শীতে শিশুর যত্ন নেবেন যেভাবে!

আপনি জানেন কি, অন্যান্য ঋতুর তুলনায় শীতকালে মানুষজন বেশী অসুস্থ হয়? আর শিশুরা এমনেতেই কোমলমতি হয়ে থাকে এবং তাদের যত্নে সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়। তাই শীতের এই সময়টাতে শিশুর বাড়তি যত্ন নেওয়া জরুরী।

সুরভী তিন মাস হল মা হয়েছে। মিষ্টি ও ফুটফুটে একটা বাচ্চা এসেছে সুরভী ও রাজিবের সংসারে। সারা দিনময় ব্যস্ত সবাই বাচ্চাটাকে নিয়ে। শুরুর দিকে ঠিক মত কোলেও নিতে পারতো না সুরভী। কিন্তু ওর ভাবনা; এত ছোট একটা মানুষ কিছু বলতে পারছে না, বুঝাতে পারছে না কি করে বুঝবে ওর কি দরকার। কিন্তু মায়েদের একটা অন্য রকম অনুভূতি থাকে তার সন্তানের প্রতি। তাই মধুরার ( সুরভীর মেয়ে) না বলা কথা সুরভী এখন ঠিক বুঝতে পারে। কখন কি লাগবে, কাঁদছে কেন, ক্ষিদা লেগেছে কিনা ইত্যাদি। 

কিন্তু কিছুদিন ধরে সুরভী কিছুটা দুশ্চিন্তায় আছে। শীত আসার পর থেকেই মধুরার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, কিছুটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। ত্বকটাও কেমন ফ্যাকাসে লাগছে। সুরভী ভেবে কুল পাছেনা যে এত যত্ন নেওয়ার পরও মধুরার কেন এমন হল! 

আসলে শীতকালে বাচ্চাদের একটু বাড়তি যত্নের প্রয়োজন হয়। কারন শীতের শুরুতে যখন আবহওয়ায় তাপমাত্রা কমতে থাকে তখনই জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, ত্বকের সমস্যা ইত্যাদি দেখা দেয়।

শীতের সময়টা শিশুর বিশেষ যত্ন সম্পর্কে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আল আমিন মৃধা বলেন, "শীতে শিশুরা সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, জ্বর, নিউমোনিয়ায় বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। শীতে আবহাওয়া শুষ্ক ও ধুলাবালু থাকার কারণে মূলত শিশুরা এসব রোগে আক্রান্ত হয়। এ সময়টা অভিভাবকদের কিছুটা সচেতন থাকতে হবে। শিশুদের ঠান্ডা বাতাস এবং ধুলাবালু থেকে দূরে রাখতে হবে। যেহেতু শীতে এ রোগগুলো সংক্রামিত হয়, তাই যতটা সম্ভব শিশুদের জনসমাগমপূর্ণ জায়গায় কম নেওয়া ভালো। শিশুদের গামছা, রুমাল, তোয়ালে প্রভৃতি আলাদা হওয়া উচিত। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির সময় শিশুদের দূরে রাখা।

আসুন জেনে নেই শীতকালে শিশুদের বাড়তি যত্নে আমাদের করণীয় কী কী?

দিনের বেলায় গরম আর রাতে ঠান্ডা?

শীতের সময় এমন কিছুদিন থাকে যেখানে দিনে গরম আবার রাতে ঠান্ডা অনুভব হয়। আর এই রকম আবহাওয়া বড় ছোট সকলেরই শরীর খারাপ বেশি হয়। কারণ শোবার সবয় ফ্যান ছাড়া প্রয়োজন হলেও ভোর রাতের দিকে আবার ঠান্ডাও লাগে। তাই এই সময় বড়দের সাথে সাঘে শিশুদেরও একটু বাড়তি যত্নের প্রয়োজন হয়। শোবার সময় অবশ্যই একটা কাঁথা বা পাতলা কম্বল নিয়ে শোয়া উচিত। ফ্যান একেবারে জোরে না দিয়ে আস্তে চালিয়ে দিন। রাতের বেলায় শিশুদের ক্ষেত্রে একটু বাড়তি নজর দিন।

ঘরের দরজা জানালা সবসময় বন্ধ করে রাখবেন না

শীতকালে ঠান্ডা বাতাস আসবে বলে আমরা দরজা জানালা সব বন্ধ করে রাখি। কিন্তু ঠান্ডা বাতাস আসলেও সবসময় দরজা জানালা আটকে রাখা উচিত না বরং তা সময় সময় খুলে দেয়া উচিত। এতে করে রোদ ও নির্মল বাতাস ঘরে ঢুকতে পারে। সকালের মিষ্টি রোদ মানব শরীরের জন্যও উপকারী। 

অসুস্থ সদস্য থেকে শিশুকে দূরে রাখা 

শীতকালে যেহেতু বড়রাও জ্বর, সর্দি, কাশি আক্রান্ত হন তাই অসুস্থ সদস্যের থেকে শিশুকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। কারন জ্বর, সর্দি কাশি ভাইরাসের আক্রমনের কারণে হয়ে থাকে। আর এই ভাইরাস সহজে সংক্রমিত হয়। তাই এই সময় শিশুকে ভারী জামা কাপড় পরিধান করাতে হয়। কারণ শিশুর সামান্য জ্বর, কাশি বা হাঁচিও কিন্তু সন্দেহজনক। তাই কাশি, শব্দ করে শ্বাস টানা, দুধ টেনে খেতে না পারা, শ্বাস নিতে কষ্ট বা পাঁজর নিশ্বাসের সঙ্গে বেঁকে যেতে থাকলে তাড়াতাড়ি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

উষ্ণ গরম পানির ব্যবহার করবেন

শীতকালে শিশুকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে গোসল করানো বা হাত মুখ ধোঁয়া  সব কিছুতেই উষ্ণ গরম পানি ব্যবহার করা উচিত। এ সময়  শিশুদের নানা কাজে  কুসুম গরম পানি  ব্যবহার করলে শিশুরা ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকবে। শীতেও শিশুকে নিয়মিত গোসল করাতে হবে। তবে দুপুর ১২ টার আগেই গোসলের পর্ব সেরে ফেলা উচিত। গোসলের পর বাচ্চার মাথা ও শরীর ভালো করে মুছে তারপর জামা কাপড় পরাবেন। তবে নবজাতক কিংবা ঠাণ্ডার সমস্যা আছে এমন শিশুর ক্ষেত্রে গরম পানিতে কাপড় ভিজিয়ে পুরো শরীর মুছে দিতে হবে। 

গরম পোশাক পরিধান করাতে হবে 

শিশুদের শীতকালে অবশ্যই গরম পোশাক যেমন, উলের তৈরি পোশাক পরানো উচিত। এতে শরীর গরম থাকে তবে চিকিৎসকের মতে শিশুদের সরাসরি উলের পোশাক পরানো ঠিক নয়। এতে উলের ক্ষুদ্র লোমে শিশুদের অ্যালার্জি হতে পারে। সুতি কাপড় পরিয়ে তার ওপর উলের পোশাক পরানো উচিত। গরম পোষাকটি অবশ্যই নরম ও আরামদায়ক যেন হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে গরম পোশাকে যাতে শিশুরা না ঘামে সে দিকে নজর রাখতে হবে। এতে করে ঘেমে ঠান্ডা লাগতে পারে।

শীতে শিশুর ত্বকের যত্ন 

বড়দের চেয়ে শিশুদের গায়ের চামড়া যেমন নরম হয় তেমনি অনেক সেনসেটিভও হয়। তাই শীতে অবশ্যই শিশুর ত্বকের বাড়তি যত্নের প্রয়োজন হয়। ভালো মান সম্পূর্ণ লোশন বা অলিভ অয়েল ব্যবহার করা উচিত। নারকেল তেল কিন্তু ভালো ময়েশ্চারাইজারের কাজ করে। শীতে আপনার শিশুর ত্বক বাঁচাতে ঘন ঘন ডায়পার পরিবর্তন করুন। ভেজা ডায়পার যত বেশি শিশুর ত্বকের সংস্পর্শে থাকবে ত্বকে ততবেশি ফুসকুড়ি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই শিশুর ডায়পার ভেজা অবস্থায় বেশিক্ষণ পরিয়ে না রাখাই ভালো।

শীতকালীন খাদ্য তালিকা

শিশুকে যাতে সহজে রোগে আক্রমণ করতে না পারে এমন খাবার খাওয়াতে হবে। সাধারণত শিশুদের ছয় মাস বয়স পর্যন্ত তার মায়ের বুকের দুধই তার জন্য পুষ্টি এবং অ্যান্টিবডিগুলির একমাত্র উৎস হিসেবে কাজ করে। মায়ের দুধ শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সর্দি, কাশি ও অন্যান্য সংক্রমণ রোগ থেকে দূরে রাখে। তাই আপনার বাচ্চাকে যতটা সম্ভব স্তন্যপান করান। ছয় মাস পর থেকে স্তন্যপানের সাথে সাথে বাচ্চাকে অন্যান্য পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে যেমন, খিচুড়ি ও খিচুড়িতে  ডিমের সাদা অংশ, লাল শাক, পালং শাক অল্প করে দিতে পারেন।

তবে শিশুর শীতের খাবার বেছে নিতে একটু বিবেচনা করে পছন্দ করতে হয়। এই শীতে শিশুদের খাবারে যেন গরম তরল জাতীয় খাবার থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে যাতে শিশুদের পানি শুন্যতা পূরণ হবে আর গরম তরল তাকে ঠান্ডা লাগা থেকে দূরে রাখবে।

শিশুদের মৌসুমী ফল ও শাকসবজি খাওয়াতে হবে।এছাড়া, শীতে শিশুরা অতিরিক্ত ভিটামিন সি পাবে এমন খাবার দিতে হবে। লেবু, কমলা, মাল্টা, আমলকী এসব ফল দেওয়া ভালো। তবে যারা চিবিয়ে খেতে পারে না, তাদেরকে ফলের রস করে খাওয়াতে পারেন।

সময়মত শিশুকে টিকা দিন

শীতকালে শুধু শিশুদের নয় বড় ও বয়স্কদের সহজেই ভাইরাসে আক্রান্ত হবার প্রবণতা দেখা যায়। তাই বলে শিশুর টিকার তারিখ থাকলে সেটাকে অবহেলা করা মোটেও ঠিক হবে না। সঠিক সময়ে সঠিক টিকাদান করলে তা শিশুকে  সারা জীবন সুস্থ রাখার ক্ষেত্রে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে সহায়তা করবে। সুতরাং, শিশুর টিকাদানের কোনও একটি সময়সূচীকেও এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।

শরীর খারাপের লক্ষণ গুলো এড়িয়ে যাবেন না

সাধারণত শীতকালে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে আর এতে তাদের সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকিও বেশি থাকে। আপনি যদি আপনার বাচ্চার ঘুমের সময় তাকে জোরে জোরে শাঁ শাঁ শব্দের সাথে শ্বাস ফেলতে, মারাত্মক কাশতে লক্ষ্য করেন অথবা শ্বাসকষ্ট জনিত অসুবিধা হতে দেখেন, সেক্ষেত্রে সে হয়ত কোনও সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনার উচিত হবে অবিলম্বে আপনার বাচ্চাকে তার চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া। আর যদি এটি একটি সাধারণ সর্দি,কাশি হয়ে থাকে এবং অবস্থাটি খুব তীব্র না হয় তবে আপনি ঘরোয়া প্রতিকারগুলি বেছে নিতে পারেন।

শীতে অন্যান্য যে সকল বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন

  • শীতের শুরুতেই শিশুর ব্যবহৃত গরম কাপড়, লেপ, কম্বল, কাথা, চাদর ইত্যাদি সব কিছু ব্যবহারেট আগেই রোদে দিতে হবে। রোদে রেখে ধুলা ঝেরে ব্যবহার করতে হবে। লেপ, কম্বলের উপর কাপড়ের কাভার দিতে পারলে ভালো।

