পিত্তথলির পাথর কেন হয়? প্রতিরোধ করবেন কীভাবে?

পিত্তথলিতে পাথর আমাদের সবারই অতি পরিচিত ও সাধারণ একটি সমস্যা। কিন্তু আপনি কি জানেন পিত্তথলির পাথর কেন হয়, এর লক্ষণগুলো কী, এবং এটি প্রতিরোধ করবেন কীভাবে? আসুনে জেনে নেই বিস্তারিত।

  • বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জনের ৫ জন পিত্ত-পাথর রোগে আক্রান্ত হন

  • পুরুষের (৩.৩%) চেয়ে নারীদের (৭.৭%) পিত্ত-পাথর হওয়ার প্রবণতা বেশি

  • স্বাস্থ্যকর ফ্যাট গ্রহণ পিত্ত-পাথর প্রতিরোধে সাহায্য করে।

পিত্তথলি হলো আমাদের পেটের উপরের অংশে থাকা থলির মত একটি অঙ্গ যার ভেতরে পিত্তরস বা বাইল সংরক্ষিত থাকে। পিত্তরস উৎপন্ন হয় যকৃতে যা সরু টিউবের মাধ্যমে পিত্তথলিতে পৌঁছায়। পিত্তরস অন্য একটি টিউবের মাধ্যমে আমাদের ক্ষুদ্রান্তে যায় যার মাধ্যমে ফ্যাট বা চর্বি জাতীয় খাবার ভেঙে পুষ্টি শোষণে সাহায্য করে। কিন্তু পিত্তথলিতে পাথর হলে এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে যা বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করে।

 

পিত্তথলির পাথর কি?

পিত্তরস বা বাইল এর মূল উপাদান হলো কোলেস্টেরল, তাছাড়াও এতে বাইল সল্ট, ফসফোলিপিড ও বিলিরুবিন পাওয়া যায়। এর কোন কারণে এসব উপাদান কঠিন হয়ে জমে গেলে তা পাথরের ন্যায় হলুদাভ বস্তু তৈরি করে। পিত্ত-পাথর বালির দানা থেকে শুরু করে গলফ বলের সমান বড় হতে পারে। সাধারণত পিত্তে এরকম পাথর উৎপন্ন হলে কোন সমস্যা দেখা যায় না, সমস্যা হয় যখন পিত্ত-পাথর পিত্তথলি থেকে বের হয়ে পিত্তনালীকে আটকে দেয়। এর ফলে তীব্র ব্যথা ও বিভিন্ন উপসর্গ দেখা যায়।

 

পিত্ত-পাথরের লক্ষণগুলো কি কি?

পিত্তথলির পাথরের লক্ষণ ততক্ষণ পর্যন্ত অনুভূত হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত পাথর নালি পথ আটকে দেয়। পিত্ত-পাথরের লক্ষণগুলো হলো:

  • পেটের উপরের অংশে তীক্ষ্ণ ব্যথা যা ৩০ মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

  • জ্বর আসা

  • ডায়রিয়া 

  • ত্বক ও চোখ হলদেটে দেখানো

  • বমি হওয়া

  • ডান কাঁধে ব্যথা হওয়া

এরূপ উপসর্গ দেখা গেলে চিকিৎসা নেওয়া জরুরী কারণ, চিকিৎসায় দেরী করলে জন্ডিস ও ইনফেকশনের মত জটিলতা তৈরি হতে পারে। 

 

পিত্তথলিতে পাথরের প্রকারভেদ

পিত্তথলিতে সাধারণত দুই ধরণের পাথর তৈরি হতে দেখা যায়। 

১. কোলেস্টেরল স্টোন

কোলেস্টেরল পিত্ত পাথর জমাট বাঁধা কোলেস্টেরল ও অন্যান্য উপাদান। এটি সবুজাভ হলুদ রঙের হয়ে থাকে। ৭৫% ক্ষেত্রে কোলেস্টেরল স্টেন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

২. বিলিরুবিন স্টোন

পিত্তরসে বিলিরুবিন এর ঘনত্ব বেড়ে গেলে এটি জমাট বেঁধৈ কালো পাথর তৈরি করে। ২৫% ক্ষেত্রে এ ধরণের পাথর তৈরি হয়।

 

পিত্তথলির পাথর কেন হয়?

পিত্তথলিতে পাথর কেন হয় তার একদম নিশ্চিত কোন কারণ না গেলেও কিছু কারণে এই রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। পিত্তথলির পাথর হবার কারণগুলো জেনে নেওয়া যাক।

১. ফ্যাট জাতীয় খাবার না খাওয়া

আমাদের পিত্তরস এর মূল কাজ হলো ফ্যাটকে ভেঙে পরিপাক ক্রিয়ায় সাহায্য করা। পিত্তথলির কাজ সঠিকভাবে চলতে পিত্তরস এর নিয়মিত ব্যাবহার হওয়া প্রয়োজন। সে জন্য দরকার স্বাস্থ্যকর ফ্যাট জাতীয় খাদ্য নিয়মিত গ্রহণ। নিয়মিত স্নেহ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ না করলে পিত্তরস অব্যবহৃত থেকে ঘন হয়ে আসে যা পিত্ত-পাথর তৈরির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।

