টডলার পার্সোনালিটিঃ ১-৩ বছরের শিশুর ব্যক্তিত্ব সনাক্ত করবেন যেভাবে

শান্ত বা চঞ্চল, কৌতূহলী বা লাজুক যাই হোক না কেন আপনার সন্তান কিন্তু তাদের নিজস্ব স্বভাব নিয়েই জন্মগ্রহণ করে, এর ধরাবাঁধা কোন নিয়ম নেই। তবে আপনার শিশু যা কিছু অনুভব করে, দেখে ও শোনে এবং যে পরিবেশে বড় হয় তা সময়ের সাথে সাথে তাদের চরিত্র এবং ব্যক্তিত্ব তৈরিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। শিশুর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বিষদ জানতে প্রবন্ধটি সম্পূর্ণ পড়ুন।

পৃথিবীতে প্রত্যেকটি শিশুই ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রতিটি  শিশুর মধ্যেই একটি  একক ও নিজস্ব ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা, কোমলতা এবং  মেজাজের সংমিশ্রণ  রয়েছে। মূলত খুব ছোট বয়স থেকেই তাদের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

একজন সচেতন অভিভাবক হিসাবে আপনি ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছেন যে, আপনার সন্তান ১ থেকে ৩ বছর বয়সেই একটি স্বতন্ত্র মনোভাব অথবা  আলাদা আচরণ প্রদর্শন করে থাকে। আসুন আজকের লেখায় টডলার পার্সোনালিটি বা শিশুর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই।

 

টডলার পার্সোনালিটি বা শিশুর ব্যক্তিত্ব বলতে কী বুঝায়?

সাধারণত ১ থেকে ৩ বছরের বাচ্চাদেরকে টডলার এবং তাদের ব্যক্তিত্বের ধরণকে টডলার পার্সোনালিটি বলা হয়ে থাকে। আপনার সন্তানের জন্মের কয়েক মাস পর থেকেই সে কি টাইপের হবে তা বুঝতে পারবেন। কেননা গবেষকরা ধারণা করেন যে, টডলার বয়স থেকেই শিশুদের ব্যক্তিত্বের ধরণ বুঝা যায়। সেক্ষেত্রে একটি বাচ্চা শান্ত অথবা লাজুক কিংবা চঞ্চল হবে কিনা তা সহজেই অনুমেয় করা যায়। 

শিশুর ব্যক্তিত্ব নির্ধারণ করে এমন প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি কি কি?

  • কার্যকলাপের স্তর (শিশু কতটা সক্রিয়)

  • বিভ্রান্তি বা দ্বিধা (একাগ্রতার মাত্রা)

  • তীব্রতা (শিশু কত জোরে চিৎকার করতে পারে)

  • নিয়মিত কার্যক্রম (জৈবিক ক্রিয়াকলাপের পূর্বাভাস, যেমন-ক্ষুধা, ঘুম)

  • সংবেদনশীল অংশ (শারীরিক উদ্দীপনার প্রতি সংবেদনশীলতা)

  • দৃষ্টিভঙ্গি বা প্রত্যাখ্যান করা (একটি নতুন পরিবেশ বা অপরিচিতদের প্রতি প্রতিক্রিয়া)

  • অভিযোজন যোগ্যতা (শিশু কত সহজে, তাড়াতাড়ি পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেয়)

  • মনের ভাব (ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক মনের ভাব)

 

শিশুর ব্যক্তিত্ব কোন ধরণের তা সনাক্ত করবেন কীভাবে?

বেশিরভাগ বাচ্চাদের পার্সোনালিটি একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তিত্বের ধরণের সাথে খাপ খায় না। তবে আপনার ছোট শিশুটির ব্যক্তিত্বের সাধারণ ধরণ জানা থাকলে তা আপনাকে কীভাবে তাদের আরও ভালভাবে পরিচালনা করতে হয় তা বুঝতে সাহায্য করবে।

পৃথিবীতে মূলত ৩ ধরণের টডলার পার্সোনালিটি সম্পন্ন বাচ্চা দেখা যায়-

১. ইজিগোয়িং শিশু (সহজ বা সুখী)

২. লাজুক বা চিন্তাশীল শিশু 

৩. অতিচঞ্চল শিশু

 

১. ইজিগোয়িং শিশু

প্রায় ৪০% বাচ্চাদের মধ্যে ইজিগোয়িং বা সাবলীল ব্যক্তিত্বের লক্ষণ দেখা যায়। তারা সাধারণত নতুন মানুষ এবং পরিবেশে বেশ প্রফুল্ল ও সক্রিয় থাকে। অভিভাবকদের এই ইজিগোয়িং, সহজ ও সবকিছুর সাথে মানিয়ে নেয়ার মতো শিশুদের নিয়ে আলাদা ভাবে তেমন একটা চিন্তা করা লাগে না। তবে  মনে রাখবেন যে, অন্যান্য ভাইবোনদের প্রতি বেশি মনোযোগ প্রদান করে তাদের যেন উপেক্ষা না করা হয়। এছাড়াও আপনার ইজিগোয়িং সন্তান যেন অবহেলিত অথবা অসহায় বোধ না করে সেদিকেও যথেষ্ট খেয়াল রাখুন।

ইজিগোয়িং বা সহজ ব্যক্তিত্বের শিশুদের বৈশিষ্ট্য

  • এই ধরণের বাচ্চারা অনেকটা সহজ প্রকৃতির হয়ে থাকে।

  • এরা মিশুক এবং সব পরিস্থিতিতে সাবলীল ভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।

  • বেশির ভাগ ইজিগোয়িং টডলার সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে পছন্দ করে।

  • এরা সাধারণ সক্রিয় হয়ে থাকে। 

  • সহজেই ​মনোনিবেশ করতে পারে।

  • যে কোন পরিবর্তন সহজেই মেনে নেয়।

  • তাদের পরিমাণযোগ্য খাওয়া এবং ঘুমের অভ্যাস আছে।

  • তারা নতুন মানুষের সাথে দেখা করতে আগ্রহী।

  • তারা বেশিরভাগই সুখী বা সাবলীল থাকে।

  • অনেকসময় এরা মা-বাবা ছাড়াও পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে থাকতে বা সময় কাটাতে পারে।

 

২। লাজুক বা চিন্তাশীল শিশু

আনুমানিক ১৫% বাচ্চারা লাজুক এবং ধীরগতিসম্পন্ন হয়ে থাকে। সাধারণত এই টাইপের বাচ্চারা সহজ হতে একটু সময় নিয়ে থাকে। এরা অনেকটা চুপচাপ ধরণের এবং চিন্তাশীল হয়ে থাকে। মূলত একটি লাজুক শিশুর কার্যকলাপের মাত্রা কম এবং  প্রতিক্রিয়ার মাত্রাও ধীর হয়ে থাকে। কেননা তারা নতুন পরিবেশ কিংবা তাদের দৈনন্দিন সময়ের রুটিন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়।

তবে সময়ের সাথে সাথে তারা আরও ইতিবাচক হয়ে উঠতে পারে এবং তাদের নিজস্ব গতিতে নতুন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু তাদের যদি মানিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয়, তবে তারা ইতিবাচক পথ থেকে সরে আসতে পারে। এক্ষেত্রে লাজুক বাচ্চাদের অত্যধিক চাপ, কঠোর সমালোচনা এবং উপহাস থেকে রক্ষা করা উচিত, কেননা এগুলো তাদের সারা জীবনের জন্য ভয়ের কারণ হতে পারে।

লাজুক ব্যক্তিত্বের শিশুদের বৈশিষ্ট্য

  • এই পার্সোনালিটির শিশুরা একা, শান্ত এবং নিজের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে থাকে।

  • তারা শান্ত ভাবে খেলা উপভোগ করে।

  • আকস্মিক পরিবর্তনগুলো সেভাবে মেনে নিতে পারে না।

  • তারা নিজেদের মধ্যে হাসি-খুশি থাকে। 

  • অপরিচিত পরিবেশে তারা উদ্বিগ্ন এবং ভীত হয়ে পড়ে। 

  • তাদের সঠিক পরিমানে খাওয়া এবং ঘুমের অভ্যাস আছে। 

  • এরা নতুন মানুষের সাথে দেখা করতে অনিচ্ছুক হয়ে থাকে। 

  • তারা প্রত্যাখ্যান, অসম্মতি, সমালোচনা বা উপহাসের প্রতি তার নিজস্ব প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে।

