পায়খানার সাথে রক্ত পড়া বন্ধের ৮টি কার্যকরী উপায়!
পায়খানার সাথে রক্ত পড়া সমস্যাটি অন্যান্য জটিল রোগের সাথে সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনা থাকে বিধায় অন্যান্য পায়ু পথের রোগ যেমন, অ্যানাল ফিসার ও পাইলসের চেয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। এ সম্পর্কে জ্ঞানের স্বল্পতা সমস্যাটিকে করতে পারে জটিলতর। তাই পায়খানার সাথে রক্ত আসার কারণ ও প্রতিকার এবং তা বন্ধের উপায় জানতে লেখাটির একদম শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
পায়খানার সাথে রক্ত পড়ার রোগকেই মূলত বলা হয় রেক্টাল ব্লিডিং বা মলদ্বারে রক্তক্ষরণ। রেক্টাল ব্লিডিং কে কোন নির্দিষ্ট রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না বরং এটি বেশ কয়েকটি রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয়। যদিও এটি সাধারণত সাময়িক ও সহজে নিরাময় যোগ্য রোগ।
কিন্তু, শরীরের দৃশ্যমান অংশের রক্তপাতের চেয়ে ভেতরে অংশের রক্তপাত বেশি আতঙ্কজনক, কারণ আপনি ক্ষতের উৎপত্তি, কারণ ও পরিমাণ বেশিরভাগ সময় জানতেই পারবেন না। তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই উৎকর্ষতার যুগে ভয় পাওয়াটা অমূলকই বলা চলে।
যাইহোক, পায়খানার পর কোনভাবে রক্ত আবিষ্কার করলে আতঙ্কিত না হয়ে বেশ কিছু জিনিস লক্ষ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পায়ুপথে রক্তপাতের উপসর্গ তেমন জটিল নয় আবার কিছু উপসর্গে খুব দ্রুত ডাক্তার দেখানো বাঞ্ছনীয় হয়ে দাঁড়ায়। তবে চলুন প্রথম থেকে শুরু করা যাক। ধারাবাহিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলো নিয়ে আলোচনা করব।
রেক্টাল ব্লিডিং বা পায়খানার সাথে রক্তক্ষরণ কী?
পায়ু পথ দিয়ে যে কোন রকম রক্ত পড়াকে রেক্টাল ব্লিডিং বলা হয়। যদিও রেক্টাল ব্লিডিং হলে প্রাথমিক ভাবে ধরে নেওয়া হয় যে রক্ত পায়ুপথের উপরের অংশ ও ক্ষুদ্রান্তের শেষ অংশ থেকে রক্তপাত হচ্ছে। রক্তের রং ও অবস্থা দেখে রেক্টাল ব্লিডিং এর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা করা যায়। রক্ত আলাদা ভাবে পড়তে পারে, পায়খানার সাথে মিশ্রিত ভাবে পড়তে পারে যা টয়লেটের প্যানে, পানিতে মিশে, টয়লেট টিস্যু ব্যবহারের সময় বা অন্তর্বাসে দেখা যেতে পারে।
পায়খানার সাথে রক্ত আসার কারণ
রেক্টাল ব্লিডিং বহুমুখী কারণে হতে পারে। সে কারণেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া রোগীর পক্ষে তা বোঝা অসম্ভবই বলা যায়। তবে পায়খানার সাথে রক্ত আসার নিম্নোক্ত তিনটি কারণ সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ক্ষেত্রে দায়ী হতে পারে।
১. কোষ্টকাঠিন্য
কেষ্টকাঠিন্যের জন্য মলদ্বারে/ অন্ত্রে কোন স্থান কেটে বা ছড়ে গেলে মলের সাথে রক্ত যেতে পারে।
২. অ্যানাল ফিসার
মলদ্বারের শেষ প্রান্তেরর কোন অংশ কোষ্টকাঠিন্য বা অন্য কারণে কেটে গেলে তাকে অ্যানাল ফিসার বলা হয়। অ্যানাল ফিসারের কারণে মলের সাথে রক্ত যেতে পারে, সেক্ষেত্রে তীব্র ব্যথা অনুভূত হবে।
৩. হেমোরয়েডস
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অ্যানাল ফিসার ওর জন্য দায়ি হলো হেমোরয়েডস। হেমরয়েডস হলো যখন ক্ষুদ্রান্তের রক্তনালী চাপের কারণে সরু হয়ে আসে।
এছাড়া আরো কিছু বিরল ক্ষেত্রে পায়ুপথ দিয়ে রক্ত আসতে পারে।
-
অ্যানাল ক্যান্সার
-
কোলন ক্যান্সার
-
কোলন পলিপস
-
পায়ুপথের দেওয়ালে ঘা
-
পায়ুপথে অন্যান্য ইনফ্লামেটরি রোগ।
দেখা যাচ্ছে, পায়খানার সাথে রক্ত পড়া কিছু সাধারণ রোগের সাথে সাথে কিছু জটিল রোগেরও উপসর্গ। ঠিক এই কারণেই রেক্টাল ব্লিডিংকে খাটো ভাবে দেখা উচিৎ নয়।
পায়খানার সাথে রক্ত পড়া কখন জটিল অবস্থায় ধারণ করে?
পায়খানার সাথে পড়া রক্তের রং দেখে রক্তের উৎপত্তি স্থান বোঝা যায়। লক্ষ করুন,
-
যদি টাটকা লাল রক্ত দেখতে পান তাহলে তা মলদ্বারের কিছুটা উপরের প্রান্ত বা ক্ষুদ্রান্তের শেষ প্রান্ত থেকে হচ্ছে।
-
যদি কিছুটা বাদামী বা কালচে রক্ত লক্ষ করেন, তবে বুঝবেন তা বৃহদান্ত্র বা অন্ত্রের উপরের অংশ থেকে হচ্ছে।
-
এবং রক্ত যদি কালো রং এর হয়ে থাকে, তা যদি মলের সাথে পুরোপুরি মিশে থাকে তাহলে বুঝবেন তার উৎপত্তি স্থল পাকস্থলি।
এখন প্রশ্ন হল, রক্তের রং হালকা হওয়া না গাঢ় হওয়া, কোনটি বেশি গুরুতর? উত্তরটি হলো,
-
উজ্জ্বল লাল রং এর রক্ত দেখলেই আপনি অনেকটা সঙ্কা মুক্ত থাকতে পারেন যদিও পুরোপুরি নয়।
-
গাঢ় রক্ত পাকস্থলি ও অন্ত্রে জটিলতর রোগের নির্দেশ করতে পারে।
এখন আপনার করণীয় হলো, যদি রক্তপাত একদিনের বেশি স্থায়ী হয় তবে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া। রক্তের রং ও পরিমান দেখে সন্দিহান হলে লক্ষ করার পরই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন। যদি সামান্য রক্ত দুএকবার লক্ষ করেন, তবে রক্তপাতের বিষয়টি মাথায় রেখে পরবর্তি ধাপগুলো উপেক্ষা করতে পারেন। আশা করা যায় পরদিন থেকে এই উপসর্গ আর দেখা যাবে না।
কিভাবে বুঝবেন রেক্টাল ব্লিডিং বা মলদ্বারে রক্তক্ষরণ হচ্ছে?
-
কমোড বা প্যানের গায়ে রক্ত লেগে থাকতে পারে।
-
কমোডের পানি লাল, ক্ষয়েরি, বা কালচে হয়ে যেতে পারে।
-
পায়খানার সাথে রক্তের ছাপ দেখা যেতে পারে ও পায়খানার রং কমলা, ক্ষয়েরী, বেগুনী বা কালো রং এর দেখাতে পারে।
-
অন্তর্বাসে রক্ত চুইয়ে পড়তে পারে বা টিস্যুপেপার ব্যবহারের পর রক্তের দাগ দেখা যেতে পারে।
এইসব উপসর্গ দেখলে রেক্টাল ব্লিডিং হচ্ছে বলে ধরে নিতে পারেন। উল্লেখ্য রেক্টাল ব্লিডিং সাধারণ ভাবে অনেক মানুষের হয়ে থাকে কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ পায়খানা লক্ষ করেন না বিধায় তা টের পান না।
রেক্টাল ব্লিডিং বা মলদ্বারে রক্তক্ষরণ এর উপসর্গ
রেক্টাল ব্লিডিং হলে নিন্মোক্ত উপসর্গ গুলো দেখা যেতে পারে,
-
পায়ুপথে চাপ বা ব্যাথা অনুভব করা
-
পায়ুপথ দিয়ে নতুন বা পুরোনো রক্ত বের হওয়া
-
লাল, মেরুন বা কালো পায়খানা হওয়া
-
মানসিক বিভ্রান্তি, মাথা ঘোরা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
-
বিরল লক্ষন হিসেবে, নিন্মরক্তচাপ, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, প্রস্রাব করতে না পারা অন্যতম।
রেক্টাল ব্লিডিং বা মলদ্বারে রক্তক্ষরণ এর চিকিৎসা
পূর্বে উল্লেখ করেছি রেক্টাল ব্লিডিং মূলত কোন রোগ নয় এটি অনেকগুলো রোগের একটি উপসর্গ। যে রোগ বা সমস্যার কারণে পায়ুপথে রক্ত নির্গত হচ্ছে সেই সমস্যাটির সমাধান করা গেলে রেক্টাল ব্লিডিং বন্ধ হয়ে যাবে। সে জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি নিন্মোক্ত প্রশ্নগুলো করতে পারেন, তাই আগে থেকে জেনে রাখা ভালো। মনে রাখবেন, রোগের বর্ণণা যতই গা ঘিনঘিনে হোক, তা ডাক্তার কে আপনার রোগ নির্ণয় করতে সাহায্য করবে।
-
পায়খানার সাথে রক্ত পড়া কখন শুরু হয়েছিলো?
-
শুরু হবার আগের দিন কি খেয়েছিলেন?
-
কতবার পায়খানা করেন?
-
কোষ্ঠকাঠিন্য আছে কিনা?
-
কোন রকম ব্যাথা আছে কিনা?
-
নির্গত রক্তের রং কি? ইত্যাদি
আপনার উপসর্গের উপর নির্ভর করে সঠিক রোগটি নির্ণয় করতে ডাক্তার নিন্মোক্ত এক বা একাধিক পরীক্ষা করতে বলতে পারেন-
-
পায়ুপথে বাহ্যিক অবস্থার সাধারণ পরীক্ষা
-
কোলনোস্কপি
-
সিগমোইডিস্কপি
-
রক্ত পরীক্ষা।
পরীক্ষার রিপোর্ট পর্যবেক্ষন করে আপনার সঠিক রোগটির চিকিৎসা প্রাদান করলে রেক্টাল ব্লিডিং সেরে যাবে।
পায়খানার সাথে রক্ত পড়া বন্ধের উপায়
রেক্টাল ব্লিডিং যেহেতু কোন একক রোগ নয়, এটির কোন নির্দিষ্ট প্রতিকার ও প্রতিরোধ দেওয়া দুঃসাধ্য। কিন্তু যদি আপনি জানেন ঠিক কোন কারণে রেক্টাল ব্লিডিং হচ্ছে তবে আপনি নির্দিষ্ট ভাবে ঐ রোগটির দমনে ব্যাবস্থা নিতে পারবেন। তবু যেহেতু এটি পরিপাক তন্ত্রের রোগ, কিছু সাধারণ জীবন পদ্ধতি মেনে চললে রেক্টাল ব্লিডিং এর রোগগুলো সহ সর্বপরি পরিপাকতন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।
১. প্রচুর পরিমানে পানি পান করা।
২. পর্যাপ্ত আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করা।
৩. নিয়ম মাফিক খাবার গ্রহণ করা।
৪. ধুমপান ও মদ্যপান পরিহার করা।
৫. কোষ্ঠকাঠিন্যকে অবহেলা না করা। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় পরিমাণ মত ইশপ গুলের ভুসি সেবন করা।
৬. পায়খানার সময় তাড়াহুড়া না করা।
৭. অতিরিক্ত সময় পায়খানা না করা।
৮. পায়খানার অবস্থা রং ও ধরণ নিয়মিত পর্যবেক্ষন করা।
রেক্টাল ব্লিডিং হলে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পায়খানার ধরণ ও রক্তের ধরণ লক্ষ রাখা। তাছাড়া বেশি ব্যথা অনুভব করলে, ৬ ঘন্টা পরপর প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দু একদিন এর জন্য খাওয়া যেতে পারে। কুসুম গরম পানি ভরা বালতিতে বসে থাকাও ব্যাথা কমাতে সাহায্য করবে। সর্বপরি উপসর্গ প্রাথমিক ভাবে না কমলে ডাক্তার দেখানোর কোন বিকল্প নেই।
পায়খানার সাথে রক্ত পড়া নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নোত্তর
১. পায়খানার সাথে রক্ত পড়লে কখন এবং কোন ডাক্তার দেখাবেন?
রেক্টাল ব্লিডিং যদি এক দিনের বেশি নিয়মিত ভাবে হয়ে থাকে তবে একজন গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট, প্রক্টোলজিস্ট (রেক্টাল ও কোলন সার্জন) ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে সঠিক চিকিৎসা পাবেন।
২. রেক্টাল ব্লিডিং ও অ্যানাল ফিসার এর মধ্যে পার্থক্য কী?
পায়ুপথে রক্ত গেলেই তাকে রেক্টাল ব্লিডিং বলে। অন্যদিকে অ্যানাল ফিসার হলো পায়ুপথের শেষ প্রান্ত কেটে যাওয়া। অ্যানাল ফিসারের কেটে যাওয়া স্থান থেকে যদি রক্ত পড়ে তবে তা রেক্টাল ব্লিডিং এর অন্তর্গত হবে। অ্যানাল ফিসারে তীব্র ব্যাথা, জ্বলুনি ও চুলকানী অনুভব করবেন।
৩. পয়খানার রং এর সাথে কি খাবারের কোন সম্পর্ক আছে?
পায়খানায় অস্বাভাবিক রং খেয়াল করছেন? আতঙ্কিত না হয়ে ভাবুন গতদিন কি খেয়েছেন। অনেক সময় খাবারের রং ও পায়খানার রং এ ভালো তফাৎ রাখতে পারে। রঙিন কোন খাবার অতিরিক্ত খাওয়া পায়খানার রং এ প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে জাম, লালশাক, বিট অথবা যেকোনো কৃত্তিম রং মেশানো খাবার যেমন, নিন্মমানের টমেটো সস। আর খাবারের জন্য যদি এমনটা হয়, সেই খাবারটি না খেলে পরবর্তিতে আর পায়খানার রং এ কোন প্রভাব ফেলবে না।
৪. গ্যাস্ট্রিক থেকে কি মলদ্বারে রক্তক্ষরণ হতে পারে?
হ্যাঁ, দীর্ঘদিন ধরে যদি গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসা না করা হয় তাহলে পাকস্থলিতে ক্ষত বা আলসার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেই ক্ষত থেকে রক্তপাত হলে রেক্ট্রাল ব্লিডিং হতে পারে। সেক্ষেত্রে পায়ুপথ দিয়ে কালো রক্ত নির্গত হবে। অতএব, গ্যাস্ট্রিক অবহেলা নয়। বলে রাখা ভালো, প্রেসক্রিপশন ছাড়া হরহামেশা গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ সেবন শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর হতে পারে।