বাচ্চাদের ঠান্ডা কাশি থেকে দ্রুত মুক্তির উপায়!
সর্দি একটি সাধারণ রোগ হলেও দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে সর্দি মারাত্নক জটিলতা তৈরি করতে পারে। যার ফলে শিশুর ঘুম ও স্তন্যপান ব্যাহত হতে পারে। তবে চলুন জেনে আসা যাক, কিভাবে শিশুর সর্দি জনিত সমস্যা মোকাবেলা করবেন।
সর্দি লাগা একটি খুব সাধারণ ভাইরাস জনিত রোগ। Common Cold বা সাধারণ ঠান্ডায়, ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে আমাদের দেহ মিউকাস উৎপন্ন করে। যা থেকে সর্দির উৎপত্তি। সর্দি সাধারণত নিজে নিজেই সেরে যায়। এবং শরীরের তেমন কোন ক্ষতি করে না। তবে শিশুদের জন্য সর্দি কখনও কখনও বিপদ নিয়ে আসতে পারে।
মৌসুম পরিবর্তনের সময় শিশুদের ঠান্ডা কাশি লেগেই থাকে। তবে দুই বছরের কম বয়সী শিশুর সর্দি হলে বাড়তি যত্নের প্রয়োজন। কারণ এ বয়সে শিশু নিজের সমস্যার কথা জানাতে পারে না এবং নিজের শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণও কম থাকে। সর্দিতে বাচ্চার নাকের ছিদ্র বন্ধ হয়ে যেতে পারে যে কারণে তার শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে সমস্যা হয় এবং খাওয়া ও ঘুমের অসুবিধা সৃষ্টি হয়।
যে যে কারণে বাচ্চার সর্দি লাগতে পারে
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ ঠান্ডার কারণে সর্দি লাগে। এছাড়াও অন্য যে কারণগুলি রয়েছে -
-
ব্রঙ্কাইটিস
-
নিউমোনিয়া
-
ইনফ্লুয়েঞ্জা
-
শ্বাসতন্ত্রের সিন্সিটিয়াল ভাইরাস।
সর্দির সাথে অন্য কোন উপসর্গ না থাকে তবে শঙ্কিত হবার কোন কারণ নেই। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে সর্দি লাগা সমস্যার তৈরি করে কারণ তখনো কফ বা সর্দি ঝেড়ে ফেলার প্রবৃত্তি তৈরি হয় না। একটু বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও জটিলতা তৈরি হতে পারে যদি,
-
কোন রোগের কারণে যদি বাচ্চার কাশি দেওয়ার প্রবৃত্তি তৈরি না হয়।
-
কোন অসুস্থতা বা দুর্ঘটনায় যদি শিশুর নার্ভাস সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্থ হয়, সেক্ষেত্রেও বাচ্চা কাশি দিতে পারে না।
-
কিছু সার্জারির পরে জোরে কাশি দিয়ে কফ পরিষ্কার করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এমতাবস্থায় বাল্ব সাকশানিং বা সাকশনিং সিরিঞ্জ এর মাধ্যমে মিউকাস বের করে ফেলা প্রয়োজন।
শিশুর সর্দিজনিত জটিলতায় করণীয়
শিশু ঠান্ডা জনিত সমস্যায় কিছু কাজ শিশুর অবস্থার উন্নতিতে সাহায্য করতে পারে। যেমন,
-
আরামদায় উষ্ণ পানিতে গোসল করানো। এতে শিশুর নাক বন্ধে উপকার হয়।
-
শিশুর খাবার বা ঘুমানোর সময়ে কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা, খেয়াল রাখা। সর্দি লেগে গেলেই খাওয়া-ঘুম ও নিশ্বাসে সমস্যা শুরু হয়।
-
এলার্জির সৃষ্টি করতে পারে এমন সবকিছু শিশুর ঘর থেকে দূরে রাখা। যেমন পুরানো টেডি বিয়ার, ফুল, পোষা বিড়াল ইত্যাদি।
-
দৃশ্যমান সর্দি পরিষ্কার করে ফেলা।
-
কপাল ও নাকের উপরের অংশ মাসাজ করা।
যদি খেয়াল করেন মাত্রারিক্ত সর্দি লাগার কারণে শিশু সমস্যা বেড়ে চলেছে যেমন, বারেবারে কাঁদছে, দুগ্ধ লেহন করতে পারছে না, বা ঘুমাতে সমস্যা করছে, তবে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিন। এ পর্যায়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সাকশন এর মাধ্যমে মিউকাস নিষ্কাশন করতে হতে পারে।
কখন বুঝবেন শিশুর নাক ও মুখের সাকশান ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন?
