শীতের ৫ টি রোগব্যাধি এবং এর প্রতিকার!
শীতকালে আমরা কি কি রোগে আক্রান্ত হতে পারি এবং আক্রান্ত হলে আমাদের করণীয় কি। আর সেই সাথে থাকছে শীতকালে সুস্থ থাকার কিছু টিপস!
হেমন্তকে বিদায় জানিয়ে ভাপা পিঠার গরম ধোঁয়ার সাথে সাথে আবির্ভাব হয় শীতকালের। আমাদের দেশে সা্ধারণত ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি এই দুই মাসে শীতের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। শহরাঞ্চচলে শীতে একটু দেরিতে আসলেও উত্তরাঞ্চলের কোথাও কোথাও নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শীত শীত অনূভুত হওয়া শুরু করে। শীত আসলে যেমন পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে ঠিক তেমনি আমাদের অবহেলার সুযোগ নিয়ে কিছু ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া আমাদের দেহে আক্রমণ করে বসে। তারা তাদের সৈন্য সামন্ত নিয়া আমাদের দেহে আঘাত করে আর আমরা তাদের আঘাতে কুপোকাত হয়ে শীতের ছুটি, আনন্দ জলাঞ্জলি দিয়ে বিছানায় পড়ে থাকি।
তাই চলুন জেনে নিই ওইসব ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া কারণে যে রোগবালাই হয় শীতকালে,
১. ইনফ্লুয়েঞ্জা (Influenza): যেভাবে নিজেকে রক্ষা করবেন!
ইনফ্লুয়েঞ্জা হলো একটি ভাইরাল সংক্রমণ রোগ যা আমাদের শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন নাক, গলা এবং ফুসফুসে আক্রমণ করে। সাধারণত ইনফ্লুয়েঞ্জাকে “ফ্লু (Flu)” বলা হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেহের পাকস্থলীতে আরেক ধরণের ফ্লু থাকে যার কারণে আমাদের ডায়রিয়া বা বমি হয়ে থাকে। আর তাই পাকস্থলীর ফ্লু এবং শ্বসনতন্ত্রের ফ্লু একই রকম নহে। বেশির ভাগ মানুষে ফ্লুতে আক্রান্ত হলে এমনি নিজে থেকেই ভাল হয়ে যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে ফ্লু এবং এর থেকে সৃষ্ট জটিলতা মারাত্মক হতে পারে।
ফ্লু তে আক্রান্ত হলে বুঝবো কিভাবে?
ফ্লু তে আক্রান্ত হলে শুরুতে সাধারণ সর্দি কাশি হলে যেমন লাগে ঠিক তেমন ই লাগবে। নাক দিয়ে পানি পড়া, হাঁচি আসা এবং গলা ব্যথা এইগুলো সাধারণ সর্দি কাশির লক্ষণ। সচরাচর এই সর্দি খুবই ধীরগতিতে বিকশিত হয়। অন্যদিকে ফ্লু হটাৎ করেই এসে আক্রমণ করে এবং সর্দির সাথে ফ্লু মিলে আরো খারাপ অবস্থার সৃষ্টি করে। ফ্লুর কিছু সাধারণ লক্ষণ ও উপসর্গ হলো,
-
জ্বর ১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট এর উপরে থাকতে পারে
-
মাংস পেশিতে ব্যথা
-
হটাৎ ঠাণ্ডা এবং গরম লাগা
-
মাথা ব্যথা
-
শুষ্ক কাশি
-
অবসাদ এবং দুর্বল লাগা
-
নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া
-
গলা ব্যথা
কি কারণে আক্রান্ত হয়?
ফ্লু ভাইরাস বাতাসের কণার মাধ্যমে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ভ্রমণ করে। কেউ যদি ফ্লুতে আক্রান্ত থাকে তাহলে তার হাঁচি, কাশি অথবা কথা থেকে ফ্লু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে আর সেই ফ্লু যদি নিঃশ্বাসের সাথে কারো দেহে প্রবেশ করে তাহলে সেও ফ্লুতে আক্রান্ত হতে পারে। আর শীতকালে আমাদের দেশে এসব ফ্লু বেশি ছড়ায় কারণ আমাদের বাতাসে ধুলি কণার পরিমাণ বেশি থাকে, সাথে আমাদের পরিবেশও দূষণ হচ্ছে বেশি মাত্রায়। নিশ্বাস ছাড়াও বিভিন্ন ভাবে আমাদের দেশে ফ্লূতে আক্রান্ত হতে পারে। দেখা গেলো আপনি এমন একটা জিনিস উঠালেন হাতে করে, আর সেই জিনিসটাতে ফ্লু জার্ম ছিল। সেটা হতে পারে আপনার টেলিফোন কিংবা কম্পিউটারের কিবোর্ড।
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস প্রতিনিয়ত নিজেকে চেঞ্জ করে নতুন নতুন রূপে বা স্ট্রেইন দেখা দিচ্ছে। আপনি যদি একবার ইনফ্লুয়েঞ্জাতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে আপনার শরীরে নির্দিষ্ট স্ট্রেইন এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এন্টিবডি তৈরি হয়ে যায় যেন পরবর্তীতে আবার আক্রান্ত হলে আগে থেকেই সে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু নতুন স্ট্রেইন এর বিরুদ্ধে আমাদের শরীর লড়াই করতে পারে না ফলে আমরা আবার ফ্লুতে আক্রান্ত হই।
আক্রান্ত হবার সম্ভাব্য ঝুঁকি সমূহ কি কি?
-
বয়সঃ সিজনাল (ঋতুকালিন) ইনফ্লুয়েঞ্জা সাধারণত ১২ মাসের কম বয়সি এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সি মানুষকে আক্রমণ করার প্রবণতা বেশি দেখায়।
-
বাসস্থান ও কাজের পরিবেশঃ যেসব জায়গায় একসাথে অনেক লোকের সাথে বসবাস অথবা একই জিনিসপত্র বিভিন্ন জন ব্যবহার করে সেসব জায়গায় ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। উদাহরণস্বরুপ মিলিটারি ব্যারাক, নার্সিং হোম অথবা অনেকদিন হাসপাতালে থাকলে ইনফ্লুয়েঞ্জা দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।
-
দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাঃ অনেকের বিভিন্ন ধরণের ওষুধ যেমন ক্যান্সার ট্রিটমেন্ট, স্টেরোয়েড সেবনের ফলে তার শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে তারা সহজেই ইনফ্লুয়েঞ্জা দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
-
গর্ভাবস্থায়ঃ গর্ভবতী মহিলাদের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ট্রাইমিস্টারে ইনফ্লুয়েঞ্জা দ্বারা আক্রান্ত হবার ঝুঁকি থাকে।
কি কি জটিলতা দেখা দিতে পারে?
সাধারণত তরুণ এবং স্বাস্থ্যবানদের ক্ষেত্রে সিজনাল ফ্লু তেমন একটা গুরুতর হয় না। তারপর ও কেউ যদি আক্রান্ত হয় সাধারণত এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্ত শিশু বা বয়স্করা আক্রান্ত হলে অনেক সময় তাদের কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন,
-
নিউমোনিয়া
-
ব্রংকাইটিস
-
এজমা
-
কানের ইনফেকশন
এর মধ্যে নিউমোনিয়া সবচেয়ে বেশি মারত্নক রোগের মধ্যে একটি।
প্রতিরোধ করার উপায়
আমেরিকার গবেষণা সংস্থা CDC ( Centre disease for Control and Prevention) মতে ৬ মাস বা তার তার বেশি বয়সি সবাইকে বাৎসরিক ফ্লু এর ভ্যাক্সিন দেওয়ার জন্য। প্রতিবছর সিজনাল ফ্লু ভ্যাক্সিন সেই বছরের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সবচেয়ে কমন তিন থেকে চার ধরণের স্ট্রেইন এর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিয়ে থাকে।
কখন ডাক্তার দেখাবো?
বেশির ভাগ ফ্লু এমনিতেই ৫-৭ দিন পর্যন্ত থাকে। তাই এর জন্য ডাক্তার কাছে না গিয়ে সাধারণ চিকিৎসাতে সেরে উঠে। কিন্তু যদি ফ্লু এর লক্ষণ এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট জটিলতা দেখা দেয় তখনি দ্রুত চিকিৎসক এর কাছে যাওয়া উচিত।
২. সাধারণ ঠান্ডা, সর্দি ও কাশি
সর্দি ও কাশি শীতকালের সব চেয়ে কমন রোগের মধ্যে একটি। এটি নাক ও গলায় ভাইরাল ইনফেকশনের কারণে হয়ে থাকে। অনেক ধরণের ভাইরাসের কারণে সর্দি হয়ে থাকে। তার মধ্যে রিনোভাইরাস (Rhinovirus) হল সবচেয়ে ক্ষতিকর। সাধারণত এই সর্দি কাশি ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই সেরে উঠে। কিন্তু যারা ধুমপান করেন তাদের ক্ষেত্রে এই সর্দি কাশি সেরে উঠতে একটু সময় লাগে।
সর্দি কাশি আক্রান্ত হলে বুঝবো কিভাবে?
সাধারণত ঠান্ডা ও সর্দি কাশির লক্ষণ গুলো ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার এক থেকে তিন দিন পর দেখা যায়। এই লক্ষণ গুলো লোকভেদে বিভিন্ন হতে পারে। যেমন,
-
নাক দিয়ে পানি পড়া
-
গলা ব্যথা
-
হাঁচি দেয়া
-
নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া
-
হালকা মাথা ব্যথা ও শরীর ব্যথা
-
হালকা জ্বর
-
অবসাদগ্রস্থ হওয়া
সাধারণত ঠান্ডা সর্দি হলে নাক দিয়ে যে পানি বের হয় তা একটু ঘন, হলুদ বা সবুজাভ রং এর হতে পারে।
কি কারণে হয়ে থাকে?
অনেক ধরণের ভাইরাসের কারণে ঠান্ডা, সর্দি কাশি হয়ে থাকে। তার মধ্যে রিহনোভাইরাস সবচেয়ে কমন। এই ভাইরাস আমাদের নাক, মুখ ও চোখ দিয়ে আমাদের দেহে প্রবেশ করে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত লোক যখন কথা বলে, হাঁচি দেয় অথবা কাশি দেয় তখন বাতাসের কণার মাধ্যমে এইগুলো ছড়িয়ে থাকে।
এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিস্পত্র ব্যবহার করলেও আপনি এই ঠান্ডা সর্দিতে আক্রান্ত হতে পারেন।
আক্রান্ত হবার ঝুঁকি সমূহ
-
বয়সঃ ৬ বছর বা তার চেয়ে ছোট বয়সি বাচ্চাদের সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অন্য বয়সের ও সবাই আক্রান্ত হতে পারে।
-
দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাঃ অনেকদিন ধরে অসুস্থ থাকলে বা তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল থাকলে ঠান্ডা সর্দি হবার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
-
সময়ঃ বাচ্চা ও বয়স্ক সবাই শীতকালে ঠান্ডা সর্দি কাশিতে আক্রান্ত হওয়ার বেশি সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া বছরের যেকোন সময়ই ঠান্ডায় আক্রান্ত হতে পারে।
-
ধুমপানঃ ধুমপানকারীদের অন্যদের তুলনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে এবং তাদের নিরাময় হতেও একটু বেশি সময় লাগে।
-
পরিবেশঃ আপনি যদি অনেক লোকের ভীড়ে থাকেন যেমন বিদ্যালয়, কোন সমাবেশ বা জমায়েত সেখান থেকেও আপনি ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন।
কি কি জটিলতা দেখা দিতে পারে?
