শিশুর মানসিক বিকাশ নিশ্চিত করতে জরুরী আয়োডিন
বাংলাদেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ আয়োডিন ঘটিত সমস্যায় ভোগেন। এই পরিসংখ্যান দেখলেই আয়োডিন সচেতনতার স্বরূপ বোঝা যায়। আর সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়, আয়োডিন ঘাটতির প্রভাব পড়ে মূলত শিশুদের মানুষিক বিকাশে। চলুন এই সমস্যা প্রতিরোধ ও করণীয় সম্পর্কে জানা যাক।
-
ইউনিসেফ এবং গেইন এর যৌথ প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর জন্ম নেওয়া শিশুর মধ্যে প্রায় ১৪% (২ কোটি) শিশু আয়োডিনের অভাবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন সমস্যায় এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা কমে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
-
এই শিশুদের মধ্যে প্রায় ৪৩ লক্ষ শিশু দক্ষিণ এশিয়ায় বাস করে।
-
গর্ভাবস্থায় এবং শৈশবকালে অপর্যাপ্ত আয়োডিনের ফলে স্নায়বিক (নিউরোলোজিক্যাল) এবং মনস্তাত্ত্বিক (সাইকোলোজিক্যাল) ঘাটতি দেখা দেয়, যার ফলে শিশুর আইকিউ ৮ থেকে ১০ পয়েন্ট কমে যায়।
আমাদের শরীরে অত্যাবশ্যকীয় উপাদানগুলোর মধ্যে আয়োডিন অন্যতম। কিন্তু সচেতন না হলে খুব সহজেই আয়োডিন এর ঘাটতি হয়ে যেতে পারে। যার ফলে ক্রিটিনিজম এর মত জটিল মানসিক অবস্থা দেখা দেয়। আসুন বিস্তারিত জেনে নেই।
আয়োডিনের অভাবে আপনার যেসব রোগ হতে পারে
মস্তিষ্কের কার্যকারিতায় আয়োডিনের ভূমিকা
শুধু শরীর নয়, মস্তিষ্কের বিকাশের জন্যেও আয়োডিন অপরিহার্য। বিশেষত নিউরোজেনেসিস, নিউরোনাল এবং গ্লিয়াল কোষ বিভাজন, মাইলিনেশন, নিউরোনাল মাইগ্রেশন এবং সিন্যাপটোজেনেসিস সহ বিভিন্ন ধরণের স্নায়ুতন্ত্রের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে আয়োডিনের বিকল্প নেই। আর তাই, আপনার শিশুর শৈশবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন সমস্যার প্রধান কারণ হতে পারে আয়োডিনের অভাব।
এই আয়োডিনের অভাব শিশুর মানসিক বিকাশ এবং দৈহিক বিকাশ রোধ করে, ফলে আপনার শিশুর স্কুলে নিজের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে সমস্যা হতে পারে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক হবার পরেও বংশধর তৈরি এবং চাকরি জীবনে প্রবেশের পর স্বাভাবিক জীবনযাপন বাধাগ্রস্থ হতে পারে।
গুরুতর মানসিক সমস্যা- ‘ক্রিটিনিজম’
ক্রিটিনিজম হলো থাইরয়েড হরমোনের জন্মগত ঘাটতি যাকে জন্মগত হাইপোথাইরয়েডিজম বলে। এটি হচ্ছে গুরুতরভাবে শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চরম সীমা। এককথায়, এটি মানসিক সমস্যার গুরুতর রূপ। তবে ক্রিটিনিজম দুই ধরনের হতে পারে।
১. নিউরোলজিক্যাল ক্রিটিনিজম সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়, এমন কয়েকটি উপসর্গ হলো-
-
অত্যন্ত গুরুতর মানসিক সমস্যা
-
টেরা চোখের (তেরছা চোখে চাওয়া)
-
বধির এবং বোবা
-
স্নায়ুবিক সমস্যা
-
গলগন্ড
তবে এ ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের সেরেবেলাম, হাইপোথেল্যামাস, দৃষ্টি শক্তি অপেক্ষাকৃত কম আক্রান্ত হয়।
২. অপরদিকে, মাইক্সেডেম্যাটোস ক্রিটিনিজম চিহ্নিত করা হয়-
-
গুরুতর বৃদ্ধি প্রতিবন্ধকতা হলে
-
মুখের গঠন অসম্পূর্ণ ও অপরিপক্ক হলে
-
নাসো-অরবিটাল কনফিগারেশন
-
ম্যান্ডিবলের অ্যাট্রোফি হলে
-
শরীর ফুলে গেলে
-
মাইক্সেডেম্যাটাস বা ঘন এবং রুক্ষ ত্বক প্রকট হলে
-
চুল রুক্ষ অথবা পরিমাণে কম হলে
-
চোখের পাপড়ি এবং ভ্রু অনেক দেরিতে দেখা গেলে
-
যৌন পরিপক্কতা স্বাভাবিকের তুলনায় দেরিতে হলে
তবে মাইক্সেডেম্যাটোস ক্রিটিনিজমের ক্ষেত্রে গলগন্ড সাধারণত অনুপস্থিত থাকে। বেশিরভাগ সময় থাইরয়েড গ্রন্থি প্রায়শই স্পষ্ট হয় না, যা থাইরয়েড অ্যাট্রোফির নির্দেশ করে।
আয়োডিন যুক্ত খাবার তালিকা
আয়োডিনের অভাব পূরণ করতে কোন ধরণের দামী ঔষধ গ্রহণ হতে অধিক কার্যকর উপায় হচ্ছে আয়োডিন জাতীয় খাদ্য গ্রহণ। আয়োডিন মূলত মাটি এবং সমুদ্রে পাওয়া যায়। আয়োডিন প্রধাণত প্রাণীজ প্রোটিন এবং সামুদ্রিক শাকসবজিতে পাওয়া যায়, কিছু পরিমাণে রুটিতে এবং দুধের মতো সাধারণ খাবারে পাওয়া যায়। আরো পাওয়া যায়-
-
সামুদ্রিক শৈবাল (নরি, কেল্প, কম্বু, ওয়াকামে) এবং মাছ
-
শেলফিশ (কড, টিনজাত টুনা, ঝিনুক, চিংড়ি)
-
আয়োডিনযুক্ত খাবার লবণ
-
দুগ্ধজাত পণ্য (দুধ, পনির, দই)
-
ডিম
-
গরুর গোশ বা যকৃত
-
মুরগীর মাংস
শিশুদের খাদ্য তালিকাঃ কি খাওয়াবেন, কি খাওয়াবেন না (পর্ব ১)
প্রতিদিন কতটুকু আয়োডিন গ্রহণ করবেন?
আয়োডিনযুক্ত খাবার তো পাওয়া গেল, এবার নিশ্চয়ই খেতে শুরু করবেন? সাবধান! প্রবাদ আছে, "উনো ভাতে দুনো বল, অতি ভাতে রসাতল।" অতএব, অতিরিক্ত আয়োডিন গ্রহণের ফলে, উল্টো বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। আপনার শরীরের আয়োডিনের চাহিদা অনুযায়ী ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন এবং স্বাভাবিক খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন আয়োডিনযুক্ত খাবারের পরিমাণ হবে-
আপনার শরীর প্রাকৃতিকভাবে আয়োডিন তৈরি করে না, তাই আপনার খাদ্যই এটি পাওয়ার একমাত্র উপায়। প্রাপ্তবয়স্কদের সাধারণত প্রতিদিন ১৫০ মাইক্রোগ্রাম (mcg) প্রয়োজন। গর্ভবতী ব্যক্তিদের প্রতিদিন ২২০ মাইক্রোগ্রাম প্রয়োজন, যখন স্তন্যপান করাচ্ছেন তাদের দৈনিক ২৯০ মাইক্রোগ্রাম প্রয়োজন।
-
৬ মাস বয়সী শিশুদের জন্য ১১০ মাইক্রোগ্রাম
-
৭-১২ মাস বয়সী বাচ্চাদের জন্য প্রস্তাবিত পরিমাণ ১৩০ মাইক্রোগ্রাম
-
১-৮ বছর বয়সী বাচ্চাদের জন্য ৯০ মাইক্রোগ্রাম
-
৯-১৩ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরী হলে ১২০ মাইক্রোগ্রাম
-
১৪ বছর হতে প্রাপ্তবয়স্ক হলে ১৫০ মাইক্রোগ্রাম
-
গর্ভবতী মহিলা হলে ২২০ মাইক্রোগ্রাম ২০ মিলিগ্রাম
আয়োডিন নিয়ে কিছু প্রশ্নোত্তর-
১. আয়োডিনের ঘাটতিজনিত রোগ প্রতিরোধের উপায় কী?