  • চুপচাপ থাকে, কম কথা বলে, কিন্তু তাড়াতাড়ি কথা বলা শুরু করে। 

  • অনেকসময় এরা লাজুক হওয়ায়  হাঁটা শিখতেও কিছুটা সময় বেশি নেয়। 

 

৩. অতিচঞ্চল শিশু  

প্রায় ১০ জন শিশুর মধ্যে ১ জন অতিচঞ্চল টডলার হয়ে থাকে। এসব বাচ্চারা প্রবলভাবে সক্রিয়, উদ্যমী এবং চঞ্চল হয়ে থাকে। অনেক পেডিয়াট্রিশিয়ান এই পার্সোনালিটির বাচ্চাদের ওয়াইল্ড চাইল্ড হিসেবে অবহিত করেছেন। এছাড়াও এই চঞ্চল শিশুদের একগুঁয়ে, কঠিন বা উচ্চ চাহিদার বাচ্চাও বলা হয়ে থাকে। এদের  ধরেবেঁধে রাখা যায় না এবং এরা অতিরিক্ত চঞ্চল বিধায় এদের  নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটা কঠিন একটি কাজ। আর এসব বাচ্চাদের লালন-পালন করাও বেশ কঠিন।

এই ক্ষেত্রে বহু বিশেষজ্ঞই মনে করেন যে- এই অতিচঞ্চল শিশুদের এনার্জি নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদেরকে বেশি করে মাঠে খেলতে দেয়া উচিত। কেননা তাদের অতি এনার্জি শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা শান্ত আচরণ করে না কিংবা নিরব থাকে না।

অতিচঞ্চল ব্যক্তিত্বের শিশুদের বৈশিষ্ট্য

  • তারা অত্যন্ত সক্রিয় এবং সবসময় এনার্জিতে ভরপুর থাকে।

  • অনেক অস্থির বা অধৈর্য্য হয়ে থাকে। 

  • উৎসাহী, উদ্যমী,  প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন হয়ে থাকে।

  • যেকোন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তীব্র মানসিক প্রতিক্রিয়া দেখায়।

  • প্রতিবাদী, তীব্র সংবেদনশীল এবং অনমনীয় হতে পারে।

  • স্পর্শকাতর, অভিমানী এবং বেশ আবেগপূর্ণ হয়ে থাকে।

  • মেজাজের উত্থান-পতন হয়ে থাকে এবং অনেকসময় জেদি আচরণ করে থাকে।

  • নতুন পরিস্থিতি এবং মানুষের প্রতি তীব্র ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখায়।

  • তাদের অপ্রত্যাশিত খাওয়া এবং ঘুমের ধরণ লক্ষ্য করা যায়।

  • বেশিরভাগই প্রফুল্ল, খুশি এবং আমোদজনক হয়ে থাকে। 

  • নতুন জিনিস অন্বেষণ করতে এবং নতুন লোকেদের সাথে দেখা করতে ভয় পায় না। 

  • তারা সহজেই ফোকাস হারাতে পারে এবং একঘেয়ে রুটিনের সাথে ভালোভাবে সামঞ্জস্য করতে পারে না।  

 

সবশেষ

পিতামাতা শিশুদের ব্যক্তিত্ব বোঝার মাধ্যমে তাদের সুন্দর জীবন গঠনে আরও ভালভাবে সহায়তা করতে পারে। এর মূল চাবিকাঠি হল তাদের আচরণগুলি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং তাদের প্রয়োজন অনুসারে অভিভাবকত্বের কৌশলগুলি তৈরি করা।

Default user image

সাবরিনা দিলশাদ এলিন, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি একজন কন্টেন্ট রাইটার! আমি বই পড়তে, গল্প করতে এবং ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করি। মূলত লেখালিখি আমার প্যাশন এবং তা এখন আমার পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে! আশা করি আস্থা লাইফের সাথে আমার এই লেখালিখির জার্নিটা অনেক দূর এগিয়ে যাবে!

Related Articles