কম ওজনের নবজাতক হওয়ার কারণ ও ঝুঁকিসমূহ

শিশুর জন্মগত কম ওজন চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ। নানান অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা ও আর্থ সামাজিক অবস্থা জনিত কারণে শিশু কম ওজন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। যা শিশুর পরবর্তী জীবনের জন্য ক্ষতিকর। এই জন্মগত কম ওজন এর ঝুঁকি এড়াতে দরকার সচেতনতা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা।

 

  • বর্তমানে বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ৩১।

  • এর মধ্যে ০-২৮ দিন বয়সী বাচ্চাদের মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ১৭।

  • অর্থাৎ শিশু মৃত্যুহারের প্রায় ৫৫ শতাংশ হচ্ছে নবজাতক।

নবজাতক মৃত্যুর অন্যতম কারণগুলি হচ্ছে অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেওয়া, জন্মের সময় ওজন কম হওয়া, জন্মের সময় শ্বাসকষ্ট, বিভিন্ন ধরণের সংক্রমণ, জন্মগত ত্রুটি ইত্যাদি। তবে স্বল্প বা কম ওজনের নবজাতকের মৃত্যুর ঝুকিও অনেক বেশি। সর্বশেষ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ অনুসারে নবজাতক মৃত্যুর ২২ শতাংশ হয় অপরিণত জন্ম ও জন্মের সময় কম ওজনের কারণে। আসুন এই ব্যপারে বিস্তারিত জেনে নেই।

 

স্বল্প ওজনের নবজাতক কী?

জন্মের সময় শিশুর ওজন যদি আড়াই কিলোগ্রামের (২.৫ কেজি) কম হয় তাহলে ধরে নেয়া হয় নবজাতকটি ওজনহীনতায় ভুগছেন আর শিশুটিকে বলা হয় স্বল্প ওজনের নবজাতক বা Low Birth Weight Baby (LBW)।

সাধারণত প্রিম্যাচিউরড বেবি কম ওজনের হয়ে থাকে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক জন্ম নেয়া শিশুও কম ওজনের হতে পারে। 

জন্মের সময় শিশুর কম ওজন মূলত তিন ধরণের-

১. কম জন্মকালীন ওজন (LBW)

একটি LBW নবজাতকের ওজন ২.৫ কেজি বা ২৫০০ গ্রামের কম হয়ে থাকে।

২. খুব কম জন্মকালীন  ওজন (VLBW)

একটি VLBW নবজাতকের ওজন ১.৫ কেজি বা ১৫০০ গ্রামের কম হয়।

৩. অত্যন্ত কম জন্মকালীন  ওজন (ELBW)

একটি ELBW নবজাতকের ওজন ১ কেজি বা ১০০০ গ্রামের কম হয়ে থাকে।

 

কম ওজনের নবজাতক হওয়ার কারণ

শিশুর কম ওজন নিয়ে জন্মানোর দুটি প্রধান কারণ হলো-

১. নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে শিশুর জন্ম 

অর্থাৎ যদি শিশুর জন্ম গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগে হয়ে থাকে, সেটিকা বোঝানো হয়। যদি শিশুর জন্ম নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে ই হয়ে যায়, সেই ক্ষেত্রে শিশু জরায়ুতে তার সঠিক বৃদ্ধির সময় টুকু পায় না। মূলত গর্ভাবস্থার শেষ কয়েক সপ্তাহে একটি ভ্রূণের ওজন অনেক বৃদ্ধি পায়, এজন্য পূর্ণ গর্ভাবস্থায় শিশুর মাতৃ গর্ভে থাকা প্রয়োজনীয়।

২. ভ্রূণের বৃদ্ধির সীমাবদ্ধতা

ভ্রূণের বৃদ্ধির সীমাবদ্ধতা (FGR) এমন একটি অবস্থাকে বোঝায় যেখানে একটি ভ্রূণ তার বংশগত ভাবে নির্ধারিত সম্ভাব্য আকার অর্জন করতে অক্ষম হয়। প্লাসেন্টার বিভিন্ন রোগ ও সমস্যার কারণে ও ভ্রূণ এর বৃদ্ধি আটকে যায়। একারণে  শিশুর ওজন জন্মগত ভাবেই কম হয়ে থাকে।

কম ওজনের নবজাতক হওয়ার অন্যান্য কারণগুলি হচ্ছে-

  • মায়ের অপুষ্টি ও অসুস্থতা 

  • রক্তস্বল্পতা

  • অল্প বয়সে সন্তান ধারণ

  • একাধিক গর্ভধারণ (দু’টি অথবা তিনটি শিশু)

  • জরায়ুতে সংক্রমণ

  • জরায়ুর অস্বাভাবিকতা 

  • ক্রোমোজোম অস্বাভাবিকতা

  • উচ্চ রক্তচাপ

  • জেস্তেসনাল টক্সিমিয়া এবং ম্যালেরিয়া

এছাড়াও সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা ও শিক্ষাগত অবস্থাও এই বিষয়টির সাথে সম্পর্কিত।

 

যেসব গর্ভবতী মায়েরা কম ওজনের নবজাতকের ঝুঁকিতে থাকেন 

১. অকাল প্রসব বা আর্লি লেবোর

গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহ আগে অকাল প্রসবের ফলে নবজাতকের ওজন কম হতে পারে।

২. দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা এবং ওষুধের প্রভাব

মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, বা হৃদপিণ্ড বা ফুসফুসের সমস্যা থাকলে বা গর্ভবতী মা যদি এই সমস্যাগুলোর জন্য কোনোরূপ ওষুধ নিয়মিত গ্রহণ করে থাকেন তবে শিশু কম ওজন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করতে পারে।

৩. মায়ের বয়স এবং ওজন

খুব অল্প বয়স্ক মা (১৫ বছরের কম) এবং ৩৫ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে শিশুর জন্মদানের ক্ষেত্রে কম ওজন এর ঝুঁকি বেড়ে যায়। 

গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত ওজন নিয়ন্ত্রণ না রাখতে পারলেও কম ওজনের নবজাতক হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

৪. ড্রাগ এবং অ্যালকোহল গ্রহণ

মায়ের ধূমপান, মদ্যপান এবং মাদকের ব্যবহার পাশাপাশি প্রসবপূর্ব যত্নের অভাবে নবজাতক কম ওজনের হতে পারে।  

৫. পরপর সন্তান ধারণের সময়সীমা কম হলে

সন্তান জন্মদানের কিছু মাস পর পুনরায় আবার সন্তান ধারণ করলে ঝুঁকি বাড়াতে পারে। 

৬. বিভিন্ন সংক্রমণ এবং দূষণ

রুবেলা, চিকেন পক্স এবং নির্দিষ্ট কিছু STI বা যৌনবাহিত সংক্রমণের পাশাপাশি বায়ু দূষণ এবং সীসার এক্সপোজারের কারণে শিশুর ধীর বৃদ্ধি এবং কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ এর মত ঘটনা ঘটতে পারে। 

৭. মায়ের প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য 

গর্ভবতী মায়ের প্রতি পারিবারিক সহিংসতা, শারীরিক, যৌন বা মানসিক নির্যাতন একজন মায়ের স্বাস্থ্য এবং গর্ভে তার শিশুর বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করতে পারে। মায়ের প্রতি যত্নের অভাব, অনিশ্চিত খাদ্য ও পুষ্টি মান ইত্যাদি বিষয়ে বৈষম্য ও কম ওজনের শিশু জন্মদানের বিশেষ কারণ।

 

কম ওজনের নবজাতক হওয়ার ৯টি ঝুঁকি

১. শিশুর শারীরিক তাপমাত্রা কমে যাওয়া

ইনকিউবেটর, রেডিয়েন্ট ওয়ারমার, কাপড়চোপড় ইত্যাদির সাহায্যে কম ওজনের নবজাতককে সুরক্ষা দেয়া প্রয়োজন । কম ওজনের (<২.৫ কেজি) বা সময়ের আগে জন্ম নেয়া (<৩৭ সপ্তাহ) শিশুরা শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাদের প্রয়োজন ২০ ঘন্টা ত্বকের স্পর্শ প্রতিদিন। (UNCEF Bangladesh) 

২. ফুসফুসের গঠন ঠিকঠাক মত না হওয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা

কম ওজনের শিশুর প্রায় ৭৪ শতাংশ এআরডিএস (অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোম) নামক রোগে ভোগে। সারফেকটেন্টের অভাবজনিত কারণে জন্মের চার ঘণ্টার মধ্যে শিশুর শ্বাসপ্রশ্বাসের অসুবিধা দেখা যায়।

৩. রক্তচাপ কমে যাওয়া

জন্মগত হৃদ্ত্রুটি ও অন্যান্য কারণে শিশুর রক্তচাপ কমে যায় 

৪. জন্ডিস

বিলিরুবিনের মাত্রা বেশী থাকায় এমন শিশুদের জন্ডিস দেখা দেয়া

৫. অপুষ্টিতে ভুগতে থাকা

কম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুরা বেশিরভাগ সময় বুকের দুধ টেনে খেতে পারে না। ফলে তারা চরম অপুষ্টিতে ভোগে।

৬. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা

স্বল্প ওজনের নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কম থাকে। যার ফলে ঘন ঘন বিভিন্ন রোগে সক্রমিত হয়।

৭. ডাইজেস্টিভ সিস্টেম বা অন্ত্রে সমস্যা

কম ওজনে জন্ম নেওয়া শিশুদের এনইসি (Necrotizing Enterocolitis) হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এটি একটি প্রাণঘাতী রোগ যা প্রায় প্রচণ্ডভাবে নবজাতককে প্রভাবিত করে যার মৃত্যুহার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে।

৮. চোখে সমস্যা

প্রায় ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুদের রেটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচুরিটি দেখা যায়।

৯. মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রক্তপাত

প্রায় ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুদের  মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে মারাত্মক রক্তপাত ঘটতে পারে।

 

শিশুর স্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি

১. শিশুর গড় ওজন বৃদ্ধি তাদের জন্মের পরবর্তী তিন মাসের জন্য প্রতিদিন ২৫ গ্রাম হয়। এটি পরের দুই ত্রৈমাসিকে কম হবে।

২. ওজন বৃদ্ধির প্যাটার্নটি দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে যথাক্রমে ২০ গ্রাম এবং তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ১৫ গ্রাম হয়।

৩. এক মাসে নবজাতক শিশুর গড় ওজন বৃদ্ধি প্রতি সপ্তাহে ১৭৫ থেকে ২০০ গ্রাম হয়। 

৪. এটি মাসে ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম (আনুমানিক) হিসাবে গণনা করা যায়। 

৫. পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার পেলে  শিশুর ওজন পাঁচ বা ছয় মাসের মধ্যেই বাড়তে থাকবে। 

 

কম ওজনের নবজাতকের  যত্ন

স্বল্প ওজনের নবজাতকের যত্ন করার একটি বিশেষ পদ্ধতি হচ্ছে, ‘ক্যাঙারু মাদার কেয়ার’ সংক্ষেপে যাকে বলে কেএমসি। এ ধরণের শিশুর বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও জটিলতা এড়াতে এ পদ্ধতির মাধ্যমে যত্ন নেয়া হয় পাশাপাশি এতে মা ও শিশুর নিবিড় মানসিক বন্ধন তৈরি  হয়, যা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ সহজতর করে। 

কেএমসি পদ্ধতির মূল অংশ দুইটি —

  • ত্বকে ত্বক স্পর্শ।

  • শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো। 

সফল কেএমসির জন্য এ দুটো কাজ সঠিকভাবে করতে হবে। তাহলে শিশুর ওজন দ্রুত বৃদ্ধি পাবে এবং তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশও দ্রুত ঘটবে। এ পদ্ধতিতে শিশু যেহেতু মায়ের বুকে সারাক্ষণ নিবিড়ভাবে থাকে, সেজন্য তার নবজাতকের শরীর সবসময় উষ্ণ থাকে। ফলে শিশুর শারীরিক তাপমাত্রা  কমে যাওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে হ্রাস পায়। 

কম ওজন এর নবজাতকের যত্ন নেয়ার ক্ষেত্রে যে ব্যপারগুলি খেয়াল রাখতে হবে -

  • সব সময় শিশুটিকে উষ্ণ রাখতে হবে, তাপমাত্রা কমতে দেওয়া যাবে না

  • পরিষ্কার হাতে শিশুকে ধরতে হবে এবং শিশুর পরিধানের কাপড়ও খুব পরিষ্কার রাখতে হবে। অর্থাৎ রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করার বাবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

  • শ্বাস নিতে কোনো সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভেতরের লালা এবং নাকের সর্দি পরিষ্কার করে দিতে হবে। 

শিশুর ওজন বেশ কম হলে শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে রাখা উচিত।  সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত এর জন্য মায়ের দুধের পাশাপাশি নাকে নল দিয়ে খাবার দেওয়া এমনকি শিরার মাধ্যমেও খাবার দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

কম ওজনের শিশুর জন্য পুষ্টিকর খাদ্য অবশ্যই প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মায়ের দুধের বিকল্প নেই।  সবধরণের পুষ্টিগুন মায়ের দুধে বিদ্যমান। এছাড়াও, মায়ের দুধের পাশাপাশি তার জন্য মাল্টি ভিটামিন ও মিনারেলেরও প্রয়োজন হতে পারে যা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পরামর্শ অনুযায়ী শিশুকে দেয়া যেতে পারে।

এভাবে নবজাতকের ওজন বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হয়।  শিশুর তাপমাত্রা অতিরিক্ত কমে গেলে তাকে ইনকিউবেটরে দেয়া উচিত পাশাপাশি নবজাতক এর ইনফেকশন প্রতিরোধ করার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এর পরামর্শ নিতে হবে।


 

আরও পড়ুনঃ

 

Default user image

রাইসা মেহজাবীন, লেখক, আস্থা লাইফ

রাইসা মেহজাবীন, গভর্নমেন্ট কলেজ অফ এপ্লাইড হিউম্যান সায়েন্স এ ডিপার্টমেন্ট অফ ফুড এন্ড নিউট্রিশন এ পড়ালেখা করছি। পড়ালেখার পাশাপাশি খাদ্য ও পুষ্টি নিয়ে লেখালেখি করছি। স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে খাদ্য ও পুষ্টি সচেতনতা। সেই লক্ষ্যেই এই বিষয়ক লেখালেখিতে মনোনিবেশ করা।

Related Articles