সাধারণত এই সর্দি কাশি ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই সেরে উঠে। কিন্তু যারা ধুমপান করেন তাদের ক্ষেত্রে এই সর্দি কাশি সেরে উঠতে একটু সময় লাগে। যদি ৭-১০ দিনের মধ্যে নিরাময় না হয় তখন নানা রকম জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন
-
ওটাইটিস মিডিয়া (Otitis media) বা কানের ভিতরে ইনফেকশন
-
এজমা
-
সাইনুসাইটিস
প্রতিরোধ করার উপায়
সর্দির ঝুঁকি কমাতে আপনি কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন,
-
আপনার হাত সাবান এবং পানি দিয়ে বার বার ধুয়ে নিন
-
হাত না ধুয়ে আপনার চোখ, নাক এবং মুখ স্পর্শ করা এড়িয়ে চলুন
-
যারা অসুস্থ তাদের থেকে দূরে থাকুন
আপনার যদি সর্দি লেগে থাকে তবে এটিকে অন্যান্য লোকদের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া রোধ করতে আপনার এই পরামর্শগুলি অনুসরণ করতে হবে,
-
আপনি অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতে থাকুন এবং শিশুদের অসুস্থ থাকাকালীন স্কুল বা ডে কেয়ার থেকে দূরে রাখুন।
-
অন্যের সাথে সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন, যেমন আলিঙ্গন বা হাত মেলানো।
-
কাশি বা হাঁচির আগে আশেপাশের মানুষদের থেকে দূরে সরে যান।
-
কাশি এবং হাঁচি দেওয়ার জন্য টিস্যু ব্যবহার করুন এবং তা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে দিন।
-
আপনার শার্টের আস্তিনে পুরোপুরি আপনার মুখ এবং নাকটি ঢেকে কাশি এবং হাঁচি দেওয়ার অভ্যাস করুন।
-
কাশি, হাঁচি বা নাক ফুঁকানোর পরে হাত ধুয়ে নিন।
-
খেলনা, দরজার হাতল, মোবাইল ফোন এর মতো ঘন ঘন স্পর্শকৃত পৃষ্ঠ এবং বস্তুগুলিকে জীবাণু মুক্ত রাখুন।
সাধারণ সর্দি থেকে আপনাকে রক্ষা করার জন্য কোনও ভ্যাকসিন নেই।
কখন ডাক্তার দেখাবো?
বেশির ভাগ ঠান্ডা কাশি এমনিতেই ৭-১০ দিন পর্যন্ত থাকে। সাধারণ চিকিৎসাতে এমনেতেই সেরে উঠে। কিন্তু যদি এর লক্ষণ এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট জটিলতা দেখা দেয় তখনি দ্রুত চিকিৎসক এর কাছে যাওয়া উচিত।
৩. ব্রংকাইটিস
ব্রংকাইটিস হল শ্বাসনালির প্রদাহ। যেই নালি দিয়ে বায়ু ফুসফুসে প্রবেশ করে সেই নালিকেই বলা হয় ব্রংকিয়াল ট্রি বা শ্বাসনালি। আমাদের শ্বাসনালীতে প্রদাহের কারণে মিউকাস নিঃসরণ হয়, ফলে আমাদের শ্বাস প্রশ্বাস ব্যহত হয়। ব্রংকাইটিস ২ প্রকার হতে পারে।
১. একিউট ব্রংকাইটিস (Acute Bronchitis)
২. ক্রনিক ব্রংকাইটিস (Chronic Bronchitis)
একিউট ব্রংকাইটিস যে কারণে হয়
আপনি ঠান্ডাজনিত ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে অথবা কোনো ব্যাক্টেরিয়া শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে আপনার দেহে প্রবেশ করলে ব্রংকাইটিস এ আক্রান্ত হতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে নিজে নিজেই সেরে উঠে যদি সেটা নিউমোনিয়ায় রুপান্তরিত না হয়।
একিউট ব্রংকাইটিসের লক্ষণ সমুহ
