মা যেভাবে সন্তানকে ব্যাকক্টেরিয়া থেকে রক্ষা করতে পারে!
পৃথিবীর সবচাইতে নিরাপদ স্থান বিবেচনা করলে মাতৃগর্ভকেই সবার আগে ধরে নিতে হয়। তবে গর্ভাবস্থায় ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমনের প্রসঙ্গ উঠলে অনেকেই ব্যাপারটিকে নেতিবাচক ভাবতে পারেন। তবে ঘটে ঠিক উল্টো, মাতৃদেহ থেকে শিশুর দেহে ব্যাক্টেরিয়ার শুষ্ঠ প্রবেশ নির্ধারণ করতে পারে শিশুর সমগ্র জীবনের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার শক্তিমত্তা। এটে বসুন, কারণ প্রবন্ধটি খুবই তথ্যবহুল এবং বিশ্লেষণাত্বক হতে চলেছে।
মানব দেহ কোটি কোটি পরজীবী অনুজীবদের বাসস্থান। আমাদের শরীরে ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক, আর্কিয়ার হাজার হাজার প্রজাতির বাসবাস করে। পূর্বে ধারণা করা হতো গর্ভাবস্থায় মা থেকে শিশু শুধু পুষ্টি উপাদান পেয়ে থাকে, মা সবরকম বাহিক্য পরজীবী থেকে শিশু সুরক্ষিত রাখে। কিন্তু সম্প্রতি করা গবেষণায় উঠে আসছে, মা শিশুকে অনেক রকম রোগ থেকে সুরক্ষা প্রদান করলেও জরায়ু পুরোপুরি নিশ্ছিদ্র নয়। মায়ের অন্ত্র থেকে শিশুর দেহে কিছু ব্যাক্টেরিয়ার প্রবেশ ঘটে, যা শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
ফান ফ্যাক্টঃ শিশুদের ভাষা শেখা ও আপন মানুষদের চেনার প্রক্রিয়া শুরু হয় গর্ভাবস্থা থেকেই। তাই গর্ভাবস্থায় পরিবার পরিজনদের সাথে সময় কাটানো শিশুর মস্তিষ্ক গঠনে বেশ উপকারী। |
চলুন একটু বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা যাক। অনুজীব ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক বুঝতে পারলে, গর্ভাবস্থায় ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রোমনের গুরুত্ব উপলব্ধি সহজ হবে।
প্রথমে মাথায় রাখতে হবে, "ব্যাক্টেরিয়া মাত্রই ক্ষতিকর নয়" পৃথিবীর মাত্র ১ % ব্যাক্টেরিয়া মানবদেহে রোগ সৃষ্টি করতে পারে। বাকী ৯৯% ব্যাক্টেরিয়াকে আমাদের দেহের প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা সহজেই দমন করতে পারে। বরং বেশিরভাগ ব্যাক্টেরিয়া আমাদের জন্য উপকারই বয়ে আনে। যেমন, ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমনে বাধা দেওয়া, রোগ আক্রান্ত কোষ ভক্ষন ও ভিটামিন উৎপাদন।
ফান ফ্যাক্টঃ অন্তঃসত্তাকালীন সময়ে নারীরা টক জাতীয় খাবার খেতে পছন্দ করেন। কিন্তু এর পেছনের কারণটি অনেকের অজানা। ভ্রুণের হাড় গঠনকালে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম মায়ের দেহ থেকে স্থানন্তরিত হয়। এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুষ্ঠভাবে হওয়ার জন্য অ্যাসিডিক পরিবেশ প্রয়োজন। আর টক জাতীয় খাবার মাত্রই অ্যাসিডিক। আর সেজন্যই নারীরা প্রেগনেন্সির সময়ে টক খাবার খেতে পছন্দ করে। |
আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গে অনুজীবদের বসবাস। ত্বক, পাকস্থলি, অন্ত্র এমন কি মানব মস্তিষ্কেও অনুজীবদের সন্ধান পাওয়া যায়। কয়েক বিলিয়ন অনুজীব মানবদেহে বসবাস করে যার সংখ্যা মানুষের শরীরে কোষের চেয়েও বেশি। এসব ব্যাক্টেরিয়াকে বলা হয় ন্যাচারাল ফ্লোরা। স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকলে অনুজীবগুলো কোন ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকলে এই অনুজীব গুলো রোগের সৃষ্টি করতে পারে।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের চাইতে শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে থাকে। আরেকটি বিষয় হলো অনুজীবদের রোগ সৃষ্টিতে বাঁধা দেওয়ার জন্য আমারদের শরীরের রোগ প্রতিরক্ষাকে অনুজীব গুলোকে চিনে নিতে হয়। একটা উদাহারণ এর মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার করার চেষ্টা করা যাক।
কলেরার জীবাণু আমাদের শরীরে কলেরা রোগের সৃষ্টি করে। আমাদের রোগ প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা যদি না জানে কিভাবে কলেরাকে প্রতিরোধ করা যায় তখনই মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়। পূর্বে কলেরার প্রাদুর্ভাবে গ্রাম-কে-গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। এটি প্রতিরোধের উপায় হিসেবে আবিষ্কার হয় কলেরার টিকা। কলেরার টিকা দান প্রক্রিয়ায় কলেরা জীবাণুর নিষ্ক্রিয় অংশ মানব দেহে প্রবেশ করানো হয়। যার ফলে মানব শরীর কলেরার জীবানু চিনতে পারে ও পরবর্তিতে কলেরা সংক্রমন হলে সেটাকে প্রতিরোধ করতে পারে।
এখন ভাবুন, একটি মানব ভ্রণ যদি একেবারে ব্যাক্টেরিয়া শুন্য স্থানে বৃদ্ধি লাভ করে, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরে নবজাতকটি কোনভাবেই, ব্যাক্টেরিয়াতে পরিপূর্ণ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারবে না। প্রাকৃতিক ভাবেই মায়ের অন্ত্র থেকে কিছু ব্যাক্টেরিয়াকে শিশুর দেহে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় যাতে শিশুটির রোগ প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা গড়ে উঠতে পারে। প্রক্রিয়াটি যদি শুষ্ঠ ভাবে সম্পন্ন না হয় তবে শিশুটির প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা অনুন্নত থেকে যাবে। কিছু মানুষকে দেখবেন সবসময়ই কোন না কোন রোগব্যাধিতে ভোগেন। মূলত জীবণের প্রথমভাগে রোগ প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা উন্নত না হওয়ার কারণেই এমনটি হয়ে থাকে। শুধু গর্ভকালীনই নয়, নবজাতক শিশুকে দৈনিক গোসল করানোর মত কারণে শিশুটি ব্যাক্টেরিয়ার সংস্পর্শ পায় না। কিছু মা বাবা শিশুকে মাটির সংস্পর্শ থেকেও দূরে রাখেন। দেখা যায় ঠিক তাদেরই ভবিষ্যতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দূর্বলতা দেখা দিচ্ছে।
এখন মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক, মায়ের অন্ত্রে ব্যাক্টেরিয়ার শুষ্ঠ পরিবেশের উপর বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার শক্তিমত্তা অনেকাংশেই নির্ভর করে। অন্ত্রে ব্যাক্টেরিয়ার শুষ্ঠ পরিবেশ নির্ধারণ করতে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের কোন বিকল্প নেই।
ফান ফ্যাক্টঃ মানুষের অন্ত্রে ১০০ ট্রিলিয়নের অধিক ব্যাক্টেরিয়া বসবাস করে, যা আমাদের খাবার হজমে মুখ্য ভূমিকা রেখে থাকে। |
গর্ভকালীন বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার শুষ্ঠ বিকাশে করণীয়
১) ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার বেশি করে খেতে হবে
বিশেষজ্ঞরা সঠিকভাবে জানেন না ঠিক কোন ব্যাক্টেরিয়া গুলো সুস্থ অন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয়, কিন্তু এতে কোন সন্দেহ নেই যে যত বেশি প্রজাতির ব্যাক্টেরিয়া আমাদের পরিপাক তন্ত্রে বসবাস করবে, আমাদের জন্য ততই উপকার। প্রচুর ফাইবার যুক্ত খাবার যেমন বিভিন্ন ধরণের ফলমূল, সবজি, লাল আটা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাক্টেরিয়াকে খাদ্য যোগায়। এই ব্যাক্টেরিয়ার যেহেতু শিশুর দেহে প্রবেশ করবে, তাই যত বেশি প্রজাতির ব্যাক্টেরিয়া শিশুর দেহে প্রবেশ করবে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তত বেশি ব্যাক্টেরিয়ার সাথে পরিচিত হবে যা শিশুকে ভবিষ্যতে অসংখ্য রোগ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।
