শিশুর কানে সংক্রমণ : প্রতিরোধ ও প্রতিকার
শিশুর কানে সংক্রমণ হলে অনেক সময় বড়রা টের পান না। আর শিশুও তা বলতে পারে না। এমন সময় বেশ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় শিশুকে। এজন্য নিয়মিত শিশুর কান পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
কানে ব্যথা বা কানে প্রদাহ হবার অন্যতম প্রধান কারণ হল সংক্রমণ। প্রধানত ব্যাকটেরিয়া ঘটিত ইনফেকশন এর কারণে মধ্য কর্ণ বা মিডল ইয়ারে ব্যথা হতে পারে। তবে কখনো কখনো ভাইরাসঘটিত ইনফেকশন থেকেও কানে ব্যথা হতে দেখা যায়। যে কোনো মানুষের যেকোনো বয়সে কানে সংক্রমণ হতে পারে, তবে শিশুদের এ সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি ৬ জন শিশুর অন্তত ৫ জন জন্মের পর ৩ বছর বয়সের মধ্যে অন্তত একবার কানে ব্যথা, কান থেকে পুঁজ পড়া, কান লাল হয়ে যাওয়া এইসব সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসে। ডাক্তারি পরিভাষায় কানের ইনফেকশনকে অটাইটিস মিডিয়া (Otitis Media) বলা হয়।
শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয় - কেন?
বেশ কয়েকটি কারণে বড়দের চেয়ে শিশুরা এই সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হয়।
-
অপেক্ষাকৃত ছোট এবং আনুভূমিক ইউস্টেশিয়ান টিউব (কান থেকে গলের ভেতর একটা সরু রাস্তা খোলে)। ফলে সহজেই শ্বাসতন্ত্র থেকে ব্যাকটেরিয়া মধ্য কর্ণে বিস্তার ঘটায়। কোনো কারণে ইউস্টেশিয়ান টিউব ফুলে গেলে বা ব্লক হয়ে গেলে কান থেকে তরল পদার্থ নিষ্কাশনের সুযোগ পায় না। ফলে তা জমে জমে এক সময় পুঁজে রূপান্তরিত হয়।
-
বাচ্চাদের অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইমিউন সিস্টেম। ফলে সহজেই বাচ্চারা ঠাণ্ডাজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়।
সংক্রমণের কারণ
বেশির ভাগ সময়েই দেখা যায় শিশুর কানে ব্যথা হবার দুই এক সপ্তাহ আগে গলায় ব্যথা, সর্দি কাশি, জ্বর, ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা বা শ্বাসনালী সংক্রমণের হিস্ট্রি থাকে।
শ্বাসনালীতে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হলে তা শ্বাসতন্ত্র হয়ে মধ্য কর্ণে চলে যেতে পারে। ফলে মধ্যকর্ণে ব্যাকটেরিয়াল কলোনি তৈরি হয় এবং এ থেকে পরবর্তীতে পুঁজ জমা হয়। যা ক্রমাগত কানের পর্দার উপর চাপ সৃষ্টি করে। ফলে কানে ব্যথা অনুভূত হয়। কানের পর্দা ক্রমাগত চাপের ফলে নেক্রোসিস হয়ে এক পর্যায়ে ফেটে যেতে পারে। ফলে ভেতর থেকে পুঁজ বাইরে বেরিয়ে আসে।
সংক্রমণের উপসর্গ
-
জ্বর
-
কানে ব্যথা
-
বার বার কানে হাত দেয়া বা কানের লতি ধরে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করা
-
কোনো কারণ ছাড়াই সারাক্ষণ কান্না করা
-
খেতে না চাওয়া
-
খাবার গিলতে অসুবিধা
-
ঘুমে অসুবিধা
-
বার বার ঘুম ভেঙে কান্না করা
-
কান থেকে পুঁজ বা রক্ত পরা
-
ডাকলে সাড়া না দেয়া
-
অতিরিক্ত খিটখিটে স্বভাব
বাচ্চার বয়স যদি দেড় বছর বা তার চেয়ে বেশি হয় তাহলে কানে ব্যথা, কানে ভোঁ ভোঁ করা বা এ ধরনের কিছু বলে বাচ্চা তার সমস্যা বাবা মাকে বোঝাতে পারে। কিন্তু তার চেয়ে ছোটো বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়েই শিশুর হাব ভাব, হাঁটাচলা, খেলাধুলায় অস্বাভাবিকতা দেখে সমস্যার ধরণ বোঝা যায়।
পরবর্তী জটিলতা
পুঁজ বেরিয়ে আসার পর যদি ঠিকভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, তবে অচিরেই ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আস্তে আস্তে মধ্য কর্ণ তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরে পায়।
কিন্তু যদি ঠিকভাবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, সেক্ষেত্রে মধ্য কর্ণে ইনফেকশন রয়ে যেতে পারে। যা থেকে ক্রনিক অটাইটিস মিডিয়া বা সিএসওএম (CSOM) হতে পারে। এছাড়াও ধীরে ধীরে সেখান থেকে ইনফেকশন ম্যাস্টয়েড এয়ার সেল হয়ে মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পরে। পরবর্তীতে এ থেকে ম্যাস্টয়েডাইটিস (Mastoiditis), সাব পেরিওস্টিয়াল অ্যাবসেস (Sub periosteal abscess), ব্রেইন অ্যাবসেস (Brain abscess) হতে পারে।
প্রতিকার
-
কানে ব্যথা হলে অনেকেই কটন বাড দিয়ে কানে খোঁচাখুঁচি করেন কিংবা টর্চ লাইট দিয়ে কানের ভিতরটা দেখতে চেষ্টা করেন। এতে করে বরং হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনাই বেশি।
-
বাচ্চার কানে ব্যথা হলে কিংবা কানের ভিতরটা ভেজা ভেজা মনে হলে দেরি না করে একজন ইএনটি স্পেশালিষ্ট নিদেনপক্ষে নিকটস্থ একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। চিকিৎসক অরাল টয়লেটিং (Aural toileting) অর্থাৎ কানের ভেতরটা পরিষ্কার করে পুঁজমুক্ত করার পর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ফুল কোর্স এন্টিবায়োটিক সেবন করতে হবে। ব্যথা বেশি হলে ব্যথা কমানোর জন্য হালকা পেইন কিলার বা প্যারাসিটামল দেয়া যেতে পারে। সাথে এন্টি হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ দেয়া হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কানের পর্দা ফেটে গেলে তা মেরামত করার জন্য মাইরিংগোপ্লাস্টি করা হয়।
-
এছাড়া ঘরোয়া পদ্ধতি হিসেবে হালকা গরম সেঁক দেয়া যেতে পারে। শিশু আরাম বোধ করলে দিনে কয়েকবার সেঁক দিতে পারেন।
-
শিশুকে প্রচুর পানি, তরল খাবার, স্যালাইন খাওয়াতে হবে। কানের ভেতর জমে থাকা পুঁজ যেন সহজে বের হয়ে যেতে পারে তার জন্য মাথাটা বালিশ দিয়ে একটু উঁচু করে রাখতে পারেন।
-
এ কথা মাথায় রাখতে হবে যে, কোনো ভাবেই কোয়াক বা নিজের খেয়াল খুশিমতো এন্টিবায়োটিক বা অন্য কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না অথবা কোনো ঘরোয়া টোটকা ব্যবহার করা যাবে না।
প্রতিরোধ
কানের সংক্রমণ হবার কিছু পূর্বশর্ত বা রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে। বার বার কানে ইনফেকশন যেন না হয় তার জন্য কিছু সতর্কতা মেনে চলতে হবে। যেমন -
-
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাক্সিন - বর্তমানে আমাদের দেশে ইপিআই শিডিউলে পিসিভি (PCV) ভ্যাক্সিন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। শিডিউল অনুযায়ী সকল টিকা সঠিক সময়ে শিশুকে দিতে হবে। প্রয়োজন হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রতি বছর ফ্লু ভ্যাক্সিন নেয়া যেতে পারে।
-
বাবা মা বা পরিবারের মধ্যে কেউ যদি ধূমপায়ী হয়, তাহলে সেসব শিশুর বার বার কানে ইনফেকশন হবার সম্ভাবনা থাকে। তাই সিগারেটের ধোঁয়া থেকে শিশুকে দূরে রাখতে হবে।
-
যেসব বাচ্চা পর্যাপ্ত মায়ের বুকের দুধ পায় না, তাদের ক্ষেত্রে ফিডার বা Bottle feeding একটি বিকল্প পদ্ধতি। কখনোই ফিডার মুখে দিয়ে বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করবেন না। বাচ্চাকে বসিয়ে ফিডার খাওয়াতে হবে।
-
বাচ্চাকে বার বার হাত ধোয়ার অভ্যাস করাতে হবে। বাচ্চার বাবা মায়েরও শিশুকে স্পর্শ করার আগে হাত ধুয়ে নিতে হবে অথবা হাত জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। এতে করে জীবাণুর বিস্তার কমবে। ফলে বাচ্চার ঠান্ডাজনিত রোগ হওয়ার মাত্রা কমে যাবে।
-
বাচ্চার কান ও নাক সব সময় পরিষ্কার রাখুন।
-
কান পরিষ্কার করতে গিয়ে কটন বাড, কাঠি বা আঙুল দিয়ে অযথা খোঁচাখুঁচি করবেন না। পাতলা সুতি কাপড় গিয়ে আলতো করে পরিষ্কার করুন। অতিরিক্ত ময়লা জমে গেলে ডাক্তারের দেওয়া কানের ড্রপ ব্যবহার করতে পারেন।
-
বাচ্চাকে অসুস্থ বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করতে দেয়া যাবে না। ঠাণ্ডাজনিত যেসব রোগ থেকে পরবর্তীকালে কানের সংক্রমণ হতে পারে, সেসব রোগ খুবই ছোঁয়াচে ধরনের হয়ে থাকে। শিশুদের ইম্যুনিটি কম হওয়ার কারণে তারা সহজেই এসব রোগে আক্রান্ত হয়। অসুস্থ খেলার সাথীদের হাঁচি কাশির মাধ্যমে তারা খুব দ্রুত সংক্রমিত হতে পারে।
অনেক সময়েই কানে ব্যথা ২/৩ দিন পর আপনা আপনিই চলে যায়। আবার অনেকের ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক সেবন করে সম্পূর্ণ সুস্থ হবার পরও বার বার ইনফেকশন হতে পারে। তাই বাচ্চার কানে কোনো ধরনের সমস্যা হলে সময় নষ্ট না করে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়াই ভালো হবে। পরবর্তীতে সংক্রমণ থেকে যেন স্থায়ী এবং দীর্ঘমেয়াদী কোনো সমস্যার সৃষ্টি না হয় সেজন্য আগে থেকেই সতর্ক থাকতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।