-
যদি শিশুর নাক টানার শব্দ করে বা নিশ্বাসে ঘড়ঘড় শব্দ হওয়া।
-
ঘনঘন কাশি হওয়া।
-
বুকের ভেতর ঘড়ঘড় শব্দ হওয়া।
-
দুগ্ধ লেহন করতে না পারা।
-
শিশুর ঠোঁট ফ্যাকাশে বা নীলাভ হয়ে যাওয়া।
সর্দি লাগলে শিশুর নাক বন্ধ হয়ে যেতে পারে যার ফলে শিশু মুখ দিয়ে নিশ্বাস নিতে শুরু করে। সে অবস্থায় দুগ্ধ লোহন করে খাদ্যগ্রহণ সম্ভব হয় না।
বাল্ব সাকশন পদ্ধতিতে নাকের মিউকাস নিষ্কাশন
এ পদ্ধতিতে বাল্বের মত একটি সাকশান যন্ত্র ব্যাবহার করা হয়। বাল্বটি হাওয়া পূর্ণ থাকে ও বাল্বের সাথে একটি নল যুক্ত থাকে। প্রথমে চাপ দিয়ে বাল্বের হাওয়া বের করে নলটি নাকের ভেতর প্রবেশ করানো হয়। এরপর ধীরে ধীরে চাপ কমিয়ে মিউকাস নিষ্কাসন করা হয়। এজন্য সর্বপ্রথম একটি দ্রবণ তৈরি করতে হয় যা নোজ ড্রপের মত ব্যাবহার করা হয় যাতে নাকের ভেতরেরর মিউকাস পাতলা হয়ে সহজে বেরিয়ে আসতে পারে।
বাল্ব সাকশনিং এর জন্য লবণ পানির নোজ ড্রপার দ্রবণ তৈরি পদ্ধতি
উপকরণ:
-
৮ কাপ উষ্ণ পানি
-
ড্রপার
-
লবণ
-
পরিষ্কার পাত্র
-
টিস্যু
কার্যপদ্ধতি:
-
৮ কাপ উষ্ণ পানিতে এক চামচের এক চতুর্থাংশ পরিমাণ লবণ যুক্ত করুন।
-
চামচ দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে ফেলুন।
-
একটি পরিষ্কার ঢাকনাযুক্ত পাত্রে সংরক্ষণ করুন
-
তৈরির এক সপ্তাহ পরে ফেলে দিয়ে নতুন দ্রবণ তৈরি করুন।
চাইলে বাজার থেকে কেনা স্যালাইন নোজ ড্রপও ব্যবহার করতে পারেন।
বাল্ব সাকশন এর কার্যপদ্ধতি
-
হাত কনুই পর্যন্ত ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন।
-
বাচ্চাকে উপরের এর দিকে মুখ করিয়ে শুয়িয়ে দিন। সাকশন এর সময় যাতে বাচ্চা নড়াচড়া না করে সেজন্য হাত পা ধরার জন্য কাউকে পাশে রাখুন।
-
ড্রপার এর সাহায্যে ৩-৪ ফোঁটা লবণের দ্রবণ যে কোনো এক নাকে প্রবেশ করান।
-
৪০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট অপেক্ষা করুন। খেয়াল রাখবেন, বাচ্চা যেন নড়াচড়া না করে।
-
সাকশন বাল্ব ব্যবহারের পূর্বে চাপ দিয়ে পরিপূর্ণ বাতাস বের করে ফেলুন।
-
এবার বাল্বের নলাকার অংশ সাবধানে বাচ্চার নাকের ভেতর প্রবেশ করান এবং ভালোভাবে কিন্তু যথেষ্ট সতর্কতার সাথে ধরে রাখুন।
-
মুখে সাকশনের ক্ষেত্রে নলটি মুখের ভেতর প্রবেশ করিয়ে ডান অথবা বাম দিকে কিছু দূর প্রবেশ করান, মাঝখানের দিকে প্রবেশ করালে বাচ্চা বমি করে দিতে পারে।
-
এবার ধীরে ধীরে বাল্বের ভেতর বাতাস প্রবেশ করতে দিন। এতে করে মিউকাস বাল্বের ভিতরে আসতে থাকবে।
-
বাতাস সম্পুর্ণ ঢুকে গেলে বাল্ব টি বের করে আনুন ও মিউকাস একটি টিস্যুতে ফেলুন।
-
এই পদ্ধতি ৩-৭ বার চালিয়ে যান,যতক্ষন না পর্যন্ত পরিপূর্ণ ভাবে নাসিকা গহ্বর পরিষ্কার হয়ে যায়।
-
একটি টিস্যু দিয়ে বাচ্চার নাক মুছে দিন।
-
এরপর গরম সাবান পানি দিয়ে সিরিঞ্জ ভালোভাবে ধৌত করুন।
সতর্কতা
