বাচ্চাদের পাতলা পায়খানা হলে করণীয়। জেনে নিন কখন ঝুঁকিপূর্ণ!
বিশ্বে শিশু মৃত্যুর জন্য সর্বাধিক দায়ী তিনটি রোগের একটি হলো ডায়রিয়া। বর্ষাকালে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ, শীতের শুরু অথবা প্রচন্ড গরমে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ শিশু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। তাই এর থেকে শিশুকে নিরাপদ রাখতে এর কারন, উপসর্গ, চিকিৎসা, বিপদচিহ্ন এবং চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত জানা জরুরি। তাই চলুন ডায়রিয়া সম্পর্কে জানি এবং শিশুর সুস্থ্য ও সুন্দর জীবন গড়ি।
ছোট্ট শিশু নাবিহার দুদিন ধরে সর্দি-কাশি ছিল। হঠাৎ শুরু হল পাতলা পায়খানা সাথে বমি। সচেতন বাবা-মা আর দেরি করলেন না। দ্রুত নিয়ে গেলেন কাছের শিশু হাসপাতালে। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানালেন ঠান্ডা লাগার কারনে রোটা ভাইরাসে (Rotavirus) আক্রান্ত হয়ে শিশুটির ডায়রিয়া হয়েছে। তবে দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার কারনে শিশুটির মারাত্বক কোন ক্ষতি হয় নি।
ডায়ারিয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার অন্যতম উপায় সচেতনতা এবং দ্রুততম পদক্ষেপ গ্রহন। তাই আজকেরআলোচনায় আমরা শিশুর ডায়রিয়ার কারন, উপসর্গ, চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব।
শিশুর ডায়রিয়া কেন ঝুঁকিপূর্ণ
-
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে ডায়রিয়া। তবে এটি প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিত্সাযোগ্য উভয়ই।
-
প্রতি বছর ডায়রিয়ায় পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৫,২্৫,০০০ শিশু মারা যায়।
-
নিরাপদ পানীয় এবং পর্যাপ্ত স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধির মাধ্যমে ডায়রিয়া রোগের একটি উল্লেখযোগ্য অনুপাত প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
-
বিশ্বব্যাপী, প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ শৈশবকালীন ডায়রিয়া রোগের ঘটনা ঘটে।
-
পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অপুষ্টির একটি প্রধান কারণ ডায়রিয়া।
এই রোগ মুলত ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ও পরজীবী এর কারনে হয়ে থাকে। ডায়রিয়া হলে বার বার পাতলা পানির মত পায়খানা হতে থাকে। এর ফলে খুব দ্রুত শরীর থেকে পানি এবং ইলেক্ট্রোলাইট বের হয়ে যায়। আর এই কারনেই মূলত শিশুরা ডায়রিয়া হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়ে। শরীরে অতিরিক্ত পানিশূন্যতাই মূলত ডায়রিয়ায় শিশুমৃত্যুর প্রধান কারন।
শিশুর ডায়রিয়ার কারণ
শিশুর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার বিশেষ কিছু কারন রয়েছে। এই কারণগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানা থাকলে এই রোগ থেকে সতর্ক থাকা যায়, চলুন দেখি কারনগুলো কি কি-
১) পেটের সংক্রমণ
পেটের সংক্রমণ শিশুদের ডায়রিয়া হওয়ার অন্যতম প্রধান কারন। খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে পাচনতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়। আবার শিশুরা বারবার মুখে আঙ্গুল দেয়ার কারনে লালার সাথে জীবাণু প্রবেশ করে এবং ডায়রিয়া সংক্রমণ হয়। পেটের সংক্রমণ দুই রকম হতে পারে; ভাইরাসের সংক্রমণ এবং ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ।
ভাইরাসের সংক্রমণ
বিভিন্ন ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণেও ডায়রিয়া ছড়ায়। এই ভাইরাসগুলোর মধ্যে অন্যতম হল রোটা ভাইরাস এবং এডিনো ভাইরাস।
রোটা ভাইরাস: রোটা ভাইরাস সাধারনত নবজাতককে সংক্রমিত করে বেশী। এই ভাইরাস প্রথমে শিশুর পাচনতন্ত্রকে আক্রান্ত করে এবং পরে সেটা ডায়রিয়ায় রুপান্তরিত হয়। রোটা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী শিশুদের মারাত্বক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারন। রোটা ভাইরাস অর্গানাইজেশন অব টেকনিক্যাল অ্যালাইজ (আরওটিএ) পরিষদের এক রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিবছর দেশে প্রায় ২৪ লক্ষ শিশু রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয় যাদের বেশিরভাগের বয়স দুই বছরের নিচে। তবে আশার কথা হচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা খুব বেশী একটা না কমলেও এই রোগে মৃত্যুহার কমেছে ৪৪ শতাংশ। আর এই ভাইরাস টিকাদানের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়।
এডিনো ভাইরাস: এডিনো ভাইরাস কয়েকটি ভাইরাসের সমষ্টি। এটা একসাথে শরীরের বিভিন্ন অংশকে সংক্রমিত করতে পারে। সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্ষে আসলে অথবা কেবলমাত্র হাঁচি কাশির মাধ্যমে এই রোগ ছড়াতে পারে।
ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ
ভাইরাসের মত বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমনেও শিশুর ডায়রিয়া হতে পারে। চলুন দেখি সেগুলো কি কি-
সালমোনেলাঃ সালমোনেলা এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া। এটি শিশুর পেট এবং অন্ত্রকে মারাত্মকভাবে সংক্রমিত করে এবং ডায়রিয়া ভয়াবহ রুপ নেয়। বাসি পচা খাবার, দুষিত পানি ইত্যাদির মাধমে সাধারনত এই ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ে। যে সব শিশুরা মুখে আঙ্গুল দেয় বা সবকিছু তুলে মুখে দেয়ার অভ্যাস থাকে তাদের এই ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ই. কোলাইঃ সালমোনেলার মত ই. কোলাই-ও একটি ব্যাকটেরিয়া যেটা মানুষের অন্ত্রের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই থাকে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস, দুষিত পানি ও খাবার ইত্যাদির মাধ্যমে ই. কোলাই সংক্রমণ ঘটতে পারে। এর সংক্রমনে তীব্র পেটে ব্যাথা এবং ডায়রিয়া হতে পারে। এমনকি মলের সাথে রক্তও যেতে পারে।
২) পরজীবীর আক্রমন
মলের সাথে থাকা কিছু মাইক্রোস্কোপিক পরজীবীও সংক্রমণ ছড়ীয়ে শিশুকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত করতে পারে। পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ডায়রিয়া হলে পেটে গ্যাস, পেট ফুলে যাওয়া, তৈলাক্ত মল ইত্যাদি লক্ষন দেখা যেতে পারে। এটিও দুষিত খাবার এবং পানি থেকে ছড়ীয়ে থাকে।
৩) খাবারে এলার্জি
শিশুদের পাচনতন্ত্র অনেকবেশী দুর্বল থাকে। আর এই কারনে অনেক খাবারে মৃদু থেকে তীব্র এলার্জি হতে পারে। বিশেষ করে শিশু যখন প্রথম শক্ত খাবার খাওয়া শুরু করে তখন অনেক খাবারে শিশুর সমস্যা হতে পারে।
শিশুর সবচেয়ে বেশি যে খাবারে এলার্জি হয় তা হল দুধ বা দুগ্ধ জাতীয় খাবার। শিশু প্রথম গরুর দুধ খাওয়া শুরু করলে এলার্জির সমস্যা হতে পারে। এলার্জির সমস্যা থেকে ডায়রিয়া, পেট ফাঁপা, পেটে গ্যাস ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে।
৪) ফলের রস
ফলের রসে অধিক পরিমানে পুষ্টি উপাদান থাকার কারনে অনেক বাবা মা-ই শিশুদের বিভিন্ন রকমের ফলের রস খাইয়ে থাকেন। ফলের রসের প্রধান সমস্যা হচ্ছে অনেক পিতামাতাই পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি পুরোপুরি মেইনটেইন করতে পারেন না, ফলে শিশুর পেটের সমস্যা হতে পারে। এই কারনে শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে ১ বছরের নিচে শিশুদের ফলের রস না দিয়ে আস্ত ফলের পিউরি দেয়া উত্তম। এতে শিশু পর্যাপ্ত পরিমানে ফাইবারও পাবে।
৫) কানের ইনফেকশন
অনেক সময় শিশুর কানের ইনফেকশন হলে সেটা পরে ডায়রিয়াতেও রুপ নিতে পারে। কানের ইনফেকশন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস যে কোন সংক্রমনেই হতে পারে। এই সমস্যা হলে শিশু কান্নাকাটি করে, বার বার কানে হাত দেয়ার বা মোচড়ানোর চেষ্টা করে। সাধারনত শিশুর সর্দি কাশির পর এই সমস্যা দেখা দেয়।
৬) অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া
শিশুরা অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া সহ্য করতে পারে না। তাই গ্রীষ্মকালে যখন তাপমাত্রা অনেক বেশী থাকে তখন শিশুদের ডায়রিয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এমনকি গরমে শরীর থেকে ঘামের সাথে অতিরিক্ত পানি বের হয়ে যাওয়ায় শিশু পানি শূন্যতায় ভোগে ফলে অনেক সময় সেটা ডায়রিয়ায় রূপ নেয়।
৭) অ্যান্টিবায়োটিক
শিশুদের কোন শারীরিক অসুস্থতায় অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করানো হলে অনেক সময় অন্ত্রের খারাপ ব্যাকটেরিয়ার সাথে ভালো ব্যাকটেরিয়াও মরে যায়। ফলে শিশুদের ডায়রিয়া আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
শিশুর ডায়রিয়ার উপসর্গ
নবজাতক শিশুরা সাধারনত ঘন ঘন নরম করে মল ত্যাগ করে। তাই এটা নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তবে ডায়রিয়ার বিশেষ কিছু লক্ষনের মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে-
-
শিশু ঘন ঘন পাতলা পায়খানে করে।
-
পায়খানা দুর্গন্ধযুক্ত এবং প্রচুর মিউকাস থাকে।
-
শিশুর জ্বর থাকতে পারে সেই সাথে ওজন কমে যেতে শুরু করে।
-
শিশুর মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায় এবং কান্নাকাটি বেশী করে।
-
খাবারের চাহিদা কমে যায়।
-
পানি শূন্যতার লক্ষন দেখা দেয়।
-
ঘন ঘন বমি হতে পারে।
শিশুর ডায়রিয়ার বিপদের লক্ষণ
শিশুর বয়স যদি ৩ মাসের কম হয় তাহলে ডায়রিয়া হলে সাথে সাথেই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। এছড়াও ২৪ ঘন্টার মধ্যে ডায়রিয়ার তেমন কোন উন্নতি না হলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিতে হবে। নিচে ডায়রিয়ার বিপদজনক কিছু উপসর্গ দেয়া হল-
-
অনেক বেশী বমি হলে
-
তীব্র পানি শূন্যতার লক্ষন দেখা দিলে
-
৬ ঘন্টায় একবারো প্রশাব না করলে
-
শিশুর মাথার সামনের নরম অংশ বসে গেলে
-
পায়খানার সাথে রক্ত থাকলে
-
পেট ফুলে গেলে
-
২৪ ঘন্টার বেশী জ্বর থাকলে
উপরের সবগুলি লক্ষনই বিপদ নির্দেশ করে তাই এসব লক্ষন দেখা দিলে শিশুকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিন।
শিশুর ডায়রিয়ার চিকিৎসা
শিশুর ডায়রিয়া খুব সাধারন সমস্যা তবে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নিলে মারাত্বক হতে পারে। শিশুর পানিশুন্যতা ডায়রিয়াকে প্রানঘাতী করে তোলে তাই কোনভাবেই শিশুর শরীর পানিশূন্য হতে দেয়া যাবে না।
-
ঘন ঘন বুকের দুধ দিতে হবে।
-
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হবে।
-
শিশু সলিড খাবার অভ্যস্ত হলে ডাবের পানি, ভাতের মাড় বা রাইস স্যালাইন ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী দিতে পারেন।
যে ধরণের খাবার খাওয়াতে হবে
শিশুর যে কোন শারীরিক সমস্যায় মায়ের দুধ হল সবচেয়ে নিরাপদ খাবার। তবে ডায়রিয়া হলে যে খাবারগুলো দিতে পারেন সেগুলো হল-
-
পাকা কলা- পাকা কলায় প্রচুর পরিমানে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থাকে তাই ডায়রিয়ায় এটা শিশুর জন্য উপকারি।
-
ডাবের পানি ও ভাতের মাড়- শিশুর শরীরে পানি শূন্যতা রোধ করতে ডাবের পানি ও ভাতের মাড় খাওয়ানো যেতে পারে।
-
সেদ্ধ সবজি- বিভন্ন ধরনের সবজি যেমন আলু, গাজর ইত্যাদি সেদ্ধ করে চটকিয়ে শিশুকে খাওয়াতে পারেন।
-
আপেল- সবজির মত আপেল সিদ্ধ করে শিশুকে খাওয়ানো যেতে পারে।
-
দই- ঘরে পাতা দই ডাইরিয়ায় আক্রান্ত শিশুর জন্য অনেক উপরকারী।
যে ধরণের খাবার খাওয়ানো উচিত নয়
ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুকে নিচের খাবারগুলো দেয়া উচিত নয়-
-
এলার্জি হয় এমন খাবার যেমন গরুর দুধ এবং চিজ বাটার।
-
হজম হতে সময় নেয় এমন খাবার যেমন ক্রিম বিস্কুট, পেস্ট্রি ইত্যাদি
-
যেসব ফল ও সবজিতে শিশুর গ্যাস হতে পারে যেমন শাক, ছোলা, ব্রকলি ইত্যাদি।
-
ফলের রস।
শিশুর ডায়রিয়া প্রতিরোধে সবচেয়ে জরুরি পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা। শুধু খাবার ও পোশাক নয়, শিশুকে কোলে নেয়ার আগেও ভালোভাবে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে নেয়া উচিত। শিশুরা ঘন ঘন হাত মুখে দেয়, আবার অনেক শিশু আঙ্গুল চোষে তাই শিশুর হাতও পরিষ্কার রাখা জরুরি। সর্বোপরি আপনার সচেতনতা-ই পারে আপনার শিশুকে ডায়রিয়া থেকে অনেকাংশে নিরাপদ রাখতে। তাই সচেতন থাকুন আপনার শিশুর সুরক্ষা নিশ্চিত করুন।