এপিলেপসি বা মৃগী রোগী সামলানোর উপায়

বিশ্বব্যাপি প্রায় ৫ কোটি মানুষ মৃগী রোগে আক্রান্ত এবং আমাদের দেশেও রোগটির প্রকোপ একেবারে কম নয়! সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার মাধ্যমে রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখা ও সারিয়ে তোলা সম্ভব। চলুন রোগটির সম্পর্কে সকল খুঁটিনাটি জানা যাক।

ধরুন আপনি আপনার বন্ধুর সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছেন। হঠাত আপনার বন্ধু কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগলেন। আপনি কি করবেন বুঝতে না পেরে তার হাত পা চেপে ধরে লোকজন ডাকতে শুরু করলেন। মিনিট পাঁচেক বাদে আপনার বন্ধুর খিঁচুনি বন্ধ হলো ও জ্ঞান ফিরে পেলেন। এই ধরণের উপসর্গ দেখা দিলে আপনার বন্ধু খুব সম্ভব এপিলেপসি বা মৃগী রোগে আক্রান্ত।

এপিলেপসি বা মৃগী একটি নিউরোলোজিকাল ডিসঅর্ডার অর্থাৎ স্নায়ুবিকার জনিত রোগ। এই রোগে মস্তিস্কের এক বা একাধিক অংশ হঠাৎ সঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ফলাফল খিচুনি, অনিয়ন্ত্রিত অঙ্গ সঞ্চালন ও এ ধরণের আরো কিছু উপসর্গ।

মৃগী রোগের কথা চার হাজার বছর আগের পুরোনো মেডিক্যাল বইতে পর্যন্ত পাওয়া গেছে। তাছাড়া ইতিহাসের বিভিন্ন সাহিত্য ও মেডিক্যাল পুরাকৃত্তিতে মৃগী রোগীর বর্ণণা রয়েছে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে মৃগী রোগের ইতিহাস অতি পুরনো।

পুরোনো সময়ে কারো ইপিলেপসি বা মৃগীরোগ হলে, ভয়ঙ্কর কিছু রেওয়াজ ছিলো। ব্যাবিলনিয়রা বিশ্বাস করতেন যে মৃগী রোগীর উপর অশুভ আত্মা ভর করেছে, তাই রোগীকে হত্যা করা হতো। 

পরেরদিকে বিশ্বাস করা হতো মস্তিষ্কে খারাপ রক্ত আটকে আছে, তাই মাথার খুলি ড্রিল করে খারাপ রক্ত বের করে রোগীকে সারানোর চেষ্টা করা হতো। তবে এখন আমাদের এসব নিয়ে ভীত হবার  কিছু নেই, কারণ এপিলেপসি বা মৃগী রোগের অত্যন্ত আধুনিক ও কার্যকর চিকিৎসা আমাদের হাতের নাগালে। এদিক থেকে ভাবলে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাছে কৃতজ্ঞ হওয়াই চলে। আসুন ধারাবাহিক ভাবে মৃগী রোগের আদ্যপান্ত জানা যাক।

এপিলেপসি বা মৃগী রোগ কি?

এপিলেপসি বা মৃগী রোগ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে প্রথমে মানব মস্তিস্কের কার্যাবলি নিয়ে প্রাথমিক কিছু ধারণা নেওয়া যাক। মস্তিস্ক ও স্নায়ুর একক হচ্ছে নিউরন। নিউরন হলো স্নায়ুবিক কোষ যা একটি অন্যটির সাথে সূক্ষ ইলেক্ট্রিক ও ক্যামিক্যাল সংকেত এর দ্বারা তথ্য পরিবহন তরে। ধরুন একটি মশা আপনার হাতে কামড়ালো। আপনার হাতে থাকা স্নায়ু কোষ সেটি সেন্স করবে ও পরবর্তি স্নায়ু কোষে বার্তা দেবে, এভাবে এটি একটি করে স্নায়ু কোষে এত দ্রুত তথ্য পরিবহন হয়ে আপনার মস্তিষ্কে পৌঁছাবে যে আপনি কয়েক মিলিসেকেন্ডের ভেতর মশার কামড় টের পেয়ে যাবেন। আমাদের সমস্ত কাজ, ভাবনা, চিন্তা মস্তিস্কের এই ইলেক্ট্রক্যামিক্যাল সিগনালিং এর মাধ্যমে হয়ে থাকে।

অতএব আমরা জানলাম নিউরন সিগনালিং এর মাধ্যমে মস্তিস্ক কাজ করে। এই সিগনালিং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আবার দুই ধরণের কোষ আছে, যা নিউরনের সাথে সংযুক্ত থাকে। একটি হচ্ছে এক্সাইটেরী, যা নিউরাল সংকেত চালু করে ও অন্যটি হচ্ছে ইনহিবিটর, যা নিউরাল সংকেত বন্ধ করে। এই এক্সাইটেটরী ও ইনহিবিটর নিউরন  একসাথে কাজ করে নিউরণের সিগনালিং এর স্বাভাবিক ভারসাম্য বজায় রাখে।

