সন্তান লালন পালনে মতবিরোধ! বাবা-মা কি করবেন?

সন্তান লালন পালনে বাবা-মার মতবিরোধ অনেকসময় সন্তানের জন্য মারাত্মক বিপদ বয়ে আনে। কিন্তু কয়জন পিতা-মাতা এই ব্যপারে সচেতন! আপনি হয়ত এভাবে আগে কখনো ভেবে দেখেননি। তাহলে জেনে নিন বাবা এবং মা এর মতবিরোধ হলে সন্তানকে কি ধরণের সমস্যায় পড়তে হতে পারে এবং কিভাবে এর সমাধান করবেন। নিজে সচেতন হন এবং অন্যকেও সচেতন করুন।

সকাল থেকেই রাজুর মন অনেক বেশি খারাপ। আর মন খারাপ না হবেই বা কেন? সকালেই রাজুর মা তাকে বকা দিয়েছে। এতটুকু ছেলেকে বকা দেয়ার কি দরকার? ৫ বছর বয়সী রাজুই এটা বুঝে, অথচ তার মা বুঝছে না। 

ঘটনা কিছুটা এমন, সকালে রাজুর একটুও পড়তে ইচ্ছে করছিল না, দুরন্ত টিভিতে নতুন একটা কার্টুন এসেছে খুব সুন্দর, সেটা দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। আর এদিকে ৭ বছর বয়সী মিনা, রাজুর বড় বোন, বই খাতা নিয়ে পড়তে বসেছে। এটা দেখে রাজুকে তার মা খুব বকা দিয়েছে যে সে কেন তার বড় বোন মিনার মত পড়তে বসছে না। 

মাত্র সকাল ১১ টা বাজে, বাবা অফিস থেকে আসবে সন্ধ্যা সাতটায়। রাজুর সময় যেন আর কাটতেই চাচ্ছে না। বাবা তাকে খুব আদর করে, একটুও বকা দেয় না। বাবা থাকলে তাকে কার্টুন দেখতে দেয়, পড়ালেখা নিয়ে একটুই বকা দেয় না। 

রাজুর মত আপনারও কি এমন বাড়ন্ত কোন শিশু আছে? তাহলে আপনাকে আদতে বুঝতে হবে যে, বাবা মায়ের ভিন্ন ভিন্ন মত বা সন্তানকে লালন পালন করে বড় করার পদ্ধতি ভিন্ন হলে সেটার প্রভাব শিশুর উপরেও পরে। এমনকি রাজুর যেভাবে মায়ের সাথে একটি দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, ঠিক এমন আপনার সাথেও হতে পারে। হতে পারে আপনি অনেক বেশি গোছালো এবং সব ধরণের নিয়ম কানুন মেনে চলেন আর আপনি চান যে আপনার সন্তানও আপনার মতই গোছালো হয়ে উঠুক। কিন্তু আপনার সন্তানের বাবা মোটেও আপনার মত নয় বরং অনেক বেশি অগোছালো এবং সেই প্রভাবে সন্তানও অগোছালো হয়ে যাচ্ছে। মিনা রাজুর এই ছোট্ট পরিবারের মত আপনার বাসায়ও সমস্যা হচ্ছে। আর এই সমস্যা হয়ত একটু বেশিই হচ্ছে! 

এই সম্পর্কে একজন বিখ্যাত চাইল্ড সাইকোলোজিস্ট ডঃ এলান র‍্যাভিট বলেন, বাবা মায়ের মধ্যে শিশুকে নিয়ে এই ধরণের মতবিরোধ ছোট্ট শিশুর মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে। আর এই ধরণের মতবিরোধ অনেক বড় আকার ধারণ করলে সেটা শুধুমাত্র শিশুর মনের উপরেই প্রভাব বিস্তার করে না বরং নিত্য পারিবারিক কলহের একটি অন্যতম কারণ হয়ে উঠে। 

বাবা মায়ের ভিন্ন লালন পালন পদ্ধতি নিত্য কলহ সৃষ্টি করতে পারে 

সকালে রাজুর সাথে কি হল সেটা তো জানলাম। আসুন দেখে আসি, সন্ধ্যায় যখন রাজুর বাবা বাসায় আসার সময় আইসক্রিম নিয়ে আসলেন, তখন সেখানে কি ঘটল? 

রাজু খুব আইসক্রিম পছন্দ করে, আর সন্ধ্যায় যখন বাবা আইসক্রিম নিয়ে আসলেন, তখন তার খুব ভালো লাগল। কিন্তু রাজুর ভালো লাগা একটু পরেই আবারও মন খারাপে পরিণত হতে দেরী হল না। মা রাজুর বাবার উপরে অনেক রাগারাগি করলেন, কারণ রাজুর একটুতেই খুব ঠাণ্ডা লেগে যায়। আর এমনিতেই এখন শীতকাল, এমন সময়ে যদি রাজু আইসক্রিম খায় তাহলে খুব ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। 

রাজুর বাবা চেয়েছিলেন, অল্প হলেও যেন রাজু আইসক্রিম খায়, কিন্তু রাজুর মা সব আইসক্রিম ফেলে দিলেন। আর এতেই শুরু হল তাদের মধ্যে ঝগড়া। রাজু আরো বেশি মন খারাপ করে রাতে ঘুমাতে গেল, রাজুর বারবার মনে হতে লাগল, তার জন্যই বাবা মায়ের মধ্যে সবসময় ঝগড়া লেগে থাকে। 

বাবা মায়ের ঝগড়া দেখে রাজুর বড় বোন মিনাও রাজুকে বারবার দোষ দিয়ে বলতে লাগল, শুধু তোর জন্যই বাবা মা এত ঝগড়া করে। তুই না থাকলে আমরা অনেক ভালো থাকতাম। 

বুঝতেই পারছেন, এই ধরণের কথা রাজুর ছোট্ট মনের মধ্যে কত বড় প্রভাব ফেলতে পারে। আর তাই শিশুর সামনে বাবা মায়ের কখনই ঝগড়া করা উচিৎ নয়। এই সম্পর্কে শিশু মনরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ এলান বলেন, বাবা মায়ের উচিৎ নিজেদের মধ্যে সমস্যাগুলো এমন ভাবে আলোচনা করে ঠিক করে নেয়া, যাতে সেই কথাগুলো শিশু শুনতে না পারে। কেননা শিশুর সামনে যদি বাবা মায়ের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি হয় তাহলে সেটা শিশুর মননশীলতায় অনেক বড় প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

সন্তান লালন পালনে বাবা মায়ের ভিন্ন মত থাকলে যা করণীয় 

দিন দিন রাজু কেমন জানি চুপ হয়ে যাচ্ছে, এইট কিছুদিন আগেও যে রাজু খুব হাসিখুশি থাকত, সেই রাজুই এখন সারাদিন চুপচাপ বসে থাকে। রাজুর বাবা মা পুরো বিষয়টি লক্ষ্য করলেন, আর তারা বুঝতে পারলেন রাজু মোটেও তার বড় বোন মিনার মত নয়। আর তাই রাজুকে যদি মিনার মত করেই লালন পালন করা হয় তাহলে প্রতিনিয়ত সমস্যা লেগেই থাকবে। 

এই ক্ষেত্রে রাজুর সৌভাগ্যবান বলা যেতে পারে, কেননা তার বাবা মা খুব বেশি দেরী হওয়ার আগেই নিজেদের সমস্যাগুলো বুঝতে পেরেছেন এবং সেগুলো নিজেরা ঠিক করে নিয়েছে। আর তার কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল রাজু আবার আগের মত হাসিখুশি হয়ে উঠছে। এখন সে আর প্রতিদিন মন খারাপ করে বসে থাকে না, এমনকি মায়ের প্রতিও রাজুর আর কোন রাগ নেই। রাজু এখন ঠিক বুঝতে পারে মা বাবা দুজনই তাকে খুব আদর করে। 

