শিশুরা যে ৫ টি কারনে মিথ্যা কথা বলে!
বাচ্চাদের মিথ্যা বলার কারণ কি হতে পারে এবং তা কতটুকু ক্ষতিকর? আর এই বিষয়ে বাবা মার কি করণীয়? আসুন জেনে নেই বাচ্চাদের মিথ্যা বলা থেকে কিভাবে রোধ করা যায় এবং এর বিকল্প সমাধান কি হতে পারে।
বাস্তবিকভাবেই মানুষের সবচেয়ে নিষ্পাপ রূপটি হলো তার ছোট বেলা। একটি শিশু যখন নতুন কথা বলা শিখে তখন তার বলা প্রতিটি কথাই আমাদের রোমাঞ্চকর করে আর আমরা আধো আধো কথাগুলো শুনে খুবই আনন্দ পাই। কোন কোন ক্ষেত্রে বাচ্চা তার দাবী আদায়ের জন্য নিজের মনের মত বানিয়ে হরেক রকম কথা বলছে বুঝেও তাদের বলা মিথ্য কথাগুলোও আমাদের আদর লাগে। কত কিউট করে কথা বলছে ভেবে আনন্দ পাই। কিন্তু আস্তে আস্তে বড় হবার সাথে সাথে এই মিথ্যা বলার প্রবণতা বেড়ে যায়। অথচ মিথ্যা বলার কারণগুলো থাকে খুবই তুচ্ছ, কারণ বাচ্চারা তো আর ঘটনার গুরুত্ব বুঝে না। কিন্তু আমরা বাবা মারা যদি এই ব্যাপারে সতর্ক না হই তবে এই মিথ্যাগুলোই চিন্তার কারণ হয়ে দাড়াবে।
চার বছরের ছোট্ট শিশু অভি। খুব সুন্দর গল্প বলে সে। ওর বাবা মা খুব ছোট থেকেই নানা রকম গল্প শোনাতো অভিকে। অভির মত বাচ্চারা সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য অত বুঝে না, তবে তাদের কল্পনা শক্তিও থাকে প্রবল। আর তাই তারা তাদের খেয়াল খুশি মত গল্প বানায় ও কথা বলে। পরবর্তীতে সেটাই মিথ্যা কথায় রূপ নেয়। অভিরা তখন তাদের কল্পনায় একটা আলাদা জগৎ গড়ে তুলে। বাস্তবতার সাথে হয়তো কোন রকমই মিল থাকে না। আগেই বলেছি এমনটা হবার কারণ তারা সত্য মিথ্যার পার্থক্যই বুঝে উঠতে পারে না।
তাদের কল্পনায় মানুষ চাইলেই মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে আকাশে উড়তে পারে বা খরগোশের মত পারে ছুটতে। কখনও কখনও আকাশ থেকে পরীও নেমে আসে ওদের সাথে খেলা করে। কিংবা একটু শাসন করলেই বাবা মাকে জম্বির (খুব ভয়ানক কিছু) মত করেও চিন্তা করে।
কত বছর বয়স থেকে মিথ্যা কথা বলতে পারে শিশুরা
১৮৭৭ সালে প্রকৃতি, ভূতাত্ত্বিক ও জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন বলেন, একজন ৩০ মাস বয়সী বাচ্চাও মিথ্যা কথা বলতে পারে। কারণ তিনি উনার নিজের সন্তানের মাঝেই এই ধরনের প্রবণতা খেয়াল করেছেন।
ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এক জরিপের সমীক্ষায় দেখেন যে, ২ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৬৫% এবং ৪ বছর বয়সী বাচ্চাদের মধ্যে ৯৪% বাচ্চারা একবার হলেও মিথ্যা কথা বলে।
শিশুরা মিথ্যার আশ্রয় নেয় কেন?
শিশুরা যেখানে অনেক কথার গুরুত্ব ঠিক মত বুঝে না সেক্ষেত্রে মিথ্যা কথা কেন বলে?
অবশ্যই এই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা জরুরি। বাচ্চাদের মিথ্যা বলার একাধিক কারণ থাকতে পারে আর এই কারণগুলো হলো -
গ্রহণযোগ্যতা লাভের জন্য
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাচ্চারা নিজের বড়দের নিকট গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে ও মনোযোগ আকর্ষণের জন্য মিথ্যা বলে থাকে। কারণ বড়রা বাচ্চাদের সব রকম কথাতেই মজা পায় ও প্রশ্রয়ও দিয়ে থাকেন তাই বাচ্চাদের মনে হতে শুরু করে বড়দের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারলেই তার গ্রহনযোগ্যতা বাড়বে।
আবার যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করে তখন বন্ধু মহলে নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা প্রমাণ করার জন্য ও মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কোন কোন ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় নেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নানা রকম অবহেলার স্বীকার বাচ্চাটির মাঝেই এই রকম প্রবণতা দেখা যায়।
সাধারণত নিজেদের ভুল ত্রুটি আড়াল করতেই বাচ্চারা মিথ্যা কথা বলে এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতেই এমনটা করে থাকে।
বাবা মার প্রত্যাশানুযায়ী কাজ না করলে
ভুলবশত অন্যায় করে বাবা মার শাস্তির হাত থেকে বাঁচার জন্য বাচ্চা মিথ্যা বলা শুরু করে। যে সব বাবা মা তার বাচ্চাটিকে খুব শাসন করেন এবং খুব প্রত্যাশা রাখেন বাচ্চার উপর সে সব পরিবারের শিশুরাই বাবা মার প্রত্যাশানুযায়ী কিছু করতে না পারলে মিথ্যার আশ্রয় নেয় নিজেকে বাঁচাতে।
যেমন - পরীক্ষায় বাবা মার প্রত্যাশানুরূপ রেজাল্ট করতে না পারলে বাবা মা কষ্ট পাবে এটাবুঝে তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয়।
মনগড়া গল্পের বাস্তব রূপ দিতে
বাচ্চারা তার মনের মত করে একটা জগৎ তৈরি করে এবং সেই কল্পনা থেকে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে আনন্দ পায়। তাদের কল্পনার জগতে ঘটে তাই বলে ও ভাবতে পছন্দ করে। মিথ্যাগুলোকেই সত্য ধরে নিয়ে চিন্তা করতে থাকে। বেশিরভাগ বাচ্চারই সত্য মিথ্যার পার্থক্য বুঝে না। আর তাই নিজের মত করে মনগড়া গল্প সাজায়।
কোন কাজ এড়িয়ে যেতে চাইলে
বাচ্চারা সাধারণত তার উপর অর্পিত দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে মিথ্যার আশ্রয় নেয়।
যেমন - অনেক বাচ্চাই দুধ খেতে পছন্দ করে না তখন নানা রকম বাহানা খোঁজে দুধ না খাওয়ার। আমার নিজের বাচ্চার কথা যদি বলি বাহানা তো করতোই মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে দুধ ফেলে দিয়ে বলতো সরি পরে গিয়েছে।
অনেক বাচ্চার দাঁত ব্রাশ করতে অনীহা। তখন তারা নানা রকম অজুহাত খুঁজে ব্রাশ বা করার।
শাস্তির ভয়ে মিথ্যা বলে
শাস্তি পাবার ভয়ে বাচ্চারা মিথ্যার আশ্রয় নেয়। যেমন - কোন কিছু ভেঙে গেলে বা তার দ্বারা নষ্ট হলে বাবা মা বকা দিবেন সেই ভয়ে বাচ্চারা শাস্তি থেকে বাচাঁর জন্য মিথ্যা কথা বলে।
বিভিন্ন গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, মিথ্যা বলার জন্য শাস্তি দেবার চেয়ে সত্য কথা বলার জন্য তাদপর পুরস্কৃত করলে সেটা অধিক কার্যকরী হয়।
বাচ্চারা যাতে মিথ্যা না বলে সেক্ষেত্রে বাবা ও মার কি কি করণীয়
প্রথমত বাবা মাকে বাচ্চাদের মিথ্যা বলার যথাপোযুক্ত করন কি হতে পারে সেটা অনুসন্ধন করতে হবে। আর সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। পদক্ষেপ গুলো কি হতে পারে নিচে আলোচনা করা হলো।
-
আত্মবিশ্বাসের অভাব ও নিরাপত্তার অভাবে বাচ্চা মিথ্যা বলে থেকে। তাই এইক্ষেত্র বাচ্চাটিকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে হবে।
-
সব কিছুকে সহজভাবে মেনে নেয়ার মানসিকতা যাতে বাচ্চাদের থাকে সেই বিষয়ে অনুপ্রাণিত করতে হবে।
-
মিথ্যা বললে তাকে বকাঝকা না করে আদর করে কাছে ডেকে নিয়ে মিথ্যা বলার কারণ জিজ্ঞাসা করতে হবে আর এই মিথ্যর ক্ষতিকর দিকগুলো কি হতে পারে সে বিষয়ে তাদের বুঝাতে হবে।
-
স্কুলে যাওয়া শুরু করার আগেই শিশুদের সত্য এবং মিথ্যা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে বাবা-মাকে। তখন মিথ্যা বললে কি কি সমস্যা হতে পরে এটা চিন্তা করেও তারা মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকবে।
-
রূপ কথার গল্প বাচ্চারা বেশি পছন্দ করে তাই রূপকথা গল্পের পাশাপাশি শিক্ষণীয় গল্পও তাদের শুনাতে হবে।
-
বাচ্চাদের অনেক বড় বড় মিথ্যা আমরা ছোট বলে হেসে উড়ায় দেই বা গুরুত্ব দেই না। এর ফলে পরবর্তীতে নিঃসংকোচে তারা মিথ্যা কথা বলে। তাই মিথ্যা কথাকে হেসে না উড়িয়ে কেন মিথ্যাটা উচিত হয়নি এই বিষয়টা তাদের বুঝাতে হবে।
-
সত্য কথা বলার জন্য বাচ্চাকে উৎসাহিত করতে হবে প্রয়োজনে পুরস্কৃতও করতে হবে।
-
আমরা বড়রাও যাতে বাচ্চাদের সাথে ও সামনে মিথ্যা কথা না বলি সেই দিকে নজর রাখতে হবে।
-
বাচ্চাটি যাতে কোন ভাবেই নিজেকে অবহেলিত মনে না করে। কারণ এটা মনে হলেই তারা সত্য বা মিথ্যা কথা দিয়ে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে।
-
সত্য কথা ও মিথ্যা কথার পার্থক্য যে বাচ্চারা বুঝবেনা এটাই স্বাভাবিক। মিথ্যা বলার কুফল থেকে কি কি সমস্যা হতে পারে সে বিষয়েও তাদের সচেতন করতে হবে।
-
নিজের কাজে ফাঁকি দেবার জন্য তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয়। যেমন স্কুলের বাড়ির কাজ করে তাকে কার্টুন দেখতে বলা হলেও সে আগে কার্টুন দেখতে বসে এবং একটা সময় বাড়ির কাজ করার কথা ভুলেই যায়। সেক্ষেত্রে তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে কার্টুন দেখাটা যেমন তার জন্য খুব পছন্দের তেমনি স্কুলের বাড়ির কাজটি সম্পূর্ণ করাটাও জরুরি এটা ঠান্ডা মাথায় বুঝাতে হবে।
-
বাচ্চার সাথে বাবা মার যোগাযোগটা যেন থাকে বন্ধুত্ব সুলভ সেদিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। তারা গুরুত্ব বাবা মার কাছে সবার আগে এটা বুঝাতে হবে।
-
অনেক সময় বাচ্চাদেরা নতুন পরিবেশে খাপখাওয়াতে সমস্যা হয়। কিন্তু বুঝাতে পারে না কি সমস্যা হয়। সেক্ষেত্রে বাচ্চাটিকে ঠিক মত পর্যাবেক্ষন করতে হবে। সে ঠিক আছে বললে অনেক কিছু এড়িয়ে যেতে চায়। তাই বলে সব ঠিক আছে তা নাও হতে পারে। সেজন্যই তাদেরভালো করে খেয়াল করলেই বুঝা যাবে সমস্যা আছে কি না।
বাচ্চাটি যখন তার মনের কথাটি বুঝে বলতে পারে না ও কল্পনার জগতটাকে অধিক নিরাপদ মনে করে তখন থেকেই শুরু হয় মিথ্যা বলা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মিথ্যা বলার হার বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে বাবা মার তার সন্তানের প্রতি উদাসীনতাও অনেকাংশে দায়ী। তাই বাবা মার সাথে ভালে মন্দ সব কিছু যাতে একটা বাচ্চা শেয়ার করতে পারে সেই সুযোগ তাদের দিতে হবে। এমনকি তাদপর কাল্পনিক চিন্তাগুলোও যাতে শেয়ার করতে পারে বাচ্চারা তাই মনোযোগ দিয়ে ওদের কথা শুনতে হবে। সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বুঝাতে অগ্রণী ভূমিকা বাবা মাকেই নিতে হবে।