ডায়াবেটিস হলে কি কি সমস্যা হয়!

ডায়াবেটিসের আদি-অন্ত জানতে অবশ্যই লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন। ডায়াবেটিসের বিভিন্ন অবস্থায় করনীয়, ডায়াবেটিসের আগে কি করবেন এবং এটি আপনার জীবনকে কিভাবে প্রভাবিত করে তা আলোকপাত করেছি এইখানে।

 

বর্তমান বিশ্বে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে ৪২ কোটিতে দাঁড়িয়েছে যা ১৯৮০ সালে ছিলো ১২ কোটি এবং ১৮ বছর বয়স অথবা তার বেশি বয়স্কদের মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রবণতা বেড়েছে ৫.৫%। গবেষনায় দেখা গিয়েছে এই ডায়াবেটিস অন্ধত্ব, কিডনিতে সমস্যা, হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ। শুধু মাত্র ডায়বেটিসের কারণে ২০১৬ সালে প্রায় ১১ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং ২০১২ সালে ডায়বেটিস জনিত উচ্চ রক্তচাপ এবং রক্তে অধিক গ্লুকোজের কারণে প্রায় ২২ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। রক্তে স্বাভাবিকের থেকে বেশিমাত্রার গ্লুকোজের কারণে দায়ী প্রায় সব মৃত্যুর প্রায় অর্ধেকই ঘটে ৭০ বছর বয়সের আগে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর পরিসংখ্যানে ডায়াবেটিসকে ২০১৬ সালে মৃত্যুর সপ্তম প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয়েছে। আর ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফাউন্ডেশনের একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ কিন্তু তাদের ৫৭ শতাংশই জানেন না যে তাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, যার একমাত্র কারণ হলো ডায়বেটিস নিয়ে অজ্ঞতা এবং ডায়বেটিস কে গুরুত্ব না দেয়া। কিন্তু নিয়মিত স্বাস্থ্যকর ডায়েট, শারীরিক ব্যায়াম, শরীরের স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখলেই খুব সহজে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখা যায়। তাই আমাদের সবার উচিত ডায়বেটিস রোগ সম্পর্কে বেশি করে জানা

 

ডায়বেটিস কী?

ডায়াবেটিসের অন্য নাম বহুমূত্র রোগ যা দীর্ঘস্থায়ী এবং তখনই ঘটে যখন রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের থেকে অধিক হয়ে যায়। সাধারানত রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেড়ে গেলে তাকে ডায়বেটিস বলে। আমাদের শরীরের অগ্ন্যাশয় থেকে উৎপাদন হয় ইনসুলিন হরমোন যা আমাদের রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ (চিনি/শর্করা) কে নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই অগ্ন্যাশয় যদি পর্যাপ্ত ইনসুলিন উৎপাদন না করে অথবা শরীর যদি তার উৎপাদিত ইনসুলিন কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে না পারে তাহলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। 

ইনসুলিন সঠিক ভাবে উৎপাদিত না হলে অথবা কাজ না করলে দেহের কোষগুলো রক্ত থেকে গ্লুকোজ নিতে সক্ষম হয় না, ফলশ্রুতিতে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। । রক্তে গ্লুকজের মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেড়ে গেলে আমরা তাকে বলি হাইপারগ্লাইসেমিয়া যা ডায়াবেটিসের একটি সাধারণ প্রভাব। সময়ের সাথে সাথে দেহের অনেকগুলি সিস্টেমের বিশেষত স্নায়ু এবং রক্তনালীগুলির মারাত্মক ক্ষতি হয় এর কারণে।

 

গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা

রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার স্বাভাবিক মাত্রা দুই ভাবে পরিমাপ করা হয়ে থাকে, খাবার গ্রহণের আগে এবং খাবার গ্রহণের দুই ঘন্টা পরে। ডায়াবেটিস নেই এমন লোক অর্থাৎ একজন সুস্থ্য মানুষের জন্য রক্তে গ্লূকোজ বা শর্করার স্বাভাবিক মাত্রা হল, 

খাওয়ার আগে ৩.৫-৫.৫ মিলিমোল/লিটার এবং 

খাবার গ্রহণের দুই ঘণ্টা পরে ৮ মিলিমোল/লিটার 

রক্তে গ্লূকোজের মাত্রা 'স্বাভাবিকের' যত কাছাকাছি থাকবে তত ভাল এবং তত ডায়বেটিস হওয়ার সম্ভবনা কম। আর রক্তে যদি গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার থেকে বেড়ে যায় তখন আমরা তাকে বলি ডায়াবেটিস।

 

ডায়বেটিসের প্রকারভেদ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ডায়বেটিস নিয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে যাতে ডায়বেটিসকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী যে সকল ডায়বেটিস দেখা যায় সেগুলো হচ্ছে টাইপ ১ ডায়বেটিস, টাইপ ২ ডায়বেটিস এবং গর্ভাবস্থাজনিত ডায়াবেটিস।

টাইপ ১ ডায়াবেটিস

চিকিৎসা বিজ্ঞানে টাইপ ১ ডায়বেটিসকে ইনসুলিন নির্ভর ডায়াবেটিস বলা হয়ে থাকে কারণ এখানে রোগীর অগ্ন্যাশয় খুব অল্প পরিমাণে ইনসুলিন তৈরী করে যা গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রন করার জন্য যথেষ্ট নয়। অথবা রোগীর শরীরে ইনসুলিনই তৈরি হয় না কারণ তার অগ্ন্যাশয়ে ইনসুলিন তৈরি করার জন্য কার্যক্ষম কোষ নেই, যার ফলে রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ হয় না।

টাইপ ২ ডায়াবেটিস

এ ধরণের ডায়বেটিস ইনসুলিন নির্ভর হয় না অর্থাৎ ইনসুলিনের অক্ষমতা অথবা অগ্ন্যাশয়ের অক্ষমতার সাথে টাইপ ২ ডায়বেটিসের কোনো সম্পর্ক নেই। টাইপ ২ ডায়বেটিস হয় যদি আমাদের শরীর কার্যকরভাবে ইনসুলিন ব্যবহার করতে না পারে যাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলা হয়ে থাকে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। এই ক্ষেত্রে রোগীর শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন স্বাভাবিক থাকে কিন্তু ইনসুলিন নিজের কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। যার ফলে যতই ইনসুলিন উৎপন্ন হোক না কেনো, ইনসুলিন ঠিক ভাবে কাজ না করার কারণে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ হ্রাস পায় না এবং ধীরে ধীরে স্বাভাবিক মাত্রার থেকে বেড়ে যায়, তখন আমরা একে টাইপ ২ ডায়বেটিস বলে থাকি। এর লক্ষণগুলি সাধারণত কম প্রকাশ পায় যার ফলে ডায়বেটিস হওয়ার বেশ কয়েক বছর পরে রোগী বুঝতে পারে তার ডায়াবেটিস আছে কিন্তু ততদিনে এটি জটিল আকার ধারণ করে। এই ধরণের ডায়াবেটিস কেবলমাত্র বয়স্কদের মধ্যেই দেখা যায় তবে এটি এখন শিশুদের মধ্যেও প্রায়শই ক্রমবর্ধমান।

গর্ভাবস্থাকালীন ডায়বেটিস

বর্তমান সময়ে গর্ভাবস্থাকালীন ডায়বেটিস খুব বড় আকারে দেখা দিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ২০১৩ সালে প্রথমাবারের মত তাদের ডায়বেটিস সংক্রান্ত নীতিমালায় এটিকে স্থান দেয়। এই ধরণের ডায়বেটিস গর্ভাবস্থায় উৎপাদিত কিছু হরমোনের কারণে হয়ে থাকে, যে সকল হরমোন ইনসুলিনকে তার কাজে বাধাগ্রস্থ্য করে, ফলে মা হাইপারগ্লাইসেমিয়া বা ডায়বেটিসে আক্রান্ত হয়।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মহিলাদের গর্ভাবস্থায় এবং সন্তান প্রসবের সময় জটিলতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। যদি একজন মায়ের গর্ভাবস্থাকালীন ডায়বেটিস হয়ে থাকে তাহলে তার বাচ্চাদের ভবিষ্যতে টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশী থাকে। এমনকি মা নিজেও সন্তান জন্মদানের ৫-১০ বছরের মধ্যে টাইপ ২ ডায়বেটিসে আক্রান্ত হতে পারে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে ২০১৭ সালে আনুমানিক ২০ কোটি ৪০ লক্ষ মহিলা যাদের বয়স ২০-৭৯ বছরের মধ্যে তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন এবং ২০৪৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যাটি ৩০ কোটি ৮০ লক্ষ হতে পারে ধারণা করা হচ্ছে। আর এসব ডায়াবেটিসে আক্রান্ত প্রতি ৩ জন মহিলার মধ্যে ১ জনই গর্ভকালীন ডায়বেটিসে আক্রান্ত এবং গর্ভকালীন ডায়বেটিসে আক্রান্ত মায়ের প্রতি ৭ জনের ১ জন মায়ের সন্তান জন্মদানে সমস্যা হয়েছিল। 

সাধারণত লক্ষণ দেখে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সনাক্ত করা খুব কঠিন তাই এটি প্রসবকালীন স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে (গর্ভাবস্থাকালীন গর্ভধারণের সময় একটি শিশুর নির্দিষ্ট জন্মগত ত্রুটি রয়েছে কিনা তা নির্ধারণের জন্য একটি পদ্ধতির) নির্ণয় করা হয়।

প্রি-ডায়বেটিস

আরেক প্রকারের ডায়বেটিস আছে যাকে বলা হয় প্রি-ডায়বেটিস। যখন কিছু না খেয়ে রক্ত পরীক্ষা করলেও রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি দেখা যায় কিন্তু ডায়াবেটিসের মাত্রার চেয়ে কম দেখায় তখন তাকে বলে প্রি-ডায়াবেটিস। অনেক ক্ষেত্রেই খাবার গ্রহণের দুই ঘন্টা পরে একটি গ্লুকোজ টলারেন্স পরীক্ষা করা হয় নিশ্চিত হবার জন্য যে ডায়াবেটিসের লক্ষণ আসলেই আছে কিনা। এই পরীক্ষায় সাধারণত বেরিয়ে আসে যে, যাকে পরীক্ষা করা হয়েছে তার শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক রাখতে খুব সমস্যা হচ্ছে কিনা। যদি এটাতে প্রকাশিত হয় যে আপনার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক রাখতে সমস্যা হছে তাহলে বুঝবেন আপনি ভবিষ্যতে টাইপ ২ ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে আছেন। কিন্তু এতে দুষচিন্তার কোনো কারণ নেই, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে এই ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। 

 

ডায়বেটিসের লক্ষণ

ডায়বেটিস হলে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে নিম্নোক্ত লক্ষণ গুলো প্রকাশ পায়,

অতিরিক্ত পিপাসা লাগা এবং ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া

ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া ডায়াবেটিসের একটি অন্যতম লক্ষণ। ডায়বেটিসের ফলে রক্তে স্বাভাবিকের থেকে বেড়ে যাওয়া অতিরিক্ত শর্করা আমাদের কিডনি প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দিতে চায়। যার ফলে ঘন ঘন প্রস্রাব হয় এবং শরীরে পানির চাহিদা বাড়তে থাকে, ফলশ্রুতিতে পিপাসাও বাড়তে থাকে।

ক্ষুধা বেড়ে যাওয়া এবং ক্লান্তি ও অবসাদগ্রস্ত ভাব

অগ্ন্যাশয় যখন পর্যাপ্ত ইনসুলিন তৈরী করতে পারে না, তখন শরীর শর্করা বা গ্লুকোজ ধরে রাখতে পারে না। আমাদের শরীরে শর্করা শক্তি জোগাতে সাহায্য করে, তাই যখন শর্করার অভাব হয় তখন শরীরের শক্তি হ্রাস পেতে থাকে। তাই ক্যালরির চাহিদা বেড়ে যায়, যা অতিরিক্ত ক্ষুধার সৃষ্টি করে, যার ফলে ফলে শরীর দুর্বল, ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

মাত্রাতিরিক্ত ওজন হ্রাস

যদিও স্থূলতা ডায়বেটিসের অন্যতম একটি কারণ কিন্তু ডায়াবেটিসের সময় রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ রোগীর শরীরের ওজন হ্রাসেরও একটি উল্লেখযোগ্য কারণ এবং দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে রোগীর ওজন প্রায় ১০ থেকে ২০ পাউন্ড কমে যায়।

অসাড়তা

রক্তে স্বাভাবিকের থেকে অতিরিক্ত গ্লুকোজ রোগীর স্নায়ু দুর্বল করে ফেলে কারণ স্নায়ু যে সকল রক্তনালীর সাহায্যে পুষ্টি গ্রহণ করতো সেগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়, যার ফলে রক্তচাপ কমে যায় এবং রোগীর দুর্বলতা অনুভব হয়, মাথা ঘোরায়, ঝিমুনি ভাব আসে।

দৃষ্টি ঝাঁপসা হয়ে যাওয়া

ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর অন্যতম লক্ষণ হলো দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া এবং চোখে ঝাপসা দেখা। গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গেলে চোখের মণি স্ফীত হয়, রক্তনালী গুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং চোখের আকারের পরিবর্তন হয় তখন হঠাৎ করে চোখে ঝাঁপসা দেখার সমস্যা হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসাহীন থাকলে ডায়বেটিস রোগীকে অন্ধ করে দিতে পারে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া

ডায়াবেটিসের ফলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, যার ফলে সহজে কোনো রোগ নিরাময় হতে চায় না। মাঝেমাঝে খুব ছোট আকারের আঘাত থেকে ইনফেকশন বা ঘা এর জন্ম নিতে পারে। তাই ডায়বেটিস আক্রান্ত রোগীদের খুব সাবধানে চলাফেরা করা উচিত।

চামড়ায় শুষ্ক, খসখসে ও চুলকানি ভাব

আমাদের শরীর ৫০ থেকে ৭৮ ভাগ পানি থাকে। ঘন ঘন প্রস্রাব ও ঘাম হওয়ার ফলে শরীর শুষ্ক হয়ে পড়ে কারণ পানির পরিমাণ কমে যায়। যার প্রভাব পড়ে ত্বকের ওপর। তাই এ সময় চামড়ায় শুষ্ক, খসখসে এবং চুলকানি ভাব হতে পারে

এখন আপনি যদি উপরের উল্লিখিত লক্ষণ গুলোর মধ্যে কিছু অথবা সব নিজের মধ্যে দেখতে পান, তাহলে আপনাকে আর দেরী না করে অবশ্যই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে এবং রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ পরীক্ষা করে জেনে নিন আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কি না।

 

ডায়বেটিস শনাক্তকরণে করণীয়

রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে ডায়বেটিস নির্ণয় করা সম্ভব। রোগীর কী ধরণের ডায়াবেটিস রয়েছে আর তাতে তার কি কি হবে সেটা বিবেচনা করে রোগীর ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে এবং এর জন্য ডাক্তারের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করতে হবে। রোগীর একমাত্র মূল লক্ষ্য হবে রক্তের শর্করার পরিমাণকে স্বাভাবিকের সীমার মধ্যে বেঁধে রাখা। আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন (এডিএ) নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের ডায়াবেটিসের জন্য পরীক্ষা করা উচিত,

বডি মাস ইনডেক্স (BMI) ২৫ অথবা তার বেশী যে কেউ যার উচ্চ রক্তচাপ, অস্বাভাবিক কোলেস্টেরলের মাত্রা রয়েছে এবং পাশাপাশি অনিয়মিত জীবনধারা অনুসরণ করে, চিকিৎসকগণ মনে করেন সে ধীরে ধীরে ডায়াবেটিসের সাথে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সম্পর্ক স্থাপন করছে। তাই তার ডায়বেটিস পরীক্ষা করা জরুরী।

৪৫ বছর অথবা তার চেয়ে বেশি বয়স্ক যে কোনও ব্যক্তিকে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা প্রাথমিক ভাবে পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয় এবং তারপরে, ফলাফলগুলি যদি স্বাভাবিক হয় তবে প্রাথমিক পরীক্ষার পরে প্রতি তিন বছর পরপর পরীক্ষা করা উচিত।

যে মহিলাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়েছে, তাকে প্রতি তিন বছর অন্তর ডায়াবেটিসের জন্য পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।

প্রি-ডায়বেটিস ধরা পড়ে এমন যে কোনও ব্যক্তিকে প্রতি বছর পরীক্ষা করার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে।

 

রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি সমূহ

কোন ব্যক্তির টাইপ-১ অথবা টাইপ-২ অথবা প্রি ডায়বেটিস আছে কিনা তা নির্ণয় করার জন্য বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে এবং গর্ভকালীন ডায়বেটিস শনাক্তকরণে একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। 

ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট (OGTT)

ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট ডায়বেটিস নির্ণয় করার জন্য বিশ্ব স্বীকৃত পদ্ধতি।  এই পদ্ধতিতে রোগী খালি পেটে থাকাকালীন রক্তে শর্করার পরিমাণ পরিমাপ করা হয়। তারপরে রোগীকে  একটি চিনিযুক্ত তরল পান করতে দেওয়া হয় এবং রক্তের শর্করার মাত্রা দুই ঘন্টা পর আবার পরীক্ষা করা হয়।

খালি পেটে রক্তের শর্করার মাত্রা ১৪০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার (mg/dl) এর চেয়ে কম এবং দুই ঘন্টা পরে ২০০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার  অথবা তার বেশী ডায়াবেটিস নির্দেশ করে। ১৪০-১৯০ মিলিগ্রাম/ডেসিলিটার প্রি-ডায়বেটিস নির্দেশ করে।

রেন্ডম ব্লাড সুগার (RBS)

রেন্ডম ব্লাড সুগার (RBS) পরীক্ষা করে গ্লুকোজের মাত্রা ১১.১ মিলিমোল/লিটার (mmol/l) অথবা তার বেশী পাওয়া গেলে ধারণা করা হয় তার ডায়াবেটিস আছে। যদি গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক অর্থাৎ ৫- ১১.১ মিলিমোল/লিটার (mmol/l) এর মধ্যে থাকে, পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য OGTT পরীক্ষা করতে হবে।

ফাস্টিং ব্লাড সুগার (FBS)

ফাস্টিং ব্লাড সুগার (FBS) পরীক্ষা RBS এর চেয়ে অনেক বেশী কার্যকরী। কারো রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা সকালে খালি পেটে ৭.০ মিলিমোল/লিটার বা তার বেশী হলে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় ডায়াবেটিস হয়েছে এবং যদি ৬.১-৬.৯ মিলিমোল/লিটার ভিতরে থাকে তাহলে বুঝতে হবে ব্যাক্তির ডায়াবেটিস হয়নি কিন্তু হওয়ার পথে রয়েছে।

গ্লাইকেটেড হিমোগ্লোবিন এ১ সি (HbA1c) পরীক্ষা

এটি একটি রক্ত পরীক্ষা, যার জন্য খালি পেটের প্রয়োজন হয় না। এই পরীক্ষা গত দুই থেকে তিন মাস ধরে আপনার রক্তে গড় শর্করার মাত্রা নির্দেশ করে। এটি নির্দেশ করে রক্তের শতকরা কত ভাগ শর্করা হিমোগ্লোবিনের সাথে সংযুক্ত হয়।

আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা যত বেশি হবে আপনার শর্করাও  তত বেশি হিমোগ্লোবিন এর সাথে লাগবে। দুটি পৃথক পরীক্ষায় যদি হিমোগ্লোবিন এ১ সি এর মাত্রা ৬.৫ শতাংশ বা তারও বেশি হয় তবে আপনার ডায়াবেটিস রয়েছে। ৫.৭ থেকে .৪.৮ শতাংশের মধ্যে থাকলে তা প্রিডিবিটিস নির্দেশ করে। ৫.৭ শতাংশের নিচে থাকলে তার ডায়াবেটিস নেই বলে বিবেচিত হয়।

গর্ভকালীন ডায়বেটিস শনাক্তকরণ

গর্ভকালীন মায়েদের ডায়াবেটিস আছে কিনা তা জানার জন্য জিসিটি (GCT) নামে একটি পরীক্ষা পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতিতে দিনের যে কোন সময়ে (খালি বা ভরা পেট যে কোন ভাবে) গর্ভকালীন সময়ে মা’কে ৫০ গ্রাম গ্লুকোজের শরবত খাওয়ানোর ১ ঘণ্টা পরে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। যদি  গ্লুকোজের মাত্রা ৭.৮ মিলিমোল/লিটার বা তার চেয়ে বেশী হলে তাকে জিসিটি পজিটিভ হিসেবে ধরে নিতে হবে। GCT পজিটিভ হলে অবশ্যই ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স পরীক্ষা করতে হবে।

 

ডায়বেটিস ঝুঁকির কারণ

গবেষকরা পুরোপুরি নিশ্চিত না যে কিছু লোক কেন ডায়াবেটিস বিকাশ লাভ করে এবং অন্যরা তা করে না। এটি স্পষ্ট যে নির্দিষ্ট কারণগুলি ঝুঁকি বাড়ায়।

বংশগত কারণ

আপনার পিতামাতা বা ভাইবোনদের ডায়াবেটিস থাকলে আপনার ডায়বেটিসের ঝুঁকি বাড়বে।

পরিবেশগত কারণ

ভাইরাল অসুস্থতার সংস্পর্শের মতো পরিস্থিতিগুলি টাইপ ১ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

অতিরক্ত ওজন

আপনার যত বেশি ফ্যাটি টিস্যু রয়েছে, আপনার কোষগুলি তত ইনসুলিনের প্রতি প্রতিরোধক হয়ে উঠবে। তাই অতিরিক্ত শারীরিক ওজন যত বেশী হবে আপনার ডায়বেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তত বেড়ে যাবে।

অলসতা

আপনি যত কম পরিশ্রম করবেন, আপনার ডায়বেটিসের ঝুঁকি তত বেশি। শারীরিক পরিশ্রম আপনাকে আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, পরিশ্রমের সময় শক্তি হিসাবে গ্লুকোজ ব্যবহার করে এবং আপনার কোষগুলিকে ইনসুলিনের প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তোলে, যার ফলে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রন থাকে।

বয়স

আপনার বয়স বাড়ার সাথে সাথে আপনার ডায়বেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে কারণ আপনার বয়সের সাথেসাথে কাজ করার ক্ষমতা কমতে থাকে এবং শরীরের ওজন বেড়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। তবে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের প্রবণতা এখন শিশু, কিশোর এবং কম বয়স্কদের মধ্যেও বাড়ছে।

উচ্চ রক্তচাপ

১২০/৮০ মিলিমোল/মার্কারি (mm/Hg) কে রক্তচাপের সাধারণ মাত্রা ধরা হয়ে থাকে। রক্ত চাপ ১৪০/৯০ মিলিমোল/মার্কারি এর বেশি থাকা মানে আপনি ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন।

অস্বাভাবিক কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা: আপনার যদি উচ্চ-ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন (এইচডিএল) বা "ভাল" কোলেস্টেরল কম থাকে তবে আপনার টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেশি থাকে। উচ্চ মাত্রায় ট্রাইগ্লিসারাইডযুক্ত লোকেরা সবসময় টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে থাকেন কারণ এতে রক্তে চর্বি বেড়ে যায়।

গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস

আপনি যদি গর্ভবতী হওয়ার সময় গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বিকাশ লাভ করেন তবে আপনার প্রি-ডায়াবেটিস এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি পরে বাড়ে। যদি আপনি ৯ পাউন্ড (৪ কেজি) এর বেশী ওজনের শিশু জন্ম দেন তবে আপনার টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও রয়েছে।

 

ডায়াবেটিস হলে কি কি সমস্যা হয়!

দীর্ঘমেয়াদী ডায়বেটিসের কারণে রোগীর বিভিন্ন ধরণের জটিলতা দেখা দিতে পারে, ডায়বেটিসের পাশাপাশি হৃদরোগ, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়া, কিডনিতে সমস্যা, কম শুনতে পাওয়া ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। নিচে দীর্ঘমেয়াদী ডায়বেটিসের কারণে সৃষ্টি হওয়া কিছু জটিলতা তুলে ধরা হলো।

হৃদরোগ

ডায়বেটিস হলে বিভিন্ন ধরণের হৃদরোগ যেমন বুকে ব্যাথা, হার্ট অ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদির ঝুঁকি বেড়ে যায়।

স্নায়ু দুর্বলতা

অতিমাত্রার গ্লুকোজ ক্ষুদ্র রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এই ক্ষুদ্র রক্তনালীর সাহায্যে আপনার স্নায়ুকোষ পুষ্টি লাভ করত, তাই ডায়বেটিসের কারণে রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় স্নায়ু কোষ দুর্বল হয়ে পড়ে। যার ফলে আপনার স্মৃতি শক্তি হ্রাস পেতে পারে, কোনো কোনো অঙ্গে অসারতা অনুভব করতে পারেন যেমন হাত, পা, আঙ্গুল ইত্যাদি।

কিডনি সমস্যা

কিডনিতে রয়েছে লক্ষাধিক ক্ষুদ্র রক্তনালী বা কৈশিক জালিকা যা রক্তকে পরিশোধন করে। ডায়বেটিসের কারণে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এই রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং পরিশোধনে বাধা সৃষ্টি হয়। তখন রোগীর কিডনি জনিত বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে।

দৃষ্টি শক্তি হ্রাস পাওয়া

ডায়বেটিসের কারণে রেটিনার রক্তনালীগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাই রোগীর দৃষ্টি শক্তি কমে যেতে পারে এমনকি অন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। তাছাড়া অন্যান্য চোখের জটিলতা যেমন গ্লুকোমা এবং চোখে ছানি পড়া হতে পারে ডায়বেটিসের কারণে।

পা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া

ডায়বেটিসের কারণে স্নায়ু দুর্বল হয়ে যায় এবং এটি শুরু হয় শরীরের নিম্নাঙ্গ থেকে অর্থাৎ পা থেকে। পায়ের স্নায়ু গুলো ক্ষতিগ্রস্থ হলে রোগী কোনো অনুভুতি পায় না, যার ফলে ছোট কিছুতে কেটে যাওয়া জায়গা থেকে বড় ঘা তৈরী হতে পারে। এমনকি পা কেটে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে।

গর্ভকালীন জটিলতা

গর্ভকালীন ডায়বেটিসের কারণে বাচ্চার আকার মায়ের গর্ভে অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যেতে পারে যাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলা হয় ম্যাক্রোসোমিয়া। রক্তে থাকা অতিরিক্ত গ্লুকোজ খুব সহজে অমরা (প্লাসেন্টা) অতিক্রম করতে পারে যা বাচ্চার অগ্ন্যাশয়ে অতিরিক্ত ইনসুলিন উৎপাদন করার সংকেত পাঠায়, যার কারণে বাচ্চারা অস্বাভাবিক হয়ে যায়। তাছাড়া ডায়বেটিসের কারণে বাচ্চা গর্ভের ভেতর অথবা ভুমিষ্ট হওয়ার পর মারা যেতে পারে অথবা টাইপ ২ ডায়বেটিসে আক্রান্ত হতে পারে।

 

ডায়বেটিসের চিকিৎসা

ডায়বেটিস মূলত নিয়ন্ত্রনে রাখতে হয় জীবনযাত্রা পরিবর্তন করার মাধ্যমে কিন্তু যাদের ডায়বেটিসের মাত্রা আশংকাজনক তাদের জন্য রয়েছে চিকিৎসা। ডায়বেটিসের মাত্রা এবং রোগীর ধরণ অনুসারে বিভিন্ন ধরনের ঔষধ রয়েছে। 

ইনসুলিন

সাধারণত টাইপ ১ এবং কিছু ক্ষেত্রে টাইপ ২ ডায়বেটিস রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখার জন্য ইনসুলিন দরকার হয়। কারণ তাদের শরীরে প্যানক্রিয়াস থেকে উৎপাদিত ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা লোপ পায়, যার ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ অনেক বেশী থাকে যা অনেক ক্ষেত্রেই আশংকাজনক। বিভিন্ন ধরনের ইনসুলিন পাওয়া যায় এবং তাদের শ্রেণীবিন্যাস করা হয় তাদের কার্যকারিতা এবং তাদের প্রভাব কতক্ষণ পর্যন্ত স্থায়ী হয় তার উপর ভিত্তি করে। 

দ্রুত কার্যকরী ইনসুলিন ১৫ মিনিটের মধ্যে কাজ শুরু করে এবং এর প্রভাব ৩ থেকে ৪ ঘন্টা অবধি স্থায়ী হয়।

সংক্ষিপ্ত কার্যকরী ইনসুলিন ৩০ মিনিটের মধ্যে কাজ শুরু করে এবং ৬ থেকে ৮ ঘন্টা অবধি স্থায়ী হয়।

মধ্যম কার্যকরী ইনসুলিন ১ থেকে ২ ঘন্টার মধ্যে কাজ শুরু করে এবং ১২ থেকে ১৮ ঘন্টা স্থায়ী হয়।

দীর্ঘ কার্যকরী ইনসুলিন ইনজেকশন দেওয়ার কয়েক ঘন্টা পরে কাজ শুরু করে ২৪ ঘন্টা বা তার বেশি সময় ধরে স্থায়ী হয় ।

বিভিন্ন ধরণের ওরাল হাইপোগ্লাইসেমিক  ড্রাগ

ওরাল হাইপোগ্লাইসেমিক ড্রাগগুলি কেবল টাইপ ২ ডায়াবেটিসের চিকিত্সায় ব্যবহৃত হয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত গর্ভবতীদের চিকিত্সার জন্য এগুলি অনুমোদিত হয় না।

বাইগোয়ানাইডস: টাইপ ২ ডায়বেটিসের রোগীদের চিকিৎসকগণ বেশীরভাগ সময় বাইগোয়ানাইডস দিয়ে থাকেন। বাইগোয়ানাইডস গ্রুপের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে  মেটফরমিন যা রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমানোর পাশাপাশি শরীরে উৎপন্ন ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। ডায়বেটিস রোগীদের একটি বড় সমস্যা হলো স্থূলতা অর্থাৎ অতিরিক্ত ওজন। মেটফরমিন শরীরের ওজন হ্রাসেও ভূমিকা রাখে, যার ফলে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রনে থাকে।

সালফোনাইল ইউরিয়াস: সালফোনাইল ইউরিয়াস প্যানক্রিয়াসে ইনসুলিন উৎপাদনের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় যার ফলে শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এই ইনসুলিন পরবর্তীতে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। এই ঔষধ গুলো খুব দ্রুত রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমিয়ে দেয় যার ফলে কিছুকিছু ক্ষেত্রে গ্লুকোজের পরিমাণ অতিরিক্ত কমে যেতে পারে। তখন রোগীর দুর্বলতা অনুভব হতে পারে। তাই এই ঔষধ নেওয়ার আগে রোগীকে একটু সচেতন থাকতে হবে এবং নিয়মিত রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ পরীক্ষা করতে হবে। সালফোনাইল ইউরিয়াস গ্রুপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গ্লিপিজাইড এবং গ্লাইমেপিরাইড।

আলফা-গ্লুকোসিডেস ইনহিবিটর: রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায় সাধারণত আমাদের খাবারের সাথে থাকা শর্করার কারণে। আমরা যখন খাবার খাই তখন খাবারে থাকা শর্করার পলিমার শরীরের ভেতর একধরনের এনজাইমের সাহায্যে ভেঙে ছোটছোট শর্করায় পরিণত হয়ে রক্তে চলে যায়। আলফা-গ্লুকোসিডেস ইনহিবিটর সেই এনজাইমকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। যার ফলে খাবার থেকে শর্করার ভাঙনের পরিমাণ কমে যায় এবং রক্তেও শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রনে থাকে। আলফা-গ্লুকোসিডেস ইনহিবিটর গ্রুপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একারবোজ এবং মিগ্লিটল।

থায়াজলিডিনেডায়োনস: এই গ্রুপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রোসিগ্লিটাযোন এবং পিওগ্লিটাযোন। এই ট্যাবলেট গুলি ইনসুলিনের প্রতি কোষের সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে কম ইনসুলিন উৎপন্ন হলেও সেটা খুব কার্যকরী হয় এবং রক্তের অতিরিক্ত গ্লুকোজ আমাদের শরীরের কোষগুলোতে পাঠিয়ে দেয় কারন গ্লুকোজ পরিবহনকারী বৃদ্ধি পায়। কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে রোগীর শরীরের ওজন বৃদ্ধি পেতে পারে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি থাকতে পারে। তাই অবশ্যই যেকোনো ঔষধ নেওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

ডিপিপি-৪ ইনহিবিটর বা গ্লিপ্টিন: গ্লিপটিন জাতীয় ট্যাবলেট গুলি ডিপিপি-৪ এনজাইমকে প্রতিরোধ করে রক্তের গ্লুকোজকে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে আপনার রক্তে শর্করাকে খুব কমিয়ে না দিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখে। লিনাগ্লিপটিন এবং সিটগ্লিপটিন হচ্ছে ডিপিপি -৪ ইনহিবিটর গ্রুপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ট্যাবলেট।

অগ্ন্যাশয় প্রতিস্থাপন

কিছু রোগীর মধ্যে যাদের টাইপ ১ ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের অগ্ন্যাশয় প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। কারণ টাইপ ১ ডায়বেটিস ইনসুলিন নির্ভর ডায়বেটিস এবং অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনে অক্ষমতা এর প্রধান কারণ। একটি সফল অগ্ন্যাশয় প্রতিস্থাপনের সাহায্যে রোগীর আর ইনসুলিন থেরাপির প্রয়োজন হবে না।

দ্রুত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করার ৬টি  উপায়!

ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের নানা উপায় শেখানোর মাধ্যমে আক্রান্ত রোগীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় ১১ই এপ্রিল, ২০১৯ এ একটি 'ডায়াবেটিস মেলা' আয়োজন করেছিলো কংগ্রেসিয়া নামের একটি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান। এই মেলার কার্যকরী পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক ডা মোঃ. ফজলে রাব্বী খান বলছেন, ডায়াবেটিস একবার আক্রান্ত হলে তা চিকিৎসায় পুরোপুরি নিরাময় করা যায় না। এটি তেমন রোগ নয়। কিন্তু সেটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আর নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়। তাই আমাদের জানতে হবে কিভাবে নিয়ন্ত্রন করা যাবে এই ডায়বেটিস। চিকিৎসকদের মতে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখতে আপনাকে কয়েকটি বিষয় গুলো মেনে চলতে হবে।

খাদ্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে

ডায়বেটিস আক্রান্ত রোগীদের খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে সচেতন থাকা বাধ্যতামূলক । কতটুকু খাদ্য গ্রহণ তার জন্য নিরাপদ সেটি আক্রান্ত ব্যক্তিকে বুঝতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য আলাদাভাবে সুষম খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। খাওয়ার পরিমাণটা আক্রান্ত ব্যাক্তি প্রাথমিকভাবে বুঝে উঠতে পারে না। সেটি যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে তত তাড়াতাড়ি রোগ নিয়ন্ত্রণে আসবে। ডায়াবেটিস রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে দীর্ঘদিন সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব বলে চিকিৎসকরা মনে করে থাকেন।

আমাদের মাঝে একটি ভুল ধারণা হল ডায়াবেটিস হলে মিষ্টি খাওয়া যাবে না। আপনি অবশ্যই মিষ্টি খেতে পারবেন কিন্তু অবশ্যই পরিমিত হতে হবে। এক বসায় এক কেজি খেয়ে ফেললেই হবে না, তখন ডায়বেটিস বাড়বে উল্টো। তাছাড়া মিষ্টিতে যেমন গ্লুকোজ আছে, ভাতেও কিন্তু সেটি আছে এবং অন্য আরও অনেক খাবারেও রয়েছে কিন্তু মিষ্টিতে গ্লুকোজের পরিমাণ বেশি সেটিই হল সমস্যা। তাই মিষ্টি অবশ্যই খাওয়া যাবে কিন্তু অল্প পরিমাণে। আপনি যদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তখন সব ধরণের খাবারই খেতে পারবেন।

কায়িক পরিশ্রম করতে হবে

সঠিক নিয়মে খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি আপনাকে করতে হবে কায়িক পরিশ্রম। শুধু খেলেন আর বসে থাকলে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে আসবে না। অবশ্যই আপনাকে প্রতিদিন শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। যেকোন ধরণের শারীরিক শ্রম হতে পারে। দিনে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট অবশ্যই কায়িক পরিশ্রম করা উচিত। আপনি যদি নিয়মিত হাটতে পারেন তাহলে আপনার শারীরিক শ্রমের কাজ হয়ে যাবে। তাই চিকিৎসকগণ রোগীদের নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

জীবনাচরণ পরিবর্তন আনতে হবে

আপনি কি খাচ্ছেন আর কতটা শারীরিত পরিশ্রম করছেন সব কিছুই আপনার জীবনাচরণের অংশ। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত আপনার কতটুকু পরিশ্রম করা উচিত, কী কী খাবার খাওয়া উচিত, কতটুকু খাওয়া উচিত, দিনে কয় বার খাওয়া উচিত, ইত্যাদি সবকিছুই আপনার জীবনাচরণের অংশ। আর এসবের পাশাপাশি আপনাকে অবশ্যই শরীরের ওজন কমিয়ে রাখতে হবে, ধূমপান পরিহার করতে হবে। ধূমপান ফুসফুস ক্যান্সার এর মতো ভয়ঙ্কর রোগের পাশাপাশি ডায়াবেটিসেরও একটি অন্যতম কারণ। সুতরাং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে না চাইলে আজই ধূমপান ছেড়ে দিন।

কফি পান করুন

দেশে বিদেশে বেশ কিছু গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রতিদিন কমপক্ষে দুই কাপ কফি পান করলে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি প্রায় ২৯% কমে আসে। তবে অবশ্যই আপনাকে চিনি ছাড়া কফি পান করতে হবে।

ফাস্টফুড এড়িয়ে চলুন

আজকাল নানা ধরনের ফাস্টফুড চাইলেই হাতের কাছে পাওয়া যায়, যা দেখে অনেকের কাছে লোভ সামলানো কষ্টকর হয়ে যায়। কিন্তু এসব প্রক্রিয়াজাত খাবার খেলে আপনার স্থূলতা, উচ্চ কোলেস্টেরল, হজমে সমস্যা এবং হৃদরোগের মতো নানা রোগ দেখা দিতে পারে। এসব খাবার দেহে ইনসুলিন তৈরীতে এবং ইনসুলিনের কাজে ব্যাঘাত ঘটায়, যা থেকে ডায়াবেটিসও হতে পারে।

স্ট্রেস বা মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকুন

অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে আপনার যেকোনো কিছুই হতে পারে। মাথা ব্যথা থেকে শুরু করে ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগও হতে পারে এই মানসিক চাপ থেকে। তাই যদি আপনি মনে করেন আপনি প্রায়ই তীব্র মানসিক চাপে থাকেন তাহলে রিল্যাক্স করার নানা কৌশল এবং যোগ ব্যায়াম করে মানসিক চাপ কমিয়ে ফেলুন। এতে আপনার দেহে হরমোনের মাত্রাও নিয়ন্ত্রণে থাকবেই আপনার রক্ত সঞ্চালন ভালো হবে এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমবে।

সুতরাং জীবনাচরণের সামান্য পরিবর্তন আর চিকিৎসকের পরামর্শমতো চললে আমরা এই ডায়াবেটিস নিয়েও পরিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারি।

Default user image

মোঃ ইকবাল হোসেন নয়ন, লেখক, আস্থা লাইফ

লিখতে পছন্দ করেন। সাধারণত তিনি তার কল্পনা থেকে কবিতা, রম্যরচনা এবং বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলি সম্পর্কে লেখালেখি করে থাকেন। তার পছন্দের একটি কাজ ব্লগে লেখা এবং অতীতে তার লেখা কিছু অনলাইন ভিত্তিক ম্যাগাজিনে প্রকাশ হয়েছে। তিনি এখন ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় এর ফার্মাসি বিভাগে স্নাতকোত্তর এ অধ্যয়নরত আছেন। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার স্নাতক শেষ করেছেন। ফার্মাসি বিভাগের শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত লেখায় তাঁর আগ্রহ এখন প্রবল। তিনি অবসর সময়ে গান শুনতে এবং বই পড়তে পছন্দ করেন। সাধারণত লেখার প্রতি তাঁর আগ্রহ বই এবং ব্লগ পড়া থেকে আসে। তাঁর প্রিয় বইগুলির মধ্যে রয়েছে ভ্রমণকাহিনী, কিছু কবিতার বই এবং সায়েন্সফিকশন যা তাকে তাঁর কল্পনার জগতে প্রবেশ করতে সহায়তা করে। লেখালেখি করার জন্য তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হলো সোশ্যাল সাইটগুলি, যেখানে সে নিজের লেখা লিখতে পারে।

Related Articles