এই গরমে আপনার শিশুর যত্ন নিবেন যেভাবে

এই তীব্র দাবদাহ ও ভ্যাপসা গরমে আপনার আদরের সন্তানটি কি মানিয়ে নিতে সক্ষম! আপনি কি জানেন গরমে শিশুদের কি কি স্বাস্থ্যগত সমস্যা হতে পারে? তবে চিন্তিত না হয়ে সঠিক সতর্কতা অবলম্বন করলে, আপনি এবং আপনার শিশু গ্রীষ্ম কালটাকে দারুণভাবে উপভোগ করতে পারবেন।

গরমে শিশুদের যেসব স্বাস্থ্যগত সমস্যা হতে পারে

ভ্যাপসা গরমে বা প্রখর রোদে অনেক বাচ্চাদেরই হঠাৎ করেই নানা রকম সমস্যা সৃষ্টি হয়। বাবা মা বুঝতেই পারেন না আসলে কি কারণে বাচ্চা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখে মিলিয়ে নিতে পারেন আপনার বাচ্চারও অতিরিক্ত গরমের কারণে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা-

১) হিট র‍্যাশ

ত্বকে ছোট ছোট কতগুলো লালচে দাগ। এগুলোর কারণে ব্যাথা থাকতে পারে। বেবি পাউডার বা অন্যান্য ট্যালকম পাউডার দিলে এই র‍্যাশ থেকে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়। 

২) সানবার্ন 

সানবার্ন হওয়ার ঘটনা এতটাই সাধারণ যে এটাকে কেউ সমস্যা বলেই মনে করেন না। কিন্তু এটির কারণে ত্বক লালচে হয়ে যেতে পারে, ত্বকের উপরের চামড়া উঠে যেতে পারে। এমনকি দীর্ঘ কয়েক বছর এভাবে সানবার্ন হতে থাকলে একটা সময় এটি স্কিন ক্যান্সার পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে। সানবার্ন থেকে বাঁচতে হলে বাচ্চাকে সানস্ক্রিন ও ছাতা ব্যাবহার করা শেখাতে হবে। 

৩) হিট ক্র্যাম্প

অতিরিক্ত গরমে শরীরচর্চা বা খেলাধুলা করার কারণে ঘামের সাথে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় লবণ এবং অন্যান্য তরল উপাদান বের হয়ে যায়, যার কারণে মাংসপেশিতে ব্যাথা হয়। কিছুক্ষণ পর পর বাচ্চারা পানি পান করতে ভুলে যাওয়ার কারণে তাদের এই সমস্যা আরো বেশি দেখা দেয়।

৪) ক্লান্তি

এটি অপেক্ষাকৃত গুরুতর সমস্যা। গরমে কেউ যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ তরল খাবার না খায় তাহলে এই সমস্যা দেখা দেয়। এর প্রধান লক্ষণগুলো হলো-

  • তৃষ্ণা বেড়ে যাওয়া

  • দুর্বলতা

  • মাংসপেশিতে ব্যাথা

  • বমি ভাব, বমি করা

  • অজ্ঞান হয়ে যাওয়া

  • মাথাব্যথা

  • অতিরিক্ত ঘেমে যাওয়া

  • শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি

 ৫) গরমে শিশুর হিটস্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা

অনেকের ধারণা হিটস্ট্রোক শুধু বড়দের হয়। অনেকে তো এটাকে গুরুত্বই দেন না, ভাবেন গরমে আবার স্ট্রোক হয় নাকি? আসল ব্যাপারটা হলো, তীব্র গরমে বাচ্চা এবং বড় সবারই হিটস্ট্রোক হতে পারে এবং উপরের দুই ধরনের অসুস্থতার চেয়ে এটা অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি গুরুতর। এমনকি এটি বাচ্চাদের মৃত্যুর কারণও হতে পারে।

যখন তীব্র গরমে শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ১০৬° ফারেনহাইট (৪১.১° সেলসিয়াস) বা তার বেশি হয়ে যায়, তখন ব্রেইনের টিস্যুগুলোর ক্ষতি হয়। জরুরী চিকিৎসা যদি না দেওয়া হয় এ অবস্থায় তাহলে এটির কারণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। 

বাচ্চারা যদি ভারী জামাকাপড় পরে থাকে, অথবা দৌড়াদৌড়ি করে এবং একইসাথে পর্যাপ্ত পরিমাণ তরল জাতীয় খাবার না খায় তাহলে তাদের হিটস্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। শহরাঞ্চলে অনেক বাবা মা তাদের বাচ্চাদের মাঝরাস্তায় গাড়ির মধ্যে রেখে কেনাকাটা করতে যান। এমতাবস্থায় বাইরের তাপমাত্রা যদি ৩৩.৯° সেলসিয়াস থাকে, তাহলে গাড়ির ভেতরে মাত্র ২০ মিনিটেই তাপমাত্রা ৫১.৭° সেলসিয়াস হয়ে যেতে পারে। সেই গাড়িতে বাচ্চা আটকে পড়লে তার শরীরের তাপমাত্রাও অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায় এবং হিটস্ট্রোক হয়।

হিটস্ট্রোকের লক্ষণগুলো

  • প্রচন্ড মাথাব্যাথা,

  • বমি ভাব ও বমি করা,

  • প্রচন্ড দুর্বল হয়ে যাওয়া,

  • শ্বাসকষ্ট, 

  • হার্টরেট বেড়ে যাওয়া, 

  • জ্ঞান হারানো,

  • খিঁচুনি, 

  • ঘাম না হওয়া,

  • শরীরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়া,

  • ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। 

হিটস্ট্রোক হলে করণীয়

বাচ্চার মাঝে হিটস্ট্রোকের একাধিক লক্ষণ দেখা দিলে প্রথমেই তাকে ছায়ায় বা ঠান্ডা কোনো স্থানে নিয়ে আসতে হবে। জামাকাপড় খুলে পুরো শরীর পানিতে ভেজানো কাপড় দিয়ে মুছে দিতে হবে। এরপর যত দ্রুত সম্ভব বাচ্চাকে নিয়ে হাসপাতালে বা অন্য কোনো ক্লিনিকে নিয়ে যেতে হবে। বাচ্চার যদি সম্পূর্ণ জ্ঞান না থাকে তাহলে বাচ্চাকে কোনো তরল খাবার বা পানি না দেওয়াই ভালো।

গরমে শিশুর যত্নে কিছু প্রশ্নোত্তর

গরমের উত্তাপ থেকে শিশুকে রক্ষা করতে হলে তাকে অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রা আছে এমন স্থানে রাখতে হবে। পরিমিত পরিমাণ তরল খাদ্য, পানি পান করানো, সুতি বা লিনেন কাপড়ের আরামদায়ক পোষাক পরানো হলে এবং, বাচ্চার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন থাকলে অতিরিক্ত গরমের কারণে সৃষ্টি হওয়া জটিলতা থেকে বাচ্চাকে রক্ষা করা সম্ভব। আসুন জেনে নেই বিস্তারিত-

১) রৌদ্র থেকে কিভাবে শিশুকে সুরক্ষা দিব?

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, তীব্র রোদ থেকে বেঁচে থাকা এবং বেশি বেশি তরল জাতীয় খাবার খাওয়া। এই দুটি বিষয় খেয়াল রাখলে বেশিরভাগ অসুস্থতা থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়। অনেক সময় বাচ্চাদের তৃষ্ণা থাকেনা তাই পানি পান করে না যা একদমই ঠিক নয়। বাচ্চাদের গরমের দিনে বাইরে বের করাও উচিত নয়, আর করলেও ছাতা ও পানির বোতল সঙ্গে নেওয়া উচিত। 

২) গরমে বা ভ্যাপসা গরমে শিশুকে কিভাবে ঠান্ডা রাখব?

কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললেই শিশু এই গরমে সুস্থ থাকবে। এরমধ্যে কিছু হয়তো আপনি ইতোমধ্যে জানেন এবং মেনেও চলেন। নিচের লিস্ট দেখে মিলিয়ে নিতে পারেন বাচ্চাদের সুস্থ রাখতে আপনি কি কি করেন এবং নতুনভাবে কি কি করতে পারেন-

  • ঘুমানোর আগে কিছুক্ষণ এসি অন করে ঘর ঠান্ডা করতে পারেন। অথবা জানালা খুলে ফ্যান ছেড়ে দিলেও ঘর অনেক ঠান্ডা হয়।

  • সম্ভব হলে প্রতি ঘন্টায় শিশুকে লেবুর শরবত, ডাব, স্যালাইন ইত্যাদি দেওয়া উচিত। এতে বাচ্চার শরীর ঠান্ডা থাকে।

  • চওড়া হ্যাট অথবা টুপি পরলেও মাথা ও মুখে রোদ অনেকটা কম লাগে। এর সাথে ছাতা ব্যবহার করা উচিত।

  • সবসময় বাচ্চাকে হালকা রঙের সুতি বা কটন কাপড়ের পোষাক পরিয়ে রাখা উচিত।  

৩) শিশুর থাকার পরিবেশ কেমন হবে?

অনেক সময় অতিরিক্ত গরম পরিবেশের কারণে শিশুর বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়, যেমন ঘুম ঠিকমতো না হওয়া, অতিরিক্ত ঘামের কারণে ঠান্ডা লেগে যাওয়া ইত্যাদি। এসব সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে হলে শিশুর থাকার পরিবেশ আরামদায়ক করা প্রয়োজন। এরজন্য শিশুকে যে ঘরটা সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা এবং বেশি বাতাস চলাচল করে, সেখানে রাখা যেতে পারে। 

ভেজা তোয়ালে ও জামাকাপড় ঘরে শুকানোর জন্য মেলে দেওয়া যেতে পারে, যেন বাতাস ঠান্ডা হতে পারে। বেশি গরম পড়লে ঘরের মেঝেও গরম হয়ে যায় অনেক সময়। এক্ষেত্রে মেঝেতে ঘুমাতে চাইলে শীতল পাটি ব্যাবহার করা যেতে পারে। বিছানায় শীতল পাটি বিছিয়ে দিলেও গরম অনেকটাই কমে যায়। বাচ্চাদের বেশি সময় এয়ার কন্ডিশনের মাঝে রাখা উচিত নয়, এতে পরিবেশ শুষ্ক হয়ে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। অল্প সময় এসি অন করে ঘর ঠান্ডা হয়ে গেলে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। অথবা পোর্টেবল মিনি এয়ার কুলার ব্যাবহার করতে পারেন, এতে ঘরের পরিবেশ ঠান্ডা হয়।

৪) গরমকালে শিশুর পরিধেয় কাপড় কি হবে?

গরমে শিশুকে এমন কাপড় পরাতে হবে যেন সে আরাম বোধ করে। লিনেন, সুতি, কটন কাপড়ের অনেক আরামদায়ক পোষাক বাজারে পাওয়া যায়। এসব কাপড় দিলে বাচ্চারা অতিরিক্ত গরমে অস্বস্তি অনুভব করবে না।

৫) গরমে শিশুর পানিশূন্যতা কিভাবে দূর করব?

গরমকালের সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি সমস্যা হলো পানিশূন্যতা। দৌড়ঝাঁপ, খেলাধুলা করার কারণে ও পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান না করার কারণে শিশুরা পানিশূন্যতায় বেশি ভুগে থাকে। পানিশূন্যতা দূর করার জন্য শিশুকে বেশি বেশি পানি পান করাতে হবে এবং এর সাথে যেসব খাবারে পানির পরিমাণ বেশি, যেমন স্যুপ, ডাল ইত্যাদি খাওয়াতে হবে। গরমের সময় উপকারী খাবারগুলো নিয়ে নিচে আলোচনা করা হয়েছে। 

বাচ্চা যদি অনেক ছোট হয়, তাহলে তাকে ঘন ঘন বুকের দুধ, ফিডার দেওয়া উচিত, এতে পানিশূন্যতা দূর হয়। এর সাথে মা কেও অনেক বেশি পরিমাণে তরল খাবার, পানি পান করতে হবে যেন বুকের দুধের তারল্য ঠিক থাকে এবং এর মাধ্যমে বাচ্চা পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পায়। বাচ্চার বয়স ছয় মাসের বেশি হলে বুকের দুধের পাশাপাশি ফুটানো ঠান্ডা পানিও দেওয়া উচিত। খেয়াল রাখতে হবে যেন বাচ্চা প্রতিদিন অন্তত ১-১.৫ লিটার পানি পান করে।

৬) গরমে শিশুদের খাবার কেমন হওয়া উচিৎ?

অন্যান্য সতর্কতা অবলম্বন করার সাথে সাথে শিশুর খাবারের প্রতিও খেয়াল রাখা দরকার। গরম আবহাওয়ায় এমন কিছু খাবার খাওয়া প্রয়োজন যেগুলো শরীরকে ঠান্ডা রাখতে সহায়তা করে। গ্রীষ্মকালে যেসব ফল পাওয়া যায়, যেমন, তরমুজ, শশা, আনারস, ডাব ইত্যাদি খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে। এসব খাবারে পানির পরিমাণ বেশি তাই পানিশূন্যতাও দূর করতে সহায়তা করে এসব ফলমূল। তাছাড়া দই, আম, কলাসহ অন্যান্য সবজি যেগুলোতে পানির পরিমাণ বেশি সেগুলোও বাচ্চাদের দেওয়া যায়। লেবু, কমলা, জাম্বুরা, অ্যালোভেরার জুসও এক্ষেত্রে অনেক উপকারী। 

বিশেষ বার্তা

এই আর্টিকেল পড়ে গরমকাল চলে আসলেই দুশ্চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। মানুষের সুস্থতার জন্যও রোদের অনেক ভুমিকা রয়েছে। সকাল ও বিকালের হালকা মিষ্টি রোদে কিছু সময় হাঁটাহাঁটি, খেলাধুলা, ব্যায়াম করা সব বয়সের মানুষের জন্যই অত্যন্ত উপকারী। এই রোদ শরীরে ভিটামিন ডি তৈরীতে সহায়তা করে, কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি করে। দুপুরের কাঠফাটা রোদে অনেকক্ষণ সময় কাটালে বা গরমকালের তীব্র তাপদাহে যে সব সমস্যা হতে পারে, সেগুলোই এখানে আলোচনা করা হয়েছে। 

পরিশেষে 

সাধারণভাবে গরম পরিবেশে শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে শিশুর প্রতি সর্বদাই একটু সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিত। গরমের কারণে বাচ্চাদের যেসব সমস্যা হয় সেগুলো এই আর্টিকেলে আলোচনা করা হয়েছে। তবে এসব লক্ষণ শুধুমাত্র অতিরিক্ত গরমের কারণেই হয়না। অন্য কোনো রোগের জন্য অন্য কোনো ঋতুতেও এসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এমন একাধিক সমস্যা যদি হয় বা একটি সমস্যাই প্রকট আকার ধারণ করে, তাহলে দেরি না করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

Default user image

মেঘলা, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি মেঘলা। রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেছি। ভালো লাগে পাহাড় আর ঝর্ণায় ঘুরতে। পছন্দের কাজ বাগান করা আর বিভিন্ন রেয়ার গোলাপ সংগ্রহ করা। বই পড়ার শখ থেকেই লেখালেখির শুরু। আস্থা লাইফের হেলথ ব্লগগুলো লিখতে ভালো লাগে, পাঠকদের সচেতন করার পাশাপশি নিজেও অনেক নতুন কিছু জানতে পারি।

Related Articles