২. গর্ভ-নিরোধক বড়ি

গর্ভনির‌োধক বড়ি বাড়িয়ে তোলে পিত্ত-পাথর হবার সম্ভাবনা। তাছাড়া মাসিক ও গর্ভকালীন সময়ে হরমোনাল ইমব্যালেন্স এর কারণে পুরুষে চাইতে নারীর পিত্ত-পাথর হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণেরও বেশি।

৩. অপর্যাপ্ত পানি পান

পর্যাপ্ত পানি পান না করলে অনেক সময় পিত্তরস ঘন হয়ে আসে যার কারণে পিত্ত-পাথর হতে পারে। যতটুকু পানি পান করলে দৈনিক ২ লিটার মূত্র তৈরি হবে ততটুকু পানি পান করলে কিডনি সহ শরীরের বাকী অঙ্গ তাদের স্বাভাবিক কার্যাবলী সম্পাদন করতে পারে।

৪. খাওয়াদাওয়ায় অনিয়ম

আমাদের শরীর একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন অনুস্মরণ করতে চায়। খাবার বেলাতেও তাই। অনিয়মিত খাবার গ্রহণ করলে শরীরের পরিপাক ক্রিয়ায় ত্রুটি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে খাবারের সময় যেমন মেনে চলা উচিত, দৈনিক কোন উপাদান কি পরিমাণ গ্রহণ করছেন, সেখানেও থাকা উচিৎ সামঞ্জস্য।

৫. রক্তে সমস্যা

রক্তে কোন প্রকার সমস্যার কারণে লোহিত রক্ত কণিকা অতিরিক্ত ভাঙলে যকৃত খুব বেশি পরিমাণ বিলিরুবিন উৎপন্ন করে যা পিত্তে জমা হয়। অতিরিক্ত বিলিরুবিন এর কারণে কালো পাথর উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

৬. ওজন ও বয়স

অতিরিক্ত স্থূল ও চল্লিশউর্ধ্ব মানুষের পিত্তে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তাছাড়া ওজন কমানোর বিভিন্ন ট্রিটমেন্টও পিত্তে পাথরের সম্ভাবনা বাড়ায়।

৭. পারিবারিক ইতিহাস

পরিবারে কারো পিত্ত-পাথর হওয়ার ঘটনা থাকলে অন্যদেরও হবার ঝুঁকি থাকে। ডায়াবেটিসের ও লিভার সিরোসিস এর রোগীদেরও পিত্ত-পাথর হওয়ার সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশি।

 

পিত্তথলির পাথর প্রতিরোধ করবেন কীভাবে?

১. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন

অতিরিক্ত ওজন বা ডায়াবেটিস থাকলে পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। কিন্তু দ্রুত ওজন কমানো, ব্যারিয়াট্রিক সার্জারি, বা খুব কম-ক্যালোরি ডায়েট করলে (প্রতিদিন ৮০০ ক্যালোরির কম), আসলে পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

ক্র্যাশ ডায়েট এবং দ্রুত ওজন হ্রাস পিত্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা পিত্তথলির পাথর হওয়ার উচ্চ সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

তাই দরকার সুষম ডায়েট। ক্র্যাশ ডায়েট বা খুব কম ক্যালোরি গ্রহণ (প্রতিদিন ৮০০ ক্যালোরির কম) এড়িয়ে চলুন। ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখা পিত্তথলির পাথর প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায়, তবে তা হতে হবে ধীরে ধীরে, দ্রুত নয়।

২. স্বাস্থ্যকর খাবার খান

স্বাস্থ্যকর খাওয়া-দাওয়া পিত্তথলির রোগ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তবে এটি শুধুমাত্র ফল এবং সবজি খাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাবারের সাথে প্রোটিন ও ফ্যাট জাতীয় খাবারের সুষম আপনার পিত্তথলির রোগের ঝুঁকি কমাতে পারে। যেমন-

  • বাদাম, ফল, শাকসবজি, ফাইবার এবং

  • মনো- বা পলি-আনস্যাচুরেটেড চর্বিযুক্ত খাবার, শস্য এবং সামান্য লাল মাংস

৩. নিয়মিত ব্যায়াম করুন

নিয়মিত শারীরিক ক্রিয়াকলাপ পিত্তথলিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করে।

প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫০ মিনিটের নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ বা সপ্তাহে পাঁচবার ৩০ মিনিট, সামগ্রিক স্বাস্থ্যের ফলাফল উন্নত করে এবং ওজন বৃদ্ধি রোধ করতে পারে।

 

পিত্ত-থলির পাথর দূর করার উপায় কী?

পিত্ত-থলির পাথর যদি কোন সমস্যা তৈরি না করে তাহলে তা অপসরণের দরকার হয় না। কিন্তু জটিলতার সম্ভাবনা থাকলে তা অপারেশন করেই দূর করা সবচেয়ে কার্যকরী উপায়। পিত্ত-থলির পাথর দূর করা ও এর চিকিৎসা নিয়ে আক্রান্তদের মাঝে অনেক রকম বিভ্রান্তি তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে পিত্ত পাথরের চিকিৎসা নিয়ে আমাদের বিশেষ প্রবন্ধ: পিত্তথলির পাথরের চিকিৎসা করবেন কীভাবে?

 

পরিশেষ

পিত্তথলির পাথর হওয়ার লক্ষণ এবং কারণ সম্পর্কে সচেতন থাকুন। আর এটি প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা করুন।
 

আরও পড়ুনঃ

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles