আপনার শিশু কি ঠিকমত দৃষ্টি বিনিময় করছে?

শিশুদের দৃষ্টি বিনিময় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? শিশুদের দৃষ্টি কিভাবে বিকশিত হয়? শিশুদের দৃষ্টি বিনিময়ে কাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি? অটিজমের সাথে দৃষ্টি বিনিময়ের সম্পর্ক কী?

আপনার শিশু সন্তান যখন  প্রথমবারের মতো আপনার চোখে চোখ রাখে, নিশ্চয়ই সেই মূহুর্তটি আপনার হৃদয়ে একটি অসাধারণ সুখের অনুভূতি তৈরি করে। বাবা-মায়ের দীর্ঘ অপেক্ষার পর যখন তাদের বাচ্চা তাদের প্রত্যাশা পূরণ করে চোখে চোখ রেখে একবার তাকায়, তখন সেই বাবা-মা অত্যন্ত আবেগে আপ্লুত হোন এক প্রশান্তি অনুভব করেন। জন্মের পর থেকে শিশুদের শারীরিক বিকাশের সাথে সাথে তাদের পারস্পরিক যোগাযোগের বিকাশ হওয়ার বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ শিশুই নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে তাদের (আই কন্টাক্ট) দৃষ্টি যোগাযোগের বিকাশ লাভ করে। শিশুদের বাবা-মায়ের প্রতি আই কন্টাক্ট যদি কিছুটা তাড়াতাড়ি বা দেরিতে হয়, তা নিয়ে বাবা-মায়ের উদ্বিগ্ন হবার কোন কারণ নেই। কারণ এরফলে শিশুদের সার্বিক বিকাশের উপর তেমন প্রভাব পড়েনা। 

আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন, আপনি যখন তার সাথে হাসছেন, খেলাধূলা করছেন বা গান গাইছেন, তখন সে আপনার দিকে তাকাবে। এমনকি সে যদি সরাসরি নাও তাকাতে পারে, তবে তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন- হাত, পা নেড়ে সেসব প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দেয়। কখনো কখনো আপনার কথা বলার সাথে সাথে সে হাসি দিয়ে কিংবা অঙ্গভঙ্গি করার মাধ্যমে আপনার সাথে যোগাযোগ করবে। শিশুর দৃষ্টি যোগাযোগ উন্নতি হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এর মধ্য দিয়ে তাদের অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের উপরও প্রভাব পড়ে। প্রথম বছরেই বাচ্চা আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে। তাই তাদের দিকে অবশ্যই লক্ষ্য করুন, তাদের প্রতি মনোযোগ দিন এবং তাদের চোখে চোখ রেখে যোগাযোগ করুন। 

 

শিশুদের দৃষ্টি বিনিময়ের গুরুত্বঃ

শিশুদেরকে দুনিয়া সম্পর্কে জানতে, ভাষাকে আয়ত্ত করতে ও আবেগ প্রকাশ সম্পর্কে জানার জন্য তাদের দৃষ্টিগত যোগাযোগ বা বড়দের চোখের দিকে তাকানো এবং তাদের ভাষা বুঝতে পারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে সাধারণত ঘ্রাণ, স্পর্শ ও দৃষ্টির দ্বারা তারা আশপাশের সব কিছুকে চিনতে ও জানতে পারে। তাই দৃষ্টি শক্তির বিকাশ আবেগ এবং বুদ্ধিবৃত্তি উভয় দিক দিয়েই তাৎপর্য বহন করে। সাধারণত বাবা-মা বা অন্য কেউ যখন কোন শিশুর সাথে কথা বলে, তাদের আদর করে, তাদের সাথে বিভিন্ন খেলনা নিয়ে খেলা করেন তখন তাদের দৃষ্টি সেই ব্যক্তির চেহেরার দিকে থাকে এবং তাদের হাতে থাকা বস্তুর দিকে শিশুটির নজর পড়ে। আর এইভাবে তাদের মানসিক বিকাশ ঘটে ও তাদের কন্ঠস্বর, হাসি এবং সেই মানুষটিকে পুনরায় চিনতে সক্ষম হয়। শিশুদের সাথে ঘনঘন অঙ্গভঙ্গি করা, কথা বলা ও মেলামেশার মধ্য দিয়ে শিশু তাদের এসব বিষয়কে অনুসরণ করে। তাই বাচ্চাদের বিভিন্ন বস্তু, পরিবেশ, ভাষা ও তথ্য সম্পর্কে দ্রুত শেখাতে তাদের সাথে সবসময় কথা বলতে হবে, মাঝে মাঝে গান গাওয়া কিংবা কোন কিছু পড়ে শোনাতে হবে। যাতে করে তাদের দৃষ্টির পাশাপাশি মানসিক বিকাশ তরান্বিত হয়।

