়, সঠিক উপায়ে মালিশ আপনার শিশুর জন্য জরুরি। এই আর্টিকেলে আপনি শিশুর মালিশের সঠিক পদ্ধতি ও এর উপকারীতা সম্পর্কে পরিস্কার ধরনা পেয়েছেন যেটা অনুস্মরণ করে আপনিও আপনার শিশুকে একটি আরামদায়ক মালিশ দিতে পারবেন। আপনার ছোট্ট সোনামনির জন্য রইলো অনেক ভালোবাসা!