আয়োডিনের অভাবজনিত ব্যাধি প্রতিরোধের সর্বোত্তম এবং সর্বনিম্ন ব্যয়বহুল পদ্ধতিগুলির মধ্যে একটি হল আয়োডিনযুক্ত খাবার লবণ গ্রহণ, যা বর্তমানে অনেক দেশে সরবরাহ করা হচ্ছে।
২. হাইপোথাইরয়েডিজম রোগের চিকিৎসা কী?
গুরুতর অবস্থা, হাইপোথাইরয়েডিজম জনিত অসুস্থতা প্রাথমিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার মাধ্যমে কমিয়ে আনা সম্ভব। আপনার হাইপোথাইরয়েডিজম রোগ সাধারণত কৃত্রিম থাইরয়েড হরমোনের সাহায্যে চিকিৎসা করা যাবে, তবে তা আপনার সারাজীবন গ্রহণ করতে হবে।
৩. শিশুদের জন্মগত আয়োডিনের ঘাটতি হলে চিকিৎসা কী?
যদি আপনার শিশু জন্ম হতে আয়োডিনের ঘাটতি জনিত সমস্যায় ভোগে, তাহলে চিকিৎসক আপনার শিশুর শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে থাইরয়েড হরমোন সাপ্লিমেন্ট দিয়ে চিকিৎসা করতে পারবেন। বেশিরভাগ উন্নত দেশে নবজাতকের জন্য স্ক্রিনিং পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। টি৪ (থাইরয়েড) ট্যাবলেটগুলি সাধারণত চূর্ণ করে, বুকের দুধ, হালকা খাবার, কৌটাজাত দুধ বা পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়াতে হয়।
৪. আয়োডিনের অভাব কি কোন জন্মগত জেনেটিক্যাল সমস্যা?
একেবারেই তা নয়। কারন, বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৮৮ কোটি মানুষ আয়োডিনের ঘাটতির ঝুঁকিতে রয়েছে এবং ২৪ কোটি স্কুল-পড়ুয়া শিশুর খাদ্যতালিকায় আয়োডিন গ্রহণের পরিমাণ অপর্যাপ্ত। যা খাদ্যে অপরিহার্য পুষ্টি নিশ্চিত না করার বিষয়টি ইঙ্গিত করে। তাই এভাবে চলতে থাকলে, আয়োডিনের ঘাটতি উন্নয়নশীল দেশের গণ্ডি পেরিয়ে, উন্নত অথবা অনুন্নত দেশগুলোর জনস্বাস্থ্যের স্বাভাবিক ধারাকে সমূলে উৎপাটন করতে পারে।
৫. আয়োডিনের অভাবে কি আপনার শিশুর আইকিউ কমে যেতে পারে?
আয়োডিনের অভাবে অল্পবয়সী শিশুরা মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকে, কারণ জীবনের প্রথম দুই বছরে মানসিক বিকাশে আয়োডিন অতীব জরুরী উপাদান। ডব্লিউ এইচ ও এর তথ্যমতে, আয়োডিনের অভাবজনিত ব্যক্তিদের ১৫ আইকিউ পয়েন্ট নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং প্রায় ৫ কোটি লোক স্বল্প মাত্রায় আয়োডিনের অভাবজনিত মস্তিষ্কের ক্ষতিকর সমস্যাগুলোর শিকার হয়। গর্ভাবস্থায় আয়োডিনের ঘাটতি শুধুমাত্র ভ্রূণের মস্তিষ্কের ক্ষতি করে না, নবজাতকের ওজন কম হওয়া, এবং প্রসবকালীন শিশুমৃত্যুর হারও বৃদ্ধি করে।
শিশুর মানসিক রোগ: লক্ষণগুলি জানুন
পরিশেষ
সৌভাগ্যক্রমে, আয়োডিনের অভাবজনিত রোগের প্রকোপ যতটা ভয়াবহ, প্রতিরোধ ব্যবস্থা ততোধিক সহজ। আপনার প্রতিদিনের খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণ আয়োডিনযুক্ত এক চিমটি লবণ আপনার দেহে আয়োডিনের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে সহায়তা করবে। তা সত্ত্বেও আপনি যদি মনে করেন আপনার আয়োডিনের ঘাটতি আছে, অথবা কোন লক্ষণ লক্ষ্য করেন, তাহলে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
আরও পড়ুনঃ
-
শিশুদের ভারী স্কুল ব্যাগে রয়েছে ৪টি স্বাস্থ্যঝুঁকি
-
যে ৮টি কারণে আপনার সন্তানকে জাদুঘরে ঘুরতে নিয়ে যাবেন
-
ডাউন সিনড্রোমঃ দরকার সচেতনা ও ভালোবাসা