শিশুদের পরিপূর্ণভাবে বেড়ে উঠতে দৃষ্টি বিনিময় কতগুলি গুরুতপূর্ণ বিষয়ের উপর ভূমিকা রাখে। আসুন জেনে নাই সেগুলি সম্পর্কেঃ

চোখের যোগাযোগ বা আই কন্টাক্ট হলো  ভাষাগত দক্ষতার প্রাথমিক নির্দেশকঃ

স্বভাবতই আপনারা খেয়াল করবেন শিশুরা প্রথমেই তার সামনে যে আছে তার অন্যন্য অঙ্গের দিকে না তাকিয়ে মুখে র দিকে তাকায়। কারণ অল্প বয়সের শিশুদের চোখের দৃষ্টি বেশি দূরে যায় না। শিশুরা খুব সম্ভব চার দিন বয়সেই তার মায়ের চেহেরা চিনতে পারে। ভাষাবিদরা মনে করেন, শিশু ও প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যবর্তী দৃষ্টি যোগাযোগ ও ভাব বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে তাদের আই কন্টাক্ট ও ভাষার মধ্যে একধরনের মস্তিষ্ক-শরীরবৃত্তিয় (নিউরোবায়োলজিকাল) সম্পর্ক স্থাপিত হয়। যার ফলে শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের কথা-বার্তাকে অনুসরণ করতে পারে ও সহজে ধীরে ধীরে মায়ের মুখের ভাষা শিখতে পারে।

শিশুদের আচরণ ও তাদের বেড়ে ওঠার উপর করা একটি গবেষণায় প্রকাশিত হয় যে, “প্রাথমিক পর্যায়ের ‘জয়েন্ট এটেনশন’ (শিশু ও প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে সহজ যোগাযোগ মাধ্যম) দক্ষতা হলো অধিক পরিমাণে শব্দ শেখার মতো একটি নির্দেশক।” অর্থাৎ আপনি যখন কোন একটি নির্দিষ্ট বস্তুর দিকে তাকাচ্ছেন, তখন শিশুটি প্রথমে বস্তুটিকে দেখছে তারপর আপনার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। এটির মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে যে আপনি যা করছেন, সে বুঝতে পারছে যে তাকে সেই কাজটি করা উচিৎ এবং সে তাই করছে। আর এই যোগাযোগের মাধ্যমকে পিতামাতা-শিশু সম্পর্ক বা ‘পেরেন্ট-চাইল্ড রিলেশনশীপ’ বলে অভিহিত করা হয়।

আই কন্টাক্ট শিশুর শিক্ষা ও যোগাযোগ দক্ষতা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে

প্রতিটা বাবা-মা চান তাদের নবজাতক শিশুটির সংস্পর্শে থাকতে এবং যতটা সম্ভব তার যত্ন নিতে। বাচ্চাদের কথা বলা বা যোগাযোগের উন্নতির ক্ষেত্রে ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য যা কিছু করা দরকার তাই করেন। আর সেই লক্ষ্যে পৌছাতে বাবা-মায়ের কেবল শিশুর সাথে আই কন্টাক্ট করলেই যথেষ্ট। কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটির গবেষকদের মতে, “আপনি যখন আপনার নবজাতকের চোখে চোখ রাখেন, তখন তার মস্তিষ্কে একধরনের সংকেত পাঠানো হয় এবং তার মস্তিষ্ক তাকে আপনার দিকে তাকাতে বাধ্য করে।” 

যখন মা শিশুকে দুগ্ধ পান করায় তখন শিশুরা মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং এইভাবে তাদের সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতার ভিত্তি তৈরি হয়ে যায়। আট থেকে পনেরো মাস বয়সের শিশুদের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রাপ্ত বয়স্করা কোন একটি বস্তুর দিকে তাকালে তারাও ঠিক সেই বস্তুটির দিকে তাকাচ্ছে।

যেহেতু শিশুদের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে তাদের আচরণগত ও মানসিক পরিবর্তন সাধিত হয়, তাই তাদের সাথে সর্বদা বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করতে হবে এবং তাদের চোখে চোখ রেখে যোগাযোগ করতে হবে। অনেক শিশু ট্যারা কিংবা অটিস্টিক হতে পারে। তবে যারা জন্মের পর থেকেই ভালো পরিবেশ ও প্রত্যেকের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সামাজিক যোগাযোগ করে এবং তাদের সাথে আই কন্টাক্ট করে সে ক্ষেত্রে তাদের কিছু প্রতিবন্ধকতা এড়ানো সম্ভব।

আই কন্টাক্ট বা দৃষ্টি বিনিময় শিশুর মস্তিষ্কের সমন্বয় সাধন করেঃ

কিছু গবেষণায় জানা যায়, শিশুদের সাথে আই কন্টাক্ট বা দৃষ্টি বিনিয়ময়ের মধ্য দিয়ে একে অপরের মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে। শিশুদের সাথে আই কন্টাক্ট করার ফলে তারা যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরো বেশি উৎফুল্ল হয় এবং বয়স্কদের যেকোন ইঙ্গিত বুঝতে সক্ষম হয় ও তাদের ইশারায় সাড়া প্রদান করে। একইভাবে বাবা-মা ও বাচ্চাদের মধ্যকার খুব ভালো বোঝাপড়ার উন্নতি হয় এবং বাচ্চাদের প্রাথমিক স্তরের যোগাযোগ দক্ষতা আরোও কার্যকর করে তোলে। যখন শিশুর সাথে বাবাা-মায়েরা কথা বলে বা ভাব বিনিময় করে তখন শিশুদের দৃষ্টি, হার্ট রেট এবং আবেগের সমন্বয় সাধিত হয়। গবেষকরা বলেন, শিশুদের মস্তিষ্ক বিকাশের সময়টি একটি জটিল সময়। আর এই সময়ে বাবা-মায়েরা তাদের শিশুর সাথে পারস্পরিক যোগাযোগ করার মাধ্যমে তাদের যোগাযোগ এর দক্ষতাকে কার্যকরভাবে উন্নত করতে পারেন।

উল্লেখিত গবেষণার মূল বিষয় হলো দৃষ্টি বিনিময় ও কথোপকথন উভয়ই শিশুদের যোগাযোগ বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এটি অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে প্রমাণিত হয় যে, উক্ত প্রক্রিয়া দ্বারা বাবা-মা সক্রিয়ভাবে শিশুর সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন এবং এটি কথা বলার ও শোনার সময়কে একই সাথে সমন্বয় করে।

 

চোখের দৃষ্টির বিকাশঃ 

শিশুদের বেড়ে ওঠার সাথে সাথেই তাদের দৃষ্টি শক্তির বিকাশ হতে থাকে। আমরা যদি শিশুর জন্মের পর প্রথম কয়েক মাস তাদের প্রতি লক্ষ্য করি তাহলে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো পরিলিক্ষিত হবে।

  • শিশুরা শুধু তাদের খুব কাছের (৮ থেকে ১৫ ইঞ্চি দূরত্বের) কোন বস্তুর দিকে তাকাতে পারে।

  • কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় শিশুরা জন্মের ৭ ঘন্টার মধ্যেই তাদের মায়ের চেহেরা চিনতে পারে এবং তাদের চোখ মুখে সেই অবয়ব ফুটে ওঠে।

  • বাচ্চাদের বয়স যখন ৬ থেকে ১০ সপ্তাহে পৌছায় তখন তারা নিজে থেকেই তাদের চোখ এদিক ওদিক ফিরাতে পারে ও আশপাশের বস্তু দেখতে পারে।

  • ৩ মাস বয়সেই শিশুরা তাদের মায়ের বা সেবাপ্রদানকারীর নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে কোন ইঙ্গিত করলে বা তাদের চোখের সামনে কোন দৃশ্যমান বস্ত ধরলে তারা তা অনুসরণ করতে সক্ষম হয়।

  • ৯ থেকে ১১ মাস বয়সের বাচ্চারা প্রাপ্ত বয়স্কদের দৃষ্টি সুনির্দিষ্টভাবে অনুসরণ করতে পারে। অর্থাৎ বড়রা যেভাবে যেদিকে তাকাতে পারে, শিশুরাও তাদের মতো এদিক ওদিক ফিরে তাকাতে পারে।

 

বাবা-মা কিভাবে শিশুকে দৃষ্টি বিনিময়ে উৎসাহ প্রদান করতে পারে?

