চোখের যে ৬টি রোগ কখনও অবহেলা করবেন না
পৃথিবীতে শত শত চোখের রোগ এবং দৃষ্টিগত সমস্যা আছে, যার মধ্যে অনেকগুলোরই চিকিৎসা করা যায় আবার কোন কোনোটা অনিরাময়যোগ্য। আর এসব রোগের সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে এবং একটি স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল অনুসরণ করতে পারলে আপনি নিজের চোখকে সুন্দরভাবে আলোকিত করে রাখতে পারবেন।

চোখের ৬টি রোগ
রিয়নের বাবা ইদানিং চোখে ঝাপসা দেখছেন। ডাক্তারের সরনাপন্ন হওয়ায় ডাক্তার জানান তাঁর চোখে ছানি পড়েছে। এদিকে মাত্র দশ বছর বয়সেই ডাক্তার আয়াতকে চশমা দিয়েছে, ওর দূরদৃষ্টিতে সমস্যা। এরকম অসংখ্য চোখের রোগ রয়েছে যে রোগে আমরা প্রায়ই আক্রান্ত হই। সেসব রোগ, রোগের কারণ, চিকিৎসা নিয়েই আলোচনা হবে এই আর্টিকেলে।
চোখের রোগ কী?
চোখের রোগ বলতে, চোখের বিভিন্ন অংশের সাথে যুক্ত সমস্যাকে বোঝায়। চোখের রোগ অনেক ধরণের হয়ে থাকে। এর মধ্যে প্রচলিত কিছু রোগ হলো- ছানি, ডায়াবেটিস-সম্পর্কিত রেটিনোপ্যাথি, গ্লুকোমা, চোখ ওঠা বা কনজাঙ্কটিভাইটিস, দৃষ্টিশক্তির ত্রুটি ইত্যাদি। কম বেশি প্রত্যেকেই আমরা এই সব চোখের রোগে আক্রান্ত হই, তাই সচেতনতার জন্য আজ এই সকল রোগের কারণ, প্রতিকার সম্পর্কে জানবো।
১. ছানি
চোখে এক ধরণের লেন্স থাকে যার মাধ্যমে আমরা স্বচ্ছতার সাথে দেখতে পারি। ছানি চোখের এমন একটি রোগ, যার ফলে চোখের লেন্সটি ঘোলাটে হয়, যার ফলে আমাদের দেখতে সমস্যা হয়, স্বাভাবিক দৃষ্টি বাঁধাপ্রাপ্ত হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই রোগটি হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। তবে কম বয়সীদের মধ্যেও এই রোগ হতে পারে।
ছানি রোগের কারণ
-
দীর্ঘদিন ধরে স্টেরয়েড ব্যবহার
-
জিনগত অসুখ
-
বয়স বৃদ্ধি
ছানি রোগের উপসর্গ
-
দৃষ্টি আবছা বা ঘোলাটে হওয়া
-
রঙিন জিনিসের উজ্জ্বলতা প্রত্যক্ষ করতর না পারা
-
রাতে দেখতে অসুবিধা হওয়া
-
উজ্জ্বল বস্তুর চারপাশে বর্ণবলয় দেখা
-
বড় হরফের লেখা দ্বৈত দেখা
ছানি রোগের চিকিৎসা
হোমিও ও অ্যালোপেথিক দুই ভাবেই ছানির চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। চোখে ছানি পড়লে সাধারণত ডাক্তার ওষুধ ও চশমা দিয়ে থাকেন। এতে কাজ না হলে অর্থাৎ চোখে ছানির পরিমাণ বেড়ে গেলে দৃষ্টিশক্তি বাড়ানোর জন্য চোখে অস্ত্রপাচারের মাধ্যমে কৃত্রিম লেন্স লাগিয়ে দেন যা স্বাভাবিক লেন্সের মতো কাজ করে। ছানি অপারেশনের পর চোখের গুরুত্ব নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২. দৃষ্টিশক্তির ত্রুটি
চোখে কম বা ঝাপসা দেখাকেই মূলত দৃষ্টিশক্তির ত্রুটি বোঝায়। অধিকাংশেরই দৃষ্টিশক্তির ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। দৃষ্টিশক্তির ত্রুটির কারণে কাছের বা দূরের বস্তু দেখতে অসুবিধা হয়, ঝাপসা লাগে। স্বাভাবিক চোখের দৃষ্টির পাল্লা ২৫ সেমি থেকে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত। যদি এই পাল্লার মধ্যে কোনো চোখ ঠিক ভাবে দেখতে ননা পারে ততবে ওই চোখকে ত্রুটিপূর্ণ চোখ ধরা হয়। দৃষ্টিশক্তির এই ত্রুটি নানান কারণে হয়ে থাকে। তারতম্য ভেদে দৃষ্টিশক্তির ত্রুটিকে চারভাগে ভাগ করা হয়-
-
মায়োপিয়া বা হ্রস্ব দৃষ্টি
-
হাইপারমেট্রোপিয়া বা দূর দৃষ্টি
-
এ্যাসটিগমেটিজম
-
প্রেসবাইওপিয়া বা চালশে
এগুলোর মধ্যে মায়োপিয়া ও হাইপারমেট্রোপিয়া বেশি হয়ে থাকে।
ক. মায়োপিয়া বা হ্রস্ব দৃষ্টি
মায়োপিয়া একটি সাধারণ দৃষ্টিজনিত সমস্যা যা সাধারণত ২০ বছর বয়সের আগে নির্ণয় করা হয়। মায়োপিয়া আক্রান্ত রোগীরা কাছের লেখা বা বস্তু পরিষ্কার দেখতে পারলেও দূরে ঝাপসা দেখে।
হ্রস্ব দৃষ্টির কারণ
হ্রস্ব দৃষ্টির অনেক কারণ থাকলেও উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ হলো-
-
অতিরিক্ত মোবাইল/ টিভি দেখা
-
জেনেটিক্যাল কারণ, অর্থাৎ বাবা-মায়ের একজন বা উভয়েরই মায়োপিয়া থাকলে।
-
কম আলোতে বইপত্র পড়া
রোগের উপসর্গ
-
মাথা ব্যথা করা
-
চোখে চাপ অনুভব করা
-
চোখে ঘোলা দেখা
-
চোখ ব্যথা করা
চিকিৎসা
মায়োপিয়ার চিকিৎসার জন্য সাধারণত ডাক্তারগণ এক ধরণের ড্রপ দেন চোখ পরিষ্কার রাখার জন্য। সেই সাথে পরিষ্কার ভাবে দেখার জন্য পাওয়ারি চশমা বা কন্টাক্ট লেন্স প্রেসক্রাইব করেন।
খ. হাইপারমেট্রোপিয়া বা দূর দৃষ্টি
দৃষ্টি সংক্রান্ত আরেকটি সমস্যা হলো হাইপারমেট্রোপিয়া। এই রোগে আক্রান্তরা কাছের বস্তু দেখতে পারেন না কিংবা ঝাপসা বা ঘোলা দেখেন। সাধারণত ৪০ বছর বয়সের পর থেকে এই সমস্যা দেখা দেয় তবে এর আগেও হতে পারে।
দূর দৃষ্টি বা হাইপারমেট্রোপিয়ার কারণ
-
বংশগত কারণ
-
ডায়বেটিস
-
চোখের চারপাশে ক্যন্সার এবং রেটিনার রক্তনালীগুলোর সমস্যার মতো কারণেও এটি হয়
রোগের উপসর্গ
-
মাথা ব্যথা
-
চোখে ক্লান্তি বা চাপ অনুভব করা
-
কাছের বস্তু ঘোলা, দূরের বস্তু পরিষ্কার দেখা
চিকিৎসা
হাইপারমেট্রোপিয়ার চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকরা চশমা ও কনটাক্ট লেন্সের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
৩. ডায়াবেটিস সম্পর্কিত রেটিনোপ্যাথি
এটি এমন একটি রোগ যার ফলে রক্তে দীর্ঘমেয়াদি অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ গ্লুকোজ মাত্রার কারণে রেটিনার রক্তনালীর ক্রমাগত ক্ষতি হয়। ডায়াবেটিস সম্পর্কিত রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্ত রোগীদের রোগটি গুরুতর না হওয়া পর্যন্ত দৃষ্টি পরিবর্তন হয় না।
কারণ
এর কারণ মূলত রক্তে গ্লুকোজের মাত্রার উপর নির্ভরশীল।
উপসর্গ
-
ঝাপসা বা বিকৃত দৃষ্টি
-
দূবর্ল রাতের দৃষ্টি
-
দূরের বস্তু পড়তে বা দেখতে সমস্যা
চিকিৎসা
এই রোগের চিকিৎসায় চিকিৎসকরা রোগীতে এক ধরণের ইনজেকশন দিয়ে থাকেন। তাছাড়া সার্জারির মাধ্যমেও রেটিনার রক্তনালীগুলো মেরামত বা সংকুচিত করা যায়।
৪. গ্লুকোমা
চোখের একটি সাধারণ সমস্যা হলো গ্লুকোমা। এই রোগে অপটিক নার্ভের ক্ষতি সাধিত হয় যার ফলে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে মানুষ। পঞ্চাশোর্ধ মানুষের এই রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশি। গ্লুকোমা অন্ধত্বের কারণ হতে পারে।
কারণ
গ্লুকোমার কারণ নিয়ে চিকিৎসকরাও সন্দিহান। তারপরেও ধারণা করা হয় চোখের ভিতরে তরলের চাপ বেড়ে গিয়ে তরলটি অপটিক স্নায়ুর উপর শক্ত ভাবে চাপ দেয়, যা গ্লুকোমার কারণ হতে পারে।
উপসর্গ
গ্লুকোমার অনেক সময় উপসর্গ থাকে না আবার কিছু কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে। উপসর্গ গুলো হলো-
-
বমি বমি ভাব
-
মাথা ব্যথা
-
চোখ দিয়ে জল পড়া
চিকিৎসা
গ্লুকোমা হলে সাধারণত ডাক্তাররা চোখের চাপ কমানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। চোখের ড্রপের পাশাপাশি কখনো কখনো চোখের অস্ত্রপাচারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
৫. চোখ কাঁপানো
চোখের একটি উল্লেখযোগ্য রোগ হলো চোখ কাঁপানো। কমবেশি সবারই এই সমস্যা হয়। সাধারণত অল্প সময়ের জন্য হয় এবং আপনাআপনি সেরে যায়। চোখের পাতার পেশীগুলো নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই সংকুচিত হলে চোখ কাঁপতে থাকে।
চোখ কাঁপার কারণ
স্ট্রেস, ক্লান্তি, উজ্জ্বল আলো, চোখ জ্বালা করা, ধ
ধূমপান, দূষণ বা অ্যালকোহল সেবন সহ অসংখ্য কারণে চোখ কাঁপানো সমস্যা হতে পারে। সাধারণত আপনাআপনি সেরে যায়। তবে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এটি চলতে থাকলে গুরুতর সমস্যায় রূপ নেয়।
চিকিৎসা
এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এই সমস্যা থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া জরুরী। এই রোগের চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে পর্যাপ্ত ঘুম, চোখকে বিশ্রাম দেওয়া, উজ্জ্বল আলো এড়িয়ে চলা। এছাড়াও ডাক্তার কিছু আই ড্রপ ও ওষুধ প্রেসক্রাইব করে থাকেন।
৬. কনজাংটিভাইটিস
এটি চোখের এক ধরণের রোগ যা বহুল প্রচলিত ও কমবেশি সকলের হয়ে থাকে। চোখের কনজাংটিভা নামক পর্দার প্রদাহের কারণে এ রোগ হওয়ায় একে কনজাংটিভাইটিস বলা হয়। এই রোগটি "চোখ ওঠা" রোগ নামে সমধিক পরিচিত। সাধারণত এই রোগটি বর্ষাকালে বেশি দেখা দেয় তবে সারা বছরই হয়ে থাকে। মূলত যে মৌসুমে বাতাসে আদ্রতা বেশি থাকে তখন এই রোগটি বেশি হয়। সাধারণত ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার কারণে চোখ ওঠা রোগ হয়। এই রোগটি সারতে ৭-১০ দিন সময় লেগে যায়। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে ১৫ দিনের মতো সময় লাগতে পারে।
কারণ
কনজাংটিভাইটিস বা চোখ ওঠা রোগটি বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। এর উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ হলো-
-
ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ
-
ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণ
-
এলার্জি
-
আদ্র বাতাস
উপসর্গ
কনজাংটিভাইটিস প্রধাণ উপসর্গ হলো চোখ লাল বা গোলাপী হওয়া। এ ছাড়া আরো কিছু উপসর্গ হলো
-
চোখ চুলকানো
-
চোখ দিয়ে জল পড়া
-
চোখ ফুলে যাওয়া
-
চোখ জ্বালা করা
-
আলোর প্রতি সংবেদনশীল
চিকিৎসা
কনজাংটিভাইটিসের চিকিৎসা এর কারণের উপর নির্ভর করলেও কিছু কমন চিকিৎসা রয়েছে। যেমন-
-
চোখে হালকা গরম জলের ভাপ দেওয়া
-
চোখে হাত না দেওয়া
-
চোখে কালো চশমা ব্যবহার করা
-
চোখে ড্রপ দেওয়া
চিকিৎসকগণ আরেকটি পরামর্শ দিয়ে থাকে তাহলো রোগির গামছা, তোয়ালে আলাদা রাখা।
চোখ যতটা সম্ভব সুস্থ রাখতে আপনি কী করবেন?
আপনার দৃষ্টি রক্ষা করার জন্য আপনি অনেক কিছু করতে পারেন। আসুন জেনে নেই-
-
আপনার দৃষ্টিতে কোনো লক্ষণীয় পরিবর্তন না থাকলেও নিয়মিত ব্যবধানে চোখের ডাক্তারকে দেখান। কারণ, কিছু চোখের রোগের প্রাথমিক সতর্কতা লক্ষণ নেই।
-
চোখের রোগের জন্য আপনার ঝুঁকির কারণগুলি জানুন। ঝুঁকিগুলির মধ্যে রয়েছে বয়স, চোখের রোগের পারিবারিক ইতিহাস, আপনার জাতিগত পটভূমি বা অন্যান্য স্বাস্থ্যগত অবস্থা যেমন উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস।
-
স্বাস্থ্যকর লাইফস্টাইল প্রাধান্য দিন। আপনার শরীরকে ততটাই সুস্থ রাখুন যতটা যতটায় আপনার চোখের রোগ বা দৃষ্টি সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি থাকবে না। যেমন, স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন, স্বাস্থ্যকর খাবার খান, সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনে অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য ব্যায়াম করুন এবং ধূমপান বন্ধ করুন ইত্যাদি।
-
আল্ট্রাভায়োলেট (UVA এবং UVB) আলো থেকে আপনার চোখকে রক্ষা করতে মেঘলা দিনেও সানগ্লাস ব্যবহার করুন। খেলাধুলা করার সময় বা বাড়িতে বা শিল্প প্রকল্পে কাজ করার সময় যথাযথ প্রতিরক্ষামূলক চশমা পরিধান করুন। দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার এবং ফোনে চোখের স্ট্রেন এড়িয়ে চলুন। আপনার চোখকে বিশ্রাম দিন এবং প্রতি ২০ মিনিটে এক মিনিটের জন্য দূরবর্তী বস্তুগুলিতে ফোকাস করুন।
শেষ কথা
চোখ আমাদের অত্যন্ত সংবেদনশীল অংশ। চোখের মাধ্যমেই দিনের সূর্য, রাতের তারা দেখি। এই চোখকে সুস্থ রাখা নিজেদের দায়িত্ব। চোখের বিভিন্ন রোগ অনেক সময় নিজেদের অবহেলার কারণেই হয় এমন কি এই অবহেলা আমাদের চিরকালের জন্য অন্ধও করে দিতে পারে। তাই চোখের প্রতি যত্নশীল হওয়া জরুরী প্রত্যেকের এবং ছয় মাস অন্তর চোখ বিশেষঞ্জ দ্বার চোখের চেক-আপ করা প্রয়োজন।
আশা করি আমাদের এই আর্টিকেল থেকে আপনারা উপকৃত হয়েছেন এবং নতুন কিছু জেনেছেন। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানতে আমাদের ওয়েব সাইট ভিজিট করুন। ধন্যবাদ।