বিশ্ব অপরিণত নবজাতক দিবস, সচেতনাই পারে আগামীকে জয় করতে
বাংলাদেশে বছরে প্রায় ছয় লাখ শিশু অপরিণত বা প্রিম্যাচিওর বেবি হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। প্রিম্যাচিওর বাচ্চার জন্ম, জন্ম সংক্রান্ত এবং জন্ম পরবর্তী জটিলতা নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই মূলত ওয়ার্ল্ড প্রিম্যাচ্যুরিটি ডে পালন করা হয়।

-
সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১৫০ লক্ষ প্রিম্যাচিওর শিশু জন্ম নেয়
-
প্রতি দশটি নবজাতকের মধ্যে একটি নবজাতক সময়ের আগেই অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে
-
বিশ্বব্যাপী, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ প্রিটার্ম বার্থ
-
এবং প্রতি বছর প্রায় ১০ লক্ষ শিশু শুধুমাত্র অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেবার কারণে মারা যায়
প্রিম্যাচিওর বেবি বা অপরিণত শিশু বলতে কি বোঝায়?
দিনটি সম্পর্কে জানার আগে আসুন দিনটি কাদের জন্য সেই সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়া যাক। প্রথমেই আসি, প্রিম্যাচিওর বেবি কারা। দুইভাবে এটির ব্যাখ্যা দেয়া যায়-
-
৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম নেয়া সকল বাচ্চাকে প্রিম্যাচিওর বা অপরিণত শিশু বলা হয়।
-
আবার EDD বা এক্সপেক্টেড ডেলিভারি ডেটের ৩ সপ্তাহ বা তার বেশি আগে কোনো শিশু জন্ম নিলে তাকেও প্রিম্যাচিওর বলা যাবে।
প্রিম্যাচুরিটি ডে এবং তার ইতিহাস
বিশ্বব্যাপী, প্রতি বছর ১৭ই নভেম্বর ওয়ার্ল্ড প্রিম্যাচ্যুরিটি ডে বা বিশ্ব অপরিণত নবজাতক দিবস হিসেবে পালিত হয়।
The European Foundation for the Care of Newborn Infants (EFCNI) এবং Partnering European Parent Organizations ২০০৮ সালে এই দিনটি পালন করার ব্যাপারে প্রথম উদ্যোগ নেয়৷ বিশেষ করে এই দিনটিকে বেছে নেয়া হয়, কারণ এই দিনে EFCNI এর একজন ফাউন্ডিং মেম্বার একটি কন্যা সন্তানের বাবা হন যিনি কিনা আগে প্রিম্যাচুরিটি সংক্রান্ত জটিলতায় নিজের সন্তানকে হারিয়েছেন।
মূলত প্রিম্যাচুরিটি সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা এবং প্রিম্যাচিওর শিশু আছে এমন পরিবারগুলোর মধ্যে একাত্মতা তৈরি করার জন্য ২০১১ সাল থেকে প্রতি বছর ১৭ই নভেম্বর দিনটি ওয়ার্ল্ড প্রিম্যাচুরিটি ডে হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালেও দিনটি পালিত হচ্ছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে-
'A parent’s embrace: a powerful therapy.
Enable skin-to-skin contact from the moment of birth.'
দিনটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
মাত্র ১১ বছর আগে দিনটি উদযাপন শুরু হলেও এরই মধ্যে বিশ্বের ৬০ টিরও বেশি দেশে দিনটি পালিত হচ্ছে৷ প্রতি বছর আরো নতুন নতুন দেশ এই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে দিনটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ।
এর প্রথম কারণ হচ্ছে, দিন দিন প্রিম্যাচিওর শিশুর জন্মহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশেই প্রিম্যাচিওর বাচ্চার সংখ্যা আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু শিশুর জন্ম হয় সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে বাবা মাসহ পরিবারের সবার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সময়ের আগেই সিজারিয়ান সেকশন করা হয়৷ ইদানীং বাংলাদেশে এই ধরনের সিজারিয়ান সেকশন অহরহ হচ্ছে। এক্সপেক্টেড ডেট আসার আগেই সময় সুবিধা মত দুই এক সপ্তাহ আগেই বাচ্চা বের করা হচ্ছে। ফলাফল, প্রিম্যাচুরিটি এবং সে সংক্রান্ত জটিলতা।
মোটামুটি ৩৪ থেকে ৩৭ সপ্তাহ হলে বাচ্চাকে লেট প্রিটার্ম বেবি বলা হয়। এক্ষেত্রে জন্ম পরবর্তী জটিলতা অপেক্ষাকৃত কম হয়। তবে বাচ্চা যদি ৩২ সপ্তাহ বা তার থেকেও আগে জন্মগ্রহণ করে, তবে হার্ট, লাংস, ব্রেইন এবং ভিশন বা দৃষ্টিশক্তি জনিত নানা সমস্যা দেখা দেয়। অনেকের লার্নিং ডিজ্যাবিলিটি, শ্রবণশক্তি কম হবার মত সমস্যাও হতে পারে।
উন্নত বিশ্বে ২৫ কিংবা ২৬ সপ্তাহের মাইক্রো প্রিমি শিশু বাঁচানোর নজির রয়েছে৷ তবে বাংলাদেশ সহ তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশেই এই সুবিধা নেই। কিংবা থাকলেও রাজধানী বা দেশের বড় বড় দুই একটি শহর ছাড়া প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং অপরিণত শিশুর 'প্রাইমারি কেয়ার' দেবার মত দক্ষ জনবল নেই।
কেন অপরিণত শিশুর জন্ম হয়?
ঠিক কি কারণে প্রত্যাশিত সময়ের আগেই শিশুর জন্ম হয়, তার সঠিক কারণ জানা যায় না। তবে এর কিছু কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে-
-
ডায়বেটিস
-
মায়ের উচ্চ রক্তচাপ
-
মাল্টিপল প্রেগনেন্সি
-
ভ্যাজাইনাল সংক্রমণ
-
ধূমপান
-
স্ট্রেস ইত্যাদি।
-
এছাড়াও মায়ের দারিদ্র্যজনিত অপুষ্টি, মদ্যপান, জরায়ুর গঠনগত অস্বাভাবিকতা, UTI বা মূত্রনালীর সংক্রমণ জনিত কারণে অপরিণত শিশুর জন্ম হতে পারে।
-
প্লাসেন্টার বিভিন্ন সমস্যা যেমন প্লাসেন্টা প্রিভিয়া এবং অ্যাবরাপসিও প্লাসেন্টাতেও প্রিটার্ম শিশুর জন্ম হতে পারে৷
প্রিম্যাচিওর শিশুর সম্ভাব্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতাগুলি কি কি?
৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম নেওয়া শিশুর বিভিন্ন রকম স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতা হতে পারে। যেমন :
-
শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
-
কম ওজন
-
শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকা
-
বাচ্চা মায়ের বুকের দুধ খেতে না পারা
-
খিঁচুনি
-
ফ্যাকাশে বা হলদেটে চামড়া
-
হার্ট ফেইলিওর
-
ডিহাইড্রেশন
-
রেটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচুরিটি
-
এছাড়াও ব্রেইন হেমোরেজ বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, পালমোনারী হেমোরেজ বা ফুসফুসে রক্তক্ষরণ, হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা রক্তে অতিরিক্ত কম শর্করা, নিউমোনিয়া, অ্যানিমিয়া, রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম (RDS) সহ জীবন সংশয়কারী বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।
কিভাবে অপরিণত শিশুর জন্ম প্রতিরোধ করা যেতে পারে?