খাবার গ্রহণের পর শিশুকে বাল্ব সাকশনিং করাবেন না, এতে করে শিশুটি বমি করে দিতে পারে। যদি বাল্ব সাকশনের মাধ্যমে মিউকাস নিষ্কাসন সম্ভব না হয় তবে ডাক্তার বা থেরাপিস্ট ন্যাসোফেরেন্জিয়াল সাকশনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
ন্যাসোফেরেন্জিয়াল (NP) সাকশন
যদি বাল্ব সাকশন যথেষ্ট কার্যকর না হয় তবে ন্যাসোফেরেন্জিয়াল সাকশন করা হয়। যদি বাচ্চার খেতে অসুবিধা, শ্বাসকষ্ট বা জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার মত সমস্যা দেখা দেয় তবে এ চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিৎ।
এ পদ্ধতিতে একটি যন্ত্রের সাথে সাকশন করা হয়। যন্ত্রের সাথে একটি সরু নল যুক্ত থাকে। এই পদ্ধতিতেও প্রথমে লবণ দ্রবণ দিয়ে মিউকাস পাতলা করা হয়ে থাকে। এরপর নলটি শিশুর নাকের ভেতর দিয়ে গলার আগ পর্যন্ত প্রবেশ করাসো হয়, যাতে শিশু কেশে ফেলে। কাশি দেওয়ার ফলে মিউকাস গলার অগ্রপ্রান্তে চলে আসে, তখন যন্ত্রটি চালু করে সব মিউকাস বের করে ফেলা সম্ভব হয়। এই প্রক্রিয়াটি দুই নাকেই পর্যায়ক্রমে করা হয়। এর নাকের সাকশন সম্পন্ন হলে মুখের সাকশন করা হয়।
ন্যাসোফেরেন্জিয়াল সাকশনের পার্শপ্রতিক্রিয়া
ন্যাসোফেরেন্জিয়াল বা NP সাকশন খুব প্রয়োজন না হলে দেওয়া হয় না। যদি আপনার বাচ্চার রেগুলার ন্যাসোফেরেন্জিয়াল সাকশনের প্রয়োজন হয় তবে বুঝতে হবে শিশুটির নাসিকা গহ্বর সংকোচিত হয়ে আছে। NP সাকশনের ফলে মৃদু রক্তপাত হতে পারে। যদি নাক দিয়ে রক্ত পড়ে তবে সাধারণ সাকশন টিউবের চাইতে ছোটো টিউব "নিওসাকার" ব্যাবহার করতে হয়।
যদি বাচ্চাকে খাওয়ানোর ৩০ মিনিটের ভেতর ন্যাসোফেরেন্জিয়াল সাকশন করা হয়, তবে শিশু বমি করে দিতে পারে। যদিও স্বাভাবিক ভাবেই এ প্রক্রিয়ায় শিশু বেশ কান্নটাকাটি করবে, তবু প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবার কয়েক মিনিটের ভেতর সে খুবই সতেজ ও স্বাচ্ছন্দ বোধ করবে।
ঠান্ডা-সর্দি জনিত জটিলতা মারাত্বক না হলেও কিছু ক্ষেত্রে শিশুদের বেশ ভোগাতে পারে। উপরিক্ত বিষয়গুলো মাথায় রাখলে এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ সহজ হবে।
বাচ্চাদের সুস্থ সবল ও স্বাচ্ছন্দে বেড়ে ওঠার উপর তার শুষ্ঠ মেধা বিকাশ ও সামাজিকীকরণের অনেকটাই নির্ভর করে। তাই সব পিতা-মাতার উচিত শিশুর সামান্য অস্বস্তি বোধ ও গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: উপরোক্ত তথ্যগুলো আপনার সন্তানের চিকিৎসকের কাছ থেকে প্রাপ্ত পেশাদার চিকিৎসা পরামর্শের বিকল্প বা প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যে নয়। এই লেখায় সরবরাহ করা সমস্ত তথ্য কেবল তথ্যগত উদ্দেশ্যে, এবং কোনও স্বাস্থ্য সমস্যা বা রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসার জন্য নয়। চিকিৎসা সম্পর্কিত কোনও প্রশ্ন বা উদ্বেগ থাকলেআপনার সন্তানের চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করুন।