ডায়াপার র্যাশ থেকে বাচ্চাকে সুস্থ রাখবেন যেভাবে
আপনার বাসায় যদি এক থেকে তিন বছর বয়সী বাচ্চা থাকে কিংবা আপনি যদি খুব শীঘ্রই বাচ্চা নেবার কথা ভেবে থাকেন তাহলে আজকের এই লেখাটা আপনার জন্য। কারণ আজ আমরা কথা বলব বাচ্চাদের ডায়াপার র্যাশ নিয়ে।
বাচ্চাদের ডায়াপার পরানো খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। বার বার যেন ত্যানা কাঁথা ধুতে না হয় সেজন্য আজকাল প্রায় সব বাবা মা কাপড়ের বদলে ডায়াপার পরাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। শহর এলাকায় অনেক বাবা মা বাচ্চাকে সারাক্ষণই ডায়াপার পরিয়ে রাখেন। কেউ কেউ আবার শুধুমাত্র বাইরে যাবার সময় বাচ্চাকে ডায়াপার পরিয়ে নিয়ে যান। আপনি যে দলেরই হোন, আপনার বাচ্চার এই ডায়াপার থেকেও তৈরি হতে পারে ছোটখাটো স্বাস্থ্য সমস্যা। এমনই একটি সমস্যা হল ডায়াপার র্যাশ। আর ঠিক সময়ে ঠিক পদক্ষেপ না নিলে ডায়াপার র্যাশ থেকে বাচ্চার অন্যান্য সমস্যাও তৈরি হতে পারে।
ডায়াপার র্যাশ কি?
ডায়াপার মূলত দুই ধরণের। এক ধরণের ডায়াপার আছে যেগুলো সুতি কাপড় দিয়ে তৈরি হয়। বার বার ধুয়ে ব্যবহার করা যায়। অন্য এক ধরণের ডায়াপার আছে যা ডিসপোজেবল অর্থাৎ একবার ব্যবহারের পর ফেলে দিতে হয়।
ধরন যেটাই হোক এই ডায়াপার বাচ্চাদের দীর্ঘক্ষণ পরিয়ে রাখলে নিতম্ব এবং জানুর উপরভাগে অনেকটা ঘামাচির মত ছোট ছোট লাল লাল ফুসকুড়ি হতে দেখা যায়। কখনো কখনো এগুলো চুলকায়। একেই বলে ডায়াপার র্যাশ।
ডায়াপার র্যাশ কেন হয়?
-
দীর্ঘ সময় একই ডায়াপার পরা থাকলে তাতে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়। এ থেকে ডায়াপার র্যাশ হতে পারে।
-
ডায়াপার যদি বাচ্চার সাইজের চেয়ে ছোট হয়, তাহলে অতিরিক্ত টাইট হয়ে চামড়ার উপর এটে বসে। ফলে বাতাস চলাচল করতে পারে না এবং র্যাশ তৈরি হয়।
-
প্রস্রাব কিংবা পায়খানার পর ভেজা, ময়লা ডায়াপার বদলানো না হলে বাচ্চার ত্বক অনেক ক্ষণ সেই ভেজা জলীয় ডায়াপারের সংস্পর্শে থাকে। এ থেকেও র্যাশ হতে পারে।
-
অনেক বাচ্চাই বিভিন্ন কারণে ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা জনিত সমস্যায় ভোগে। বাচ্চা যদি বার বার ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয় তাহলে বাচ্চা বার বার পায়খানা করে। এমনিতে প্রতিবার পায়খানার পর ডায়াপার বদলানোর কথা বলা হলেও এক্ষেত্রে এত ঘন ঘন ডায়াপার বদলানো সম্ভব হয় না। ফলাফল – ডায়াপার র্যাশ।
-
এলার্জি জাতীয় খাবার খেলে এ জাতীয় র্যাশ হতে পারে। আবার যে বাচ্চা শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ খায়, তাকে যদি অন্য কোনো ফর্মুলা বা বাড়তি খাবার খাওয়ানো হয় সেক্ষেত্রেও শরীরে র্যাশ বের হতে পারে।
-
সব ডায়াপারের গঠন প্রণালী এক নয়। ডায়াপার কেনার আগে ডায়াপারের ম্যাটেরিয়ালস চেক করে নিন। রেগুলার ডায়াপারে সেলুলোজ, পলি-ইথিলিন, শোষণ ক্ষমতা সম্পন্ন পলিমার, ইলাস্টিক এসব ব্যবহার করা হয়। তবে এখন অনেক ডায়াপারে বিশেষ বিশেষ উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। ডায়াপারে থাকা এলার্জিক ম্যাটেরিয়ালস থেকেও র্যাশ হতে পারে। তাই সন্তানের প্রয়োজন অনুযায়ী ডায়াপার সিলেক্ট করাও একটি বড় কাজ।
ডায়াপার র্যাশ কোন শিশুদের বেশী হয়?
ডায়াপার র্যাশ কাদের বেশি হয় এ ধরণের নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নেই। তবে কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর অবশ্যই রয়েছে। যেমন-
-
৬ থেকে ৯ মাস বয়স্ক বাচ্চাদের এই সমস্যা বেশি হয়। যেসব বাচ্চা কেবলই বুকের দুধের পাশাপাশি সম্পূরক খাবার খাওয়া শুরু করেছে তাদের ক্ষেত্রে এই র্যাশ হবার সম্ভাবনা বেশি।
-
যেসব বাচ্চা এক ঘুমে রাত পার করে ফেলে, সারা রাত ভেজা ডায়াপারে শুয়ে থাকে বলে তাদেরও র্যাশ হবার সম্ভাবনা বেশি।
-
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, সব সময়ই একটা কিছু লেগেই রয়েছে এসব বাচ্চারা ডায়াপার র্যাশে বেশি আক্রান্ত হয়।
-
আবার যেসব বাচ্চার বাবা মা দুজনেই কর্মজীবী, সেসব বাচ্চা এই সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হয়।
ডায়াপার র্যাশের কোন ঘরোয়া চিকিৎসা কীভাবে করবেন?
ডায়াপার র্যাশের জন্য ঘরোয়া চিকিৎসাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। খুব কম ক্ষেত্রেই বাচ্চাকে হাসপাতালে নেবার প্রয়োজন পড়ে। বাসায় একটু খেয়াল রাখলেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
-
র্যাশ উঠলে কারণ যেটাই হোক, প্রথমেই ডায়াপার ব্যবহার কিছু দিনের জন্য বন্ধ রাখুন। পালা করে বাবা মা দুজনে অথবা পরিবারের অন্য কেউ বাচ্চার সাথে থাকুন। বাচ্চা পায়খানা প্রস্রাব করার পরপরই বাচ্চার ভেজা কাঁথা প্যান্ট এসব বদলে দিন।
-
যে জায়গায় র্যাশ হয়েছে সেই জায়গায় যেন চাপ না পড়ে এজন্য বাচ্চাকে কাত করে বা উপুড় করে শোয়ানো উচিত।
-
বাচ্চাকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। গোসলের পর আক্রান্ত স্থান পাতলা নরম সুতির কাপড় দিয়ে মুছে দিতে হবে। এবং বাচ্চার শরীর খোলা বাতাসে শুকানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
-
যদি নিতান্তই ডায়াপার ব্যবহারের প্রয়োজন পরে তবে বার বার ডায়াপার বদলে দিন। সাধারণ সময়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা পরপর ডায়াপার বদলানোর জন্য বলা হয়। তবে র্যাশ উঠলে দুই তিন ঘন্টা পর পর বদল করা উচিত।
-
বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে গেলে সাথে করে অতিরিক্ত ডায়াপার নিয়ে নিন এবং ময়লা ডায়াপার ফেলার মত প্যাকেটও সাথে করে নিয়ে যান।
-
প্রতিবার বাচ্চাকে পরিষ্কার করার আগে নিজের হাত ধুয়ে নিতে ভুলবেন না। আমরা বাচ্চার পায়খানা পরিষ্কারের পর হাত ধোয়ার দিকেই বেশি মনোযোগ দেই। তবে পরিষ্কারের আগেও হাত ধোওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
-
অনেক সময় অ্যালোভেলা জেল বা নিম পাতা বাটার মত ভেষজ চিকিৎসা খুব কাজে দেয়।
-
এছাড়া র্যাশের উপর জিংক অক্সাইড যুক্ত মলম বা লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে। এসব লোশন ফার্মেসিতে ওভার দ্য কাউন্টার (OTP) ড্রাগ হিসেবে পাওয়া যায়। এর জন্য আলাদা করে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের দরকার পরে না।
রয়েছে সংক্রমণের ঝুঁকি
বাচ্চার বার বার জ্বর সর্দি ঠান্ডা কাশির একটি অন্যতম কারণ হল বাচ্চার ভেজা অপরিষ্কার ডায়াপার। ডায়াপার র্যাশ থেকে ব্লিস্টার হতে পারে। এবং পরবর্তীতে এই ব্লিস্টার থেকে ব্যাকটেরিয়া কিংবা ফাংগাল সংক্রমণ হতে পারে।
ডাক্তারের কাছে কখন যাবেন?
সাধারণত ডায়াপার র্যাশ নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবার প্রয়োজন পরে না। তবে কিছু কিছু সাইন সিম্পটম দেখলে বাচ্চাকে ডাক্তারের কাছে নেবার প্রয়োজন হবে বৈকি!
-
র্যাশ ফেটে গিয়ে ব্যাকটেরিয়া বা ফাংগাল ইনফেকশন হলে
-
আক্রান্ত জায়গা লাল হয়ে ফুলে উঠলে
-
জ্বর হলে
-
র্যাশ পেকে এ থেকে ব্লিস্টার তৈরি হলে
-
র্যাশ থেকে পুঁজ বা পুঁজ জাতীয় ডিসচার্জ বের হলে
-
কয়েকদিন পর পর র্যাশ হলে এবং ঘরোয়া চিকিৎসায় অবস্থার উন্নতি না হলে
সাধারণত এ অবস্থায় টপিকাল এন্টিবায়োটিক ক্রিম বা মুখে খাওয়ার এন্টিবায়োটিক দেয়া হয়। যেসব বাচ্চার ইমিউনিটি কম তাদের কখনো কখনো ডায়াপার র্যাশ থেকে Candidiasis নামক ফাংগাল ইনফেকশন হতে পারে। তখন এন্টিফাংগাল ক্রিম বা মুখে খাবার এন্টিফাংগাল ওষুধ দেয়া হয়। এর জন্য প্রথমদিকে একজন শিশু বিশেষজ্ঞর শরণাপন্ন হতে পারেন। তবে শিশুর ত্বক যদি অতিরিক্ত সেনসিটিভ হয়ে যায়, শিশু সব সময় কাঁদে কিংবা অল্পতেই খিটখিটে আচরণ করে সেক্ষেত্রে একজন স্কিন স্পেশালিষ্টের কাছ থেকেও পরামর্শ নিতে পারেন।
আরো একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক চয়েজ এবং এর ডোজ বড়দের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাই কোনো অবস্থাতেই গ্রাম্য ডাক্তার বা ফার্মেসীর দোকানদারের কাছ থেকে নিয়ে বাচ্চাকে এন্টিবায়োটিক খাওয়ানো যাবে না।
পরিশেষে
আজকাল বেশির ভাগ পরিবারে বাবা মা দুজনেই কর্মব্যস্ত। সেক্ষেত্রে বাচ্চাকে ডায়াপার পরিয়ে রাখা, বুকের দুধের জায়গায় বাজারের কেনা ফর্মুলা খাওয়ানো খুবই কমন বিষয়। বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে বের হলে বাচ্চা যেন জামা কাপড় নোংরা না করে সেজন্য প্রায় সব বাবা মা এখন ডায়াপারের উপর নির্ভরশীল। এজন্য ডায়াপার ব্যবহার না করাটা কোনো সমাধান নয়। একটু খেয়াল রাখবেন যেন বাচ্চা কোনো অবস্থাতেই বেশি সময় ভেজা না থাকে।
মা বাবার পাশাপাশি পরিবারের বাকি সদস্যদেরও সজাগ থাকতে হবে। নতুন মায়ের পক্ষে সারা রাত জেগে বাচ্চার কাঁথা বদলে দেয়া খুবই ক্লান্তিকর একটা ব্যাপার এবং মায়ের স্বাস্থ্যের জন্যও এটা ক্ষতিকর। তাই পালা করে সংসারের সবাইকে এ দায়িত্ব নিতে হবে। ডায়াপার র্যাশ সহ শিশুর যেকোনো শারীরিক সমস্যা যেন না হয়, আর হলেও তা যেন মারাত্মক কিছুতে পরিণত হতে না পারে এজন্য পরিবারের সকলের সহযোগিতা দরকার।