কিডনি রোগ সম্পর্কে ৭টি মিথ বা ভ্রান্ত ধারণা

বেশিরভাগ লোকের কিডনি সম্পর্কে খুব সাধারণ ধারণা রয়েছে এবং তার পরিবর্তে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে অপ্রমাণিত এবং কখনও কখনও ভিত্তিহীন পরামর্শের উপর নির্ভর করে তাদের কিডনি স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়ে ফেলেন। আসুন কিডনি রোগ নিয়ে যে মিথগুলি রয়েছে তা জেনে নেই।

  • বিশ্বের প্রায় ১০ ভাগ (৮৫ কোটি) মানুষ কিডনির রোগে ভুগছেন, যা ডায়াবেটিস রোগীর দ্বিগুণ। 

  • বাংলাদেশেও দিনে দিনে বাড়ছে কিডনি রোগীর সংখ্যা। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বর্তমানে ২ কোটির বেশি মানুষ নানা ধরনের কিডনি সমস্যায় ভুগছেন। 

  • তবে আশঙ্কার কথা হলো এদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশই (২৫ শতাংশ) ১৮ বছরের কম বয়সী।

কিডনি বা বৃক্ক শরীরের অন্যতম প্রধান একটি অঙ্গ। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা, ইলেক্ট্রোলাইট এর ভারসাম্য রক্ষা করা, দেহের বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়া সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজ কিডনির মাধ্যমে হয়ে থাকে। কিন্তু তারপরও হৃদরোগ, ফুসফুসের জটিলতা, স্ট্রোক এসব নিয়ে মানুষের মধ্যে যতটা সচেতনতা দেখা যায় তার সিকিভাগও কিডনি নিয়ে দেখা যায় না। 

ফলশ্রুতিতে কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা বাংলাদেশে ক্রমশই বেড়ে চলেছে। প্রথমত, মানুষ বুঝতেই পারে না যে এ সংক্রান্ত সমস্যায় কখন ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। দ্বিতীয়ত, মানুষের মধ্যে এ নিয়ে প্রচুর ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। 

কিডনি রোগের যত ভ্রান্ত ধারণা 

কিডনি রোগ, রোগের লক্ষণ ও শনাক্তকরণ নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। যেমন : 

১) কিডনি রোগ বিরল

২০১৯ সালে কিডনি ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপ থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কোন না কোনভাবে কিডনি রোগে ভুগছে। আর আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ হাজারের কিডনি পুরোপুরি অকেজো হচ্ছে প্রতিবছর।

২) বেশি বেশি পানি খেলে কিডনি ভালো থাকে

দিনে দুই থেকে আড়াই লিটার পানি খেলেই তা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য যথেষ্ট। তবে অতিরিক্ত গরম কিংবা শারীরিক পরিশ্রম করলে, কোনো ইনফেকশন বা রক্তপাত হলে, গর্ভবতী মহিলাদের এর চেয়ে বেশি পানি খাবার প্রয়োজন হতে পারে

৩) কিডনি সুস্থ থাকার একটি ভাল লক্ষণ হচ্ছে প্রায়শই প্রস্রাব করা

না, আসলে ব্যাপারটা পুরোপুরি বিপরীত। স্বাস্থ্যকর কিডনিগুলি ২ কাপ পর্যন্ত প্রস্রাবকে ঘনীভূত করতে পারে এবং কার্যকরভাবে শরীরের বর্জ্য অপসারণ করতে পারে। রোগাক্রান্ত কিডনি এটি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আসলে, ঘন ঘন প্রস্রাব করা একটি অস্বাভাবিকতা টের পাওয়া যায় যা কিডনি রোগের প্রথম লক্ষণগুলির মধ্যে একটি। অসুস্থ কিডনিগুলি যা ঘন করতে অক্ষম, বর্জ্য পদার্থগুলি অপসারণ না করে প্রচুর পরিমাণে প্রস্রাব উত্পাদন করে। এর ফলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয় এবং পরবর্তীকালে তৃষ্ণা বৃদ্ধি পায়। অন্যান্য রোগ যা ঘন ঘন প্রস্রাবের কারণ হয় সেগুলির মধ্যে রয়েছে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, প্রোস্টেট সমস্যা এবং হরমোন ভারসাম্যহীনতা।

৪) কোমড়ের আশেপাশে ব্যথা মানেই কিডনিজনিত সমস্যা 

প্রকৃতপক্ষে কিডনি রোগ খুব জটিল হওয়া না পর্যন্ত কোনও লক্ষণ দেখায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কিডনিতে কেবল প্রস্রাবের প্রবাহের কোনও বাধা যেমন কিডনিতে পাথর বা কিডনিতে উল্লেখযোগ্য কোন সংক্রমণের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হয় কেবল তখনই কিডনির ব্যথা হয়। আর কোমড়ে ব্যথা নানা কারণে হতে পারে। মাসল বা পেশি স্ট্রেইন বা স্প্রেইন হলে হতে পারে, লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেলে কোমড়ে ব্যথা হতে পারে, আর্থ্রাইটিস কিংবা অস্টিওপোরোসিস থেকে হতে পারে, ইন্টার ভার্টেব্রাল ডিস্ক রাপচার থেকে কোমড়ে ব্যথা হতে পারে। তাই কোমড়ে ব্যথা হলেই চোখ বন্ধ করে শুধুমাত্র কিডনির সমস্যা ধরে নেবেন না। 

৫) কিডনির সমস্যা মানেই হল পা ফুলে যাওয়া 

কিডনির সমস্যাতে পা ফুলে যায় ঠিকই, তবে আরো অনেক রোগে এভাবে পায়ে পানি আসতে দেখা যায়। কনজেস্টিভ কার্ডিয়াক ফেইলিওর বা সিসিএফ (CCF), ক্রনিক লিভার ডিজিজ বা সিএলডি (CLD), লিম্ফেটিক অবস্ট্রাকশন, দীর্ঘদিন ধরে প্রোটিনের অভাব বা লং টার্ম প্রোটিন ডেফিসিয়েন্সি এসব কারণেও পা ফুলে যেতে পারে। 

৬) শুধুমাত্র ক্রিয়েটিনিন টেস্ট দিয়েই কিডনির রোগ বুঝে ফেলা যায়

অনেকে পায়ে পানি এলে নিজে নিজেই ক্রিয়েটিনিন টেস্ট করে ফেলেন। ক্রিয়েটিনিন ঠিক থাকলেই কিডনিও ঠিক আছে ধরে নেন। অন্যান্য রোগের কথা ছেড়ে দিন, কিডনির সুস্থতা জানার জন্যও আপনাকে আরো অন্যান্য টেস্ট করতে হবে। কিডনির কর্মক্ষমতা নির্ণয় করতে গ্লোমেরুলার ফিলট্রেশন রেট বা জিএফআর (GFR) অবশ্যই জানতে হবে। তাই নিজে নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে একজন ইউরোলজিস্ট এর শরণাপন্ন হতে হবে।

৭) কিডনি বিকল বা অকেজো হয়ে গেলে তা নিরাময় করা যায়

সাধারণ কিডনি রোগ থেকে যদি এক সময় কিডনি বিকল বা অকেজো হয়ে যায় তবে সে ধরনের রোগীর জন্য মাত্র দুরকম চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। হয় ডায়ালাইসিস অর্থাৎ যন্ত্রের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে কিডনির কাজ করানো বা কিডনি প্রতিস্থাপন। কিন্তু এই দুই ধরণের চিকিৎসা পদ্ধতিই ব্যয়বহুল।

 

এক সময় ধরে নেওয়া হত, কিডনির কাজ শুধুমাত্র প্রস্রাব তৈরি করা। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ও তার সহজলভ্যতার কারণে এখন আমরা জানি কিডনি মূত্র উৎপাদন ছাড়াও শরীরের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। তাই কিডনি সংক্রান্ত যেকোনো জটিলতা হালকা ভাবে নেবার কোনো সুযোগ নেই। স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, রক্তে শর্করার মাত্রা ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি যেকোনো অসুবিধা, যেকোনো সমস্যায় ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। 

Default user image

ডাঃ ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী। বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অল্প স্বল্প লেখালেখি করতে ভালো লাগে। আস্থা লাইফের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্লগগুলি মানুষের মধ্যে একটু হলেও সচেতনতা তৈরি করবে বলে আমার বিশ্বাস। ভালো লাগে ঘুমাতে, গান শুনতে, নানা রকম খাবার খেতে আর সবচেয়ে ভালো লাগে কথা বলতে।

Related Articles