আসুন তাহলে দেখে নেই, মিনা রাজুর বাবা মা যেভাবে লালন পালনের ভিন্ন মত থাকা সত্ত্বেও নিজেদের মধ্যে সবকিছু ঠিক করে রাজুকে খুব সুন্দর একটি পরিবেশ উপহার দিয়েছিলেন। এগুলো জানা থাকলে আপনার বাসায়ও ছোট্ট শিশুটি খুব চমৎকার ভাবে বেড়ে উঠতে পারবে। 

যে কোন সমস্যা কথা বলুন একে অপরের সাথে 

আপনার স্বামী অথবা স্ত্রী’র সাথে যে কোন ধরণের সমস্যা হলেই আলাপ করুন। কেননা মনে রাখবেন একে অপরের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলার মাধ্যমেই যে কোন কিছুর সমাধান করা যেতে পারে। কোনটাতে শিশুর ভালো হবে এবং কোন ধরণের লালন পালনের পদ্ধতি শিশুর জন্য খারাপ সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে নিন। কোন একটি সমস্যায় যদি আপনারা একমত না হতে পারেন তাহলে প্রয়োজনে একজন শিশু বিশেষজ্ঞর সাথেও দুইজন মিলে যেয়ে আলাপ করে নিতে পারেন। এটা আপনার শিশুর বেড়ে উঠার জন্য খুব চমৎকার একটি পরিবেশ সুনিশ্চিত করতে পারবে। 

শিশুর মধ্যে মানবিক গুণাবলী  নিশ্চিত করুন 

শিশুর মধ্যে দয়া, পরস্পরের সহযোগিতা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলী যাতে গড়ে উঠে সেদিকে নিশ্চিত থাকতে হবে। যেমন ধরুন আপনি চাচ্ছেন না শিশু তার খেলনা বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে খেলাধুলা করুক। কিন্তু আপনার সঙ্গী এটা করতে বলছে, কারন এতে করে শিশুর মধ্যে সহযোগিতা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করার গুণাবলী তৈরি হবে। আর তাই এটা সুনিশ্চিত করার জন্য আপনাকে অবশ্যই সঙ্গীর সাথে একমত হতে হবে। 

সবসময় মনে রাখবেন যে কাজই করেন না কেন, সেটা যাতে শিশুর জন্য কল্যাণকর হয়। এছাড়া শিশুর মধ্যে চমৎকার সব গুণাবলী সুনিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এই সমস্ত ক্ষেত্রেও আপনারা যদি একমত না হন, তাহলে অবশ্যই বয়স্ক কারো সাথে এই নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। এমন কারো সাথে আলোচনা করুন, যার কথা আপনারা দুইজনই শুনবেন। অর্থাৎ দুইজনই শ্রদ্ধা করেন এমন কারো সাথে আলাপ করুন। 

যে কোন বিষয়ে দুইজন একসাথে কাজ করুন 

শিশুর পড়ালেখা থেকে শুরু করে খেলাধুলা সহ সব ধরণের বিষয় নিয়েই দুইজন একসাথে কাজ করুন। সর্বদা মনে রাখবেন দুইজন মিলেমিশে শিশুর লালন পালন নিয়ে কাজ করলে সেটা অবশ্যই কল্যাণকর হবে। কোনটি সঠিক অথবা কোনটি ভুল এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ না করে বরং শিশুর ভালোর জন্য দুইজন একসাথে যে কোন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করুন। শিশুর যদি ঠাণ্ডা লাগে তাহলে শিশুকে আইসক্রিম নয় বরং গরম সুপ খাওয়ান। 

বাবা এবং মা দুইজন আলাদা মানুষ এটা মেনে নিন 

মনে রাখবেন প্রত্যেকটি মানুষই একে অপরের থেকে একদমই আলাদা। আর যেহেতু দুইজন ভিন্ন সত্তা, তাই দুইজনের ইচ্ছে এবং সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যেও পার্থক্য আসতে পারে। আর এই পার্থক্যগুলো নিয়ে কলহ না করে বরং দুজনের পার্থক্যগুলো মেনে নিন। এবং কীভাবে এই পার্থক্যের দূরত্ব কমিয়ে নিয়ে আসা যায় সেটা নিয়ে দুইজন একসাথে আলাপ আলোচনা করুন। 