নবজাতকের মৃত্যু এবং অপরিণত জন্ম থেকে সৃষ্ট জটিলতা প্রতিরোধ একজন মায়ের সুস্থ গর্ভাবস্থার মাধ্যমে শুরু হয়।
প্রাইমারি কেয়ার
বিভিন্ন রকম রিস্ক ফ্যাক্টর যেমন ডায়বেটিস, ইনফেকশন, প্রি একলাম্পসিয়া, ডায়রিয়া, এনিমিয়া, লো বিএমআই এসব সমস্যা গর্ভবতী মায়েদের আগেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
সেকেন্ডারি কেয়ার
নিয়মিত মায়ের স্ক্রিনিং টেস্ট করতে হবে। যেন কোনো সমস্যা থাকলে সেটা আগেই ধরা পড়ে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যায়। অনেক সময় টকোলাইটিক এজেন্ট ব্যবহার করে জরায়ুর সংকোচনশীলতা কমানো সম্ভব হয়। এভাবে টকোলাইটিক ব্যবহার করে ৩ দিন বা তারও বেশি সময় অপেক্ষা করা যায়।
টারশিয়ারি কেয়ার
অনেক সময় গর্ভকালীন শিশুর লাং ম্যাচুরিটি অর্থাৎ ফুসফুসকে পরিণত করার জন্য কর্টিকোস্টেরয়েড দেয়া হয়। এর ফলে রেসপিরেটরি ডিসট্রেস এবং ইন্টার ভেন্ট্রিকুলার হেমোরেজ হবার সম্ভাবনা কমে যায়।
ওয়ার্ল্ড প্রিম্যাচ্যুরিটি ডে সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করবেন যেভাবে
বাংলাদেশে এই দিনটি নিয়ে এখনো ততটা আলোচনা চোখে পড়ে না। তবে দেশের অনেক হাসপাতাল, এনজিও এবং হেলথ অর্গানাইজেশন দিনটিকে বিশেষ ভাবে পালন করার জন্য নানা রকম ইভেন্ট, ক্যাম্পেইন এবং সেমিনার আয়োজন করে।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে আপনি ওয়ার্ল্ড প্রিম্যাচুরিটি ডে সম্পর্কে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেন। আমাদের মধ্যে অনেকেই জীবনে কখনোই কোনো প্রিম্যাচিওর বেবি সামনাসামনি দেখি নি। সামনা সামনি হোক কিংবা গুগল সার্চ - এই দিনটিতে একটি অপরিণত নবজাতকের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে আমরা সবাইকে দিনটি সম্পর্কে জানাতে পারি।
হাসপাতালের Neonatal Intensive Care Unit বা NICU ওয়ার্ডে কাজ করা স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজের প্রতি সম্মান জানাতে এবং প্রিম্যাচিওর বাচ্চাদের নিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে চলা এই মানুষগুলোর প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করার জন্য আজকের দিনে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে #NICUheroes এই হ্যাশট্যাগটি ব্যবহার করতে পারেন।
পার্পল বা বেগুনি ওয়ার্ল্ড প্রিম্যাচুরিটি ডে'র অফিশিয়াল রঙ৷ হাতে একটি পার্পল রিবন বেধে বা বেগুনি রঙের জামা পড়ে আপনি এই দিনটির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করতে পারেন। এর মাধ্যমে হয়ত সরাসরি কোনো প্রিম্যাচিওর নবজাতকের পরিবারকে আপনি সাহায্য করতে পারবেন না, তবে লাখ লাখ প্রিম্যাচিওর শিশু এবং তাদের পরিবারের প্রতি সবার মনোযোগ ফেরাতে আপনি সক্ষম হবেন।
আন্তর্জাতিক ভাবে ১৭ নভেম্বর দিনটিকে প্রিম্যাচিওর বাচ্চাদের দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার প্রিম্যাচিওর শিশু বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় জন্ম নিচ্ছে৷ উন্নত অনুন্নত স্বল্পোন্নত কিংবা উন্নয়নশীল, যে দেশেই জন্ম হোক না কেন, ৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম নিলেই সেই শিশু প্রিম্যাচিওর হিসেবে গণ্য হবে। আগে এই বাচ্চাগুলোর জন্ম বাবা মায়ের কাছে বোঝা স্বরূপ ছিল৷ তবে এখন উন্নত চিকিৎসাসেবার কারণে অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলে প্রিম্যাচিওর বাচ্চার সংখ্যা এবং এই কারণে শিশু মৃত্যু আরো কমে আসবে। তাই দিনটি নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রিম্যাচিওর বেবি ও প্রিটার্ম বার্থ নিয়ে যেকোনো আলোচনায় আমাদের সরব উপস্থিতি বিষয়টি আমাদের আরো ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।