ডায়াবেটিস ও ক্রনিক কিডনি ডিসিজ রোগীদের খাদ্যাভ্যাস কেমন হওয়া উচিৎ

দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ কিডনির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি বোঝায় যার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে ডায়াবেটিস। আর এই দুটি রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে জীবনচরণ ও খাদ্যাভ্যাস ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরী। আসুন জেনে নেই সেই সম্পর্কে।

টাইপ ২ ডায়াবেটিসের প্রধান ঝুঁকির কারণ অতিরিক্ত ওজন যার ফলে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বা ক্রনিক কিডনি ডিসিজ (সিকেডি বা CKD) হতে পারে। এই উভয় রোগ আলাদাভাবে চিকিৎসা করা এমনেতেই কঠিন, কিন্তু যখন আপনাকে উভয়ই একসাথে পরিচালনা করতে হয় তখন আপনার জন্য আরও বেশি চাপ সৃষ্টি হতে পারে।

উভয় অবস্থার রোগীদের জন্য ডায়েট খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আপনি যে পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট (শর্করা) খাবেন সেদিকে আপনাকে আরও মনোযোগ দিতে হবে। কার্বোহাইড্রেট অনেক খাবারে পাওয়া যায় যেমন ফল, দুধ, রুটি, মিষ্টি এবং অনেক পানীয়। সোডিয়াম সিকেডি এবং ডায়াবেটিক রোগীদের উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার ডায়েটে যদি সোডিয়াম কম রাখতে পারেন তবে তা রক্তচাপ কমাতে এবং শরীরে পুনরায় তরল ধারণ কমাতে সাহায্য করে। 

প্রোটিন আরেকটি পুষ্টি উপাদান যার গুরুত্ব অনেক এবং অত্যধিক প্রোটিন ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। 

আপনার যত্নের জন্য উপযুক্ত মানদণ্ড নির্ধারণ করতে আপনার ডায়েটিশিয়ান এবং নেফ্রোলজিস্টের সাথে কথা বলা গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র একটি কিডনি বান্ধব ডায়েট থেকে আরেকটি বড় পরিবর্তন হল একটি রুটিন করে খাওয়ার উপর জোর দেওয়া এবং আপনার খাবার এবং স্ন্যাক্সের ভারসাম্য বজায় রাখা।

পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস রোগী যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের চিনির মাত্রা নিয়ে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন, কারণ শরীর পরিষ্কার করতে ব্যবহৃত ডায়ালিসেট তরলগুলি সাধারণত চিনি ভিত্তিক তরল। আপনার চিকিতসক আপনার জন্য কোন তরলটি সবচেয়ে ভালো তা নির্ধারণ করতে সাহায্য করবে এবং ডায়ালিসেটে অতিরিক্ত চিনির জন্য আপনার খাদ্য সামঞ্জস্য করতেও সাহায্য করবে। আপনার চিকিৎসক ডায়াবেটিস রোগী হিসাবে আপনার অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত, এবং এই বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নিন।

জীবনচরণ সম্পর্কিত নিয়ম বিধি

  • ধূমপান, মদ্যপান কিংবা তামাক জাতীয় দ্রব্য যেমন, তামাক পাতা, জর্দা, গুল প্রভৃতি সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে।

  • প্রতিদিন নূন্যতম ৩০-৪৫ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করতে হবে বা ব্যায়াম করতে হবে। তবে হৃদরোগী কিংবা ইনসুলিন নিচ্ছেন এমন রোগীকে ব্যয়ামের ব্যপারে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

  • খাবার এর ৩০ মিনিট পূর্বে ইনসুলিন গ্রহণ করবেন। ইনসুলিন গ্রহনের পর এবং খাবার গ্রহনের পূর্বে কায়িকশ্রম করবেন না।

  • ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীকে নিয়মিত দাঁত ও মাড়ির যত্ন নিতে হবে।

  • পায়ে ক্ষত/অসুবিধা দেখা দিলে বা কোনও সংক্রামক রোগ হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

  • নিয়মিত সকালে ও রাতে খাবারের পর দাঁত ব্রাশ করতে হবে ও দাঁতের মাড়ি আঙুল এর মাধ্যমে ম্যাসেজ করবেন।

খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কিত নিয়ম বিধি

  • অতিরিক্ত লবন পরিহার করতে হবে, চিকিৎসকের পরামর্শ মতো খেতে হবে।

  • পাতে কাঁচালবন, ভাজা লবন, বিটলবন প্রভৃতি বাদ দিতে হবে

  • অতিরিক্ত লবন যুক্ত খাদ্য দ্রব্যাদি যেমন- চানাচুর, পুরি, সিঙ্গারা প্রভৃতি পরিহার করাই শ্রেয় 

  • লবন দিয়ে সংরক্ষিত খাবার যেমন -আঁচার, শুঁটকিমাছ, লবন জাত সামুদ্রিক মাছ প্রভৃতি

  • চর্বি ও কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার সম্পূর্ণ পরিহার, স্বল্প পরিমানে, চিকিৎসকের নির্দেশমত খেতে হবে। যেমন:

    • ডিমের কুসুম, কলিজা, খাসি/গরুর চর্বিযুক্ত মাংস, হাঁস মুরগীর চামড়া, মাছের ডিম, হাড়ের মজ্জা, মার্জারিন, ঘি, মাখন, ডালডা, চিংড়ি, পাম অয়েল, নারিকেল এবং উপরোক্ত উপকরণ দিয়ে তৈরী করা খাবার।

  • অতিরিক্ত আমিষ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করা নিষেধ। আমিষ জাতীয় খাদ্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাবেন। সাধারন আমিষ জাতীয় খাদ্য হলো মাছ, মাংস, ডিম, ডাল প্রভৃতি।

  • চিনি বা গুড় দিয়ে যেকোন খাবার, চিনিযুক্ত চা, মিষ্টি ফল -পাকা আম, কমলা, আঙ্গুর, খেজুর, তাল আখের রস।

  • বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুড কেক, পুডিং, বার্গার, স্যান্ডউইচ, পোড়া তেলে ভাজা যেকোন খাবার (পুরি, সিঙ্গারা, সমুচা, পিঁয়াজু প্রভৃতি), আইসক্রিম, বোতলজাত কোমল পানীয় প্রভৃতি।

যেসব খাবার খেতে পারবেন

  • করলা, ঝিঙে, ধুন্দল, গাজর, কাকরোল, লাউ, পটল, বেগুন, শসা, চিচিঙ্গা, চালকুমড়া, আলু (সামান্য), টমেটো (সামান্য), মিষ্টিকুমড়া

  • ডাঁটাশাক, লাল শাক, সরিষা শাক, লাউ শাক, কচু শাক, কলমি শাক

  • মুরগির মাংস, চাল, আটা, ময়দা, মুড়ি, চিড়া, মুগডাল (অল্প), সুজি, সেমাই, বার্লি, কর্ণফ্লেক্স, ভুট্টা, কর্নফ্লাওয়ার প্রভৃতি।

  • পাকা পেঁপে, পাকা পেয়ারা, আপেল, আনারস, জামরুল, নাসপাতি, কাঁচা আম, চালতা।

  • উপকারী ও অসম্পৃক্ত চর্বিজাতীয় খাবার বেশী খেতে হবে, যেমন-

    • সবধরনের মাছ, বিশেষত : সমুদ্রের মাছ, ছোট মাছ,মাছের তেল প্রভৃতি।

    • উদ্ভিজ্জ তেল বিশেষত কর্ণ অয়েল, সানফ্লাওয়ার অয়েল, অলিভ অয়েল, সয়াবিন তেল প্রভৃতি।

যেসব খাবার খাবেন না বা কম খাবেন

  • মূলা,মিষ্টি আলু,ওলকপি, বিট, বাঁধাকপি, ফুলকপি, সজনে, ঢেঁড়স, পেঁপে,সীম, বরবটি, কাঁঠালের বীচি, সীমের বীচি, করলা।

  • পালংশাক, পুঁই শাক, মূলাশাক, পাট শাক।

  • ডাবের পানি, তরমুজ, বাঙ্গি, করলা, পাকা আম, টকফল, বাতাবিলেবু, জাম, আমলকি, কামরাঙ্গা, নারিকেল, কুল, আঙ্গুর।

  • বিভিন্ন ধরনের ডাল, বাদাম, কফি প্রভৃতি।

  • রান্নার পর সবজি কাটার পর অনেক বেশী পানিতে দেড় থেকে দু'ঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন বা ১০ মিনিট গরম পানিতে সিদ্ধ করে, সবজি হতে পানি ছাড়িয়ে নতুন করে রান্না করুন। লাউ,কুমড়া জাতীয় সবজির ক্ষেত্রে খোসা ছাড়িয়ে পাতলা করে কাটবেন। রান্নার পর শুধু সবজি খাবেন, ঝোল খাবেন না।

খেয়াল রাখবেন

রক্তে গ্লুকোজ কমে গেলে যেসব লক্ষণ হতে পারে তা হল-

  • অসুস্থ বোধ করা

  • শরীর কাঁপতে থাকা

  • চোখে ঝাঁপসা দেখা

  • খুব বেশী ক্ষুধা পাওয়া

  • বুক ধড়ফড় করা

  • বেশী ঘাম হওয়া

  • শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা

  • হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া 

আর এসব লক্ষণগুলি দেখা দিলেই হাতের কাছে মিষ্টি জাতীয় যা পাবেন দ্রুত খাবেন বা খাওয়াবেন। ভালো হলো চা চামচের কয়েক চামচ গ্লুকোজ একগ্লাস পানিতে গুলিয়ে খাবেন বা খাওয়াবেন এবং দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।

আপনার রোগ সমূহ নিয়ন্ত্রণে থাকলে প্রতিমাসে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন। নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ১৫ দিন বা ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়ে কম সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। পরামর্শ অনুযায়ী সিরাম ক্রিয়েটিনিন, রক্তের গ্লুকোজ এবং অন্যান্য পরীক্ষা করাতে হবে।

Default user image

ত্রপা চক্রবর্তী, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি ত্রপা চক্রবর্তী, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ফার্মেসী তে স্নাতক সম্পন্ন করে, এখন একটি ফার্মাসিউটিক্যালসে প্রোডাকশন ফার্মাসিস্ট হিসেবে চাকরি করছি। ফার্মাসিস্ট হিসেবে মানুষের সুস্বাস্থ্যে অবদান রাখতেই আস্থা লাইফের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছি।

Related Articles