বাবা মায়ের মত শিশুরও একটি আলাদা সত্তা রয়েছে

মনে রাখবেন, আপনারা দুইজন যেমন একই মানুষ নয় ঠিক তেমনই শিশুর যদি কোন ভাই বোন থাকে তাহলে তারাও একই রকম নয়। একজনকে দেখবেন পড়াশোনা নিয়ে একটি মনযোগী, আবার আরেকজনকে দেখবেন খুবই দুরন্ত, পড়ালেখা করতেই চায় না। তখন যদি আপনি দুইজনকে একই ভাবে লালন পালন করেন তাহলে সেটা অবশ্যই শিশুর মনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। 

যেমন আপনার এক সন্তান নিজ থেকে প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে পড়ালেখা করে। আর তাই আপনি যদি চান যে আপনার দুরন্ত শিশুটিও চার ঘণ্টা করে পড়ালেখা করুক সেটা কখনই ভালো কিছু বয়ে আনবে না। দুইজনকেই আলাদা ভাবে লালন পালন করতে হবে। যে কোন প্রয়োজনে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ অথবা অভিজ্ঞ কারো সাথে আলাপ আলোচনা করে নিতে পারেন। 

বিশেষজ্ঞ কারো পরামর্শ নিন 

আমরা বারবার বলে আসছি যে আপনাকে যে কোন ধরণের সমস্যায় একজন বিশেষজ্ঞর সাথে আলাপ করে নিতে হবে। এই ক্ষেত্রে আপনাদের মধ্যেও যদি হাজারো বিরোধ দেখা যেতে থাকে, তাহলে আপনারা দুইজনও চাইলে একজন সাইকোলোজিস্ট অর্থাৎ মনরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে আলাপ করে নিন। মনে রাখবেন কখনই কোন প্রফেশনাল কারো কাছ থেকে পরামর্শ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে সেটা নিয়ে দ্বিধায় থাকবেন না। একজন বিশেষজ্ঞ অবশ্যই নির্দিষ্ট বিষয়ে অনেক ভালো জানেন এবং আপনাকে সৎপরামর্শ প্রদান করতে পারবেন।   

 

একজন বাবা-মার কাছে তাদের সন্তানের চেয়ে আপন আর কেউ নেই। কিন্তু আমরা ভুলে যাই সংসারে কলহ সন্তানের মানসিক উন্নয়নকে ব্যহত করে। নিজের মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সন্তান ও সংসারে ঝামেলা সৃষ্টি করি। আসুন সন্তান লালন পালনে বাবা-মারা একসাথে কাজ করি। আর এক্ষেত্রে নিজে সচেতন হই এবং অন্যকেও সচেতন করি।

Default user image

ইকবাল মাহমুদ ইকু, লেখক, আস্থা লাইফ

দীর্ঘদিন ধরেই লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ততার সুবাদে বেশ কিছু স্বনামধন্য অনলাইন পোর্টালে লেখালেখি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই লেখার প্রতি রয়েছে অদম্য অনুরাগ। এই লেখালেখিকেই নেশা এবং পেশা হিসেবে নেয়া আমার ইতোমধ্যেই চারটি উপন্যাস এবং একটি ছোট গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে। জন্ম থেকেই ঢাকায় বসবাসরত আমি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবেও পথ শিশুদের জীবন যাপনের মান উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে আসছি প্রায় ১২ বছর ধরে। বর্তমানে আস্থা লাইফের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতাকে জন সাধারণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়ার একটি সুযোগ হিসেবে দেখছি। বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসি এবং অবসর সময়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর মুভি নিয়েই কাটে।

Related Articles