যে ৭টি কারণে মায়েরা শিশুকে ফর্মুলা মিল্ক খাওয়াতে বাধ্য হন
আপনি কি জানেন মায়েরা কোন শারীরিক অবস্থায় তাদের সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারে না? বাজারে কোন ফর্মুলা দুধ সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের? শিশুর ফর্মুলা মিল্ক বানানোর সঠিক নিয়ম কী? আসুন বিস্তারিত জেনে নেই।

শিশুর কৌটার দুধ বা ইনফ্যান্ট ফর্মুলা মিল্ক আমাদের দেশে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় পণ্য। বিগত বছরগুলোতে দেশের অধিকাংশ শিশুকে জন্মের পর থেকেই এই ফর্মুলা মিল্কে অভ্যস্ত করে তোলা হচ্ছে। তবে এই ফর্মুলা মিল্ক নিয়ে বিতর্কের কমতি নেই। আমাদের মুরুব্বীদের কাছে এটিকে স্রেফ মাতৃত্বের চরম অপমান এবং শিশুর জন্য ক্ষতিকারক বলে মনে হয়। অনেকে আবার এটিকে মায়েদের অহেতুক উচ্চাকাংখার ফসল বলেও মনে করেন। তবে নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে ফর্মুলা মিল্ক বা কৌটার দুধ এখন আর কোন ‘বিশেষ পছন্দ’ না, বরং প্রয়োজনীয়তা হিসাবে দেখা দিয়েছে। কিভাবে? আসুন দেখা যাক।
মায়েরা কেন শিশুকে ফর্মুলা মিল্ক খাওয়াতে বাধ্য হন?
ইদানীং অনেক নতুন মায়েদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে সন্তান জন্মদানের পরেও তাদের বুকে দুধ আসে না। এবং এটা শুধুমাত্র মায়েদের ইচ্ছার কারণে ঘটে না। বরং এর পেছনে রয়েছে রীতিমত মেডিক্যাল কারণ। আসুন দেখি কারণগুলি কি কি-
১. আইজিটি
আইজিটি বা ইনসাফিশিয়েন্ট গ্ল্যান্ডিউলার টিস্যুর কারণে মায়েদের বুকে দুধ তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্ট থাকে না। তাই দুধ একদমই তৈরি হয় না অথবা খুবই কম পরিমাণে তৈরি হয়।
২. হরমোন ইমব্যালান্স
প্রেগন্যান্সির সময়ে ডায়াবেটিস হলে শরীরে ইনসুলিন উৎপন্ন হয় কম। এই ইনসুলিন যেহেতু দুধ উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ, তাই এমন রোগীদের ক্ষেত্রে দুধের উৎপাদন স্বাভাবিকভাবেই কম হয়। এছাড়াও হাইপোপিটুইটারিজম এর কারনেও দুধ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।
৩. থাইরয়েড
যেসব মায়েদের থাইরয়েডের সমস্যা আছে তাদের বুকে দুধ নাও আসতে পারে।
৪. পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (পিসিওএস)
বর্তমানে মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে কমন শারীরিক সমস্যা হল এই পিসিওএস। এর কারণে দুধ উৎপাদনকারী হরমোনগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই পিসিওএস এর রোগীদের দুধ উৎপাদন কম হয় বা একেবারেই হয় না।
৫. জেস্টেশনাল ওভারিয়ান সিস্ট
এ ধরণের সিস্টগুলো মায়েদের শরীরে প্রেগন্যান্সির সময়ে উৎপন্ন হয় এবং এগুলো মায়ের বুকে পর্যাপ্ত দধ উৎপাদনে বাঁধা দেয়। তবে খুশির খবর হলো, এই সিস্টগুলো ডেলিভারির পর প্রথম ৩–৪ সপ্তাহের মধ্যে আপনাআপনিই চলে যায়, তখন দুধ উৎপাদন আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত আসে।
৬. বার্থ কন্ট্রোল পিল বা কনট্রাসেপ্টিভ পিল
যেসব মহিলারা দীর্ঘ সময় এ ধরণের পিল ব্যাবহার করে তাদের বুকে দুধ আসতে সমস্যা তৈরি হতে পারে।
৭. অতিরিক্ত ওজন
যারা ওজন অতিরিক্ততায় ভুগছেন সেসব মায়েদের শরীরে প্রোল্যাকটিন ঠিকমতো সাড়া দেয় না। তাই দুধ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। এছাড়াও অতিরিক্ত ওজনের কারণে ডায়াবেটিস বা হাইপারথাইরয়েডিজম হতে পারে যার দরুন দুধ তৈরি হয় না।
এর বাইরেও আরও কিছু কিছু কারণ রয়েছে যার জন্য মায়েরা শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণ বুকের দুধ খাওয়াতে সক্ষম হন না। তাই ফর্মুলা মিল্কই হয়ে ওঠে তাদের একমাত্র ভরসা।
শিশুর জন্য কোন ফর্মুলা দুধ সবচেয়ে ভালো?
বর্তমানে বাজারে নানান ব্র্যান্ডের ফর্মুলা দুধ কিনতে পাওয়া যায়। এতো এতো ব্র্যান্ডের ভিড়ে ‘কোন দুধ সবচেয়ে ভালো?’ এই ব্যাপারে টেনশনে পড়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। তবে আশার সংবাদ হলো – বাজারে যত ব্র্যান্ডের ফর্মুলা দুধই পাওয়া যাক না কেন, সবগুলোই মানের দিক থেকে একইরকম। এর কারণ হচ্ছে, ইনফ্যান্ট ফর্মুলা মিল্ক তৈরি করার ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোতে কিছু স্ট্রিক্ট নিউট্রিশনাল গাইডলাইন রয়েছে যেগুলো না মানলে সেই কোম্পানির দুধ বাজারে বিক্রি হতে দেয়া হয় না। এবং আমাদের দেশে প্রচলিত ফর্মুলা মিল্কগুলো যেহেতু ইউএস বা ইউভুক্ত দেশগুলো থেকেই আসে, তাই নিশ্চিন্তে যেকোনো ভালো ব্র্যান্ডের দুধই আমরা ব্যাবহার করতে পারি। তবে হ্যাঁ, কিছু কিছু দুধে কিছু অতিরিক্ত উপাদান যেমন ডিএইচএ এবং এআরএ যোগ করা থাকে যেগুলো শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে বিশেষ ভুমিকা রাখে। তাই কেনার সময় এই উপাদানযুক্ত ফর্মুলা মিল্ক বেছে নেয়া উত্তম।
শিশুর ফর্মুলা মিল্ক বানানোর নিয়ম
নিয়ম মেনে শিশুর জন্য ফর্মুলা মিল্ক বানানো খুবই জরুরী। তা না হলে শিশুর শরীরে নানারকম ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটতে পারে। তাই ফর্মুলা দুধ তৈরি করতে নীচের ধাপগুলি অনুসরণ করুন-
১. প্রথমেই একটি হাড়ি অথবা ইলেকট্রিক কেটলিতে পানি নিয়ে তা ফুটিয়ে নিন। অনেকে মনে করতে পারেন যে বোতলজাত পানি বা জারের পানি ব্যাবহার করলে তা ফুটানো লাগে না, তবে এটি একটি ভুল ধারণা। পানি যেটাই হোক, কলের বা বোতলের, ফুটিয়ে নেয়া বাধ্যতামূলক। ফোটানোর পরে পানি কিছুটা ঠাণ্ডা করে নিন।
২. নিজের হাত এবং দুধ বানাবার জায়গা ভালোভাবে পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করে নিন।
৩. ফোটানো পানি দিয়ে বাবুর ফীডার ভালোভাবে ধুয়ে নিন। ফীডারের ভেতরে, বাইরে, নিপল, এবং নিপলের মুখ সবই ঠিকমতো ধুতে হবে যাতে কোন জীবাণু থাকতে না পারে।
৪. এবার আপনার শিশুর চাহিদা অনুযায়ী ফোটানো ও ঠাণ্ডা করা পানি ফীডারে নিয়ে নিন। তবে খেয়াল রাখবেন যেন পানি একদম স্বাভাবিক তাপমাত্রায় চলে না আসে।
৫. এবার আপনি যে ফর্মুলা মিল্ক ব্যাবহার করছেন তার প্যাকেট বা কৌটার গায়ে লেখা নির্দেশনা অনুযায়ী পরিমাণমতো দুধ ফীডারে ঢেলে ভালো করে ঝাঁকিয়ে নিন। দুধ পরিমাপের জন্য অবশ্যই শুধুমাত্র প্যাকেটের সাথে দেয়া স্কুপ বা চামচই ব্যাবহার করবেন, অন্য কোন চামচ দিয়ে দুধ মাপবেন না।