ইনহেবিটরী নিউরন গাবা (GABA) মলিকিউলস এর মাধ্যমে ব্রেইনের সিগনালিং প্রয়োজন মত কমিয়ে ফেলে। অন্যদিকে এক্সাইটরী নিউরন গ্লুটামেট মলিকিউলস এর মাধ্যমে সিংনালিং বাড়িয়ে তোলে। 

এপিলেপসি বা মৃগী তখন হয় যখন এক্সাইটেরী নিউরন প্রয়োজনের চেয়ে বেশি এক্টিভ হয়ে যায়, কিংবা ইনহিবিটরী নিউরন ঠিক ভাবে নিউরনের সিংনালিং ঠিকমত বন্ধ করতে পারে না। এই দুটি কারণের একটি ঘটলে ব্রেনের এক বা একাধিক স্থানে অনিয়ন্ত্রিত ও অপ্রয়োজনীয় ভাবে ব্রেইনের সিগনালিং হতে থাকে। অনিয়ন্ত্রিত সিগনালিং এর ফলে শরীরও নিয়ন্ত্রণ হারায়। রোগী কতটুকু নিয়ন্ত্রন হারাবে তা নির্ভর করে মস্তিস্কের কতটুকু বা কোন অংশে এপিলেপসি হচ্ছে।

মস্তিস্কের ছোট কোন স্থানে এপিলেপসি হলে তাকে ফোকাল এপিলেপসি বলে। ফোকাল এপিলেপসি যে স্থানে হয় শরীর শুধু সে স্থানের নিয়ন্ত্রন হারায়। অদ্ভুত শব্দ বা গন্ধ পাওয়াও এ ধরণের এপিলেপসিতে দেখা যায়।

আবার যদি পুরো মস্তিস্কে একসাথে অনিয়ন্ত্রিত সিগনালিং দেখা যায়, তাহলে রোগী সঙ্গা হারায়, অনিয়ন্ত্রিত ভাবে দেহের বিভিন্ন অংশ ছুঁড়তে থাকে। এই ধরণের এপিলেপসি কে ক্রনিক টনিক এপিলেপসি বলা হয়। কোন কোন ধরণের এপিলেপসিতে রোগী চেতন থাকে, আবার কোন ক্ষেত্রে অচেতন হয়ে পড়ে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খিচুনি হবার সময়ের কথা রোগী ভুলে যান। অন্য আরেক ধরণের এপিলেপসি আছে যাতে রোগী হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকে কোন নড়াচড়া করে না। 

এপিলেপসি রোগের উপসর্গ 

মানব মস্তিষ্কের জটিল কাঠামোর কারণে অনিয়ন্ত্রিত সিগনালিং এর উপসর্গ রোগী ও সময় ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। লক্ষ করুন, যখন খিচুনি হয় তখন এলোমেলো ভাবে মস্তিস্কের বিভিন্ন স্থানে ইলেক্ট্রোক্যামিক্যাল সিগনাল চলতে থাকে। সেই অবস্থায় যদি হাত নিয়ন্ত্রন হওয়া অংশে সিগনালিং হয়, হাত নড়বে, গন্ধ পাওয়ার স্থানে সিগনালিং হলে গন্ধ পাওয়া যাবে বা পুরো মস্তিস্কে একসাথে সিংনালিং হলে পুরো শরীরেই খিচুনি দেখা দেবে। 

বাচ্চা ও বৃদ্ধদের মধ্যে এপিলেপসির প্রকোপ বেশি দেখা যায়। বয়স ও এপিলেপসির ধরণ ভেদে উপসর্গও আলাদা আলাদা হয়ে থাকে।

এপিলেপসি রোগের সাধারণ লক্ষন গুলো হলো-

  • খিঁচুনি হওয়া

  • অনিয়ন্ত্রিত ভাবে হাত পা নাড়ানো

  • জ্ঞান হারানো

  • কথা বললে উত্তর না দেওয়া

  • শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা

  • হাত থাকা বস্তু পড়ে যাওয়া

  • জ্ঞান ফিরলে ভীত ও অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়া

এপিলেপসি হবার কারণ

এপিলেপসি হওয়ার নির্দৃষ্ট ও নিখুঁত কোন কারণ এখনো খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। তবে ঠিক যে যে কারণে এপিলেপসি হতে পারে তা হলো:

  • কোন প্রকার মানসিক আঘাত বা ট্রমা

  • মাথায় আঘাত পাওয়া

  • জন্মানোর সময় অক্সিজেনের ঘাঢতি (শিশুর ক্ষেত্রে)

