ফেসিয়াল প্যারালাইসিস বা মুখ বেঁকে যাওয়া রোগের চিকিৎসা করবেন যেভাবে

ফেশিয়াল প্যারালাইসিস বা Bell's palsy বর্তমান সময়ের একটি বহূল আলোচিত রোগ। বিশেষ করে বিখ্যাত কয়েকজন তারকা এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর এই রোগটি আলোচনায় উঠে এসেছে। চলুন এই রোগটির নাড়ি-নক্ষত্র জেনে নেওয়া যাক।

  • বিশ্বজুড়ে বছরে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন।

  • সম্প্রতি কণ্ঠশিল্পী তারকা তাশরিফ খান, কার্নি উইলসন, জাস্টিন বিবার সহ অনেকেই এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তাহলে কি গান করার সাথে এর কোন সম্পর্ক রয়েছে?

ফেশিয়াল প্যারালাইসিস হলো এমন একটি সমস্যা যাতে সাধারণত মুখের একপাশ হঠাৎ করে দুর্বল বা অসাড় হয়ে পড়ে। প্রাথমিক অবস্থায় কোনভাবেই সেই পাশের পেশি স্বাভাবিক ভাবে নাড়ানো যায় না। মুখ একপাশে ঝুলে পড়ে, চোখের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। স্বাভাবিক মুখভঙ্গি, খাওয়া সহ এ জাতীয় কাজ বিঘ্নিত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফেশিয়াল প্যারালাইসিস অস্থায়ী ও কয়েক সপ্তাহের ভেতর আস্তে আস্তে সেরে উঠে। এসময় অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে ভুল ভাবে মুখের ব্যায়াম বা নড়ানোর চেষ্টা করে উল্টো ক্ষতি করে ফেলতে পারেন। তাই এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চলুন একে এতে রোগটি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আসি।

ফেশিয়াল প্যারালাইসিস কী?

ফেশিয়াল প্যারালাইসিস সম্পর্কে জানার আগে আসুন স্নায়ু সম্পর্কে জানা যাক। আমাদের দেহের সকল নড়াচড়া ও প্রায় সকল কাজ নিয়ন্ত্রিত হয় স্নায়ুর মাধ্যমে। আমাদের শরীরের প্রায় প্রত্যেকটি অঙ্গে জালের মত বিস্তৃত স্নায়ুর একটি নেটওয়ার্ক রয়েছে। আমাদের ব্রেইন থেকে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ স্নায়ুতে পৌঁছানোর সাথে সাথে সেই স্থান নড়ার সংকেত পায়। 

বোঝার সুবিধার্থে আমাদের ব্রেইনকে ভাবতে পারেন হেডকোয়ার্টার বা নিয়ন্ত্রনক্ষ, আর আমাদের অঙ্গ গুলো হচ্ছে রোবট। হেডকোয়ার্টারের থেকে তারের মাধ্যমে রোবট গুলোলো নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানে তারটি হচ্ছে স্নায়ু। বাতি জ্বালানোর সাথে সাথে যেমন আলো জ্বলতে শুরু করে, তেমনি স্নায়ুর কার্যক্রমও অত্যন্ত দ্রুত।

এখন কি হবে যদি হেডকোয়ার্টারের সাথে একটি রোবেটের ভেতরের তার ছিড়ে যায়? রোবটটি অকেজো ও নিয়ন্ত্রনহীণ হয়ে পড়বে। ঠিক একই ঘটনা ঘটে ফেশিয়াল প্যারালাইসিসের ক্ষেত্রে।

আমাদের কানের কাছ দিয়ে একটি বড় স্নায়ু প্রধান পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে মুখের যাবতীয় নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে। এমন স্নায়ুর জাল মুখের দুই পাশেই বিদ্যমান।

যখন মুখের সেই মূল স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্থ হয়, বা ছিড়ে যায় তখন মুখের সাথে ব্রেইনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে হয় ফেশিয়াল প্যারালাইসিস। 

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফেশিয়াল প্যারালাইসিস সম্পুর্ণ ভাবে নিরাময় হয়। যদিও কিছু ক্ষেত্রে এর কিছু সিনড্রম সারা জীবন থাকতে পারে। ব্যপারটা আরেকটু ভালো ভাবে বুঝতে আমাদের জানতে হবে ফেশিয়াল প্যারালাইসিস কেন হয়?

ফেশিয়াল প্যারালাইসিসের কারণ

ফেশিয়াল প্যারালাইসিস এর সুনির্দিষ্ট কোন কারণ এখনো বের করা সম্ভব হয় নি। তবে এর বেশ কিছু সম্ভাব্য কারণ চিহ্ণিত হয়েছে। সম্ভাব্য কারণ হলেও ব্যপারটা সুচিন্তিত অনুমান। যেমন ধরুন, ফ্লু এর কারণে ফেশিয়াল প্যারালাইসিস হতে পারে। অর্থাৎ ফ্লু হলেই যে ফেশিয়াল প্যারালাইসিস হবে তা নয়, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস মুখের নার্ভ বা স্নায়ুরক্ষতি করতে পারে। 

অর্থাৎ যে সব রোগ মুখের স্নায়ুর ক্ষতি করতে পারে সে সবই ফেশিয়াল প্যারালাইসিস এর কারণ হতে পারে। কিন্তু এমন কোন রোগ নেই যেটির কারণে নিশ্চিতভাবে ফেশিয়াল প্যারালাইসিস হয়ে থাকে। আসুন ফেশিয়াল প্যারারলাইসিস এর কারণ গুলো জেনে নেই।

  • জ্বর ঠোসা

  • চিকের পক্স

  • ইনফেকশিয়াস প্রোটিন

  • সাইটোমেগালোভাইরাস

  • কাশি জাতীয় অসুখ

  • মাম্পস

  • ফ্লু ইত্যাদি।

লক্ষ করুন, তালিকার প্রায় সবগুলোই ভাইরাল অসুখ। যদিও এ রোগের অন্যান্য কারণও থাকতে পারে, কোন দুর্ঘটনা বা আঘাত লাগলে নার্ভের ক্ষতি হতে পারে। এজন্য কাউকেই মুখে চড় বা আঘাত করা উচিত নয়। 

ফেশিয়াল প্যারালাইসিস এর উপসর্গ

ফেশিয়াল প্যারালাইসিস এর উপসর্গ গুলো খেয়াল করুন।

  • মুখের একপাশে হঠাৎ দুর্বল ও নড়ানো অসাধ্য হয়ে পড়া।

  • মুখের একপাশ ঝুলে পড়া। 

  • হাসলে একপাশ বিকারহীন থাকা।

  • এক চোখ নিয়ন্ত্রতহীন হয়ে পড়া।

  • আক্রান্ত পাশে ব্যথা হওয়া।

  • আক্রান্ত পাশে স্বাদ না পাওয়া।

  • মাথা ব্যথা।

  • অশ্রু ও লালা ঠিকভাবে উৎপন্ন না হওয়া বা পরিবর্তন হওয়া।

খুবই অল্প কিছু ক্ষেত্রে মুখের দুই পাশেই এই রোগ হতে পারে। উল্লেখ্য, ফেশিয়াল প্যারালাইসিসে শুধু যে মুখের অংশই আক্রান্ত হয় তা না। এ রোগের কিছু মানসিক প্রভাবও লক্ষনীয়, যদিও তা নিয়েও সুস্পষ্ট তথ্য নেই। স্বাভাবিক ভাবে মুখমন্ডলের বিকৃতি যেকোনো স্বাভাবিক মানুষকে ভয়ঙ্কর মানসিক অস্থিরতায় ফেলতে যথেষ্ট। ঠিক সে কারণেই এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।

কণ্ঠশিল্পী তারকারা কেন ফেশিয়াল প্যারালাইসিসে ভুগছেন?

এই প্রশ্নেরও সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর এখনো নেই। এটি উপরিক্ত যে কোন কারণে হতে পারে। তাছাড়াও কিছু কন্ঠ অনুশীলন মুখের স্নায়ু ক্ষতির জন্য দায়ী হয়ে থাকতে পারে। যদিও বৈজ্ঞানিক ভাবে কোন স্পষ্ট তথ্য পাওয়া, সময় ও গবেষনাসাধ্য। সঠিক নিয়ম মেনে কন্ঠ অনুশীলন করা এ জাতীয় জটিলতার ঝুঁকি কমাতে পারে।

কারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন?

