শিশুর ডায়াপার সম্পর্কে ১০টি তথ্য যা প্রতিটি পিতামাতার জানা দরকার
কোন ডায়াপারটা আপনার শিশুর জন্যে ভালো হবে, ডায়াপার কতক্ষণ পর পর বদলানো উচিৎ, বা ডায়াপার ব্যাবহারের ফলে আপনার শিশুর কোন ক্ষতি হচ্ছে কিনা তা জানতেই পড়ুন আজকের বিশেষ লেখাটি।

শিশুর জন্য ডায়াপার বর্তমান সময়ে আর কোন বিলাসিতা নয়, বরং প্রয়োজন হিসাবে দেখা দিয়েছে। ব্যাস্ত জীবনের সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য হোক, অথবা শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য – ডায়াপারই এখন আধুনিক মায়েদের প্রথম পছন্দ। তবে এটি ব্যাবহারের বিপক্ষে যে একেবারে কোন যুক্তি প্রচলিত নেই তাও কিন্তু নয়। তবু আমাদের সমাজের বেশীরভাগ মায়েরাই এখন ডায়াপার এর উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
এদিকে ডায়াপার যারা ব্যাবহার করেন এবং যারা করেন না, এই উভয় গোষ্ঠীর মাঝেই ডায়াপার নিয়ে রয়েছে বেশ কিছু সংশয়। তবে সত্যি বলতে সেই সংশয় সম্পর্কে বিস্তারিত সদুত্তর খুব একটা কোথাও চোখে পড়ে না। তাই আজ এই ব্লগে আমরা চেষ্টা করব ডায়াপার সম্বন্ধে আপনাদেরকে একটা বিস্তারিত ধারণা দিতে। তো চলুন একেবারে গোঁড়া থেকে শুরু করা যাক।
প্রশ্ন-১: ডায়াপার এর উৎপত্তি প্রথম কবে কোথায় হয়েছিল?
উত্তর- বর্তমান সময়ে আমরা ডায়াপার এর যে ধরণটি দেখতে পাই তার উৎপত্তি হয়েছিল উনিশ শতকের দিকে। তবে তখনকার ডায়াপারগুলো কিন্তু এখনকার চেয়ে ছিল অনেকটাই আলাদা। ওই সময়ের ডায়াপারগুলো কটন কাপড় দিয়ে বানানো হত এবং সেগুলো আটকাবার জন্য সেফটি পিন ব্যাবহার করা হতো। পরে ১৮৮৭ এর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে মারিয়া অ্যালেন নামক এক ভদ্রমহিলা প্রথম এই কাপড়ের ডায়াপার এর ম্যাস প্রোডাকশন শুরু করেন।
প্রশ্ন-২: ডায়াপার এর নামকরণ কিভাবে হলো?
উত্তর- মধ্যযুগীয় আমলে ইংরেজি ভাষায় ‘ডায়াপার’ বলতে এমন এক ধরণের সাদা সুতি বা লিনেন কাপড়কে বোঝাতো যার উপরে রম্বাস আকৃতির ডিজাইন থাকত। ধারণা করা হয় যে এই জাতীয় কাপড় থেকেই প্রথম ডায়াপার বানানোর কারণে বা কাপড়কে ঠিক এই প্যাটার্নে কেটে ডায়াপার বানাবার কারণেই এর নাম ‘ডায়াপার’ রাখা হয়েছে।
প্রশ্ন-৩: ডায়াপার কত ধরণের হয়?
উত্তর- দুই ধরণের। ডিসপোজেবল ডায়াপার এবং নন-ডিসপোজেবল বা ক্লথ ডায়াপার। ডিসপোজেবল ডায়াপার বলতে বোঝায় যেগুলো আমরা একবার ব্যাবহারের পর ফেলে দিতে পারি। বাজারে সাধারণত আমরা যে ডায়াপারগুলো দেখি তা সবই এই প্রকারের। আর ক্লথ ডায়াপার হল কাপড়ের তৈরি এক ধরণের ডায়াপার যা আমরা একবার ব্যাবহারের পর ধুয়ে পুনরায় ব্যাবহার অর্থাৎ রিইউজ করতে পারি। যদিও এই ক্লথ ডায়াপার এর ভেতরেও এমন একটা অংশ থাকে যেটা ব্যাবহারের পর ফেলে দিতে হয়।
প্রশ্ন-৪: আমার শিশুর জন্য কোন ধরণের ডায়াপার ভালো হবে?
উত্তর- ডিসপোজেবল বা ক্লথ – দুটোই শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সমানভাবে কার্যকরী। তবে অ্যাভেইল্যাবিলিটির দিক থেকে বিচার করলে ডিসপোজেবল ডায়াপার এর পাল্লাই ভারী থাকে কারণ এগুলো সহজলভ্য। মেট্রোপলিটান শহরের সুপার স্টোর থেকে শুরু করে মফস্বলের মুদি বা ওষুধের দোকান, সবখানেই এগুলো কিনতে পাওয়া যায়। তবে খরচ এবং পরিবেশগত দিক থেকে বিচার করতে গেলে ক্লথ ডায়াপারই বেস্ট। কারণ রিইউজ করতে পারার কারণে ডিসপোজেবল ডায়াপার এর চেয়ে এর খরচ পড়ে প্রায় অর্ধেক বা তারও কম। আর কাপড় দ্রুত পচনশীল হওয়ায় এটি পরিবেশেরও ক্ষতি করে অনেক কম।
প্রশ্ন-৫: আমার শিশুর জন্য ডায়াপার এর সাইজ বা টাইপ নির্ধারণ করব কিভাবে?
উত্তর- বাজারে যে ডায়াপারগুলো পাওয়া যায়, তা সে যে ব্র্যান্ড এরই হোক না কেন, প্রতিটার প্যাকেটের গায়ে সাইজ এবং সেটা কত কেজি ওজনের বাচ্চারা ব্যাবহার করতে পারবে তা উল্লেখ থাকে। যেমন ধরুন কোন এক ডায়াপার এর প্যাকেটে সাইজ লেখা আছে S বা Small, তার নীচে হয়ত লেখা আছে ০-৪ কেজি পর্যন্ত। অর্থাৎ আপনার বাচ্চার ওজন যদি ৪ কেজি বা তার কম হয় তাহলে এই সাইজটা তার জন্য উপযুক্ত। তবে এই সাইজের কোন ইউনিভার্সাল মান নেই। যেমন এক ব্র্যান্ডের ডায়াপারে হয়ত দেখলেন S সাইজ ০-৪ কেজি পর্যন্ত, আবার আরেকটায় হয়ত দেখলেন ০-৩ কেজি পর্যন্ত। তাই প্রথমবার কেনার সময় আপনার শিশুর বয়সী অন্য শিশুরা কোন সাইজটা ব্যাবহার করছে সেটা জেনে অথবা অনুমানের উপর নির্ভর করে আপনাকে কিনতে হবে। এরপর যখন শিশুকে পরানো শুরু করবেন তখন নিজেই বুঝতে পারবেন যে এই সাইজটা তার জন্য ঠিক আছে কিনা। এছাড়া বাজারে যে দুই টাইপের ডায়াপার পাওয়া যায় – স্ট্র্যাপ সিস্টেম এবং প্যান্ট সিস্টেম – এর মধ্যে যেটাতে আপনার শিশু বেশী কমফোর্টেবল বোধ করে সেটাই আপনি ব্যাবহার করতে পারেন।
প্রশ্ন-৬: ডায়াপার কতক্ষণ পর পর বদলানো উচিৎ?
উত্তর- এটি নির্ভর করে ডায়াপার এর শোষণক্ষমতা কতখানি এবং আপনার শিশু কত বার হিসু করছে তার উপর। সাধারণত বিশেষজ্ঞরা ২/৩ ঘণ্টা অন্তর ডায়াপার বদলাবার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সেটা দিনে হোক, অথবা রাতে। তবে আপনার শিশু যদি কোন কারণে বেশিবার হিসু করে তাহলে এর আগেও বদলে দেবার প্রয়োজন হতে পারে। কিছু কিছু ব্র্যান্ডের ডায়াপারে ওয়েটনেস ইন্ডিকেটর দেয়া আছে যেটা দেখলে বোঝা যাবে যে ডায়াপার কতখানি ভিজেছে। ওটা দেখেও ডায়াপার বদলাবার সময় নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে বাচ্চা হাগু করলে সাথেসাথেই ডায়াপার বদলে দিতে হবে।
প্রশ্ন-৭: ডায়াপার বদলাবার সময় কি কি জিনিস খেয়াল রাখতে হবে?
