শিশুর যে ৭টি গুণ তাকে সামাজিক ভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলে

আপনার ছোট শিশুটি হয়ত অন্যান্য শিশুদের সাথে ঠিক ভাবে মিশতে পারছে না। একটি শিশুর শারীরিক বৃদ্ধির প্রতি বাবা মায়েরা যেমন সচেষ্ট থাকেন, ঠিক তেমনই তার মানসিক বিকাশের প্রতিও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। আজকে আমরা কথা বলব এমন কয়েকটি গুণাবলী নিয়ে যেগুলো শিশুর মানসিক ও সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

শিশুকে সামাজিক ভাবে গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে সব শিশুরা সবার সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে মিশতে পারে, তারা খুব সহজে কোন কারণে হতাশ হয়ে পরে না। শিশুটি বড় হয়ে কেমন হবে, সবার সাথে কেমন আচরণ করবে তার গোড়াপত্তন এই ছোটবেলা থেকেই হয়ে থাকে। হ্যাঁ! এটা ঠিক যে প্রত্যেকটি শিশুই একে অপর থেকে একদমই আলাদা হয়ে থাকে, আর শেখানোর সময়ও তাই কোন কোন শিশুর প্রতি একটু আলাদা মনোযোগী হতে হবে আপনাকে।

আর এটাও ঠিক যে, কোন সামাজিক গুণাবলী অর্জন করা বা শেখা বেশ খানিকটা কঠিনই বটে। এছাড়া একটি নির্দিষ্ট ঘটনায় কি ধরণের আচরণ করা উচিৎ সেটা বুঝতে পারা এতটা সহজ নয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে শিশুর কোন বন্ধু যদি তার প্রিয় খেলনাটি দিয়ে খেলতে চায়, তাহলে শিশুর কি করা উচিৎ? যে কাজটি করা উচিৎ সেটা কি আদৌ শিশু করতে পারছে কি না?

“ইন্টারন্যাশনাল ইনসাইক্লোপিডিয়া অফ সোশ্যাল এন্ড বিহেভিরাল সায়েন্সে” প্রকাশিত শিশুর সামাজিক দক্ষতা এবং আচরণের উপর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একদম ছোট বয়স থেকে বন্ধু থাকলে শিশুর মানসিক বিকাশ অনেক ভালো হয়।

বাবা মায়েরা একটু সচেষ্ট হলেই শিশুকে সামাজিক ভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলা সম্ভব। আসুন তাহলে দেখে নেই শিশুর লালন পালনে যে ৭টি সামাজিক গুণাবলী শেখানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ:

১) শেয়ার করা বা ভাগাভাগি করে নেয়া

একটি শিশুর বন্ধু তৈরি এবং অন্য শিশুর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ধরে রাখার ক্ষেত্রে যে কোন খাবার অথবা খেলনা শেয়ার করতে পারা বেশ কার্যকরী একটু গুণ। ‘সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণত দুই বছর বয়স থেকে শিশুর মধ্যে এই গুণটি দেখা যায়। তবে একটি শিশু ঠিক তখনই কোন খেলনা অথবা খাবার ভাগ করার মানসিকতা প্রকাশ করে যখন তার কাছে প্রচুর পরিমাণে খেলনা অথবা খাবার থাকে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, শিশুর কাছে যদি মাত্র একটি খেলনা থাকে অথবা একটি চকোলেট থাকে তাহলে শিশু সাধারণত সেটা অন্যদের সাথে শেয়ার করতে চায় না।

যেভাবে শিশুকে শেখাতে পারবেন

আপনি যদি শিশুকে জোর করে তার খেলনা বন্ধুর সাথে শেয়ার করতে দেন, তাহলে কিন্তু হিতে বিপরীত হবে। এমনটা না করে বরং ঠিক যখনই কাউকে এমন শেয়ার করতে দেখবেন শিশুর সামনে তার প্রশংসা করুন। এছাড়া শিশু কাউকে কোন কিছু শেয়ার করলে সাথে সাথেই শিশুকে বলুন, তুমি খুব চমৎকার একটি কাজ করেছ। এভাবেই শিশুরা ধীরে ধীরে নিজের খেলনা, খাবার ইত্যাদি সবার সাথে শেয়ার করা শিখে যাবে।

২) সহযোগিতার মাধ্যমে কোন কাজ একযোগে করা

একটি শিশুর খেলাধুলার মাধ্যমেই এই ধরণের গুণাবলী ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এছাড়াও শিশু যখন স্কুলে যাওয়া শুরু করে এবং সবাই মিলে খেলাধুলা করে তখন এই ধরণের গুণাবলী তার মধ্যে প্রকাশ পাওয়া শুরু করে। তবে শুধু শিশুদের মধ্যে নয় বরং বড়দের মধ্যেও একযোগে কাজ করার মন মানসিকতা থাকা প্রয়োজন। আর আজকে শিশু যদি অন্যান্য শিশুদের সাথে একযোগে খেলাধুলা করে, তাহলেই বড় হওয়ার পরে তার মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে সবার সাথে একযোগে কাজ মন মানসিকতা তৈরি হবে।

যেভাবে শিশুকে একযোগে কাজ করা শেখাবেন

বাসার সবাই মিলে ঘর গুছানোর মত কাজ করতে পারেন আর এই কাজে শিশুকেও অংশগ্রহণ করতে দিন। এভাবে মজার ছলে কাজ করার মধ্যেই শিশু পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে একযোগে কাজ করা শিখে যাবে।

৩) মনোযোগ দিয়ে কারো কথা শোনা

শুধুমাত্র চুপ করে থাকার মানেই কিন্তু কথা শোনা নয় বরং কেউ কোন কথা বললে সেটা মনোযোগ দিয়ে শুনে বুঝতে পারাটাই হল আসল। সাধারণত শিশু যখন স্কুলে যায়, তখন টিচারদের কথা শোনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে এই গুণটি শিশুর মধ্যে প্রকাশিত হতে থাকে। শিক্ষকের কথা শোনা, বুঝা এবং সেই অনুযায়ী নোট করে রাখার পাশাপাশি পরবর্তীতে সেই কথাগুলো নিয়ে ভাবার মাধ্যমেই পড়ালেখায় ভালো করা যায়।

যেভাবে শিশুকে শেখাবেন

ছোট শিশু মানেই আপনার কাছে নানা ধরণের গল্প শোনার জন্য বায়না ধরবে। আর যখন শিশুকে আপনি গল্প শোনাবেন তখন কিছুদূর গল্প বলার পর বুঝতে চেষ্টা করবেন যে শিশু আপনার গল্পটি মনোযোগ দিয়ে শুনছে কি না! শিশুকে জিজ্ঞেস করুন এতক্ষণ পর্যন্ত বলা গল্প সম্পর্কে, আর শিশু যদি সঠিক ভাবে বলতে না পারে তাহলে শিশুকে সাহায্য করুন। এভাবেই শিশুর মধ্যে কোন কিছু মনোযোগ দিয়ে শোনার অভ্যাস রপ্ত হয়ে যাবে।

৪) কোন নির্দেশনা অনুসরণ করা

কোন নির্দেশনা অনুসরণ করা সাধারণত শিশুর জন্য বেশ কঠিন একটি কাজ। ধীরে ধীরে বড় হতে থাকা শিশুর হোম-ওয়ার্ক করা থেকে শুরু করে এমনকি কোন ধরণের বিশেষ খেলা কীভাবে খেলতে হয় সেটাও তাকে নির্দেশনা অনুসরণ করে শিখে নিতে হয়। তবে এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, শিশু তখনই ভালভাবে নির্দেশনা অনুসরণ করা শিখতে পারবে যখন আপনি সুন্দর করে নির্দেশনা দিতে পারবেন।

শিশুকে কীভাবে শেখাবেন

একদম ছোটবেলা থেকেই টিভি দেখার পর শিশুকে শিখিয়ে দিন কীভাবে টিভি দেখা শেষ হলে সেটা বন্ধ করে দিতে হয়। কিভাবে রিমোট দিয়ে এসি বন্ধ করতে অথবা টেলিভিশনে চ্যানেল পরিবর্তন করে কার্টুনের চ্যানেলটি নিয়ে আসতে হয়। এইসব ছোট ছোট নির্দেশনাগুলো যখন শিশু অনুসরণ করতে পারবে তখন তার প্রশংসা করুন।  

৫) কারো পার্সোনাল স্পেসকে সম্মান দিতে শেখা

একটি ছোট শিশু মানেই গায়ের উপর উঠে গড়াগড়ি করবে, কোলে উঠে বসে থাকবে এটা সত্য! তবে একই সাথে শিশুকে পার্সোনাল স্পেস সম্পর্কে বুঝতে শেখানোটা খুবই জরুরী। কেননা হুট করেই কারো গায়ের উপর উঠে গেলে অথবা কোলে উঠে গেলে সেটা তার জন্য বেশ বিব্রতকর এবং অস্বস্তির কারণও হতে পারে। এছাড়াও শিশু যখন বড় হবে তখন অন্যদের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দকেও গুরুত্ব দেয়া শিখতে হবে।

যেভাবে শেখাবেন

কোন রুমে প্রবেশ করার আগে দরজায় নক করা, কারো সাথে কথা বলার সময় একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলা এগুলো শিশুকে একদম ছোট বেলা থেকেই শেখানো শুরু করে দিতে হবে। তবে মনে রাখবেন শিশুকে কখনো এগুলো নিয়ে বকা দিতে যাবেন না বরং তাকে খুব সুন্দর ভাবে এগুলো বুঝাতে হবে।

৬) চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা

যে কারো সাথে কথা বলার সময় চোখের দিকে তাকানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক শিশুর ক্ষেত্রেই দেখা যায় তারা চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছে না। কখনো শিশু অনেক বেশি লাজুক হলে আবার শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস কম হলেও এমনটা ঘটতে দেখা যায়।

যেভাবে শেখাবেন

শিশুকে একদম ছোট থেকেই চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা শেখাতে হবে। তবে খেয়াল রাখবেন কখনো শিশুকে জোর করবেন না, কেননা শিশু যদি লাজুক হয় তাহলে এই কারণে সে আরো বেশি অস্বস্তিতে ভুগবে। শিশুকে মজার ছলেই বলতে পারেন, কি ব্যাপার তোমার চোখ কোথায় হারিয়ে গেল, দেখতে পাচ্ছি না তো!

৭) ভদ্রতা বজায় রাখা

আপনার সন্তান যখন স্কুলে গেল সে কারো পানি অথবা টিফিন বিনা অনুমতিতে খেয়ে ফেলছে কি না? অথবা ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে টিচারের কাছে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছে কি না? এই ধরণের ছোট ছোট ভদ্রতাগুলো আপনার শিশুকে শিখিয়ে নিতে হবে। তবে অনেক শিশুর মধ্যে দেখা যায় এই ধরণের অনুভূতিগুলো একটু দেরিতে আসে আবার কারো মধ্যে একটু দ্রুত।

এছাড়াও ভদ্রতা এবং বড়দের সম্মান করার বিষয়টি শিশুকে শেখানো খুবই জরুরী। শিশু বড় হতে থাকার সাথে সাথেই শিশুর মধ্যে এই অভ্যাসগুলো রপ্ত হয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

যেভাবে শিশুকে শেখাবেন

শিশুকে সব পরিস্থতিতে এই বিষয়গুলো মনে করিয়ে দেয়া। যেমন তার কোন বন্ধু যদি তাকে একটি খেলনা দিয়ে খেলতে দেয়, তখন আপনি শিশুকে তাৎক্ষণিক ভাবেই মনে করিয়ে দিন এই বলে যে, “তুমি কি তোমার বন্ধুকে ধন্যবাদ দিয়েছ?”। খেয়াল রাখবেন শিশুকে কখনো জোর করবেন না।

 

পরিশেষে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, শিশু কিন্তু সবসময় আপনাকেই অনুসরণ করে। শিশু সবসময় তার বাবা মাকে অনুসরণ করেই বড় হয়। আর তাই শিশুকে কোন একটি বিষয়ে শেখানোর আগে জরুরী হল আপনি নিজে সেটা করছেন কি না! একটি ছোট্ট ঘটনা দিয়ে আজকের আর্টিকেল শেষ করতে চাইঃ

“ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি পোস্ট বেশ ভাইরাল হয়ে উঠেছে। আর সেটা হল কোন এক ট্রেন ভ্রমণে একটি শিশুকে মনোযোগ দিয়ে বই পড়তে দেখে অবাক হয়ে তার মায়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়, আপনি কীভাবে নিজের শিশুকে স্মার্ট-ফোন ব্যবহার করা বাদ দিয়ে বই পড়া শিখিয়েছেন? উত্তরে শিশুর মা বলল, শিশু আপনাকেই অনুকরণ করে। আর তাই আপনি যদি চান যে শিশু স্মার্ট-ফোন ব্যবহার না করে বরং বই পড়ুক তাহলে নিজেও স্মার্ট-ফোনে অতিরিক্ত সময় ব্যয় না করে বই পড়ুন।”

Default user image

ইকবাল মাহমুদ ইকু, লেখক, আস্থা লাইফ

দীর্ঘদিন ধরেই লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ততার সুবাদে বেশ কিছু স্বনামধন্য অনলাইন পোর্টালে লেখালেখি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই লেখার প্রতি রয়েছে অদম্য অনুরাগ। এই লেখালেখিকেই নেশা এবং পেশা হিসেবে নেয়া আমার ইতোমধ্যেই চারটি উপন্যাস এবং একটি ছোট গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে। জন্ম থেকেই ঢাকায় বসবাসরত আমি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবেও পথ শিশুদের জীবন যাপনের মান উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে আসছি প্রায় ১২ বছর ধরে। বর্তমানে আস্থা লাইফের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতাকে জন সাধারণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়ার একটি সুযোগ হিসেবে দেখছি। বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসি এবং অবসর সময়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর মুভি নিয়েই কাটে।

Related Articles