দাদ রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা, দাদ হলে যা যা করা নিষেধ
দীর্ঘদিন দাদের সমস্যায় ভুগছেন! কোনোভাবেই সেরে উঠছেনা? আপনার প্রয়োজন সঠিক চিকিৎসার। কিন্তু কীভাবে? তা জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।

দাদ রোগটি এতোটাই সাধারণ যে, যে কোন প্রদত্ত সময়ে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগ মানুষ এ রোগটিতে আক্রান্ত থাকেন। রোগটি জটিল না হলেও প্রচন্ড অস্বস্তিকর তাতে কোন সন্দেহ নেই। দাদ সাধারণ হলেও সমাজ গত কারণেই হয়ত রোগটি লজ্জাজনক বলেই ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু অন্য যেকোন রোগের মত দাদ সহ অন্যান্য চর্মরোগ লুকাবার কিছু নেই।
দাদ বা রিংওয়ার্ম একটি সাধারণ ফাংগাস জাতীয় রোগ। চিকিৎসা না করা বা ভুল চিকিৎসা গ্রহণ করলে দাদ রোগটির ভোগান্তি বেড়ে যেতে পারে বহুগুণ। উপর্যপরি বর্তমান দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোতে ড্রাগ রেসিস্টেন্ট ফাংগাসের দ্বারা দাদে আক্রান্ত হবার সমস্যাটি বেড়ে চলেছে জ্যামিতিক হারে। রোগটি অস্বাভাবিক রকম ছোঁয়াচে, তাই এটি বিপুল হারে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও বেশি। আসুন জেনে আসি, দাদ রোগ কি, কেন হয়, চিকিৎসা, প্রতিরোধে করনীয় সহ সম্পর্কিত বিষয়াবলি।
দাদ বা দাউদ কি?
Dermatophytosis জাতীয় ফাংগাসের সংক্রমনে হওয়া রোগকে দাদ বলে। ইংরেজিতে একে রিং ওয়ার্ম বলা হয়। তবে এর সাথে ওয়ার্ম বা পোকার কোন সম্পর্ক নেই। এটি সম্পুর্ণই ফাংগাস এর কারণে হয়ে থাকে।
দাদ এর ফাংগাস ত্বকের ভেতর বাসা বাধে, ও ত্বকের ভেতর প্রবেশ করে বসবাস ও খাদ্য গ্রহণ করে। মোট ৪০ টি প্রজাতির ফাংগাস দ্বারা দাদ রোগ হতে পারে।
দাদ কেন হয়?
সাধারনত অপরিষ্কার ও স্যাতস্যাতে পরিবেশে বসবাস বা ব্যাক্তিগত পরিচ্ছন্নতায় অবহেলার কারণে দাদ রোগটি বেশি হয়ে থাকে। রোগটি অত্যন্ত সংক্রমক রোগ হবার কারণে আক্রান্ত ব্যাক্তির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংষ্পর্শে অন্যরা আক্রান্ত হতে পারে। সে কারণে ঘনবসতি এলাকায় দাদ রোগের সংক্রমণ বেশি হতে দেখা যায়।
দাদ মানুষ ছাড়াও কুকুর, বিড়াল ও গৃহপালিত স্তন্যপায়ী পশুকে আক্রান্ত করতে পারে এবং আক্রান্ত পশুর সংষ্পর্শে মানুষও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সাধারণত শিশু, কিশোর ও বৃদ্ধদের এ রোগটিতে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে দাদ সহজে আক্রান্ত করতে পারে ও সারতেও সময় লাগে।
দাদ রোগের লক্ষন
দাদ রোগের লক্ষন ও উপসর্গ জায়গা ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। দাদ হাতে, পায়ে, মুখে, মাথায়, বগল ও কুচকিতে হতে দেখা যায়। তবে সাধারণত নিচের উপসর্গ গুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়-
-
প্রাথমিক অবস্থায় ছোট ফোঁড়া ও চুলকানি হতে দেখা যায়। এমন অবস্থায় সহজে দাদ সনাক্ত করা যায় না।
-
ছোট ফোড়া থেকে আস্তে আস্তে ত্বকে লালচে ফুসকুড়ি সহ গোলাকার স্থান তৈরি হয়। ফাংগাস প্রায় সমভাবে ত্বকের চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ফলে একটি গোলাকার আকৃতি তৈরি হয়। গোলাকার অংশের চারপাশে নতুন আক্রান্ত স্থান সামান্য ফুলে থাকে।
-
আক্রান্ত স্থানে চুলকানী ও জ্বলুনী অনুভব হয়।
-
চিকিৎসা না করলে আক্রান্ত স্থান ক্রমশ বড় হতে থাকে ও নতুন স্থান আক্রান্ত হতে পারে।
-
মাথায় দাদ হলে আক্রান্ত স্থানের চুল পড়ে যেতে পারে।
দাদ এর চিকিৎসা ও জটিলতা
দাদ এর চিকিৎসা খুব জটিল কখনোই ছিলো না। শত শত বছর ধরে মানুষ সহজেই এ থেকে উপসম পেয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমানে দাদ রোগ কে ঘিরে বেশ জটিলতা তৈরি হয়েছে।
পূর্বে বলেছি, দাদ প্রায় ৪০ প্রজাতির Dermatophytosis ফাংগাস এর কারণে হয়ে থাকে। বেশিরভাগ প্রজাতিই এন্টিফাংগাল ব্যবহারে সহজে সেরে ওঠে।
কিন্তু বিগত বছরগুলোতে এমন কিছু দাদ এর ফাংগাস প্রজাতি পাওয়া গেছে যারা এন্টিফাংগাল ক্রিমেরর উপর রেজিস্টেন্স অর্জন করেছে। অর্থাৎ, সাধারণত যে ফাংগাল ক্রিম বা ঔষধে দাদ সেরে উঠতো, কিছু ক্ষেত্রে সেই ক্রিমগুলো প্রায় অকেজো হয়ে পড়ছে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী দাদ রোগ খুব বেশি দেখা যাচ্ছে। অনেক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ৬-৮ মাসেও দাদ সারছে না। যতো যাই ঔষধ নেন, কোন কাজ হয় না। ড্রাগ রেজিস্টেন্ট দাদ হলে কি করবেন তাতে একটু পর আসছি। আগে আসুন দেখা যাক সাধারণ দাদ হলে কি করণীয়।
-
ঢিলেঢালা ও পরিষ্কার প্রশাক পরুন
-
আক্রান্ত স্থান পরিষ্কার রাখুন, নিয়মিত গোসল করুন
-
আক্রান্ত স্থান ঠিকভাবে পরিষ্কার করে শুকিয়ে সাধারণ ফাংগাস নাশক ক্রিম ব্যাবহার করুন
-
ওভার দ্যা কাউন্টার ফাংগাস নাশক ক্রিম প্রেসক্রিপশন ছাড়া ব্যাবহার করতে পারেন (ঔষধের বিবরণ পরবর্তি অংশে)
-
দিনে দুই থেকে তিনবার ঔষধ সেবন করুন
-
২-৩ দিনে আক্রান্ত স্থান শুকিয়ে আসতে শুরু করা উচিৎ। কিন্তু দুই সপ্তাহ পরেও যদি না সারে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
দুই সপ্তাহেও যদি সাধারণ চিকিৎসায় দাদ ভালো না হয়, হতে পারে আপনার হওয়া দাদ হলো ড্রাগ রেজিস্টেন্ট প্রকৃতির। আপনার দাদ রোগটিও যদি বারবার ফিরে ফিরে আসতে থাকে ও ঔষধে সম্পুর্ণ না সারে, তবে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। তাহলে কোন ডাক্তার দেখাবেন?
দাদ জনিত জটিলতার জন্য একজন ত্বক বিশেষজ্ঞ বা Dermatologist ডাক্তারকে দেখাবেন। ডাক্তার আপনার রোগের প্রকৃতি ও বিভিন্ন টেস্টের রেজাল্ট বিবেচনা করে আপনাকে সঠিক চিকিৎসা দিতে পারবেন।
দাদ এর ঔষধ
দাদ আক্রান্ত হলে ওভার দ্যা কাউন্টার এন্টিফাংগাল ক্রিম ব্যাবহার করবেন। এ জাতীয় ঔষধের মধ্যে clotrimazole বা terbinafine জাতীয় ক্রিম অন্যতম। তাছাড়া মাথায় দাদ আক্রান্ত হলে Griseofulvin বা terbinafine সমৃদ্ধ এন্টিফাংগাল শ্যাম্পু ব্যাবহার করলে উপসম পাওয়া যায়। আপনার পার্শবর্তি ফার্মেসিতে এন্টিফাংগাল শ্যাম্পু পেয়ে যাবেন।
দাদ চুলকানি দূর করার উপায়
দাদ এর চুলকানি অত্যন্ত যন্ত্রনাদায়ক যা দাদ সম্পুর্ণ সেরে না যাওয়া পর্যন্ত হতে থাকে। দাদ হলে অবশ্যই নখ ছোট রাখতে হবে ও আক্রান্ত স্থানে যথাসম্ভব কম হাত দিতে হবে। চুলকানের পর দাদ এর জীবানু হাতে ও নখে লেগে থাকতে পারে। সেই হাত দিয়ে অন্য কিছু ধরলে তা অন্য ব্যাক্তির দাদ সংক্রমন হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে।