২) সেদ্ধ আধাসেদ্ধ ও কাঁচা ফলমূল খেতে হবে
খাবার কিভাবে তৈরি করা হচ্ছে সেটাও পরিপাকতন্ত্রে ব্যাক্টেরিয়ার ভারসাম্যে প্রভাব ফেলে। ভাজা পোড়া খাবার এর চাইতে সেদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন। সেদ্ধ আধাসেদ্ধ ও কাঁচা ফলমূলে প্রচুর পরিমাণ আঁশ থাকে, অন্যদিকে সবজি ভাজি করে খেলেও সেটার আঁশ এর পরিমাণ কমে যায়।
৩) প্রোটিন ও ফ্যাটযুক্ত খাবার পরিমিত খেতে হবে
মাছ, মাংস ও দুগ্ধজাত খাবারের মত প্রোটিন ও ফ্যাটযুক্ত খাবার অন্ত্রে উপকারী ব্যাক্টেরিয়ার জন্য কোন পুষ্টি প্রদান করে না। এ জাতীয় খাবার অতিরিক্ত গ্রহণ ও তুলনামূলক কম ফাইবার যুক্ত খাবার গ্রহণের ফলে পাকস্থলিতে উপকারী ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা ও প্রজাতি খাদ্যের অভাবে কমে যায়। খাদ্যের বেশি অভাব দেখা দিলে উপকারী ব্যাক্টেরিয়া অন্ত্রের দেওয়াল ভক্ষণ শুরু করতে পারে যার কারণে আলসার ও দীর্ঘমেয়াদে এরূপ চলতে থাকলে কোলন ক্যান্সারের মত রোগ হতে পারে।
তাহলে সবকিছুর সারমর্ম দাড়াচ্ছে, গর্ভাবস্থায় ফাইবার যুক্ত খাবার গ্রহণের কোন বিকল্প নেই।
এছাড়া বাচ্চার রোগ প্রতিরোধে গর্ভবতী মায়েরা যে কাজগুলি করতে পারে-
-
খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কোন প্রকার এন্টিবায়োটিক গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। যেকোনো প্রকার ঔষধ সেবনে ডাক্তারের পরামর্শ অবশ্যই গ্রহণ করবেন।
-
একই ধরণের খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন, বিভিন্ন রকম ফল সবজি, মাছ মাংস গ্রহণ মানুষের অন্ত্রে ব্যাক্টেরিয়ার জন্য শুষ্ঠ পরিবেশ প্রদান করে। যা গর্ভকালীন সময়ে পুষ্টির চাহিদা পূরণ সহ, ব্যাক্টেরিয়ার ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
-
গর্ভকালীন সময়ে এলকোহল পানের তো প্রশ্নই ওঠে না। বরং স্বাভাবিক সময়েও অতিরিক্ত মদ্যপান আমাদের অন্ত্রের ব্যাক্টেরিয়াকে মেরে ফেলে। আমরা যে হ্যান্ডস্যানিটাইজার দিয়ে হাতের অনুজীব মারি, তা মূলত এলকোহল ও মসচারাইজার।
-
পর্যাপ্ত না ঘুমানো গর্ভাকালীন সময়ে নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে যার ভেতর অন্ত্রে ব্যাক্টেরিয়ার ভারসাম্য নষ্ট হওয়া অন্যতম। দেহঘড়ি বিষয়টি শুধু গানেই নয়, আমাদের শরীরের ভেতরও দেহঘড়ি বিদ্যমান, যা নির্ধারণ করে কখন ঘুমাতে হবে, কখন উঠতে হবে। ঘুমানোর সময়ে আমাদের দেহে বিভিন্ন হরমোন উৎপন্ন হয়ে থাকে। পাকস্থলি ও অন্ত্রের কার্যাবলীও পরিবর্তন হয়। মূলত ঘুমানোর সময়ই আমাদের অন্ত্রের ব্যাক্টেরিয়া শুষ্ঠভাবে পুনরায় উৎপাদিত হতে পারে।
-
চাপ নেওয়া ও দুশ্চিন্তা থেকে বিরত থাকা, ইদুরের উপর করা একটা গবেষণায় দেখা যায় যে, স্ট্রেসের কারণে ইদুরের অন্ত্রে ব্যাক্টেরিয়ার সংখ্যা যেমন হ্রাস পায় তেমনি উপকারী ব্যাক্টেরিয়া কমে গিয়ে ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া বেগে যায়। বলাই বাহুল্য যে, গর্ভকালীন সময়ে স্ট্রেস শিশুর বৃদ্ধি তে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
ফান ফ্যাক্টঃ গ্রিক নারীরা গর্ভকালীন সময়ে প্রচুর কৌতুক ও ধাঁধা সমাধান করতেন। তাদের বিশ্বাস ছিলো এতে তারা প্রাণোচ্ছল ও বুদ্ধিমান হয়। সম্প্রতি গবেষণায় উঠে আসে আসলে ঘটেও তাই। |
গর্ভকালীন সময় একটি নারী ও একটি শিশুর জীবনের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে ছোট-ছোট বিষয়ও প্রভাব ফেলতে পারে একটি শিশুর পরবর্তি পুরো জীবনে। তাই এই সময়টিতে গর্ভবতী মায়ের খেয়াল রাখার দায়িত্ব পরিবারের সবার।