  • ব্রেইন ইনফেকশন

  • পরিবারে কারো এপিলেপসি হওয়া ইতিহাস

  • মাদকাসক্তি।

এপিলেপসির চিকিৎসা

আশার কথা হলো বর্তমান সময়ে এপিলেপসি নির্ণয় ও চিকিৎসার নানাবিধ প্রযুক্তি বের হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে মস্তিস্কের ঠিক কোন জায়গায় সিগনালিং এ বিঘ্ন ঘটছে তা খুব সহজেই ধরতে পারা সম্ভব হচ্ছে।

এপিলেপসির জন্য কার্যকরী ঔষধ রয়েছে যাকে এন্টি-এপিলেপটিক ড্রাগ বলা হয়। এসব ড্রাগ মস্তিস্কের এক্সাইটেরি নিউরন এর অনিয়ন্ত্রিত গ্লুটামেট সিগনালিং কমিয়ে আনে এবং অপদিকে ইনহিবিটর নিউরনের GABA সিগনালিং বাড়িয়ে তুলে একটি ভারসাম্য তৈরি করে।

প্রথমবার খিচুনি হলে ডাক্তার সাধারণত কোন ঔষধ বা চিকিৎসা দেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা এপিলেপসিতে রূপ নেয় না। কিন্তু যদি আপনার মানসিক ট্রমা, এক্সিডেন্ট বা পারিবারিক ইতিহাস থাকে, তবে ডাক্তার বিভিন্ন চেকাপ এর মাধ্যমে আপনার এপিলেপসির ঝুঁকি নির্ণয় করে ঔষধ প্রদান করেন। 

এপিলেপসির ঔষধ কার্যকর হলেও কা গ্রহণ করতে হয় সঠিক নিয়ম মেনে, ডাক্তারের পরামর্শ ও নিয়মিত চেকাপের মাধ্যমে। কারণ এতে কিছু পার্শ প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি থাকে। অতএব এ রোগের ঔষধ গ্রহণের ব্যপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

এপিলেপসির চিকিৎসা অনেকটা নির্ভর করে আপনার এপিলেপসির ধরণ ও জটিলতার উপর। রোগটি জটিল আকার ধারণ করলে ব্রেইন সার্জারির মাধ্যমে তা সারিয়ে তোলা যায়। সর্বপরি একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্বাবধায়নে চিকিৎসা গ্রহণ করলে খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা যায়।

এপিলেপসির জন্য কোন ডাক্তার দেখাবেন?

এপিলেপসি আক্রান্ত রোগীর জন্য একজন epileptologist ডাক্তার দেখানো উচিত। অর্থাৎ একজন নিউরোলোজিস্ট যিনি এপিলেপসি রোগ বিশেষজ্ঞ।

এপিলেপসি রোগীকে কিভাবে সামলাবেন?

এপিলেপসি বা মৃগী রোগীর খিচুনি হলে বিভিন্ন উদ্ভট পদ্ধতিতে তার জ্ঞান ফেরানোর কুসংস্কার প্রচলিত আছে। যেমন চামড়ার জুতা শোকানো, মুখের ভেতর কাপড় জাতীয় কিছু চেপে দেওয়া ইত্যাদি। কিন্তু বৈজ্ঞানিক ভাবে এই সব কার্যবলী ভিত্তিহীন ও হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনা থাকে।

এপিলেপসি রোগীর খিচুনী হলে হাত পা চেপে ধরা, সিপিআর দেওয়া থেকেও বিরত থাকুন। এর পরিবর্তে এই কাজ গুলো করুন।

  • রোগীকে একপাশে কাত করে শুয়িয়ে দিন।

  • আসেপাশ থেকে সব ধরণের ধারালো ও আঘাত পেতে পারে এমন বস্তু সরিয়ে ফেলুন।

  • আপনি নিজে শান্ত থাকুন।

  • রোগী জিভে কামড় দিয়ে আছে কিনা নিশ্চিত হয়ে নিন।

  • ঘড়ি বের করে সময়টা দেখে নিন।

  • পাঁচ মিনিটের ভেতর রোগীর জ্ঞান না ফিরলে এম্বুলেন্সের জন্য জরুরী হেলথ হেল্পলাইনে কল করুন।

  • রোগীর জ্ঞান ফিরলে, পর্যাপ্ত পানি ও ইলেক্ট্রলাইটের ব্যাবস্থা করুন ও রেস্ট নিতে দিন।

শেষ কথা

এপিলেপসি বা মৃগী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, তার পরিবার ও প্রিয়জনের কাছে সবসময় একটি দুশ্চিন্তার কারণ। চিকিৎসায় বিলম্ব হলে এ রোগটি জটিল আকার ধারণ করে ও মৃত্যুও হতে পারে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ও আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে রোগটি সারিয়ে তোলা যায়।

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles