আপনার মেয়েকে প্রথম পিরিয়ডের জন্য যেভাবে প্রস্তুত করবেন
একজন মা হিসেবে আপনি নিশ্চই জানেন যে পিরিয়ড বা মাসিক নারীদের জীবনের কতটা গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। তাই মেয়ের প্রথম পিরিয়ড সম্পর্কে তাকে সচেতন করুন এবং মানসিকভাবে সাপোর্ট দিন।
ঋতুস্রাব, রজঃস্রাব, মাসিক বা পিরিয়ড যে নামেই ডাকুন না কেন আসলে সবগুলির অর্থ একই। পিরিয়ড নারী শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মূলত মাসিক হওয়ার মাধ্যমেই একজন নারী মা হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে। এক্ষেত্রে ঋতুস্রাব হওয়ার আগে মেয়েদের ভিতর কিছু শারীরিক পরিবর্তন, যেমন-
-
দেহের নানা স্থানে লোম হওয়া,
-
স্তন কিছুটা দৃশ্যমান হওয়া এবং
-
যৌনাঙ্গ দিয়ে অল্প করে তরল নির্গমন হওয়া ইত্যাদি দেখা দেয়।
সেক্ষেত্রে আপনার মেয়ের মধ্যে এই তিনটি লক্ষণ দেখা দিলে তাকে পিরিয়ড সম্পর্কে আগাম ধারণা দিবেন। আর এরই ফলশ্রুতিতে আপনার মেয়েকে প্রথম পিরিয়ডের জন্য প্রস্তুত করতে আপনি যেসব পদক্ষেপ অনুসরণ করতে পারেন, তা হল-
পিরিয়ড সম্পর্কে ধারণা দিন
আপনার মেয়ের মাসিক হওয়ার আগেই তাকে সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিন। মূলত আপনি যদি তখন তাকে পিরিয়ড সম্পর্কে সচেতন না করেন, তবে সে অন্য কোন মাধ্যম থেকে শুনে ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠবে। আর এর প্রভাব ভালো নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রথমেই তাকে তার বয়ঃসন্ধিকাল সম্পর্কে বলুন। তারপর মাসিক নিয়ে তাকে একটি বেসিক ধারণা দিন। সেক্ষেত্রে তাকে পিরিয়ড কী, কেন হয়, তখন কেমন অনুভূতি হয়, শারীরিক কি কি পরিবর্তন হয়, কেমন টাইপের ব্লিডিং হবে ইত্যাদি জানিয়ে রাখুন। এতে পরবর্তীতে তার ঋতুস্রাব শুরু হলে সে আতঙ্কিত ও শঙ্কিত হয়ে পড়বে না।
পিরিয়ডকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখতে বলুন
আমাদের দেশে অনেক বছর ধরেই ঋতুস্রাবকে ট্যাবু বানিয়ে রাখা হয়েছে। তাইতো শুরুতেই এটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয়ার মন-মানসিকতা তৈরি করতে হবে। তাকে সচেতন করা ভালো, তবে তা করুন বাস্তবসম্মত উপায়ে।
আপনি আপনার সন্তানের সাথে এই ব্যাপারে খোলাখুলি আলোচনা করুন। আপনার মেয়েকে এই বলে বুঝান যে, মাসিক একটি সহজ ও স্বাভাবিক বিষয়। একজন কন্যাশিশুর নারী হয়ে উঠার প্রথম ধাপ এটি, আর পরবর্তীতে যা মা হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। এতে অঝথা ভয়ের কিছু নেই, বরং এটা নারীত্বের একটি প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
কিশোরীর প্রথম পিরিয়ড স্বাস্থ্যসম্মত হতে যা করণীয়
পিরিয়ডের সময়কার হাইজিন কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে তা জানান
আপনার কন্যা শিশুকে মাসিক হলে তার কি করতে হবে, কিভাবে প্যাড ইউজ করতে হবে, কিভাবে হাইজিন মেনে চলতে হবে তা সম্পর্কে বুঝিয়ে বলুন। মূলত পিরিয়ডের সময়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং সচেতন থাকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এতে অসচেতন হলে এবং সঠিক হাইজিন মেনে না চললে জরায়ুতে ক্যান্সারসহ অনেক ভয়াবহ রোগ হতে পারে। তাইতো পিরিয়ডের সময় ৫-৬ ঘন্টা পর পর প্যাড চেঞ্জ করা, পরিষ্কার সুতির অন্তর্বাস পরা, হালকা গরম পানিতে ভালো করে গোসল করা ইত্যাদি মেনে চলতে হবে।
পিরিয়ডের সময়কার বিষণ্ণতা কিংবা মুড সুইং সম্পর্কে অবগত করুন
আপনার সন্তানকে ঋতুস্রাবের সময় হওয়া হতাশা, বিষণ্ণতা, মানসিক বিষাদ, মুড সুইং, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সম্পর্কে আগাম ধারণা দিন। সেসময় তার মন খারাপ দূর করতে কি কি করতে হবে সে সম্পর্কেও বুঝিয়ে বলুন।
তবে প্রথম পিরিয়ডে কন্যা শিশুর কাছে ব্লিডিং আর তলপেটে ব্যাথাটাই প্রধান সমস্যা হয়ে দাড়ায়। সেক্ষেত্রে আপনার মেয়েকে বুঝিয়ে বলুন যে, এটা স্বাভাবিক এবং হরমোনের তারতম্যের কারণেই তা হচ্ছে। এই সময় তাকে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে বলতে পারেন। কেননা হাঁটার ফলে দেহে হরমোনাল রিসাইক্লিংয়ের পাশাপাশি মস্তিষ্ক থেকে এন্ডোরফিন নির্গত হয়, আর যা কিনা মনে এক ধরনের সুখানুভূতি তৈরি করে এবং মানসিক অবসাদ কাটাতে সহায়তা করে।
আপনার নিজের পিরিয়ডের অভিজ্ঞতা মেয়ের সাথে শেয়ার করুন
মেয়ের সাথে আপনার নিজের প্রথম মাসিকের ঘটনা শেয়ার করুন। সেই সময় আপনার কেমন লেগেছিল, কি করেছিলেন, কেমন অনুভূতি হয়েছিল তা জানান। মূলত আপনার সেই সময়কার অভিজ্ঞতা এবং মজার কোন ঘটনা থাকলে, তা শেয়ার করুন। এতে আপনার কন্যা শিশু পিরিয়ডকে সহজ ভাবে নিতে পারবে। এছাড়াও এতে সে অনুধাবন করতে পারবে যে, ঋতুস্রাব একটি স্বাভাবিক শরীর বৃত্তিয় প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিটা নারীকেই যেতে হয়।
সব পরিস্থিতি মোকাবেলায় সহায়তা করুন
আপনার মেয়ের যে কোন জায়গায় যেমন ধরুন- স্কুলে, কোন অনুষ্ঠানে, ঘুরতে গেলে মানে বাইরের যেকোন জায়গায়ই মাসিক শুরু হতে পারে। আর তাই সেক্ষেত্রে আগে থেকেই মেয়েকে প্রস্তুত করুন। সে যাতে ঘাবড়ে না গিয়ে পরিস্থিতি সামলে নিতে পারে। সেজন্য আপনি যা করবেন তা হল- মেয়ের ব্যাগে বাড়তি স্যানিটারি ন্যাপকিন, প্যান্টি রেখে দিবেন এবং তাকে তা কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তা জানিয়ে দিবেন। আবার তার যদি স্কুল চলাকালীন সময়ে মাসিক শুরু হয়, তবে সে যাতে স্কুলের কোন আয়া কিংবা মহিলা শিক্ষকের হেল্প নিতে পারে তা নিশ্চিত করুন। এক্ষেত্রে আপনি তার স্কুলের আয়া কিংবা টিচারের সাথে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে পারেন।
পেট ব্যথার করণীয় সম্পর্কে জানিয়ে রাখুন
ঋতুস্রাব হলে পেটে ও কোমরে যে তীব্র ব্যথা হয়, সেটাও আপনার মেয়েকে জানিয়ে রাখুন। তবে সবক্ষেত্রে ব্যথা নাও হতে পারে কিংবা প্রথম দুই-একদিন ব্যথা হতে পারে। আবার অনেকের পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগে থেকেই যন্ত্রণাদায়ক ব্যথা হয়। আর একে প্রিমেনস্ট্রুয়াল সিনড্রোম বলে। সেক্ষেত্রে মাসিকের সময় হালকা ব্যায়াম কিংবা সাধারণ গতিতে ৪০-৫০ মিনিট হাঁটলে এ সময়কার তলপেটে ব্যথা ও ব্যাক পেইন কমে যাবে। আবার হট কম্প্রেশনও ব্যথা কমাতে সহায়তা করে। তবে অতিরিক্ত রক্তপাত, তীব্র ব্যথাসহ যেকোনো জটিলতা দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কেউ যেন কোন প্রকার বিদ্রূপ না করে তা নিশ্চিত করুন
প্রথম পিরিয়ডের সময় একজন কিশোরীর মনে এমনিতেই অনেক ভয়, শঙ্কা, লজ্জা, দ্বিধা কাজ করে। আবার অনেকেই অন্যভস্তার কারণে জামায় দাগ লাগিয়ে ফেলতে পারে। সুতরাং মাসিক চলাকালীন সময় যদি তাকে কেউ বুলিং করে, বকা দেয় বা লজ্জা দেয়, তাহলে তা তার মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে অনেক বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। তাই, এই সময় আপনার কন্যাশিশু যাতে কোন ভাবেই বিদ্রূপের স্বীকার না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
নাটকীয়তা করবেন না
অনেক সময় দেখা যায় কোন কোন বাবা-মা মেয়ের পিরিয়ড নিয়ে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন সবাইকে জানানোর চেষ্টা করেন। তাই আপনার মেয়ে যে "একজন নারী হয়ে উঠেছে!" সব জায়গায় এই কথাটি ছড়িয়ে দিবেন না।
আপনার মেয়ে জীবনের একটি নতুন এবং অপরিচিত পর্বের মধ্যে সবেমাত্র যাত্রা শুরু করেছে এবং ইতিমধ্যেই এটি নিয়ে সে বিভ্রান্ত বা বিচলিত। তাই যেকোন ধরণের অতিরঞ্জন কথা তার জন্য কেবল ক্ষতিই বয়ে আনবে।
কোন কিছু চাপিয়ে দিবেন না
মেয়ের উপর এমন কিছুর নিষেধাজ্ঞা দিবেন না যাতে সে ভয় পেয়ে যায়। পিরিয়ডের সাথে সাথেই আপনার মেয়ের কিশোরীদের মত জীবনধারা এবং আচরণে আমূল পরিবর্তনের আশা করা এড়িয়ে চলুন। তাকে ফিজিক্যাল একটিভিটি বা খেলাধুলা করতে নিষেধ করবেন না। তাকে জানতে দিন যে এটি অভ্যস্ত হতে সময় লাগতে পারে এবং ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে সতর্ক থাকতে হবে। তবে আপনার মেয়েকে আশ্বস্ত করুন যে সে যা করত তার সবকিছুই এখনও চালিয়ে যেতে পারবে।
আপনার সন্তানের প্রথম পিরিয়ড উদযাপন করুন
আপনার মেয়ের প্রথম পিরিয়ড উদযাপন করতে পারেন। সে যে বড় হয়ে যাচ্ছে, একজন মেয়ে থেকে নারীতে রূপান্তরিত হচ্ছে, তা সেলিব্রেশন করতে পারেন। এতে পারিবারিক ভাবে কেক কেটে কিংবা ভালো কিছু রান্না করে অথবা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে তাকে তার পছন্দের খাবার খাওয়াতে পারেন। এমনকি তাকে নতুন জামা, গল্পের বই, চকলেট কিংবা তার পছন্দের কোন কিছু তাকে গিফট দিতে পারেন। এতে পরিবারের সবার সাপোর্ট পেলে, তার মাসিক নিয়ে কোন ভয়ভীতি, উদ্বেগ, জড়তা ইত্যাদি থাকলে তা সহজেই দূর হয়ে যাবে।
শেষকথা
ঋতুস্রাব একজন নারীর স্বাভাবিক জীবনচক্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মাসিকের মাধ্যমেই একজন কিশোরী ধীরে ধীরে নারী হয়ে উঠে। সেক্ষেত্রে প্রথম পিরিয়ডের সময়টা মেয়েদের কাছে খুবই স্পর্শকাতর। সেজন্য কোনও ট্যাবুতে আটকে না থেকে, আপনার মেয়ের সঙ্গে এই বিষয়ে সরাসরি কথা বলুন।
আরও পড়ুনঃ
-
মাসিকের সময় তলপেটে তীব্র ব্যাথা! এন্ডোমেট্রিওসিস নয়তো?
-
সন্তান হতাশাগ্রস্ত হবার ৮ টি লক্ষণ ও দ্রুত মুক্তির উপায়!
-
সন্তান লালন পালনে মতবিরোধ! বাবা-মা কি করবেন?