শুরুতে আপনার শুষ্ক কাশি হবে এবং পরবর্তীতে কাশির সাথে কফ বের হতে পারে। এর সাথে আপনার মাথা ব্যথা, ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূতি, নাক দিয়ে পানি পড়া, হালকা শ্বাসকস্ট, চোখ দিয়ে পানি পড়া এবং হাঁচি দেয়া ইত্যাদি অনুভূত হবে।
কতদিন থাকতে পারে
সাধারণ ২ সপ্তাহ পর্যন্ত এই লক্ষণ গুলা থাকতে পারে আর যদি কফ থাকে তাহলে ১ মাস পর্যন্ত বৃদ্ধি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করাই উত্তম।
ক্রনিক ব্রংকাইটিস
ক্রনিক ব্রংকাইটিস হলো যখন শ্বাসনালির প্রদাহ এবং সেক্ষত্রে শ্বাসনালি থেকে অতিরিক্ত মিউকাস নিঃসরণ হবে এবং প্রতি বছর ৩ মাস কাশির সাথে মিউকাস সমৃদ্ধ কফ থাকবে এবং তা হবে টানা ২ বছর।
ক্রনিক ব্রংকাইটিস এর লক্ষণসমুহ
-
অবিরাম কাশি
-
শ্বাসকষ্ট
-
বুকে চাপা অস্বস্তি
প্রতিরোধ করার উপায়
এক্ষেত্রে প্রধান উদ্দেশ্য হলো যেন রোগী সহজে শ্বাস নিতে পারে। শ্বাস নিতে না পারার কারণেই উপরোক্ত লক্ষণগুলো আরো প্রকোপ আকার ধারন করে।
-
ধূমপান করা থেকে বিরত থাকুন। অন্যদেরকেও আপনার বাড়িতে ধূমপান করা থেকে বিরত থাকতে বলুন
-
আপনার এয়ারওয়ে (নাক, গলা এবং ফুসফুস) জ্বালাতনকারী জিনিসগুলির কাছ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন। জ্বালাতনকারী জিনিসগুলির মধ্যে ধূলিকণা, পোষা প্রাণী, বায়ু দূষণ, ধোঁয়া ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
-
ঠান্ডা লাগলে প্রচুর বিশ্রাম নিন
-
ডাক্তার আপনাকে যেভাবে বলেছে ঠিক তেমনভাবে ওষুধ গ্রহণ করুন
-
স্বাস্থ্যকর খাবার খা্বেন
-
আপনার হাত বার বার ধুয়ে ফেলুন। সাবান এবং পানি ব্যবহার করুন। আপনি যদি সাবান এবং পানি ব্যবহার করতে সক্ষম না হন তবে একটি হাত স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন যাতে অ্যালকোহল রয়েছে।
-
নিয়মিত ফ্লু এবং নিউমোনিয়া ভ্যাকসিনগুলি নেওয়ার চেষ্টা করুন
কখন ডাক্তার দেখাবো?
ব্রংকাইটিস হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়িতে সহজেই চিকিত্সা করা যায়। তবে কেবলমাত্র আপনার লক্ষণগুলি গুরুতর বা অস্বাভাবিক হলে ডাক্তারের সাথে দেখা করা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ,
-
কাশি গুরুতর বা তিন সপ্তাহের বেশি হলে
-
তিন দিনেরও বেশি সময় ধরে অবিরাম জ্বর থাকলে
-
রক্ত সহ শ্লেষ্মা কাশি হলে
-
যদি আপনার অন্তর্নিহিত হার্ট বা ফুসফুসের অবস্থা থাকে যেমন হাঁপানি বা হার্ট ফেইলিওর
৪. নিউমোনিয়া
নিউমোনিয়া হলো ফুসফুসের সংক্রমণ। নিউমোনিয়া হলে উভয় ফুসফুস আক্রান্ত হতে পারে। নিউমোনিয়া হলে আমাদের যে বায়ুথলি থাকে যাকে ইংরেজিতে এলভিওলাই বলে থাকি সেখানে পুজ বা ফ্লুইড দ্বারা পূর্ণ থাকে, যার ফলে শ্বাস নিতে অনেক কষ্ট হয়।
নিউমোনিয়া যে জীবাণু দ্বারাই আক্রান্ত হোক না কেন এটা একটা সংক্রামক ব্যাধি। তাই নিউমোনিয়ার জীবাণু সহজেই একজন থেকে আরেক জনের দেহে ছড়াতে পারে। ভাইরাল নিউমোনিয়া হোক বা ব্যাক্টেরিয়াল নিউমোনিয়া এই দুই দ্বারা আক্রান্ত নিউমোনিয়া সংক্রামক।
নিউমোনিয়া এর লক্ষণসমুহ
নিউমোনিয়ার লক্ষণসমুহ মাঝারি থেকে হালকা বা অনেক ঝুকিপূর্ণও হতে পারে। যেমন,
-
শ্লেষ্মা সহ কাশি হওয়া
-
জ্বর
-
অতিরিক্ত ঘাম হওয়া
-
ক্ষুধা মন্দা
-
বমি বমি ভাব বা বমি করা
-
ঘন ঘন শ্বাস নেয়া
-
কাজ করলে শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
-
কাশির অথবা দীর্ঘ শ্বাস নেয়ার সময় বুকে ব্যথা হওয়া।
এসব ছাড়াও বয়স ও স্বাস্থ্যভেদে লক্ষণ বিভিন্ন হতে পারে। যেমন,
-
৫ বছর কম বয়সিদের অনেকে দ্রুত শ্বাস নেয়া
-
যেসব বাচ্চারা কথা বলতে শিখেনি তাদের এইভাবে কোনো লক্ষণ নাও দেখা দিতে পারে। তাদের ক্ষেত্রে বমি করা, দুর্বল লাগা এবং খাওয়া দাওয়ায় সমস্যা দেখা দিতে পারে।
কি কারণে হয়ে থাকে?
সবচেয়ে কমন যেই কারণে নিউমোনিয়া হয়ে থাকে তা হলো ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণে মাধ্যমে। তার মধ্যে উলেখযোগ্য ব্যাক্টেরিয়া হচ্ছে স্ট্রেপ্টোকোকাস (Streptococcus). এছাড়া আরো ব্যাক্টেরিয়া আছে। যেমন মাইকোপ্লাজমা (Mycoplasma), হিমোফিলাস (Haemophilus), লিগোনেলা (Ligonella)। এসব ব্যাক্টেরিয়া ছাড়াও ভাইরাস দ্বারাও নিউমোনিয়া হতে পারে। যেমন ইনফ্লুয়েন্জা, রেসপইরেটোরি সাইনসিটাল ভাইরাস, রিনোভাইরাস।
প্রতিরোধ করার উপায়
সহজ কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে খুব সহজেই নিউমোনিয়ার মত ভয়াবহ রোগের প্রতিকার সম্ভব।
-
নিয়মিত আপনার হাত ধুয়ে নিন, বিশেষত বাথরুমের পরে এবং খাওয়ার আগে।
-
প্রচুর ফল এবং শাকসব্জী সহ ভাল খাবার এবং সাথে প্রচুর পরিমাণে তরল জাতিয় খাবার খেতে হবে
-
ব্যায়াম করা
-
যথেষ্ট ঘুমাবেন
-
ধুমপান পরিহার করুন.
-
সম্ভব হলে অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন
-
নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন নিন
কখন ডাক্তার দেখাব?
বেশির ভাগ আক্রান্ত রোগী ১-৩ সপ্তাহে নিরাময় হয়ে যায়। কিন্তু যথাযথ চিকিৎসা না পেলে রোগীর প্রাণহানিও ঘটতে পারে। তাই লক্ষণগুলি দেখামাত্র দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়াই উত্তম।
৫. নিপাহ ভাইরাস
নিপাহ একটি ভাইরাস জনিত রোগ। মানুষের মধ্যে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হয় মালয়েশিয়া ও সিংগাপুরে ১৯৯৮ সালে। সেই প্রাদুর্ভাবে ২৭৬ জন আক্রান্ত হয়। সকল রোগির মধ্যে এনসেফালাইটিস (মস্তিষ্ক প্রদাহ) এর লক্ষণ দেখা দেয় এবং মৃত্যুর হার ছিল ৩৯%। আমাদের বাংলাদেশে ২০০৪ সালে এই ভাইরাস সংক্রমণ প্রথম সনাক্ত হয়।
লক্ষণ সমূহ
নিম্নোক্ত লক্ষণগুলি প্রকাশ পেতে শুরু হলে আমরা বুঝব নিপাহ ভাইরাস আমাদের দেহে সংক্রমিত হচ্ছে,
-
জ্বর এবং মাথাব্যথা
-
মাইলজিয়া (পেশী ব্যথা)
-
গলা ব্যথা
-
বমি করা
-
মাথা ঘোরা
-
তীব্র শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা বা একিউট নিউমোনিয়া
এনসেফালাইটিস (মস্তিষ্ক প্রদাহ) হয় এবং তারপর আক্রান্তরা তন্দ্রা, বিশৃঙ্খলা, মানসিক বিভ্রান্তি, পরিবর্তিত চেতনা এবং খিঁচুনি প্রদর্শন করতে পারে যা ২৪-৪৮ ঘন্টার মধ্যে কোমা এবং অবশেষে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হতে পারে।
কি কারণে হয়?
নিপাহ ভাইরাস নামে একটি মারাত্মক রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের কারণে নিপাহ রোগ হয়ে থাকে। ইহা প্যারামিক্সো ভাইরাস গোত্রিয় হেনিপাভাইরাস এর অন্তর্ভুক্ত। এই ভাইরাসের বাহক হচ্ছে টেরোপাস গোত্রিয় বাদুর।
এই রোগের সংক্রমণের প্রধান ঝুকি খেজুরের কাচা রস পান করা। সংক্রমণের অন্যান্য ঝুকি হচ্ছে নিপাহ রোগীর সংস্পর্শে আসা।
প্রতিরোধ করার উপায়
নিপাহ রোগ প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিম্নলিখিত নিয়মাবলি অনুসরনের পরামর্শ দিয়েছেন।
-
খেজুরের কাচা রস খাবেন না
-
কোন ধরণের আংশিক খাওয়া ফল খাবেন না
-
ফলমুল পরিষ্কার পানিতে ভালমত ধুয়ে খাবেন
-
রোগীকে যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে প্রেরণ করুন
-
আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসার পর সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন।
কখন ডাক্তার দেখাব?
লক্ষণগুলি প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথেই কোন কালক্ষেপণ না করে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে দ্রুত স্থানান্তর করতে হবে।
শীতকালে সুস্থ থাকার ১০ টি টিপস
ঋতুরাজ বসন্ত হলেও শীতের দিনগুলোর আনন্দই অন্য রকম। এই সময় সবাই ছুটি পায়, বাচ্চাদের ইশকুল কলেজ ছুটি থাকে, তরুন-তরুনিরা ঘুরতে যায়। বিয়ে-শাদি ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য শীতকালের থেকে উপযুক্ত সময় আর হয়না।
তাছাড়া শীতকাল হচ্ছে পিঠার সময়। আমাদের দেশের সংস্কৃতির বিশাল একটা স্থান জুড়ে আছে গ্রাম বাংলার নানারকমের পিঠা। তাই এই সময়ে সুস্থ থাকা জরুরী। আসুন জেনে নিই কিভাবে শীতকালীন এই রোগগুলো প্রতিরোধ করা যায়,
-
শারীরিক কার্যক্রমঃ নিয়মিত অনুশীলন আমাদের স্বাস্থ্যকে ভালো রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, এমনকি সারা দিন অল্প পরিমাণে চলাচলে ইতিবাচক সুবিধা থাকতে পারে। আপনি প্রতি দুই থেকে তিন ঘন্টা পর একটি অ্যালার্ম সেট করুন যাতে যখন যে অবস্থায় থাকুন না কেন সে অবস্থা থেকে উঠে একটু আশেপাশে ঘুরে আসুন।
-
পানি পান করাঃ প্রচুর এবং প্রচুর পানি পান করুন। দিনে আট থেকে দশ গ্লাস পান করা যেতে পারে, বিশেষত শীতকালে। যদি আপনার সর্দি হয়ে থাকে তবে শরীরকে হাইড্রেটেড (জলয়োজন) রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
-
ধূমপান এবং অ্যালকোহল বর্জনঃ মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং লয়োলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন আপনার প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে দুর্বল করতে পারে। এছাড়া ধূমপানে আমাদের শ্বাসকষ্ট এবং হৃদরোগের ঝুকি বাড়ে। তাই ধূমপান এবং অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকাই আমাদের জন্য শ্রেয়।