মায়োক্লিনিক এর মতে কিছু মানুষ ক্ষেত্রে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। যেমন-

  • প্রেগনেন্ট নারী।

  • ফ্লু বা ঠান্ডা লাগা ব্যক্তি।

  • ডায়বেটিক ব্যক্তি।

  • হাই ব্লাড প্রেশার আক্রান্ত ব্যক্তি।

  • স্থুল ব্যক্তি।

কখন ডাক্তার দেখাবেন? 

ফেশিয়াল প্যারালাইসিস এর উপসর্গ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে আপনার পারিবারিক ডাক্তার দেখাবেন। সেই ডাক্তারের পরামর্শ মত পরবর্তি কাজ করতে পারেন। যদি এই সমস্যা সহসা উন্নতির দিকে না যায় তাহলে একজন নিউরোলোজিস্ট কে দেখালে তিনি সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা দিতে পারবেন।

ফেশিয়াল প্যারালাইসিস কিভাবে সারে?

সৌভাগ্যবসত মানুষের স্নায়ু কোষ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় ও ক্ষতিগ্রস্থ হলে তাও সেরে ওঠে। সামান্য কিছু ক্ষেত্রে নার্ভ সেরে ওঠে না। তার জন্য সার্জারি প্রয়োজন হতে পারে। 

সমস্যা হলো যতক্ষন না পর্যন্ত নার্ভ সম্পুর্ণ সেরে ওঠে ততক্ষন পর্যন্ত পুরো অংশটিই অকেজো থাকে। স্নায়ু কোষের বৃদ্ধি বেশ ধীর, তাই সেরে ওঠার জন্য সময় প্রয়োজন। আবার ডায়বেটিস আক্রান্ত রোগীর জন্য এটি আরো বেশি স্লথ হতে পারে।

নার্ভ ক্ষতিগ্রস্থ হলে জোর করে মুখ নড়ানোর, চেষ্টা, এবড়োথেবড়ো ম্যাসাজিং হিতে বিপরীত ডেকে আনতে পারে। তাই না বুঝে কিছু করা উচিত নয়। সেই সাথে সুডো সায়েন্টিফিক চিকিৎসা যেমন আকুপ্রেশার জাতীয় চিকিৎসারও কোন রকম বৈজ্ঞানীক ভিত্তি নেই। 

একজন ফেশিয়াল প্যারালাইসিস রোগীর প্রয়োজন সময়। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলে স্নায়ু কোষগুলো ধীরে ধীরে সেরে উঠতে থাকে, সেই সাথে ডাক্তারের পরামর্শ নিলে তিনি ইনফেকশন বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার বিবেচনা করে ঔষধ দেবেন যা দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে সাহায্য করবে। 

কিছু ক্ষেত্রে পুরোনো নর্ভ এতোটাই ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যায় যে তা আর সেরে উঠে না। সে ক্ষেত্রে নার্ভের সুস্থ্য স্থানের থেকে নতুন নার্ভ আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেতে থাকে ও সময়ের সাথে সাথে নতুন নার্ভ মুখের প্রয়োজনীয় অংশে বিস্তার করে। এভাবে স্নায়ু কোষ সেরে উঠতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে। এক্ষেত্রে যেহেতু স্নায়ু কোষ একটু একটু করে বড় হতে থাকে মুখের নিয়ন্ত্রন একটু একটু অংশ করে পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে। 

সঠিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ফিজিও ম্যাসেজিং এর মাধ্যমে আরোগ্য দ্রুত করা সম্ভব। যদিও নিয়মটি শিখলে আপনি নিজেও তা করতে পারেন। তবে নিশ্চিত হবেন আপনি ভুল পদ্ধতি অনুস্বরণ করছেন না।

পরিশেষ

ফেশিয়াল প্যারালাইসিস একটি স্নায়বিক সমস্যা জনিত রোগ এবং এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সহজেই সেরে যায়। তাই আক্রান্ত হলে সময় দিন, অধৈর্য হয়ে, ভয় পেয়ে বা মানসিক ভাবে ভেঙে না পড়ে ধের্য ধরে অপেক্ষা করুন সেই সাথে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণের দিকে মনোযোগ দিন।

 

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles