খাবারে অরুচি বা ক্ষুধামান্দ্য দেখা গেলে কি করবেন

আপনার প্রতি মায়ের হয়ত নানা অভিযোগের মধ্যে একটি যে আপনি ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করতে চান না। আর এই নানা অভিযোগ অনুরাগের পর আপনারও মাঝেমধ্যে একটু অবাক লাগতে পারে যে, “আমার খেতে ইচ্ছে করে না কেন?।” ব্যাস! এটুকুই ভাবনা, এই বিষয়ে আপনার হয়ত আর ভাবনার অবকাশ নেই। তবে একটু সময় দিন আমাদের সাথে, কেননা আপনার এই ক্ষুধামান্দ্য বেশ কিছু গুরুতর সমস্যার কারণেও হতে পারে।

ক্ষুধামান্দ্যর এই সমস্যাটিকে ডাক্তারি ভাষায় এনোরেক্সিয়া বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন কারণেই এই ধরনের সমস্যা দেখা যেতে পারে। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা ক্ষুধামন্দার নানাবিধ কারণ এবং তার প্রতিকার নিয়েই আলোচনা করতে যাচ্ছি। অনেককেই খেতে ইচ্ছে করছে না বলতে শুনা যায়, তবে এই ধরনের সমস্যাকে আমরা কেউ তেমন একটা গুরুত্বের সাথে নেই না। তবে প্রথমেই আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে যে ক্ষুধামান্দ্যর সাথে আপনার শরীরে অন্য কোন লক্ষণ আছে কি না। আসুন এই সমস্যার বিস্তারিত জেনে নেই… 

ক্ষুধামান্দ্য কেন হয়?

যে সমস্ত কারণে আপনার মধ্যে ক্ষুধামান্দ্য দেখা যেতে পারে, সেগুলো সম্পর্কে নিম্নে ধারনা দেয়া হলঃ

ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ

ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, জ্বর, সর্দি, ইউরিন ইনফেকশন ক্ষুধামন্দার সাধারণ কারণ। ডাঃ ম্যাকক্লাইমন্ট বলেন,” আমাদের শরীরে যখন কোন ধরনের ইনফেকশন জনিত সমস্যা দেখা যায়, তখন তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে ক্ষুধামান্দ্যও দেখা যায়। কেননা মস্তিষ্ক এই সময়ে এক ধরনের কেমিক্যাল নিঃসৃত করে যা কি না আমাদের পাকতন্ত্রের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাড়ায়” 

শারীরিক অসুস্থতা

দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক অসুস্থতার কারণে ক্ষুধামন্দা হয়ে থাকে। যেমন- 

গুরুতর যে কোন ধরনের ব্যথা যেমনঃ মাইগ্রেন, ফাইব্রোমায়ালজিয়া এবং আর্থ্রাইটিস এর মত রোগের কারণে ক্ষুধামন্দা হতে পারে।

ডায়াবেটিস 

যাদের ডায়াবেটিস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রনে নেই তাদের নার্ভ দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে পরিপাকতন্ত্র খুব ধীরে ধীরে খাবার পরিপাক করে। এটাকে গ্যাস্ট্রোপেরেসিস বলা হয়। গ্যাস্ট্রোপেরেসিসের কারণে খাবারের প্রতি অনীহা তৈরি হয়।

হজমে সমস্যা 

আমাদের শরীর যদি খাবার গ্রহণ করে হজম করতে না পারে ঠিকমত তখন সে খাবার গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। আর তাই খেতে অনীহা দেখা গেলে আমাদের প্রথমেই দেখতে হবে খাবার ঠিকমত হজম হচ্ছে কি না! প্রয়োজনে একজন গ্যাস্ট্রোলোজিস্টের সাথে আলাপ করে দেখা যেতে পারে। 

বয়স 

বয়সের সাথে সাথে আমাদের ক্ষুধারও পরিবর্তন হয়ে থাকে। ধারনা করা হয়, বয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ৩০শতাংশ পর্যন্ত ক্ষুধা হ্রাস পায়, ফলে তারা কম খাবার খায় এবং তাদের ওজন হ্রাস পায় ও পুষ্টি-হীনতায় ভুগে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে উচ্চ মাত্রায় YY হরমোন থাকে ফলে তাদের ক্ষুধা কম লাগে।

এছাড়া আলঝেইমারস এবং পারকিনসন রোগ, দাঁতের সমস্যা, খাবার গিলতে সমস্যার কারণেও ক্ষুধামন্দা হয়ে থাকে। মানসিক বিষাদ, একাকীত্বের কারণেও ক্ষুধামন্দা হতে পারে।

মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি

মানসিক স্বাস্থ্য আপনার ক্ষুধার উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। ডাঃ ম্যাকক্লাইমন্ট বলেন,”যখন আপনি মানসিক চাপে থাকেন তখন আপনার মস্তিষ্ক অ্যাড্রেনালিন হরমোন নিঃসরণ করে, এই হরমোন আপনার পাচনতন্ত্রকে ধীর করে দেয়। 'বিষণ্ণতা কর্টিকোট্রপিন-নিঃসরণকারী হরমোন উৎপাদন শুরু করে, যা আপনার ক্ষুধাও কমায়।'

ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

কিছু কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ক্ষুধা কমে যেতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে ওপিওড পেইনকিলার, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস, অ্যান্টিবায়োটিক, টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ওষুধ।

ক্যান্সারের চিকিৎসা ক্ষুধা হ্রাসের কারণ হতে পারে, কেননা একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রায় ৬০শতাংশ লোকের ক্ষুধা হ্রাস পায়। এছাড়া কেমোথেরাপি এবং ইমিউনোথেরাপির মতো চিকিৎসার ফলে স্বাদ পরিবর্তন হতে পারে এবং বমি বমি ভাব হতে পারে। সাধারণত এগুলো কেমোথেরাপির একটি সাধারণ পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া।

এদিকে হাইপোথাইরয়েডিজম, অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা, এইচআইভি, হার্ট ফেইলোর, কিডনির সমস্যা, অতি মাত্রায় এলকোহল পান করা ইত্যাদি নানা কারণেও অনেকের ক্ষুধামান্দ্য হতে পারে।

ক্ষুধামান্দ্য হলে কি করবেন?

ক্ষুধামান্দ্যর চিকিৎসা নির্ভর করে এর সঠিক কারণের উপর। অর্থাৎ আপনার যে কারণে ক্ষুধামান্দ্য দেখা গিয়েছে সেই সমস্যার চিকিৎসা করলে আপনার খাবারে অনীহা ঠিক হয়ে যাবে। যদি আপনি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে ক্ষুধামন্দায় ভুগেন তাহলে এর জন্য কোন চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। সংক্রমণ নিরাময় হওয়ার সাথে সাথে আপনার ক্ষুধামন্দাও ঠিক হয়ে যাবে।

ক্ষুধামান্দ্যর ঘরোয়া সমাধান

যদি ক্যান্সার বা অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতার কারণে ক্ষুধামন্দা হয়ে থাকে তাহলে এ থেকে মুক্তি পাওয়া খুবই কঠিন হতে পারে। তবে পরিবার বা বন্ধুদের সাথে একত্রে খাওয়া, পছন্দের খাবার রান্না করা, মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্টে গিয়ে পছন্দের খাবার খাওয়ার মাধ্যমে ক্ষুধামন্দা কাটিয়ে উঠা সম্ভব।

একসাথে অনেক খাবার না খেয়ে একটু পর পর অল্প খাবার খেয়ে চেষ্টা করতে পারেন। অল্প খাবার সহজেই হজম হয়। এছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম করলে ক্ষুধামন্দা নিরাময় হয়। যে খাবার খাচ্ছেন তা থেক পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টি এবং ক্যালরি পাচ্ছেন কিনা তা নিশ্চিত হয়ে নিন।

অনেক সময় আপনি চাইলেই অল্প খাবার গ্রহণের মাধ্যমেও শরীরের প্রয়োজনীয় ক্যালোরি গ্রহণ করে ফেলতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনি যদি বাড়তি সতর্ক হয়ে থাকতে চান তাহলে একজন পুষ্টিবিদের সাথে আলোচনা করে নেয়াই ভালো। 

ক্ষুধামন্দার চিকিৎসা

ডাক্তার উপসর্গ দেখে ক্ষুধামন্দার সম্ভাব্য কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন। যদি আপনি পূর্বে কোন ওষুধ সেবন করে থাকেন তাহলে সেগুলোর নাম নোট করে রাখুন, এতে আপনার ক্ষুধামন্দার কারণ বের করতে সুবিধা হবে। এছাড়া ডাক্তার আপনাকে নিম্নে বর্ণীত প্রশ্নগুলো করতে পারে-

  • কতদিন ধরে ক্ষুধামন্দায় ভুগছেন?

  • কত ওজন কমেছে?

  • অন্যান্য কোন উপসর্গ আছে কিনা?

তারপর আপনার ক্ষুধামন্দার কারণ খুঁজে বের করার জন্য ডাক্তার নিম্নোক্ত পরীক্ষাগুলো করাতে পারেন-

  • পেটের আলট্রাসাউন্ড

  • ব্লাড কাউন্ট

  • লিভার, থাইরয়েড, কিডনি ফাংশন টেস্ট

  • আপার জিআই সিরিজ (খাদ্যনালী, পাকস্থলী এবং ছোট অন্ত্র পরীক্ষা করার এক্স-রে)

  • আপনার মাথা, বুক, পেট বা পেলভিসের সিটি স্ক্যান

  • প্রেগন্যান্সি এবং এইচআইভি টেস্ট

  • ইউরিন টেস্ট

আপনার ক্ষুধা বাড়ানোর জন্য ডাক্তার আপনাকে ওরাল মেডিসিনও প্রেসক্রাইব করতে পারে।

যদি বিষণ্ণতা, মানসিক চাপ, ইটিং ডিসঅর্ডার বা ড্রাগ সেবন এর কারণে ক্ষুধামন্দা হয়ে থাকে তাহলে আপনাকে মেন্টাল হেলথ স্পেশালিষ্ট এর কাছে রেফার করতে পারে। হ্যাঁ! মানসিক বিভিন্ন সমস্যার কারণেও এই ধরনের ক্ষুধামান্দ্য দেখা যেতে পারে। আর্টিকেলের পরবর্তী অংশে এই বিষয়ে আলোচনা করা হবে। 

তবে ওষুধের কারণে যদি আপনার মধ্যে ক্ষুধামান্দ্য দেখা যায়, তাহলে আপনার ওষুধের ডোজ বা প্রেসক্রিপশন পরিবর্তন করার প্রয়োজন হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে একটি বিষয় আপনাকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, আর সেটা হল ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কখনোই ওষুধ পরিবর্তন করবেন না। যে কোন ধরনের ওষুধের কোন পরিবর্তন করাটা যদি আপনি জরুরী বলে মনে করে থাকেন তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে নিন। 

ক্ষুধামান্দ্য কি মানসিক সমস্যা?

বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যার কারণে ক্ষুধামন্দা হতে পারে। মানসিক চাপ বা বিষণ্ণতাকে ক্ষুধামন্দার অন্যতম কারণ বলা হয়ে থাকে। দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত মানুষ দুশ্চিন্তায় এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে সে খাবার খাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এছাড়া ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তিরা খাবার সহ সবকিছুর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

মানসিক চাপে থাকলে মানুষ ক্ষুধা অনুভব করেনা, এটাকে মানসিক চাপের শারীরিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে কিছু কিছু লোকের ক্ষেত্রে এটা বিপরীত, অর্থাৎ তার মানসিক চাপে থাকলে বেশি খায়। তবে সাধারণত আপনি যদি কোন ধরনের ক্লিনিকাল ডিপ্রেশনে ভুগে থাকেন তাহলে খাবারের প্রতি অনীহা দেখা যায়। 

আপনি যদি মানসিক ভাবে বিসাদ্গ্রস্ত হয়ে থাকেন এবং ক্ষুধামন্দায় ভুগেন তাহলে আপনার উচিত কোন মেন্টাল হেলথ স্পেশালিষ্ট এর সাথে যোগাযোগ করা এবং তার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করা। সাধারণত ডাক্তার আপনাকে পরীক্ষার পর আপনাকে ওষুধ প্রদানের পাশাপাশি কাউন্সিলিং করার পরামর্শ দিতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই কাউন্সিলিং করাতে হবে। 

কেননা মানসিক রোগ থেকে যে কোন ধরনের অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে অবহেলা একদমই কাম্য নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে শরীরের যেমন অসুখ রয়েছে এবং চিকিৎসার মাধ্যমে এটা ভালো হয়, ঠিক তেমনই মনেরও রোগ হতে পারে এবং সেটা চিকিৎসার মাধ্যমে ভালো করা সম্ভব।

 

পরিশেষে বলে যেতে পারে, ক্ষুধামান্দ্য সমস্যাটি যেমন শুনলে অনেকটাই সহজ মনে হতে পারে, তবে এর কোন সহজ সমাধান নেই। বরং পরিমিত খাবার গ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রমের দিকে যদি আমরা একটু নজর দেই তাহলে ৮০ ভাগ সময়ে এটা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। এছাড়া আমরা অনেকেই খাবার ঠিকমত চিবিয়ে খাই না, আর এই কারণে আমাদের খাবার হজমেও সমস্যা হতে পারে। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, খাবার গ্রহণের সময় একটু মনোযোগী হয়ে উঠলেই আর এই ধরনের সমস্যায় ভুগতে হবে না। 

এছাড়া বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে, আর তার মধ্যে একটি হল খাবার হজমের ক্ষমতা। এমতাবস্থায় আপনার কখনই হতাশ হওয়া চলবে না বরং আপনি এই ধরনের অবস্থার সাথে যত দ্রুত মানিয়ে নিয়ে নিজে খাদ্যাভ্যাসে সঠিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারবেন ততই আপনার জন্য মঙ্গল। 

Default user image

ইকবাল মাহমুদ ইকু, লেখক, আস্থা লাইফ

দীর্ঘদিন ধরেই লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ততার সুবাদে বেশ কিছু স্বনামধন্য অনলাইন পোর্টালে লেখালেখি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই লেখার প্রতি রয়েছে অদম্য অনুরাগ। এই লেখালেখিকেই নেশা এবং পেশা হিসেবে নেয়া আমার ইতোমধ্যেই চারটি উপন্যাস এবং একটি ছোট গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে। জন্ম থেকেই ঢাকায় বসবাসরত আমি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবেও পথ শিশুদের জীবন যাপনের মান উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে আসছি প্রায় ১২ বছর ধরে। বর্তমানে আস্থা লাইফের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতাকে জন সাধারণের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়ার একটি সুযোগ হিসেবে দেখছি। বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসি এবং অবসর সময়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর মুভি নিয়েই কাটে।

Related Articles