করোনাভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড বা সুপ্তিকাল!

কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস! বিশ্ববাসীর দীর্ঘশ্বাস! এখনও মেলেনি কোনো সমাধান। ভিন্নতা রয়েছে এর ইনকিউবেশন পিরিয়ড, উপসর্গ ইত্যাদি নিয়ে। তবে গবেষণা চলছে আর বের হচ্ছে নতুন নতুন তথ্য। হয়ত খুব শীঘ্রই দেখা মিলবে সমাধানের।

করোনাভাইরাস নিয়ে নিত্য চলছে গবেষণা। একেক গবেষণায় একেক তথ্য বের হয়ে আসছে। আসুন জেনে নিই বিভিন্ন গবেষণায় বের হয়ে আসা করোনাভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড বা সুপ্তিকাল, উপসর্গ এবং বয়স, লিঙ্গ ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের পরিসংখ্যান সম্পর্কে।  

 

১. কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড 

কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড বা সুপ্তিকাল ২ থেকে ১৪ দিন। 

তবে ২৭ দিন সুপ্তিকালের তথ্যও পাওয়া গেছে!!! 

ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবার পর থেকে প্রথম লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়কালকে ইনকিউবেশন পিরিয়ড বা সুপ্তিকাল বলা হয়। 

করোনাভাইরাস এর ক্ষেত্রে ইনকিউবেশন পিরিয়ড ২ থেকে ১৪ দিন ধারণা করা হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন পরীক্ষা নিরিক্ষায় এই ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড ২৭ দিন পর্যন্ত পাওয়া গেছে।  

করোনাভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড নিয়ে কিছু তথ্য,

  • কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের সুপ্তিকালের অফিসিয়াল আনুমানিক সময়কাল ২-১৪ দিন ধরা হয়।         

  • তবে চায়নার হুবেই প্রদেশের স্থানীয় সরকার জানান যে করোনাভাইরাসের সুপ্তিকালের ক্ষেত্রে ২৭ দিনের নজির পর্যন্ত পেয়েছেন। (রেফারেন্স- ১)

  • The Journal of the American Medical Association (JAMA) - র একটি গবেষণায় ১৯ দিনের সুপ্তিকাল পাওয়া গেছে। (রেফারেন্স- ২)  

  • চায়নার আরেকটি গবেষণায় ২৪ দিনের সুপ্তিকালও পাওয়া গেছে।      

তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসের সুপ্তিকাল এত দীর্ঘ হবার কারন হিসেবে দ্বিতীয় দফায় উপসর্গ লক্ষণীয় হচ্ছে বলে মনে করছেন। অর্থাৎ প্রথম দফায় উপসর্গগুলো হয়ত বুঝা যায়নি।        

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে প্রথম ৫ দিনের মধ্যেই করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেখা যায়। চায়নার একটি ৪২৫ জন রোগীর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে গড় ইনকিউবেশন পিরিয়ড হচ্ছে ৫.২ দিন।   

ইনকিউবেশন পিরিয়ড বা সুপ্তিকাল সম্পর্কে জানা কেন প্রয়োজন? 

সুপ্তিকাল সম্পর্কে জানা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যাতে করে তাঁরা কার্যকরী কোয়ারেনটাইন বা পৃথকীকরণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে যেহেতু সুপ্তিকাল সর্বোচ্চ ১৪ দিন ধারণা করা হচ্ছে সে কারনেই কাউকে করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত মনে করা হলে ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেনটাইনে রাখা হচ্ছে।   

অন্যান্য ভাইরাসের সাথে কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের সুপ্তিকাল এর তুলনা 

যেখানে কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের সুপ্তিকাল ২-১৪ দিন ধারনা করা হয় সেখানে অন্যান্য করোনাভাইরাস যেমন সারস (SARS) এর সুপ্তিকাল ২-৭ দিন, মারস (MARS) এর ৫ দিন। আবার অন্যান্য ভাইরাস যেমন সোয়াইন ফ্লু এর সুপ্তিকাল ১-৪ দিন, সিজোনাল বা মৌসুমি ফ্লু এর ২ দিন হয়ে থাকে।   

 

২. কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের উপসর্গ

প্রথম অবস্থায় সাধারণ লক্ষণ হিসেবে জ্বর ও শুকনো কাশি এবং পরবর্তীতে ১ সপ্তাহের মধ্যে শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে। 

কিছু রোগীদের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বয়স্ক এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া রোগের লক্ষণ দেখা দেয়, শ্বাসকষ্টের পাশাপাশি বুক ব্যথা, চিনচিনে ভাব দেখা দেয়। 

শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে এখন পর্যন্ত ২০% রোগীদের ক্ষেত্রে দেখা গেছে হাসপাতালে ভেনটিলেশন নেয়ার দরকার হয়েছে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার জন্য। 

কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে খুব কম সময় দেখা গেছে নাক দিয়ে পানি পড়া, হাচি এবং গলা ব্যথা হতে। ৫% রোগীদের ক্ষেত্রে এই ধরণের লক্ষণ দেখা গেছে। মূলত এগুলো সাধারন ঠাণ্ডা বা ফ্লু এর লক্ষণ। 

৮০% ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের আক্রমন সাধারণ হয়ে থাকে 

চায়নার সিসিডিসি (CCDC) ১৭ই ফেব্রুয়ারি একটি জার্নাল প্রকাশ করে যেখানে ৭২,৩১৪ জন  রোগীর তথ্যের উপর ভিত্তি করে বলা হয়, 

  • ৮১% ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের আক্রমণে ফ্লু এর উপসর্গ দেখা গেছে এবং ঘরে বসেই ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে।       

  • ১৪% রোগীর ক্ষেত্রে নিউমোনিয়ার উপসর্গ এবং শ্বাসকষ্ট দেখা গেছে   

  • ৫% ক্ষেত্রে সংকটপূর্ণ অবস্থা দেখা গেছে যেমন শ্বাসযন্ত্র বন্ধ হয়ে গেছে, অক্সিজেন সরবারহ বন্ধ হয়ে গেছে এবং বিভিন্ন অঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। 

বয়স্ক মানুষ এবং যাদের আগে থেকেই হৃদরোগ, ডায়াবেটিক, উচ্চ রক্তচাপ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের আক্রমণ হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং মারাত্মক ক্ষতি হবার সম্ভাবনাও থাকে। 

করোনাভাইরাসের উপসর্গ কতদিন থাকে?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরীক্ষাগারে নিশ্চিত হওয়া ৫৫,৯২৪ রোগীর তথ্য থেকে নিন্মলিখিত সময়কালকে “উপসর্গ দেখা যাওয়া থেকে শুরু করে আরোগ্য লাভ করা পর্যন্ত” ধারণা করেছে।   

  • সাধারন আক্রমনের ক্ষেত্রে, প্রায় ২ সপ্তাহ

  • গুরুতর অবস্থায়, ৩-৬ সপ্তাহ এবং

  • মারা যাওয়া রোগীর ক্ষেত্রে সময়কাল ২-৮ সপ্তাহ দেখা যাচ্ছে।             

 

৩. বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী এবং অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের পরিসংখ্যান 

বয়স ও লিঙ্গ অনুযায়ী এবং অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের পরিসংখ্যান এখানে দুটি তথ্য উৎস থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। 

একটি হচ্ছে পরীক্ষাগারে নিশ্চিত হওয়া ৫৫,৯২৪ রোগীর তথ্য থেকে যা ২৮ই ফেব্রুয়ারী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত হয়।

আরেকটি হচ্ছে চায়নার সিসিডিসি (CCDC) কর্তৃক যা ১৭ই ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত যেখানে পরীক্ষাগারে নিশ্চিত হওয়া ৭২,৩১৪ জন রোগীর তথ্য থেকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

উভয়ের তথ্য থেকে নিন্মে তিনটি  তালিকা উল্লেখ করা হল যেখানে বয়সের সাথে মৃত্যুর হার, লিঙ্গভেদে মৃত্যুর হার এবং অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হার উল্লেখ করা হল। 

মৃত্যুর হার =  (মোট মৃত্যু সংখ্যামোট আক্রান্ত সংখ্যা)১০০  

 

১. বয়সের সাথে মৃত্যুর হার 

বয়স 

মৃত্যু হার 

৮০+ 

১৪.৮% 

৭০-৭৯

৮% 

৬০-৬৯

৩.৬%

৫০-৫৯

১.৩%

৪০-৪৯

০.৪%

৩০-৩৯

০.২%

২০-২৯

০.২%

১০-১৯

০.২%

০-৯

-

 

 ২. লিঙ্গভেদে মৃত্যুর হার

লিঙ্গ

মৃত্যু হার 

পুরুষ 

২.৮%

মহিলা 

১.৭% 

 

৩. অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হার

পূর্বরোগে আক্রান্ত  

মৃত্যু হার 

হৃদরোগ 

১০.৫%

ডায়াবেটিক 

৭.৩%

দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা 

৬.৩%

উচ্চ রক্তচাপ 

৬.০%

ক্যান্সার 

৫.৬%

কোন রোগ নেই 

০.৯% 

 

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষদের এসব তথ্যের উপর ভিত্তি করে গবেষকরা ভাইরাসটির কর্মপ্রক্রিয়া বুঝার চেষ্টা করছেন এবং একই সাথে নিরলস ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন কার্যকরী ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের যেই ভ্যাক্সিনের আশায় অপেক্ষারত আছেন পুরো বিশ্বের মানুষ।     


 

তথ্য সূত্র, 

১। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা 

২। রয়টার্স

৩। জামানেটয়ার্ক

৪। মেড্রিক্স

৫। চায়না সি সি ডি সি

৬। ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন 




 

Default user image

আসিফ মাহমুদ তুনান, সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও CEO, আস্থা লাইফ

ফার্মেসি নিয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়াশুনা করেছি। অভিজ্ঞতা আছে বাংলাদেশের প্রথম সারির ফার্মাসিউটিক্যাল এবং কসমেটিক কোম্পানিতে চাকুরী করার। এছাড়া রিটেইল চেইন ফার্মেসি নিয়ে কাজ করার সুবাধে সাধারন মানুষদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জিজ্ঞাসা সম্পর্কে পরিস্কার ধারনা পাচ্ছি। আর সেখান থেকেই নিজেকে আস্থা লাইফের সাথে সংযুক্ত করেছি। আমি বিশ্বাস করি সমাজের প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা সম্পর্কে তথ্য, পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণা পাওয়া দরকার। আর এই বিশ্বাস থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছি আস্থা ব্লগে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত লেখা দিয়ে মানুষকে সচেতন করার। ভালো লাগে স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে পড়াশুনা করতে এবং আর ভালো লাগে মানুষকে স্বাস্থ্য বিষয়ে জানাতে। পড়াশুনা আর কর্মের পাশাপাশি সুযোগ পেলেই ঘুরতে যাই পাহাড় পর্বতে।

Related Articles