গরমে আপনার শিশুকে সুস্থ রাখতে ৯টি টিপস
শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষাকাল যে ঋতুই হোক না কেন শিশুদের প্রয়োজন বিশেষ যত্নের। তবে অন্যান্য সময়ের তুলনায় গরমের সময়টা সত্যিকার অর্থেই শিশুদের জন্য ভীষণ কষ্টকর হয়ে উঠতে পারে। এ কারণে গরমে ছোট সোনামণিদের বিশেষ যত্ন নেওয়া অপরিহার্য। তাদের খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে সবকিছুই খেয়াল রাখতে হবে।
সময় এখন গ্রীষ্মকাল। চৈত্রের শেষ, বৈশাখের কেবল শুরু। মহামারী করোনার প্রভাবে এবার বৈশাখের উদযাপন অনেকটাই সীমিত। তবে উদযাপন সীমিত হলেও গ্রীষ্মের দাবদাহ কিন্তু তাতে থেমে নেই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে রোদ, বাড়তে থাকে তাপমাত্রা, বাড়তে থাকে অস্বস্তি। এই প্রচণ্ড গরমে আমাদের সবার মত শিশুরাও নাজেহাল। শিশুরা অত্যন্ত স্পর্শকাতর বলেই এই গরমে তাদের দরকার কিছু অতিরিক্ত যত্ন, নেয়া দরকার কিছু অতিরিক্ত সতর্কতা।
অতিরিক্ত গরমে শিশুদের কি ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে?
-
গরমে শিশুরা অনবরত ঘামে। এই অতিরিক্ত ঘাম থেকে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, নিউমোনিয়া বা ঠান্ডা লাগতে পারে।
-
ঘামের ফলে শরীর থেকে লবণ পানি বেরিয়ে যায়। ফলে পানিশূন্যতা হতে পারে। পাশাপাশি ইলেকট্রলাইট বা সোডিয়াম, পটাশিয়াম এর ঘাটতি জনিত সমস্যা হতে পারে।
-
চামড়ায় র্যাশ বা ঘামাচি হতে পারে। বার বার চুলকানোর ফলে তা থেকে ত্বকে অন্যান্য সমস্যা হতে পারে। অনেকক্ষণ ডায়াপার পরা থাকলেও এ ধরনের র্যাশ হতে পারে।
-
গরমে হজম শক্তি ব্যাহত হয়ে বাচ্চার পেট খারাপ বা ডায়রিয়া হতে পারে।
-
মাথা ঘেমে গিয়ে চুলে খুশকি হতে পারে।
এ ধরনের সমস্যা যেন না হয় তা নিশ্চিত করতে গরমকালে শিশুর ব্যাপারে কিছু অতিরিক্ত সতর্কতা পালন করা উচিত। আসুন তাহলে গরমে কিভাবে শিশুর যত্ন নেয়া যায় সে সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়া যাক,
১. শিশুকে বেশি বেশি পানি পান করাবেন
অত্যধিক গরমে ঘেমে গিয়ে শিশুর পানিশূন্যতা যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। নির্দিষ্ট সময় পর পর শিশুকে পানি অথবা ফলের রস খাওয়ান। এছাড়া শিশুর পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন সিজনাল ফলও খাওয়াতে পারেন। চাইলে ডাক্তারের পরামর্শ মত স্যালাইন কিংবা গ্লুকোজ খাওয়াতে পারেন।
যেসব শিশুদের বয়স ৬ মাসের কম, তাদের ক্ষেত্রে মায়ের বুকের দুধই একমাত্র খাদ্য। সেক্ষেত্রে বার বার বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। বাচ্চা খেতে না চাইলে বারে বারে অল্প অল্প করে খাওয়াতে হবে।
২. সহজপাচ্য নরম খাবার দিন
৬ মাসের বেশি বয়স এমন বাচ্চার পরিপূরক খাবার নির্বাচনের ক্ষেত্রে যত্নবান হতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি একজন ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী পুষ্টিকর সহজপাচ্য খাবার খাওয়ানো যায়।
সহজে পরিপাক ও শোষণ হবে এমন শাক সবজি, মাছ, খিচুড়ি বাচ্চাকে দিতে হবে। যতটা সম্ভব তরল বা নরম খাবার দেয়া উচিত। গরমে তেল মসলা, ভাজা ভুজি, ঝাল ঝোল ধরনের খাবার এড়িয়ে যাওয়া ছোট বড় সবার জন্যই উপকারী।
৩. পরিধানের জন্য সুতি কাপড়
আমাদের ছোটোবেলায় সুতির হাতাকাটা জামা, সাথে হাফ প্যান্ট এই ছিল পোশাকের নমুনা। সময় পাল্টেছে। বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও এখন ফ্যাশন নিয়ে যথেষ্ট সচেতন কিংবা বলা যায় মা বাবারা তাদের সন্তানের ফ্যাশন নিয়ে যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করেন। কিন্তু এই কাঠফাটা গরমে যেকোনো ফ্যাশনেবল পোশাকের চেয়ে সুতি ঢিলাঢালা আরামদায়ক জামা শিশুর জন্য উপযুক্ত। যদি নিতান্তই প্রয়োজন হয় তবে সুতি কাপড় দিয়ে বাচ্চার জন্য পছন্দসই জামা বানিয়ে নিতে হবে। কিন্তু কোনোভাবেই সিনথেটিক কাপড় ব্যবহার করা যাবে না।
সুতি কাপড়ের পানি শোষণ ক্ষমতা বেশি। তাই গরমে বাচ্চাকে সুতির জামা পরিয়ে দিন। জামা ভিজে গেলে সাথে সাথে জামা খুলে শরীরের ঘাম মুছিয়ে দিন। হালকা করে পাউডার দিতে পারেন। ঘাম শুকিয়ে এলে অন্য জামা পরিয়ে দিতে হবে। গায়ের ঘাম যেন গায়েই না শুকায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৪. ঘরেই খেলার ব্যবস্থা করে দিন
যেসব বাচ্চার বয়স একটু বেশি অর্থাৎ ৫ বছরের উপরে তাদের অনেকেরই বিকেলে বাইরে খেলতে যাবার অভ্যাস থাকে। খেলাধুলা শারীরিক মানসিক বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে যেহেতু ইদানীং প্রচণ্ড গরম, এই গরমে দৌড়াদৌড়ি ছোটাছুটি করলে শিশু ঘেমে গিয়ে ঠান্ডা লাগতে পারে। তাই ঘরেই ফ্যানের নিচে শিশুর খেলার ব্যবস্থা করুন। তার জন্য বিভিন্ন ইনডোর গেমস যা ঘরে বসেই খেলা যায় অথচ শারীরিক পরিশ্রমও হয় না এমন খেলার সরঞ্জাম কিনে নিতে পারেন।
৫. বাচ্চাদের নিয়ে দূরপাল্লার ভ্রমণ পরিহার করুন
যেহেতু শিশুদের শরীরের আমাদের চেয়ে বেশি নাজুক হয়, তাই গরমে বাচ্চাকে নিয়ে দূর পাল্লার ভ্রমণে না যাওয়াটাই ভালো হবে। বিশেষ করে বদ্ধ গাড়ি কিংবা বাসে ভ্রমণ করা একেবারেই উচিত না। সম্ভব হলে নদীপথে লঞ্চ জার্নি করা যেতে পারে। নিতান্তই প্রয়োজন হলে, সব ধরনের সতর্ক ব্যবস্থা নিয়ে তবেই ভ্রমণ করুন।
৬. কড়া রোদ থেকে রক্ষা করুন
বাইরে বের হলে গায়ে রোদ লাগা স্বাভাবিক। আর গায়ে রোদ লেগে ঘেমে গিয়ে তা থেকে অসুস্থ হওয়াও স্বাভাবিক। তাই শিশুকে নিয়ে বাইরে বের হলে হাতে ছাতা নিয়ে বের হওয়া ভালো। সম্ভব হলে হালকা টুপি বা পাতলা স্কার্ফ দিয়ে শিশুর মাথা ঢেকে দিন। সাথে পানি রাখুন। একটু পর পর শিশুকে পানি খাওয়াতে থাকুন। ঘরে বানানো হালকা খাবার সাথে রাখুন। যেন শিশুর ক্ষুধা লেগে গেলে বাইরের কেনা খাবার খাওয়াতে না হয়।
৭. নিয়মিত গোসল করান
অনেকেই বাচ্চাকে নিয়মিত গোসল করাতে চান না ঠান্ডা লাগার ভয়ে। এই প্রচন্ড গরমে শিশুকে অবশ্যই রোজ ভালোভাবে গোসল করাতে হবে। পানি অতিরিক্ত ঠান্ডা মনে হলে হালকা কুসুম গরম পানি ব্যবহার করা যেতে পারে। গোসলের পর শিশুর মাথা ভালো ভাবে মুছিয়ে দিন। ভিজা চুল থেকে ঠান্ডা লেগে শিশুর জ্বর, সর্দি কাশি হতে পারে। তাই ফ্যানের নিচে দাড় করিয়ে ভালোভাবে শিশুর গা মাথা মুছিয়ে দিতে হবে।
৮. বাচ্চার চুল কেটে ছোট করে রাখুন
বাচ্চাদের অনেক সময় সারাক্ষণ মাথা চুলকাতে দেখা যায়। শরীরের অন্যান্য অংশের সাথে সাথে বাচ্চার মাথার ত্বকও গরমে ঘেমে যায়। চুলের গোড়ায় ঘাম জমে তা থেকে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে। এর থেকে পরবর্তীতে ক্রনিক খুশকির সমস্যা হতে পারে। তাই যতটা সম্ভব চুল কেটে ছোট করে দিন। যেন ঘেমে গেলেও চুল তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। নিয়মিত মাথায় সাবান বা শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করান।
৯. ঘরের ভেতর আলো-বাতাস চলাচল নিশ্চিত করুন
ঘরে যেন পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচল করে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। দরজা জানালা যতটা সম্ভব খোলা রাখতে হবে। সম্ভব হলে শিশুকে বারান্দায় বসিয়ে খেলার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এসি বা ফ্যানের বাতাস আরামদায়ক ঠিকই, কিন্তু তা প্রাকৃতিক আলো বাতাসের বিকল্প নয়।
কখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন?
এত সতর্কতা সত্ত্বেও আপনার শিশু অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। তবে উপরোক্ত সতর্কতা অবলম্বন করলে সেই সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়। তাই নিম্নোক্ত বিষয়গুলো লক্ষ রাখুন,
-
যদি শিশুর চেহারা দেখে অসুস্থ বলে মনে হয়
-
হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই গায়ের তাপমাত্রা বেড়ে যায়
-
অতিরিক্ত পানি পিপাসা
-
বার বার বমি কিংবা পাতলা পায়খানা
-
একেবারেই খেতে না চাওয়া
-
প্রস্রাবের পরিমাণ যদি কমে যায়
-
চোখ বসে যায় অথবা জিহ্বা শুকনো হয়ে যায়
-
শিশুর মধ্যে যদি নিস্তেজ ভাব দেখা যায় অথবা কোনো কারণ ছাড়াই খেলাধুলা না করলে
এ সমস্ত লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ অথবা নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে। এবং ডাক্তারের পরামর্শ মত ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিশুমাত্রই প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে যত্নের দরকার হয়। নিজের অস্বস্তির কথা, অসুবিধার কথা শিশুরা হয়ত সব সময় ঠিক ভাবে বলতে পারে না, আমাদের বড়দের তা শিশুর হাব ভাবে বুঝে নিতে হয়। এই প্রচণ্ড গরমে আমাদেরই যেখানে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে, সেখানে বাচ্চাদের কথা বলাই বাহুল্য!
তাই গরমে শিশু শারীরিকভাবে যেন কাহিল না হয়ে যায় সেদিকে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে। যেকোনো সমস্যায় নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।