শিশুদের দাঁতের যত্নে ১৬টি প্রয়োজনীয় টিপস

বেশিরভাগ বাবা মায়েরা বাচ্চা ঠিকমতো খাবার খাচ্ছে কিনা, তা নিয়ে যত বেশি সচেতন, বাচ্চার দাঁতের যত্ন নিতে তার চেয়ে বেশি উদাসীন। আর এই উদাসীনতার ফলে একটা সময় বাচ্চার দাঁতে দেখা দেয় নানারকম সমস্যা। অথচ শুরুতেই যদি সচেতনতার সাথে দাঁত ও মুখের হাইজিন মেনে চলা হতো তাহলে এই সমস্যাগুলো নিয়ে বাচ্চাদের কষ্ট পেতে হতো না।

বাচ্চাদের দুধ দাঁত কিছুদিন পর উঠে যাবে ভেবেও অনেকেই দুধ দাঁত বা ডেসিডিউয়াস দাঁতের যত্ন নেওয়া প্রয়োজনীয় মনে করেন না। আর তাই এই কন্টেন্টে বাচ্চার দুধ দাঁত এবং পার্মানেন্ট বা স্থায়ী দাঁতের যত্ন কিভাবে নিতে হবে সেই বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। 

দুধ দাঁতের যত্ন নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা

দুধ দাঁত বা ডেসিডিউয়াস দাঁতের যত্ন নেওয়া তো দূর, অনেক অভিভাবক জানেনই না এই দাঁতেরও যত্নের প্রয়োজন। দুধ দাঁত কয়েকমাস পরেই উঠে পার্মানেন্ট দাঁত বের হয়, তাই অনেকেই এর যত্নের ব্যাপারে উদাসীন থাকেন। অথচ দুধ দাঁতের যত্ন নেওয়াটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই দাঁতগুলো খাবার চিবানো, কথা বলা, এবং মুখের স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে।  

  • দুধ দাঁতে পোকা ধরলে অনেকেই এর চিকিৎসা করাতে চান না। এর কারণ দুটো হতে পারে— প্রথমত, হয়তো বাচ্চার ভয় এবং চিৎকার চেঁচামেচির কারণে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়াটা ঝামেলা মনে হয়, অথবা এটা ভেবে নিয়ে যাওয়া হয়না যে, এই দাঁত তো কয়দিন পর পড়েই যাবে, কি দরকার? কারণ যেটাই হোক, বাচ্চাকে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না দিলে তা পরে বাচ্চারই ক্ষতির কারণ হয়। 

  • যেসব ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে দাঁতে পোকা বা ক্যারিজ হয়, চিকিৎসা না করলে সেসব ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং সুস্থ পার্মানেন্ট দাঁত থাকলে সেটাকেও ক্ষয় করতে শুরু করে। এমনকি এসব ব্যাকটেরিয়া মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়ে শরীরের অন্যান্য স্থানে, ফলে বাচ্চার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। যার কারণে বাচ্চা পরে সহজেই GIT Disease, ফ্যারিন্জাইটিস, রেসপিরেটরি ইনফেকশন সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে। 

  • এছাড়াও দুধ দাঁত বাচ্চার মুখমণ্ডলের আকার ও ডায়মেনশন দিতে সহায়তা করে, পার্মানেন্ট দাঁতকে সঠিক স্থানে নিরাপদে রাখতে সহায়তা করে। দাঁতে ক্যারিজ হওয়ার কারণে দাঁত ব্যাথা করে, ফলে বাচ্চার জন্য ঘুমানো, খাওয়া বা কথা বলতে কষ্ট হয়, কোনোকিছু শেখা বা মনোযোগ ধরে রাখাটাও কঠিন হয়ে যায়।

একারণে বাচ্চাদের দাঁতের সমস্যা হলে তা কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়। ছোটবেলা থেকে যদি কয়েক মাস পরপর বাচ্চাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে তার মনের ভয়টাও কমে যায়। 

বাচ্চার দাঁতের যত্ন যেভাবে করবেন

বাচ্চা জন্মের পরপরই আমরা তার দাঁত দেখতে পাইনা, কিন্তু গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ট্রাইমেস্টার থেকেই শুরু হয়ে যায় দাঁত গঠন প্রক্রিয়া এবং জন্মের সময় থেকেই তার ২০টি দুধ দাঁত থাকে। আর একারণেই, অনেকেই জেনে হয়তো অবাক হবেন যে, দাঁতের যত্ন নেওয়া উচিত দাঁত উঠারও আগে থেকে। 

American Academy of Pediatrics (AAP) থেকে দাঁতের যত্ন নিতে বেশকিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো-

১. একটি পরিষ্কার, নরম কাপড় হালকা গরম পানিতে ভিজিয়ে তা দিয়ে বাচ্চার মাড়ি আলতো হাতে মুছে ফেলতে হবে। এই কাজটি প্রতিদিন রাতে বাচ্চা ঘুমানোর আগেও করতে পারেন, বা খাওয়ার পরও করতে পারেন।

২. বাচ্চার প্রথম দাঁতটি বের হলেও কিছুদিন একই নিয়মে পরিষ্কার করতে পারেন। তারপর ছোট বাচ্চাদের জন্য তৈরী সিলিকনের ব্রাশ দিয়ে খুবই হালকা হাতে ব্রাশিং শুরু করা উচিত। আজকাল অনেক ধরনের বেবি টুথ ক্লিনিং টুল পাওয়া যায়, যেগুলো দিয়ে আপনি বৃদ্ধাঙ্গুলির সাহায্যে বাচ্চার দাঁত পরিষ্কার করতে পারেন।

৩. এর কিছুদিন পর টুথপেস্টের ব্যাবহার শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রে পেস্টের পরিমাণটা সঠিক হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। ১/২ টা দাঁতের জন্য একটি চালের দানা পরিমাণ পেস্ট নিতে হবে, বেশি নিলে বাচ্চা তা গিলে ফেলবে। ব্যাবহার করতে পারেন ফ্লোরাইড যুক্ত টুথপেষ্ট, এটি দাঁতের গঠনে ভুমিকা পালন করে। তবে খাওয়ার পানিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফ্লোরাইড থাকলে আলাদাভাবে ফ্লোরাইড যুক্ত টুথপেষ্টের দরকার নেই। 

৪. সাধারণত দুই বছর বয়সে বাচ্চা থুথু ফেলা শিখে যায় তবে তাকে পানি দিয়ে কুলি করতে দেওয়া উচিত না। এতে করে বাচ্চা পানির সাথে পেস্ট গিলে ফেলতে পারে।

৫. ৩ বছর বয়স থেকে বাচ্চাকে একটি মটর দানার সমপরিমাণ পেস্ট দিয়ে ব্রাশ করাতে শেখাবেন এবং ৮ বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চা ব্রাশ করার সময় তার সাথে থাকবেন, যেন তারা বেশি পরিমাণে পেস্ট গিলে ফেলতে না পারে।

৬. বাচ্চাকে কখনো বেশি সময় ফিডার দিয়ে রাখা উচিত না। কারণ সাধারণত ফিডারে যা-ই থাকুক তার সাথেই চিনি মেশানো থাকে, আর এই চিনিযুক্ত খাবার অনেকক্ষণ ধরে বাচ্চার দাঁতের সংস্পর্শে থাকলে তা ক্যারিজ সৃষ্টি করে। শুধুমাত্র এভাবে ফিডার খাওয়ানোর কারণে বাচ্চার বিশেষ একটি রোগ হয় যা 'baby bottle caries' নামে পরিচিত। 

৭. বাচ্চাকে ছোটবেলা থেকেই অভ্যাস করাতে হবে যেন সকালে খাওয়ার পরে এবং রাতে ঘুমানোর আগে তারা ব্রাশ করতে না ভুলে। ব্রাশ করাতে হবে ধীরে ধীরে, অন্তত দুই মিনিট সময় নিয়ে, যেন মাড়িতে চাপ না পড়ে বা খোঁচা না লাগে। 

৮. ব্রাশ করার সময় উপরের দাঁতগুলো উপর থেকে নিচে এবং নিচের দাঁতগুলো নিচ থেকে উপরে ব্রাশ করতে হবে, নইলে মাড়ি ক্ষয় হতে পারে।

৯. বাচ্চা একটু বড় হলে তাকে ফ্লস করা শেখানো উচিত। দুই দাঁতের ফাঁকে মাঝে মাঝে খাবার আটকে থাকে যা ব্রাশ করলেও দূর হয়না। এসব আটকে থাকা খাবার থেকে দাঁত ক্ষয় হতে পারে, তাই ফ্লস দিয়ে সেগুলো পরিষ্কার করতে হবে। 

১০. দাঁতের সাথে জিহ্বা পরিষ্কার করাও জরুরি। ব্রাশ করার সময় সেই ব্রাশ দিয়েই হালকাভাবে ঘষে জিহ্বা পরিষ্কার করা যায়, অথবা জিহ্বা পরিষ্কারের জন্য আলাদা টুলস পূওয়া যায়, সেগুলোও ব্যাবহার করতে পারেন।

১১. বাচ্চার পার্মানেন্ট দাঁত বের হতে শুরু করলে তার মুখে দুধ দাঁত এবং পার্মানেন্ট দাঁত দুটোই থাকে, সেক্ষেত্রে একই নিয়মে বাচ্চার দাঁতের যত্ন নিতে হবে। 

১২. মাঝে মাঝে বাচ্চার দাঁতগুলো নিজেই চেক করুন। যদি কোনো হলুদ বা বাদামি ফোঁটা দেখতে পান অথবা যেকোনো কিছু যদি অস্বাভাবিক মনে হয় তাহলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে দ্রুত।

১৩. বাচ্চাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি চুষতে থাকা একটি কমন অভ্যাস। সাধারণত এটায় তেমন কোনো সমস্যা হয়না, কিন্তু ৩ বছরের পরেও যদি এই অভ্যাগ থেকে যায় তাহলে তা পার্মানেন্ট দাঁতগুলোর বিন্যাসে প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে দাঁত আঁকাবাঁকা হয়ে বের হয়, অর্থাৎ অর্থোডোন্টিক প্রবলেমের সৃষ্টি হয়।

১৪. ছোট বাচ্চারা ঘরে বাইরে দৌড়ে বেড়াবে, হোঁচট খাবে, পড়ে ব্যাথা পাবে— এসব খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু পড়ে গিয়ে দাঁত ভেঙে গেলে, অথবা দাঁত দিয়ে জিহ্বা কেটে গেলে সেটার কারণে ওরাল হেল্থের উপর প্রভাব পড়ে। তাই খেলাধুলার সময় বাচ্চার মুখে মাউথ গার্ড দিয়ে রাখা উচিত। মাউথ গার্ড একধরণের সিলিকনের ছাঁচ, যা বাচ্চার দাঁতের উপর নরম কাভারিংয়ের কাজ করে।

১৫. বাচ্চাকে টক ফল, শাকসবজি খাওয়া শেখাতে হবে, যেন ভিটামিন সি এর অভাব না হয়। ভিটামিন সি শরীরে কমে গেলে বাচ্চাদের গাম ব্লিডিংসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়।  

১৬. উপরোক্ত নিয়মগুলো অনুসরণ করার পাশাপাশি ছয় থেকে সাত মাস পরপর বাচ্চাকে নরমাল চেকআপের জন্য ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া জরুরি। 

এভাবে ছোট থেকেই দাঁতের নিয়মিত যত্ন নিলে সহজেই দাঁতের সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। 

শেষ কথা

ছোটবেলা থেকে সঠিকভাবে বাচ্চার দাঁতের যত্ন না নিলে বাচ্চা বিভিন্ন ধরনের ডেন্টাল ডিজিজে ভুগতে পারে, যেমন— ক্যারিজ, টুথ ডিকে, বেবি বটল সিনড্রোম, ফ্লুরোসিস, ম্যাল-অ্যালাইনমেন্ট, ইনফেকশন, গাম ব্লিডিং ইত্যাদি। একারণে সচেতনতার সাথে নিয়মিত বাচ্চাকে ব্রাশ করাতে শেখানো উচিত। বাচ্চাদের দাঁতে সমস্যা হলে তাদের ভয় এবং চিৎকারের কারণে ডাক্তারদেরও সমস্যা হয় তাদের ট্রিটমেন্ট দিতে। তারচেয়ে যদি এসব রোগ ওরাল হাইজিন মেনে প্রতিরোধ করা যায় সেটাই বাচ্চার জন্য সবচেয়ে উপকারী।

 

আরও পড়ুনঃ

Default user image

নিশাত বিনতে সাইফ, লেখক, আস্থা লাইফ

আসসালামু আলাইকুম। আমি বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজে পড়াশোনা করছি। প্রতিদিন কলেজে অনেক রোগী দাঁতের সমস্যা নিয়ে আসেন যেগুলোর প্রধান কারণ দাঁতের স্বাস্থ্য নিয়ে অসচেতনতা এবং সঠিকভাবে দাঁতের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে উদাসীনতা। আস্থা ব্লগের নিয়মিত লেখক হয়ে সবাইকে এই বিষয়ে সচেতন করে তোলার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। উদ্দেশ্য একটাই—সুস্থ দাঁত, সুন্দর হাসি যেন ছড়িয়ে দিতে পারি সাধারণ মানুষের মধ্যে।

Related Articles