৬. বাচ্চাকে খাওয়ানোর আগে অবশ্যই দেখে নেবেন যেন দুধের তাপমাত্রা বেশী না থাকে। আপনার হাতের কব্জিতে কয়েক ফোঁটা দুধ ঢেলে দেখে নিন যে তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে কিনা। বাচ্চার ক্ষেত্রে ঈষৎ উষ্ণ অর্থাৎ কুসুম গরম দুধ খাওয়ানো বাঞ্ছনীয়।
৭. একবার দুধ বানিয়ে রাখলে সাধারণ তাপমাত্রায় তা ২ ঘণ্টা খাওয়ানোর উপযোগী থাকে। তাই ২ ঘণ্টার পূর্বে বানিয়ে রাখা দুধ ফেলে দিয়ে নতুন করে দুধ বানিয়ে নিন। আবার অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চা দুধ পুরোটুকু শেষ করে না। এরকম ক্ষেত্রে একবার খাওয়ার পর পুনরায় ১ ঘণ্টার মধ্যে বাকী দুধটুকু খাইয়ে দিতে হবে। তারচেয়ে দেরী হয়ে গেলে তখন আবার নতুন করে দুধ বানিয়ে নিতে হবে।
৮. বানানো দুধ সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজে রাখতেই হবে এমন কোন কথা নেই। রুম টেম্পারেচারে রাখলেই হবে।
৯. ফর্মুলা মিল্ক নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ খাবার। এর মধ্যে ৬ মাস পর্যন্ত আপনার শিশুর পুষ্টি চাহিদার সবকিছুই বিদ্যমান থাকে। তাই প্রথম ৬ মাসের মধ্যে ফর্মুলা দুধের পাশাপাশি শিশুকে আর কিছু খাওয়াবার প্রয়োজন পড়ে না। এবং এই দুধের সাথে কখনই চিনি, সাধারণ গুঁড়া দুধ, এবং সেরিল্যাক বা সিরিয়াল জাতীয় কিছু মেশাবেন না।
১০. শিশুর বয়স যখন ৬ মাসের বেশী হবে তখন দুধের পাশাপাশি অন্যান্য শক্ত খাবার দিতে পারবেন। শিশুর ১ বছর বয়সের পর সে শক্ত খাবারেই অভ্যস্ত হয়ে উঠবে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ সেইসব খাবার থেকেই পেয়ে যাবে, তখন আপনি চাইলে ফর্মুলা মিল্ক বাদ দিতে পারেন।
শিশুকে কতটুকু ফর্মুলা দুধ খাওয়াতে হবে?
প্রতিটা শিশুর খাওয়ার ধরণ আলাদা। আপনার শিশু প্রতিবারে ঠিক কতটুকু খাবে এবং দিনে কতবার খাবে এটা একমাত্র তার চাহিদার উপরেই নির্ভর করবে। তবে শিশুর জন্মের পর প্রথম কয়েক সপ্তাহ সে বুঝতে পারে না তার কতটুকু খাবার দরকার। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত নিয়মের চেয়ে বরং আমরা মায়েদের অনুভূতিকে বেশী প্রাধান্য দেই। কারণ পৃথিবীতে একমাত্র একজন মা-ই জানেন যে তাঁর বাচ্চার কি লাগবে এবং কতটুকু লাগবে। তবু যদি কোন বিভ্রান্তি থাকে তাহলে দুধের প্যাকেট বা কৌটার গায়ে লেখা পরিমাণ অনুসরণ করা যেতে পারে।
অনেকেই মনে করে থাকেন যে শিশুকে ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো হয়ত ক্ষতির কারণ। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে শিশুর জন্য মায়ের দুধের চেয়ে ভালো আর কোনকিছুই হতে পারে না, তবে ফর্মুলা দুধও শিশুর জন্য যথেষ্ট উপকারী। তাই যেসব মায়েদের প্রাকৃতিক কারণেই বুকে দুধ আসে না বা কম আসে, তারা নিশ্চিন্তে শিশুকে নিয়ম মেনে ফর্মুলা দুধ খাওয়াতে পারেন।