উত্তর- ডায়াপার বদলাবার সময় বেশ কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে-
-
ডায়াপার বদলাবার সময় শিশু যাতে যথাসম্ভব কম নড়াচড়া করতে পারে সে ব্যাপারে ব্যাবস্থা নিন। প্রয়োজনে শিশুর দুপাশে বালিশ দিয়ে দিন।
-
ডায়াপার খোলার আগে শিশুর নিম্নদেশের নীচে একটা কাঁথা বা তোয়ালে বিছিয়ে দিন, যাতে খোলা অবস্থায় হিসু করলেও বিছানা অথবা আপনি ভিজে না যান।
-
স্ট্র্যাপ আলগোছে খুলে বা প্যান্ট দুপাশ থেকে ছিঁড়ে বাবুর দুই পা আলতো করে ধরে খানিকটা উঁচু করে ডায়াপার টেনে সরিয়ে নিন।
-
এবার শিশুর যে জায়গাগুলো ডায়াপারে ঢাকা থাকে সেগুলো ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিন। পরিষ্কার করার জন্য নরম সুতি কাপড় হালকা গরম পানিতে ভিজিয়ে ব্যাবহার করতে পারেন অথবা ওয়েট টিস্যু ব্যাবহার করতে পারেন। পরিষ্কার করার সময় অবশ্যই সামনের দিক থেকে পিছনের দিকে মুছবেন। কারণ পিছন থেকে সামনে মুছলে শিশুর, বিশেষ করে মেয়ে শিশুর ইনফেকশনের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
-
মুছিয়ে দেবার পর কিছুক্ষণ জায়গাটা উন্মুক্ত রেখে শুকিয়ে নিন। এরপর প্রয়োজনমত বেবি পাউডার, বেবি লোশন, অথবা ডায়াপার জেল লাগিয়ে নতুন ডায়াপার পরিয়ে দিন। এই পাউডার বা জেল শিশুর ত্বকে র্যাশ ওঠা প্রতিরোধ করবে।
-
ডায়াপার বদলের পর পুরনো ডায়াপারটা ময়লার পাত্রে ফেলে দিন। আরও ভালো হয় যদি পলিথিনে মুড়ে ফেলতে পারেন, তাতে ওই ডায়াপার থেকে রোগজীবাণু ছড়াবার আশংকা থাকে না। এরপর আপনার হাত ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে নিন।
প্রশ্ন-৮: ডায়াপার কি আমার শিশুর জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে?
উত্তর- আমাদের সমাজে একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে যে ডায়াপার ব্যাবহার করলে শিশুর কোমর চিকন হয়ে যায়, শিশুর বৃদ্ধি ঠিকমতো হয় না, ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এই ধারনাগুলোর কোন প্রমাণিত ভিত্তি নেই। বরং অনেকসময় দেখা যায় যে কাঁথা ব্যাবহারের ফলে এটা বুঝে ওঠা মুশকিল হয়ে যায় যে শিশু কখন হিসু করল। তখন শিশু আরও তুলনামূলক বেশী সময় ভেজা অবস্থায় থাকে যেখান থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে বা শিশুর র্যাশ হতে পারে। তাই সঠিক সাইজের ডায়াপার নিয়ম মেনে ব্যাবহার করলে বরং শিশুর স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।
প্রশ্ন-৯: কোন ব্র্যান্ডের বা কেমন দামের ডায়াপার আমার শিশুর জন্য কেনা উচিৎ?
উত্তর- বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এবং দামের ডায়াপার কিনতে পাওয়া যায়। বিদেশী ব্র্যান্ডগুলোর দাম একটু বেশী থাকে, আবার দেশীগুলোর একটু কম। ব্র্যান্ড বা দামের ব্যাপারে আমরা সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলতে চাই না। তবে বাজারে ভালো ব্র্যান্ডের যে ডায়াপার পাওয়া যায় সেগুলোই আমরা ব্যাবহার করার পরামর্শ দেই। কারণ কমদামী ডায়াপার সাধারণত ভালো ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি করা হয় না। তাই এগুলো ব্যাবহারে শিশুর র্যাশ বা অ্যালার্জি জাতীয় সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই দেশী হোক কিংবা বিদেশী, ভালো ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি ডায়াপারই ব্যাবহার করুন।
প্রশ্ন-১০: ডায়াপার দিনে কতক্ষণ ব্যাবহার করা শ্রেয়?
উত্তর- এরকম কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। সঠিক উপায়ে আপনি ২৪ ঘণ্টাই ডায়াপার পরিয়ে রাখতে পারেন। তবে বিশেষজ্ঞরা দিনের একটা অংশ শিশুকে ডায়াপার ছাড়া রাখার পরামর্শ দেন। এতে শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
কর্মজীবী হোক অথবা গৃহিণী, ডায়াপার এখন সব মায়েদেরই প্রথম পছন্দ। তাই আমরা চেষ্টা করলাম ডায়াপার সম্পর্কে আপনাদেরকে একটা সম্যক ধারণা দিতে। এ থেকে আপনি উপকৃত হলেন কিনা, বা আপনার নিজস্ব কোন অভিজ্ঞতা থাকলে সেটা শেয়ার করতে পারেন আমাদের সাথে। আর যদি এই ব্লগ আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে সোশাল সাইটে শেয়ার করে নতুন মায়েদের জানিয়ে দিতে পারেন। পরিশেষে, পৃথিবীর সকল শিশু ভালো থাকুক, সুস্থ্য থাকুক, আমাদের আস্থা পরিবারের পক্ষ থেকে এই কামনা করে আজকের লেখা শেষ করছি। ধন্যবাদ।