আপনার বাচ্চার আইকন্টাক্ট দেখেই আপনি বুঝতে পারবেন যে, তার স্নায়বিক বিকাশ ঠিক মতো হচ্ছে কিনা। কারন দৃষ্টি যোগাযোগই নির্দেশ করে তার শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ ঠিকমতো এগোচ্ছে। বাচ্চার তাকানো দেখে আপনি বুঝতে পারবেন, যে সে কি চাচ্ছে বা তার চোখ-মুখ আসলে কি বলতে চায়। শিশু যখন তার দৃষ্টি ও ভঙ্গি দ্বারা তার প্রয়োজনীয়তা ও তার আবেগ প্রকাশ করতে পারে, তখন বাবা-মায়ের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়ে যায় এবং তারা তাকে ও তার চাহিদাগুলোেকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে। আর উভয়ের এমন পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের মধ্য দিয়ে শিশু তার বাবা-মাকে খুব সহজে চিহ্নিত করতে পারে ও সে বুঝতে শিখে আপনি তার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

আপনার শিশু সন্তানটি আই কন্টাক্ট করছে কিনা তা যাচাই করা আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যদি তাদের সাথে কথা বলার পরও তারা এতে সাড়া না দেয় তাহলে তাদের শ্রবণজনিত সমস্যা আছে কিনা তা জানতে হবে। আর সেজন্য বাবা-মাকে সব সময় সন্তানের সাথে কথা বলা, গান শুনানো এবং বিভিন্ন খেলাধূলায় ব্যস্ত রাখতে হবে।

কিছু কৌশল অবলম্বন করে আপনার বাচ্চাকে আই কন্টাক্ট এর প্রতি উৎসাহী করে তুলতে পারেনঃ

  • শিশুদের দৃষ্টি শক্তি খুবই কাছাকাছি থাকে। তাই তাদেরকে দূরের কিছু দেখাতে যাবেন না। প্রথম কয়েক মাসে বাবা-মাকে তাদের থেকে ১০-২০ ইঞ্চি দূরে অবস্থান করে তাদের সাথে আই কন্টাক্ট করতে হবে।

  • আপনার বাচ্চা যখন খুব ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত বা মন খারাপ অবস্থায় থাকে, তখন তাকে কিছু দেখাতে জোর করবেন না। যখন আপনার বাচ্চা স্বতস্ফূর্ত ও সতর্ক থাকে তখন খুব কোমলভাবে তাদেরকে আই কন্টাক্ট করানোর চেষ্টা করতে পারেন।

  • যখন বাচ্চা নিজে থেকে বাবা-মায়ের সাথে ইন্টারেক্ট করতে চায়, সে সময় বাবা-মায়ের উচিৎ তার সাথে কথা বলা, হাসা, গাওয়া, অভিনয় বা অঙ্গভঙ্গি করা। এই রকম পারস্পরিক যোগাযোগ পদ্ধতি শিশুদের মনে দারুন প্রভাব ফেলে ও তাদের মানসিক বিকাশে সহায়তা করে।

  • শিশু যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার দিকে না তাকায় আপনি অপেক্ষা করতে থাকুন এবং তারপর তার সাথে কথা বলা শুরু করুন। আর যখন সে আপনার দিকে তাকায়, তখন আপনি অন্য দিকে তাকাবেন না।

  • যখন আপনার বাচ্চা আপনার দিকে বা কোন বস্তুর দিকে তাকাচ্ছে, তখন আপনি তাকে সেটার নাম ধরে বলুন, তাতে তার ভাষা শেখায় উন্নতি হবে।

  • শিশুরা মানুষের চেহেরা সবচেয়ে বেশি মনে রাখতে পারে। তাই শিশুদের এই মনে রাখার প্রবণতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কিছু বাচ্চা আছে যারা অতিমাত্রায় সংবেদনশীল এবং প্রায়ই তারা আই কন্টাক্ট করতে পারেনা। কিন্তু বাকি বাচ্চাদের সাথে কেবল কথা বললে বা দুষ্টুমি করলেই তারা সাড়া দেয় এবং আই কন্টাক্ট করে।

 

শিশুরা আশেপাশের মানুষদের কাছ থেকেই বেশি শিখেঃ

শিশু মাত্রই যেহেতু অনুকরণ প্রিয়, তাই তাদের সামনে যারাই আসে, কথা বলে, আদর করে, মজা করে, কখনো কখনো সুড়সুড়ি দিয়ে তাদের হাসাতে চায়, শিশুরা এসব বিষয়ের সাথে খুব তাড়াতাড়ি অভ্যস্ত হয়ে যায়। বাবা-মায়ের পাশাপাশি যাদেরকে নিয়মিত তার সাথে কথা বলতে দেখে ও কুলে তুলে আদর করে তাদের মুখের দিকে শিশুরা তাকিয়ে থাকে এবং পরবর্তীতে তাদেরকে চিনতে ভুল করেনা। আর এরই মধ্য দিয়ে শিশুরা তাদের কাছ থেকে কথা বলা, ছোট ছোট শব্দ বলার চেষ্টা করে। বাচ্চারা যখন কারো কাছে কিছু শুনে তখন নিজে নিজে অনেক সময় নানা রকম শব্দ করে। কখনো আবার লোকের মুখে যা শুনে ঠিক তাই বলে ফেলে। বাচ্চাদের সাথে সরাসরি কথা বলার মধ্য দিয়ে যত সহজে তারা ভাষা শিখতে পারে, কোন ভিডিও দেখে বা অডিও শুনে তা সহজে করতে পারেনা। তাই শিশুদের যে যত্ন নেয়, তাদের ডাক ও কথা শুনে এবং তারা যেভাবে অঙ্গভঙ্গি করে শিশুরাও সেভাবে অঙ্গভঙ্গি করে। আপনার বাচ্চা যদি শান্ত থাকে, তার সাথে হাসুন, তার শরীরে কাতুকুতু দিন বা তার সাথে অনবরত শুদ্ধ ভাষায় কথা বলুন। ধীরে ধীরে বাচ্চাটি আপনাকে দেখে তা করার চেষ্টা করবে। সে যখনই কথা বলার জন্য চেষ্টা করছে তাকে আরো বেশী উৎসাহ দিন, লক্ষ্য করবেন সে আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইবে। এভাবে তাকে যত বেশী সময় দিবেন, তার সাথে খেলাধূলা করবেন তত তাড়াতাড়ি সে কথা বলায় পটু হয়ে উঠবে।

 

আই কন্টাক্ট এড়িয়ে যাওয়া; অটিজমের প্রাথমিক লক্ষণ

শিশুদের  জন্মের একবছরের মধ্যেই চিহ্নিত করা উচিত শিশুটি শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ্য নাকি কোন প্রতিবন্ধকতা আছে। যদি প্রথম ১২ মাসের মধ্যে তাদের কোন অস্বাভাবিক বা অটিস্টিক আরচণ চিহ্নিত করা যায়, তবে যথাসময়ে তাদের কিছু থেরাপি প্রয়োগ করার মাধ্যমে সেই আচরণসমূহকে সনাক্ত করতে হবে। শিশুরা যেসব কারণে অটিজম হতে পারে সে লক্ষণ গুলো বাবা-মায়ের জানা দরকার। শুরুর দিকে যেসব শিশু তাদের পিতা-মাতার সাথে চোখ চোখ রাখা এড়িয়ে যায়, বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই লক্ষণটি মূলত অটিজমের সামাজিক দক্ষতা বিভাগের আওতাভূক্ত। শিশুদের প্রাথমিক স্তরের অটিজম চিহ্নিত করতে হলে ছয় মাস বয়সের মধ্যেই তারা আই কন্টাক্ট করছে কিনা তা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। 

শিশু বিশেষজ্ঞরা বাবা-মাকে  শিশুদের আই কন্টাক্ট সনাক্ত করার জন্য তাদের কিছু আচরণগত বৈশিষ্ট পর্যবেক্ষণ করার নির্দেশ দেন। সেগুলো হলোঃ

  • যদি শিশুরা মা-বাবার দিকে না তাকায় 

  • পরিচিতদের চিনতে না পারা

  • বাবা-মা তাদের ছেড়ে গেলে বাচ্চা কাঁদে না

  • বাচ্চা অপরিচিত কাউকে দেখলে তেমন কোন উদ্বেগ প্রকাশ করে না

  • নির্দিষ্ট একদিকে না তাকিয়ে অন্য দিকে তাকায়

  • কোন দৃশ্যমান বস্তুর দিকে তাকাতে সমস্যা হয়

শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের বয়স তিন মাস হওয়ার পরই তারা প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে আই কন্টাক্ট বা চোখে চোখ রাখবে। আর যদি প্রথম ছয় মাসের মধ্যে তারা চোখে চোখ রাখা এড়িয়ে যায়, তাহলে খুব দ্রুত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে।

 

শিশুদের ক্ষেত্রে যা বিবেচনায় রাখতে হবেঃ

যেহেতু শিশুরা প্রথম কয়েক বছর কথা বলতে পারেনা, তাই আমরা অনেকেই শিশুদের বুঝতে পারিনা। তারা কেন কাঁদে, তাদের ক্ষিধা পেয়েছে কিনা, তারা কখন কি করবে ইত্যাদি। কিন্তু বাবা-মায়ের সার্বক্ষণিক পাশে থাকা ও তাদের সাথে পারস্পরিক যোগাযোগের মধ্য দিয়ে শিশুদের মানসিক ও শারীরিক দক্ষতা বোঝা যায়। সেজন্য তাদের প্রতি সর্বদা খেয়াল রাখা, কথা বলা, তাদের শারীরিক ইঙ্গিত বা নড়াচড়া বিশ্লেষণ করে তাদের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে হবে। নবজাতক শিশুর সাথে কেবল মা সবসময় সংযুক্ত না থেকে মা-বাবা দুজনকেই দেখভাল করতে হবে। যদিও শিশুরা বাবার তুলনায় মায়ের সাথেই সর্বোচ্চ সময় অতিবাহিত করে, বিশেষ করে যখন মা দুধ পান করান। তবুও বাবা-মা দুজনের সম্পৃক্ততায় তাদের শিশু অত্যাধিক ঘনিষ্ঠ হয় ও অনেক বেশী সেবা-যত্ন পেতে পারে। যার ফলে শিশু সবচেয়ে নিরাপদভাবে বেড়ে ওঠতে সক্ষম হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে যেসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে তা হলোঃ

  • সর্বদা শিশুর যত্ন ও পরিচর্চা নিশ্চিত করা

  • জন্মের পর অবশ্যই মায়ের দুধ পান করানো

  • সুনির্দিষ্ট সময় খাবার খাওয়ানো ও পুষ্টিগত মান বজায় রাখা

  • শিশুদের সাথে সর্বোচ্চ সময় ব্যয় করা ও চোখে চোখ রেখে কথার অভ্যাস তৈরি করা

  • শিশু কান্না করলে তার সঠিক কারণ খোঁজে বের করা ও সেই অনুরূপ ব্যবস্থা নেওয়া

  • নির্ধারিত সময় টিকাদান

  • তাদের আবেগ ও অঙ্গভঙ্গি বুঝতে পারা

  • নিয়মিত স্বাস্থ্য কর্মীর পরামর্শ গ্রহণ ও মানসম্মত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা

 

একটি শিশু বাবা-মায়ের কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার। তাই আপনারা আপনাদের শিশুদের প্রতি আরো যত্নশীল হবেন এবং সবসময় সতর্ক থাকবেন যেন তাদের সাথে আপনাদের যোগাযোগটা পরিপূর্ণভাবে হচ্ছে। তাদেরকে বেশী করে সময় দেওয়ার চেষ্টা করুন। এতে করে আপনার শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশ যথাযথভাবে হবে।

Default user image

মোঃ অলিউল্লাহ, লেখক, আস্থা লাইফ

সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এর পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের একজন লেখক। বিডিজবস.কম এ কনটেন্ট ডেভেলপার হিসাবে দায়িত্বরত আছি। সবধরনের লেখালেখি, গবেষণা ও বিশ্লেষণ করতে আমার ভাললাগে। মেডিকেল সাইন্স ও মেডিসিনের প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ ও দূর্বলতা থেকেই “আস্থা লাইফ” এর নাম শুনামাত্র কাজ করার জন্যে রাজি হয়ে যাই। একজন সচেতন মানুষ হিসাবে আমার দায়িত্ব মানুষকে শারীরিকভাবে সচেতন হতে সহায়তা করা। আর সেজন্যে “আস্থা লাইফ” এ কাজ করার থেকে ভাল প্লাটফর্ম আর হতে পারেনা।

Related Articles