-
ব্যক্তিগত কিছু ভাগাভাগি করবেন নাঃ আপনার খাবার, কলম বিশেষত কোনও ধরণের পানীয়। আপনি যদি সত্যই কর্মস্থলের জীবাণুগুলি এড়াতে চান, তবে আপনাকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদেরও একইভাবে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
-
আপনার হাত পরিষ্কার রাখুনঃ এই বিষয়ে আরও বেশি কিছু বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না। যত যাই করুন না কেন হাত সব সময় সাবান ও পানি দিয়ে পরিষ্কার রাখুন।
-
চা পান করুনঃ চায়ের স্বাস্থ্যকর অনেক গুণ রয়েছে। তাই এটি আপনার প্রতিদিনের রুটিনের অংশ হওয়া উচিত। অনেক অসুস্থতার সময়ে এটি আবশ্যক হতে পারে। কিন্তু দুধ চা কে এড়িয়ে চলুন।
-
ফল এবং সবজি খেতে যেন ভুলে না যানঃ ফল যেখানে আপনি ভিটামিন সি পাবেন)) এবং সাথে প্রচুর শাকসবজি। সমস্ত স্বাস্থ্যকর খাদ্য আপনার প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী রাখতে সহায়তা করবে। আবার এই মৌসুমে যেহেতু বিয়ে বা অন্যান্য অনুষ্ঠান বেশী হয় তাই আমাদের তৈলাক্ত খাদ্য থেকে দূরে থেকে সালাদ আইটেম বেশী করে খেতে হবে।
-
অসুস্থ সহকর্মীদের এড়িয়ে চলুনঃ এই কাজটি করা খুবই জরুরী তবে তা মেনে চলা সত্যিই কঠিন হয়ে পারে। আপনার সংস্থার নিয়ম অনুসারে কিছু কর্মচারীর অসুস্থ হয়েও কাজ করা লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করা বাধ্যতামূলক। তার সংস্পর্শ থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন এবং প্রয়োজনে মাস্ক ব্যবহার করুন।
-
আর অসুস্থ হলে বাড়িতে থাকুন বা টিস্যু সাথে রাখুনঃ অন্যদের কাছে আপনার ঠান্ডা বা ফ্লু ছড়িয়ে না দেওয়ার সর্বোত্তম উপায় কী? বিশ্রাম নিন অথবা পারলে বাড়ি থেকে কাজ করুন। যদি আপনাকে কাজে আসতেই হয়, তবে জীবাণুগুলি যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সে দায়িত্ব আপনাকে অবশ্যই পালন করতে হবে। সম্ভব হলে ভিন্ন জায়গায় কাজ করুন এবং যদি না হয় তবে প্রচুর টিস্যু সাথে রাখুন এবং সেগুলি ব্যবহার করুন।
-
ভ্যাকসিনঃ নিজেকে সুস্থ রাখতে ভ্যাকসিন দেওয়াটা খুবই জরুরী। শীতের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে আপনি ফ্লু এবং নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন আগে থেকেই নিয়ে রাখতে পারেন। এতে শীতকালীন রোগ থেকে আপনি অনেকটা নিশ্চিত থাকতে পারবেন।
তাই আসুন নিজে সুস্থ এবং থাকি পরিবার ও সমাজের সবাইকে সচেতন করি শীতকালীন রোগ-বালাই সম্পর্কে। সচেতনতার মাধ্যমেই আমরা সকলেই উপভোগ করতে পারব শীতের আমেজ।
সতর্কতা: এই তথ্যগুলোকে মেডিকেল রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসা হিসাবে গণ্য করা উচিত নয়। আপনি যদি অসুস্থ হন বিশেষত দীর্ঘ সময় ধরে তবে অবশ্যই, একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন।