পায়ুপথে ব্যথা বা এনাল ফিশারের ঘরোয়া চিকিৎসা
পায়ুপথে ব্যথা বা এনাল ফিশার মূলত পায়ুপথে ক্ষত হওয়ার রোগ। এটি খুবই স্বাভাবিক একটি রোগ হলেও আমাদের সমাজ কাঠামের খুঁতের কারণেই মূলত এটি জটিল হয়ে ওঠে। অথচ খুব সহজেই এই রোগটি থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব। আসুন জেনে নেই এর কারণ, উপসর্গ, চিকিৎসা, ঘরোয়া টোটকা সহ আদ্যপান্ত।
"অপারেশন ছাড়া অর্শ, গেজ, পাইলস সহ অন্যান্য যৌনরোগ সারিয়ে তোলা হয়" এমন বিজ্ঞাপন রাস্তাঘাট বিলবোর্ডে এমনকি পত্রিকাতেও অহরহ চোখে পড়ে। শুধু এই একটি লাইন থেকেই এসব রোগের বর্তমান অবস্থার ৩ টি দিক সম্পর্কে ধারনা করা যায়। প্রথমত "অপারেশন ছাড়া" অংশটি মানুষের মনে অপারেশন ভীতি সৃষ্টি করতে যথেষ্ট। দ্বিতৃয়ত পায়ুপথের রোগগুলোকে যৌনরোগের তালিকা ভুক্ত করে এটিকে গোপনীয় বিষয়ের তকমা লাগানো। তৃতীয়টি হলো এত অহরহ বিজ্ঞাপন নিশ্চিত প্রমান করে তাদের ব্যবসাহ চলেও রমরমা। এত লম্বা ভূমিকা দেওয়ার একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে।
লক্ষ্য করুন, এই ধরনের চিকিৎসার বিজ্ঞাপন যারা দেন তারা কেউই মূলত চিকিৎসক নন। কিছু রোগের সাময়িক চিকিৎসা যে দিতে পারেন না তা নয়, কিন্তু তা কখনোই স্থায়ী সমাধান হয় না। সেই সাথে অনেক ক্ষেত্রে ভুল চিকিৎসার কারণে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
গোপন অঙ্গ বিষয়ক যেকোনো কিছুই আমাদের সমাজে একটি ট্যাবু বা তামাশার বস্তু বলে গণ্য। সে পর্যন্ত ঠিক আছে, সমস্যাটা শুরু হয় তখনি, যখন গোপনাঙ্গের রোগও মানুষ গোপন করতে শুরু করে। এই গোপন করার প্রবনতা থেকেই পাড়া মহল্লায় গোপনে হাতুড়ে চিকিৎসা নির্ভর হয়ে পড়ে পায়ুপথের রোগ গুলো। এমনও রোগী পাওয়া যায়, যিনি কিনা দীর্ঘ ২০ বছর পায়ুপথের যন্ত্রনায় ভুগেছেন, তবু লোকলজ্জায় শল্য চিকিৎসকের কাছে যান নি। অথচ ছোট একটি অপারেশনের মাধ্যমে ৩-৪ দিনের ভেতরে সম্পুর্ণ সুস্থ্য হওয়া সম্ভব। এই ৩-৪ দিন থেকে ৩-৪ বা আরও বেশি বছর পায়ুপথে ব্যথা সহ্য করে বেড়ানোর মধ্যে ব্যাবধান শুধু সঠিক তথ্যগুলো জানা।
পায়ুপথে ব্যাথা বা এনাল ফিশার কি?
আমাদের মলদ্বারের শেষ অংশটি একটি গেটের মত কাজ করে, যেটি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। অনেক সময় নানা কারনে মলদ্বারের শেষ অংশটি ছড়ে বা কেটে যেতে পারে। যার ফলে তীব্র জ্বলুনি, ব্যথা ও চুলকানি দেখা দেয়। সেই সাথে অতিরিক্ত ঝাল-মসলা যুক্ত খাবারে ব্যথা বাড়িয়ে তোলে বহুগুন। এক কথায় অবর্ণনীয় ব্যথা যা মলত্যাগের পর ৩-৪ ঘন্টা পর্যন্ত থাকতে পারে। এ তীব্র ব্যথার ফলে পায়খানায় যেতে অনীহা সৃষ্টি হয়, দেরীতে মলত্যাগের ফলে মল কঠিন হয়ে যায়। পরবর্তিতে কঠিন মল ত্যাগ করতে আরও বেশি কষ্ট হয়। এনাল ফিশার ২ প্রকারের হয়ে থাকে,
১। একিউট এনাল ফিশার: এ ধরনের এনাল ফিশার বা গেজ রোগে মূলত মলদ্বারে ক্ষতের কারনে তীব্র ব্যাথা অনুভূত হয়। এ রোগের চিকিৎসাও সহজ ও কম সময় সাপেক্ষ।
২। ক্রোনিক এনাল ফিশার: ক্রোনিক এনাল ফিশার হলে মলদ্বার সরু হয়ে যায় যার কারণে কেষ্ঠকাঠিন্য, পেটে সমস্যা, এনাল ফিশার সহ বিভিন্ন রকমের জটিলতা তৈরি হয়। ক্রোনিক এনাল ফিশার তুলনামূলক বেশ বিরল।
এনাল ফিশার বা গেজ কেন হয়?
এই রোগটি বিভিন্ন কারণে হতে পারে। যদিও এনাল ফিশার ছাড়াও অন্য অনেক কারনে পায়ুপথে ব্যথা হতে পারে। এ রোগটি হবার কারণ গুলোর একটি তালিকা করা যাক,
১। পায়ুপথ সরু হয়ে যাওয়া: পায়ুপথ কোন কারণে সরু হয়ে গেলে মলত্যাগে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করতে হয়, সে কারনে মলদ্বার ছড়ে যেতে পারে।
২। কোষ্ঠকাঠিন্য: কোষ্ঠকাঠিন্য নিয়ন্ত্রণে না রাখলে কঠিন মল ত্যাগ করতে গিয়ে মলদ্বারে ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে।
৩। বিশৃঙ্খর জীবন যাপন: নিয়মিত মলত্যাগ না করা, যথেষ্ট আঁশ যুক্ত খাবার গ্রহন না করা, মদ্যপানের মত অভ্যসের কারণে পায়ুপথে ক্ষত হতে পারে।
৪। পূর্বে কখনো হয়ে থাকলে: পূর্বে কখনো গেজ হয়ে থাকলে, যদি সঠিক চিকিৎসা করা না হয় তবে আবার হবার সম্ভাবনা থাকে। সমস্ত ক্ষতের মত পায়ুপথের ক্ষতও সেরে ওঠে, কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের প্রতিদিন মলত্যাগ করতে হয়, আর মলের ঘষায় অর্ধেক সেরে যাওয়া ক্ষত আবার পূর্বের মত হয়ে যায়। এভাবে চলতে চলতে মলদ্বারের মাংস বাড়তে থাকে ও মলদ্বার আরও সরু হতে থাকে। ক্ষত একসময় সেরে যায়, কিন্তু পরবর্তিতে সরু হবার কারণে পুনরায় মলদ্বারে ক্ষতের সৃষ্টি হতে পারে।
৫। বিভিন্ন অসুখ ও ঔষধের কারণে: কিছু অসুখ ও কিছু ঔষধ কোষ্ঠকাঠিন্য সহ, বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া-পার্শপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। যার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য ও পরবর্তিতে এনাল ফিশার হতে পারে।
এনাল ফিশার বা গেজ এর উপসর্গ সমুহ
নিম্নোক্ত উপসর্গ গুলো দেখা দিলে এনাল ফিশার হয়েছে বলে ধারনা করা হয়। শতভাগ নিশ্চয়তার জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের স্বরনাপন্য হওয়া আবশ্যক।
-
মলত্যাগের সময় পায়ুপথে প্রচন্ড ব্যথা হওয়া। পায়ুপথ দিয়ে কাচের টুকরো বেরিয়ে আসছে এমন অনুভূত হওয়।
-
মলত্যাগের পর ৩-৪ ঘন্টা ব্যথা স্থায়ী হওয়া।
-
মলের সাথে সামান্য পরিমাণ তাজা রক্ত বেরিয়ে আসা। মাঝে মাঝে বেশি পরিমাণ রক্ত বেরোতে দেখা যায় তবে এটি খুব বিরল।
-
পায়ুপথে দৃশ্যমান ক্ষত দেখা যেতে পারে।
-
মলদ্বারে কেটে যাওয়া মাংশপেশির অংশ দেখা যেতে পারে।
কখন ডাক্তার দেখাবেন? কোন ডাক্তার দেখানো উচিত?
প্রথম প্রথম পায়ুপথে ব্যথা হবার পরপরই ডাক্তারের স্বরনাপন্য হওয়ার প্রয়োজন নেই। কিছু ঘরওয়া টোটকা অনুস্বরন করে এনাল ফিশার সারিয়ে তোলা ব্যথা উপসম করা যায়। দু একদিনের ভেতর যদি অবস্থার উন্নতি না হয় কিংবা বারবার দেখা দিতে থাকে তবে আর সময় নষ্ট না করে একজন কোলনোস্কপি বিশেষজ্ঞ অথবা একজন জেনারেল সার্জন ডাক্তারের স্বরনাপন্য হওয়া উচিৎ।
এনাল ফিশার এর অপারেশন
ডাক্তার এনাল ফিশার নিশ্চিত হলে কিছু টেস্টের পর একটি ছোট অপারেশন করান। এনাল ফিশারের অপারেশন নিয়ে ভয় পাবার কোন কারন নেই। এটি খুব ছোট একটি অপারেশন এবং অপারেশন এর দিনই বাড়ি চলে যেতে পারবেন। ২-৩ দিন পরই স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব।
এ অপারেশনে মূলত পায়ুপথের গেট এর পেছনে মাংশ পেশির সামান্য অংশ কেটে মলদ্বারকে রিল্যাক্স করানো হয়। যার ফলে মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করতে হয় না ও এনাল ফিশার খুব, দ্রুত সেরে ওঠে। এটি তুলনামূলক নির্ঝঞ্ঝাট ও দ্রুত চিকিৎসা পদ্ধতি।
তবে সবার এ অপারেশনের প্রয়োজন হয় না। প্রাথমিক অবস্থায় কিছু ঔষধ ও সাধারন ট্রিটমেন্টেই সারিয়ে তোলা সম্ভব। একবার সেরে গেলে কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললে পরবর্তিতে এ রোগ হবার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।
পায়ুপথে ব্যথা বা এনাল ফিশারের কমানোর ঘরোয়া উপায়!
নিন্মক্ত নিয়ম গুলো মেনে চললে দ্রুত এনাল ফিশার সারিয়ে তোলা ও পরবর্তিতে এ রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
১। প্রচুর পরিমানে পানি পান করা। পরিমিত পানি পান এর ফলে শরীরবৃত্তিয় কার্যাবলী শুষ্ঠভাবে সম্পাদন হতে পারে ও মল নরম থাকে।
২। মল নরম করার জন্য ইশপ গুলের ভুষি একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি। দৈনিক সকাল ও রাতে ঘুমানোর ১ ঘন্টা আগে ইশপ গুলের ভুষি খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য জনিত সমস্যা ও এনাল ফিশারে উপকার হয়।
৩। পর্যায়ক্রমে আঁশ যুক্ত খাবার যেমন শাকসবজি, ফলমুল, লাল আটা ও চাল খাওয়ার পরিমান বাড়ানো। প্রথমে প্রচুর আঁশযুক্ত খাবার খেলে পেটে গ্যাসের সমস্যা হতে পারে।
৪। এনাল ফিশার এ মলদ্বারের ব্যথা কমাতে মলত্যাগের পর উষ্ণ গরম পানিতে কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারেন। এ পদ্ধতি ব্যথা উপশমে বেশ কার্যকর।
৫। ব্যথার ভয়ে পায়খানা চেপে রাখবেন না। যখনই চাপ অনুভব করবেন চেষ্টা করবেন সাথে সাথেই কাজটি সম্পন্ন করতে। এতে মল শক্ত হয়ে যাবে না।
৬। ব্যথা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ দিনে ৫০০ মিলিগ্রাম এর ৪ টি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট গ্রহন করতে পারে।
৭। মলত্যাগের পূর্বে মলদ্বারে পেট্রোলিয়াম জেলি লাগানে যেতে পারে।
৮। পর্যাপ্ত ঘুম ও মলত্যাগ রুটিনমাফিক করতে হবে।
৯। খাবারে ঝাল-মসলা কম থাকলে মল ত্যাগে জ্বালা ভাব ও ব্যথা বেশ কমে যাবে।
এনাল ফিশার কিভাবে প্রতিরোধ করা যায়?
এনাল ফিশার মাঝে মাঝে কোন কারণ ছাড়াই হয়ে বসতে পারে। তবুও কিছু স্বাস্থ্যকর নিয়ম মেনে চললে এ রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায়।
-
প্রচুর পানি ও আঁশ জাতীয় খাবার গ্রহণ।
-
মলত্যাগের সময় তাড়াহুড়ে না করা।
-
খুব বেশি চাপ দিয়ে মলত্যাগ না করা।
-
ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য হলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া।
-
মল চেপে না রাখা।
-
মলদ্বার সাবান ও উষ্ণ পানি দিয়ে ধৌত করা।
এনাল ফিশার নিয়ে সাধারণ কিছু প্রশ্ন
-
এনাল ফিশার থেকে কি ক্যান্সার হতে পারে?
জ্বী না, এনাল ফিশার থেকে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
-
এনাল ফিশার কাদের বেশি হয়ে থাকে?
১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সে এ রোগ বেশি দেখা দেয়। তাছাড়া গর্ভবতী নারীদেরও এ রোগ হবার ঝুঁকি বেশি।
-
এনাল ফিশারের অপারেশন কেমন খরচ হয়?
হাসপাতাল ভেদে এনাল ফিশার এর চিকিৎসা খরচের অনেক তফাৎ হতে পারে। তবে সাধারণত সরকারী হাসপাতালে ১০-১২ হাজারের ভেতরে ও বেসরকারিতে ২০-৩০ হাজারের ভেতরে এ অপারেশনটি করানো যায়।
এনাল ফিশার জটিল রোগ নয় তবে এর কারনে ভেগান্তি প্রায় অসীম। সেই সাথে লজ্জা দ্বিধাও মানসিক অবসাদের কারণ হয়ে থাকে। আমাদের শরীরে কোন অঙ্গই অপ্রয়োজনীয় নয়, তাই যেকোনো রোগব্যাধিই সঠিক সময়ে সারিয়ে তোলাটাই হলো বুদ্ধিমানের কাজ।