শিশুদের খাদ্য তালিকাঃ কি খাওয়াবেন, কি খাওয়াবেন না (পর্ব ২)
শিশুদের সুস্থ, শক্তিশালী এবং স্মার্ট হয়ে উঠতে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন। প্রায় ছয় মাস বয়স থেকেই আপনার শিশু দ্রুত বেড়ে উঠছে এবং তার জীবনের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি শক্তি এবং পুষ্টির প্রয়োজন। কিন্তু আপনি কি জানেন তাকে কি খাওয়াতে হবে এবং কীভাবে খাওয়াতে হবে? এসব জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।
নতুন মায়ের হাজারো প্রশ্ন, জড়তা, ভীতি এবং দায়িত্ব। সন্তানকে কি খাওয়াবো, কি খাওয়াবোনা। কখন খাওয়াবো? কীভাবে খাওয়াবো? এসব চিন্তা থাকবেই কারণ শিশুর খাবার বাছাই এবং সঠিক প্রক্রিয়ায় খাওয়ানো বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর আভ্যন্তরীন বিকাশ, সুস্হতা, মেধা অনেকাংশেই নির্ভর করে খাবারের উপর। তাছাড়া কোন খাবারটি অভ্যন্তরীন কোন ক্ষয় ক্ষতির জন্য দায়ী এবং দূর ভবিষ্যতে তার প্রভাব কেমন হতে পারে সেটাও গবেষণার বিষয়।
একজন মা একজন গবেষকতো বটেই। তবে তাদের এই গবেষণার বিষয়টা সহজ করতে আস্থা লাইফ এর এই প্রয়াস। আমরা মায়েদের এসব চিন্তা দূর করতে খুব গুছিয়ে একই সাথে তার প্রশ্নগুলোর জবাব নিয়ে এসেছি। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে চলেছি ০ মাস থেকে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর খাদ্য তালিকা। সঠিক রুটিন। করনীয় এবং বর্জনীয় কিছু তালিকা।
দ্বিতীয় পর্বে আমাদের আলোচনার বিষয় ৮-১২ মাস বয়সী শিশুর খাদ্য বিষয়ক সকল খুঁটিনাটি। ৮-১২ মাস বয়সী শিশুর সঠিক বিকাশের জন্য অতিরিক্ত পুষ্টি সংযোজন করা প্রয়োজন। তবে অবশ্যই সাবধানতার সঙ্গে। এ বয়সী শিশুর শরীর বাড়ন্ত। তাই তাকে সঠিক পরিমান পুষ্টি প্রদান করতে না পারলে শরীরে ঘাটতি থেকে যাবে।
৮-১২ মাস বয়সী শিশুদের খাবার নিয়ে মায়েদের প্রশ্নগুলো কী?
-
এ বয়সে নতুন কি কি খাবার সংযোজন করা যায়?
-
দিনে কতোবার খাওয়াবো?
-
কি পরিমান খাওয়াবো?
-
কীভাবে খাওয়ানো ঝুঁকিহীন?
-
কোন খাবারগুলো বর্জন করব?
-
আমি যেভাবে খাওয়াচ্ছি তাতে কোন ঘাটতি থেকে যাচ্ছেনাতো? বা কোন ক্ষতি হচ্ছেনাতো?
এসব প্রশ্নের উত্তর আশেপাশে খোঁজার চেষ্টা করলেও, মায়েরা সন্তানের মঙ্গলের প্রশ্নে সবাইকে ভরসা করতে পারেন না। আর তাই এসকল প্রশ্নের উত্তর দিব আমরা বিশেষজ্ঞ ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী।
পরামর্শ দিয়েছেন
ডাঃ রানা কুমার বিশ্বাস
এমবিবিএস(ডিইউ), এফসিপিএস(শিশু)
এমডি(শিশু গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি) (পিজি হাসপাতাল)
শিশুরোগ, শিশু গ্যাস্ট্রোলিভার ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ,
সিনিয়র কনসালট্যান্ট (শিশু)
২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল, খুলনা।
তাঁর মতে-
-
এ বয়সে শিশুদের দাঁত চলে আসে। তাই তাদের সম্পূর্ণ পিষে নেওয়া খাবার না দিয়ে কিছুটা দানা জাতীয় খাবার বা ছোট ছোট করে কেটে নেওয়া এবং সেদ্ধ করা খাবার দেওয়া যাবে।
-
এ বয়সে ভাত, ডাল, ডিম, মাংস, শাক, সব্জি, ফল, কলিজা, পাস্তুরিত দুধের খাবার, বাদাম এগুলো খাওয়ানো যাবে। তবে সঠিক প্রক্রিয়ায় অবশ্যই।
-
এ বয়সে দিনে তিনবার প্রধান খাবার এবং দু'বার নাশতা দেওয়া ভালো।
-
পাশাপাশি বুকের দুধ বা আয়রণ ফর্টিফাইড মিল্ক চলবে। তবে সাধারণ খাবার শুরু করার সাথে সাথেই তাদের তরল দুধ খাওয়ার প্রবনতা কমে আসে এবং এটি স্বাভাবিক।
-
ভিটামিন ডি এবং ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণ করতে সব খাবারের পাশাপাশি ২৮ থেকে ৩২ আউন্স দুধ খাওয়া প্রয়োজন। সেটা নিশ্চিত হলেই চলবে।
খাবারের তালিকা এবং রুটিন
সকালের খাবার
-
সকালে লাল আটার রুটি দিতে পারেন গরম পানিতে ভিজিয়ে অল্প খেজুর বা কলা দিয়ে মেখে। তবে খাবারটি যেন বেশী শুকনো না হয় কারণ এ বয়সে শুকনো খাবার তাদের গলায় আটকে যেতে পারে বা শিশুর অস্বস্তি হতে পারে।
-
এছাড়াও নরম করে ভাত মেখে দিতে পারেন সেদ্ধ সব্জি দিয়ে।
অর্থাৎ তিনবেলার মূল খাবারে কার্বহাইড্রেট অথবা হোল গ্রেইন নিশ্চিত করতে হবে। সাথে রাখতে হবে প্রয়োজনীয় পুষ্টি অল্প অল্প করে। যেমন ভাতের সাথে নরম সব্জিতে কার্বহাইড্রেট এবং প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং মিনারেল সংযোজিত হয়ে খাবারকে পরিপূর্ণ করছে। ঠিক তেমনি হোল গ্রেইন অর্থাৎ আটার তৈরী রুটিতে রয়েছে কার্বহাইড্রেট, ফাইবার, ক্যালরি, সুগার এবং খেজুর /কলায় রয়েছে সুগার, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালরি, ফ্যাট ইত্যাদি। এতে করে এ খাবারটিও পরিপূর্ণ এবং পুষ্টিকর।
বেলা ১১-১২ টার খাবার
এই সময়ের মধ্যে তাকে একটি নাশতা দিতে হবে। হতে পারে নরম কোন ফল অথবা ফলের রস। যেমন সফেদা, কলা, দুটো খেজুর পানিতে চটকে ছেকে নিয়ে সেই রস, পাকা পেপে, ডিম ইত্যাদি। এসময়ে শিশুর হাতে ছোট করে কাটা নরম ফল দিতে পারেন যেন নিজে নিজেও খেতে পারে।
দুপুরের খাবার
দুপুর ১-২ টার মধ্যে তার দুপুরের খাবারে দিতে পারেন নরম করে রান্না করা একটি সব্জি খিচুড়ী। খিচুড়ীতে মাছ বা মুরগীর মাংস সংযোজন করতে পারেন। বা সরাসরি নিজেদের জন্য রান্না খাবার থেকেই মাছ, আলু, সব্জি তুলে ভাতে মুছে নিয়ে ভাতের সাথে চটকে খাওয়াতে পারেন। খেয়াল রাখবেন খাবার যেন অতিরিক্ত ঝালযুক্ত না হয়।
বিকালের খাবার
বিকেলে তাকে একটি নাশতা দেবেন। এসময়ে অবশ্যই ফল নয়। রান্না করা সুজি বা সিরিয়াল খাওয়াতে পারেন। সুজি রান্নায় দুটো বাদাম গুড়ো মেশালে শিশুর বুদ্ধি বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। সাথে সাথে প্রয়োজনীয় ফ্যাট, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিনস পাবে। বাদাম শিশুর মজ্জা গঠনে সহায়তা করে। শিশুকে এবয়সে সেদ্ধ করা সব্জি ছোট টুকরো করে হাতে দিতে পারেন যেন সে নিজে খাওয়ার বিষয়টা উপভোগ করে এবং খাবার খাওয়া তার কাছে আনন্দময় হয়।
রাতের খাবার
রাতে আবারো সব্জি /মাছ দিয়ে ভাত অথবা খিচুড়ী খাওয়াতে পারেন। এসবের ফাঁকে ফাঁকেই চলবে পানি এবং দুধ।
খাবারের পরিমাণ
খাবারের তালিকা এবং রুটিনের পরে এবার আসি খাবারের পরিমাণ বিষয়ে।
-
এ বয়সে একবারে সর্বোচ্চ আধা কাপ খাবার খাওয়ানো যাবে (ফুল মিল হিসেবে)।
-
তবে কোন শিশু যদি অতিরিক্ত অস্বস্তিতে থাকে বা খেতে না পারে তবে তখনই বাদ দিতে হবে।
-
খাবার নিয়ে জোরাজোরি করা যাবেনা কারণ তার হজমে সমস্যা থাকতে পারে আর তাই সে খাবারের চাপ নিতে পারছেনা। এমন অবস্থায় তাকে আরো বেশী করে খাওয়ালে মারাত্মক বিপদও ঘটতে পারে।
-
এ বয়সে শিশুরা বড়দের সাথে খাবার টেবিলে বসে খেতে পছন্দ করে। তাই তাকে খাবার টেবিলের একজন সাথী হিসেবে রাখবেন এবং তার জন্য প্রযোজ্য খাবারটি তাকে পরিবেশন করবেন।
-
এ বয়সে শিশুকে পাস্তুরিত দুধের তৈরী খাবারও মাঝে মাঝে খাওয়াতে পারেন।
-
তাদের প্রোটিন হিসেবে মাছের প্রোটিনটি বেশী দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
-
সপ্তাহে প্রতিদিন ডিম বা মাংস নয়। ৩/৪ দিন ডিম এবং ৩/৪ দিন মুরগীর মাংস।
-
লাল মাংস যেমন গরু, খাসিতে কোলেস্টেরল বেশী থাকে। এতে করে শিশু বেশী স্হূল হবে ঠিকই তবে কর্মক্ষমতা কমবে এবং শরীরে বিভিন্ন রোগ দানা বাঁধতে পারে।
-
কৌটাজাত খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলবেন।
সাবধানতা
রুটিনটি ছিল সাবলিল এবং সহজ। তবে এর মাঝেও ছোট ছোট বেশকিছু সাবধানতা রয়েছে। সেগুলো খেয়াল রাখতে হবে। যেমন-
-
খাবারটি এমনভাবে টুকরো করা কিনা যেন শিশু দাঁত দিয়ে কাটলে সেটা ছোট ছোট হয়ে যায়।
-
খাবারটি যথেষ্ট নরম কিনা যেন সেটা গলায় বিঁধে না যায়।
-
খাবারটি যথেষ্ট সেদ্ধ হয়েছে কিনা বা ফলটি যথেষ্ট নরম কিনা যেন সেটা হজম হয়।
-
এ বয়সে কলা সবসময় নিজের হাতে খাওয়াবেন। কলার বড় টুকরো গলায় বিঁধলে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
-
শিশুর হাতে যে খাবারটি দিচ্ছি সেটি সে ময়লা মেখে খেয়ে নিল কি'না।
-
দুপুরের পরে শিশুকে ফল জাতীয় খাবার খাওয়াবেন না।
-
ফর্মূলা মিল্ক রান্না করে খাওয়াবেন না।
-
এ বয়সে শিশুকে বাদাম খাওয়ালে কখনোই সেটা গুড়ো না করে খাওয়াবেন না।
-
এ বয়সে শিশুকে মধু খাওয়ানো যাবেনা কারণ মধুতে থাকা ব্যাকটেরিয়া এই বয়সী শিশুর জন্য ক্ষতিকর।।
-
এ বয়সে শিশুর কোষ্ঠকাঠিন্য বা গ্যাস স্বাভাবিক। এমন হলে অতিরিক্ত আয়রণযুক্ত ফল বা সব্জি যেমন আনার বা কাঁচা কলা খাওয়াবেন না। তবে স্বাভাবিক হলে আনার খাওয়ানো ভালো কারণ এতে রক্ত বৃদ্ধি করে।
-
সলিড খাবার খাওয়ানোর সাথে সাথেই বেশী পানি খাওয়াবেন না। এতে করে পেটে গ্যাসের সৃষ্টি হয়। বরং খাওয়ার ৫/১০ মিনিট আগে তাকে অল্প পানি খাওয়াতে পারেন। খাওয়ার পরেই অল্প পানি খাওয়াবেন যেন গলা শুঁকিয়ে না যায় বা খাবার গলায় বিঁধে না যায়। খাওয়ার ১০ মিনিট পর তাকে পানি খাওয়াবেন।
-
এ বয়সে দিনে দুই বা তিন প্রজাতির ফল এবং দুই বা তিন প্রজাতির সব্জি খাওয়ানো যাবে। কাঁচা ফল ভালোকরে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নেবেন।
-
সব্জি সঠিক তাপমাত্রায় পর্যাপ্ত সেদ্ধ করবেন।
চেষ্টা করেছি একটি সার্বিক এবং সাধারণ দিক নির্দেশনা দিতে যেন মায়েরা উপকৃত হন। তবে কিছুদিন পর পর শিশুকে ডাক্তারের নিকট সরাসরি নিয়ে গিয়ে দিক নির্দেশনা নিয়ে আসা উত্তম। কারণ সকল শিশুর শারীরিক গঠন চাহিদা এক নয়। আগামী পর্বে ১-২ বছর বয়সী শিশুর খাদ্য তালিকা এবং খাবার সংক্রান্ত খুঁটিনাটি নিয়ে কথা হবে।