  • শিশুর গায়ে বেবি-অয়েল, লোশন বা ভ্যাসলিন ব্যবহার করা।

  • শীতকালে শিশুদের চুল ফেলে দেয়া ঠিক হবে না।

  • অতিরিক্ত গরম জামা কাপড় পরিয়ে রাখা ঠিক হবে না। কারন এতে শিশু ঘেমে জেতে পারে আর সেই ঘাম ঠান্ডা বাতাসে শিশুর শরীরেই শুকিয়ে শিশুর শরীর খারাপের কারণ হতে পারে।

  • ১ থেকে ২ বছরের শিশুদের বিশেষ করে যারা প্রস্রাব ও মলত্যাগের কথা বলতে পারে না ঐসব শিশুদের রাতে শোবার সময় ডায়পার পরানো উচিত। তবে ডায়াপার যেন অনেকক্ষণ ধরে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

  • শিশুর নাক বা মুখের উপর কাপড়, লেপ বা কম্বল ইত্যাদি জরিয়ে না দেয়া।

  • শিশুকে অবশ্যই গরম পানি দিয়ে রোজ গোসল বা শরীর মুছে দিতে হবে।

  • একটি নবজাতক মায়ের গর্ভে উষ্ণ তাপমাত্রায় থাকে। তাই পৃথিবীর তাপমাত্রায়  শীত অনুভূতি হয়। আর শীতের দিনে তো কথাই নেই। তাই নবজাতককে একটু গরম কাপড় দিয়ে জরিয়ে রাখা দরকার।

  • জ্বর হলে শিশুকে অতিরিক্ত জামাকাপড় পরাবেন না। এতে শরীরের তাপ আরও বেড়ে যায়।

  • অনেক সময় শিশুরা ঠান্ডা লাগলে কিছু খেতে চায় না ও ঘন ঘন বমি করে। সেক্ষেত্রে শিশুদের খাওয়ার জন্য জোর না করাই শ্রেয়। খাওয়ালেও পাতলা খাবার ও লিকিইউট টাইপ খাবার খাওয়ানোই উত্তম।

যেহেতু শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে এবং বিকশিত হয় না। ফলে সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা, জ্বর ইত্যাদি রোগ সংক্রামনে আক্রান্ত হবার সম্ভবনা বেড়ে যায়। ফলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে নিজের ছোট্টটিকে উষ্ণ এবং সুরক্ষিত রাখা যায় সহজেই । শীতের মৌসুমে নবজাতকের শিশুর যত্ন নেওয়া ও যত্নের কৌশল গুলো অবশ্য মেনো চলা উচিত।

Default user image

ত্রপা চক্রবর্তী, লেখক, আস্থা লাইফ

নিজেকে ও নিজের মতামতটাকে উপস্থাপনের লক্ষ্যে এই লেখালিখির পেশায় হাতে খরি। মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা তবে অনেকেই আছেন যারা হয়তো অনেক কিছু বলে উঠতে পারেন না বা বোঝাতে পারেন না। আর লিখালিখি হয়তো সেই জড়তাটা দূর করতে সহায়তা করে, মুখে বলতে না পারা কথা লিখে অনায়াসে বলা যায়। মুক্তভাবে চিন্তা করতে ভালোবাসি। গল্প, হৈ চৈ করতে ভালোবাসি, রেগে গিয়ে হেরে জেতে চাই না আর ভালো লাগে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে এবং ঔ জায়গার সম্পর্কে মানে ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে। মনে প্রানে বিশ্বাস করি প্রতিটা মানুষের মাঝে এমন কিছু তো আছেই যা তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে ও সুন্দর করে। পরচর্চা না করে কারো চর্চা বিষয় হওয়াটাকে সৌভাগ্যের মনে করি।" একদিনে হবে না তবে একদিন ঠিকই হবে" এই বিশ্বাসটা জাগিয়ে তোলার লক্ষ্য উৎসাহিত করার এবং আমার সোনার বাংলাদেশটাকে উন্নত দেশ হিসাবে দেখার স্বপ্ন দেখি।

Related Articles