চুলকানী দূর করার জন্য ওভার দ্যা কাউন্টার এন্টিফাংগাল ক্রিম ব্যাবহার করতে পারেন। ফাংগাস নাশক ক্রিম আক্রান্ত স্থানে ফাংগাসের বংশবৃদ্ধি ও সক্রিয়তা কমিয়ে আনবে। এতে চুলকানীও উপসম হবে। তাছাড়া বেশিরভাগ সময় আক্রান্ত স্থান শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে পড়ার কারণে চুলকানী বেড়ে যায়। এ থেকে উপসম পেতে ঘরোয়া টোটকা হিসেবে নারিকেল তেল ব্যাবহার করা যেতে পারে।
দাদ আক্রান্ত হলে সতর্কতা
দাদ একি অত্যান্ত সংক্রমক রোগ, তাই পরিবারের কেউ আক্রান্ত হলে অন্যান্য সদস্যদেরও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। কিন্তু একটু সাবধানতা ও বাড়তি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে দাদ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমিয়ে ফেলা যায়।
-
আক্রান্ত ব্যাক্তির থেকে দূরত্ব বজায় রাখা।
-
আক্রান্ত ব্যাক্তির ব্যাবহৃত জিনিস যেমন কাপড়, খাবার পাত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র সঠিকরূপে ধোয়া ও অন্যদের তা ব্যাবহার করা থেকে বিরত থাকা।
-
বাথরুম কমোড ব্যাবহার করার পর সিট স্যাভলন দিয়ে ধোয়া।
-
যথা সম্ভব বাইরে বের হওয়া থেকে বিরত থাকা।
দাদ হলে যা যা করবেন না
দাদ আক্রান্ত হলে নিচের কাজগুলি থেকে বিরত থাকাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
-
রাস্তা ফেরি করা চুলকানীর ঔষধ ব্যাবহার করবেন না।
-
হোমিওপ্যাথি ঔষধ গ্রহণ করবেন না।
-
এই সময়টিতে অন্তরঙ্গ মেলামেশা বন্ধ রাখবেন।
-
কিছুটা সেরে উঠলে ঔষধ সেবন বন্ধ করবেন না। এতে দাদ এর জীবানু ঔ ঔষধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে ফিরে আসতে পারে।
-
অতিরিক্ত চুলকাবেন না এবং আক্রান্ত স্থান ধরলে সাবান দিয়ে হাত ধোবেন।
-
আক্রান্ত ব্যাক্তির সাথে ঠাট্টা বিদ্রুপ পরিহার করুন।
দাদ এর ঘরোয়া চিকিৎসা
প্রাথমিক অবস্থায় অনেক ঘরোয়া চিকিৎসা দাদ সারাতে বেশ কার্যকরী হতে পারে। তবে ঘরোয়া চিকিৎসায় সবসময় জেনে বুঝে উপকরণ ব্যাবহার করবেন ও এটির উপর দীর্ঘসময় নির্ভর করা অনুচিৎ। ঘরোয়া চিকিৎসার উপকরণ-
নিম পাতা
নিমপাতা দাদ সারাতে বেশ কার্যকরী সাথে অত্যান্ত জনপ্রিয়ও বটে। বড় গাছ থেকে নিমপাতা সংগ্রহ করবেন, দাদ সারাতে প্রতিবেশির শখের নিমগাছ ন্যাড়া করবেন না যেন।
হলুদ বাটা
কাঁচা হলুদ বাটা জীবানু প্রতিরোধী। এটি ব্যাবহার করলে দাদ উপসম হতে পারে।
এলোভ্যারা
এলোভ্যারা ত্বক সুস্থ রাখতে সাহায্য করে এবং এটির জীবানু নাশক ক্ষমতা রয়েছে। তাই এটি দাদ রোগের জন্য একটি ভালো ঘরোয়া টোটকা হতে পারে।
নারকেল তেল
নারকেল তেল ক্ষতিগ্রস্থ ত্বক সারিয়ে তুলতে ও দাদ ছড়িয়ে পড়া রোধে সাহায্য করে।
পরিশেষে
দাদ সাধারণ হলেও একটু অসতর্কতা আরো অনেকজন মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। তাই সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের পাশাপাশি সংক্রমন রোধে সচেষ্ট হওয়াও আমাদের মানবিক দায়িত্ব।