অতিরিক্ত ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিন কীভাবে ক্ষীণদৃষ্টি বা মায়োপিয়ার জন্য দায়ী

চশমার পাওয়ার বেড়েই চলছে! বেশিক্ষন ফোন ও কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকালে চোখ খারাপ হয়ে যাচ্ছে? আপনি তাহলে মায়োপিয়া বা হ্রস্বদৃষ্টি জনিত রোগে ভুগতে পারেন।

  • একবিংশ শতাব্দিতে দূরে ঝাপসা দেখা বা মায়োপিয়া রোগটি ব্যাপক হারে লক্ষ করা যাচ্ছে।

  • জনসংখ্যার অন্তত এক চতুর্থাংশ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

  • এতো লোক আক্রান্ত হলেও এই রোগটি নিয়ে সাধারণ মানুষের জ্ঞান নেই বললেই চলে। 

যে কোন প্রদত্ত সময়ে জনমানুষের মধ্যে একটু খেয়াল করলে দেখবেন, প্রায় অনেক মানুষ চশমা ব্যবহার করেন। কম বয়সীদের ভেতর এ হার আশঙ্কাজনক ভাবে বেশি। দৃষ্টির দুর্বলতা জনিত রোগের ভেতর মায়োপিয়া বা দূরে কম দেখতে পারার সমস্যাটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। একবিংশ শতাব্দিতে গোটা পৃথিবীর জনসংখ্যার ভেতর মায়োপিয়া জনিত সমস্যা খুব তাড়াতাড়ি বেড়েছে।

আমেরিকার একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ১৯৭০ এর দিকে ২৫% শিশু মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হতো, ২০০০ সালের পর তা ৪২% পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশ সহ গোটা বিশ্বেই সমস্যাটির যে একই রকম তা মোটামুটি নিশ্চিত ভাবেই ধারণা করা যায়।

তবে কি প্রযুক্তির সাথে মায়োপিয়ার কোন সম্পর্ক আছে? মোবাইল, কম্পিউটারের স্ক্রিন কি আমাদের স্বাভাবিক দৃষ্টির ক্ষতি করছে? টিভি বা মোবাইলের আলো আমাদের চোখের উপর কেমন প্রভাব ফেলে? সে সব উত্তর জানার আগে চলুন মায়োপিয়া সম্পর্কে সংক্ষেপে জানা যাক।

মায়োপিয়া কি বা ক্ষীণদৃষ্টি কি?

Myopia একটি গ্রীক শব্দ যার অর্থ দৃষ্টিক্ষীনতা। দূরে ঝাপসা দেখার রোগটিকেই মূলত মায়োপিয়া বলা হয়। মানুষের চোখ অনেকটা ক্যামেরার মত কাজ করে। বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে কর্ণিয়া ও লেন্সে হয়ে আলো একটি বিন্দুতে মিলিত হয়। মূলত রেটিনা উপর আলোক রশ্নি গুলোর কেন্দ্র মিলিত হয়ে থাকে।

রেটিনাতে থাকে আলোক সংবেদী কোষ যা, মস্তিষ্কে তথ্য পাঠিয়ে আমাদের দেখতে সহায়তা করে। কিন্তু যখন কর্ণিয়া ও লেন্স এর স্থান পরিবর্তন, বিকৃতি, ক্ষয় বা চোখের আকৃতির পরিবর্তন ঘটে, তখন আলোক রশ্নি মিলিত হওয়ার কেন্দ্রবিন্দু রেটিনার সামনে চলে, যার ফলে দূরের বস্তু ঝাপসা ভাবে দেখা যায়।

আমরা চাইলে চোখের পেশি সংকোচন বা প্রসারণ করে কাছে বা দূরে লক্ষ (ফোকাস) করতে পারি। আলো মিলিত হওয়ার কেন্দ্র রেটিনার সামনে চলে আসলে কাছে দেখতে চোখের পেশির সংকোচনের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু পেশি প্রসারণ করেও দূরে স্পষ্ট দেখতে সমস্যা হয়।

কি কি কারণে মায়োপিয়া হয়ে থাকে?

মায়োপিয়া বা দৃষ্টিক্ষীনতার মূল কারণ গুলো খেয়াল করুন,

কর্ণিয়ার আকৃতি বদলে যাওয়া

কর্ণিয়া হলো আমাদের চোখের সবচেয়ে উপরের অংশ। এই অংশের একটা নির্দিষ্ট আকার রয়েছে। কর্ণিয়ার সামান্য পরিবর্তনও আলোর প্রতিস্বরণ অনেকখানি বদলে দেয়।

লেন্স তার জায়গা থেকে সরে যাওয়া

কর্ণিয়ার নিচে থাকে লেন্সের অবস্থান। আমাদের চোখের লেন্সও আলোক রশ্নি কেন্দ্রীভূত করার কাজ করে। কিন্তু এটি সরে গেলে বা মোটা হয়ে গেলে মায়োপিয়া হয়ে থাকে।

চোখ লম্বাটে হয়ে যাওয়া

এটি শিশুদের মায়োপিয়া হওয়ার একটি মূল কারণ। চোখ লম্বাটে হয়ে গেলে রেটিনার সঠিক অবস্থান এর থেকে সামনে সরে আসবে।

জিনগত ভাবে প্রাপ্ত

বাবা-মায়ের একজনের মায়োপিয়া থাকলে সন্তানের মায়োপিয়া হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। দুজনেরই মায়োপিয়া থাকলে সম্ভাবনা আরো বেড়ে যায়।

পরিবেশগত কারণে

দূষণ ও পরিবেশগত কারণে ক্ষীনদৃষ্টির সমস্যা দেখা দিতে পারে

জীবনপদ্ধতি ও খাদ্যাভ্যাস জনিত কারণে

ছোট বয়সে বাড়তি শিশুদের যথেষ্ট পুষ্টির অভাবে চোখ ঠিক ভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না। এর কারণে মায়োপিয়া হতে পারে। মায়োপিয়ার হার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সাথে সাথে বেড়ে যাচ্ছে কিনা এটি নিয়ে বেশ অনেক গবেষণা হয়েছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রবন্ধটির পরবর্তি অংশে জানব।

কিভাবে বুঝবেন মায়োপিয়া হয়েছে?

রাস্তায় সাইনবোর্ড পড়তে সমস্যা হওয়া, ক্লাসে পেছন থেকে চোখ দেখতে না পাওয়া বা এমন দূর দৃষ্টি সংক্রান্ত সমস্যা হলে বোঝা যায় মায়োপিয়া হয়েছে। মায়োপিয়া হলে,

  • দূরে স্পষ্ট দেখতে চোখ ছোট করতে হয়

  • মাথাব্যাথা করে

  • চোখ টনটন করে ইত্যাদি।

কম্পিউটার-টিভি স্ক্রিন কি মায়োপিয়া বাড়ায়?

পূর্বে উল্লেখ করেছি গত শতাব্দিতে যে পরিমান মানুষের মায়োপিয়া হতো এ শতাব্দিতে তার দ্বিগুন সংখ্যক মানুষ মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এর সাথে কি টিভি সহ অন্যান্য ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিনের কোন সম্পর্ক আছে? ব্যাপারটা বেশ মজার। খেয়াল করুন।

ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিনের সাথে চোখের দূরে দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা কমে যায় না। তাই আপনি কি দিনের কি পরিমান সময় কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকছেন তার সাথে আপনার চোখ খারাপ হওয়ার খুব বেশি সম্পর্ক নেই।

মায়োপিয়া বেড়ে যাওয়ার মূল ব্যাপারটা লুকিয়ে থাকে আমাদের শৈশবে। জন্মের পর মানুষের চোখ একটু ছোট কিন্তু চ্যাপটা আকৃতার হয়ে থাকে। বয়সের সাথে সাথে তা সঠিক ভাবে গোলাকার আকৃতি ধারণ করে। চোখ তার সঠিক আকারে আসতে জন্ম থেকে প্রায় ৬ বছর সময় নেয়। তারপর মস্তিষ্ক থেকে এমন একটি এনজাইম রিলিজ হয় যা চোখকে বার্তা দেয় যে, চোখ সঠিক আকৃতিতে আছে, আর বড় হবার দরকার নেই। বার্তা পাওয়ার পর চোখ বড় হওয়া বন্ধ করে দেয়।

কিন্তু যে এনজাইম চোখকে এ বার্তা দেয় সেটি সঠিকভাবে রিলিজ হওয়ার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত সূর্যের আলো ও শারিরীক ভাবে সক্রিয় থাকা। 

দুঃখজনক হলেও সত্য আজকালকার পিতা-মাতা অনেকটা ভালোবেসেই বাচ্চার গায়ে রোদ লাগাতে দেন না। তাছাড়া শিশুদের সারাদির ঘরে বন্দি থাকা, খেলার মাঠের অভাব, কার্টুন বা ইন্টারনেট এডিকশন তাদের সূর্যের আলো ও শারিরীক সক্রিয়তা থেকে দূরে নিয়ে যায়। ফলে সঠিক সময়ে তাদের চোখের বৃদ্ধি বন্ধ হতে পারে না। যার ফলে দূরের জিনিস দেখতে সমস্যা তৈরি হয়।

অতএব, মায়োপিয়ার সাথে ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিন এডিকশনের সরাসরি যোগাযোগ নেই। অবশ্য টিভি দেখার কারণে যদি শিশুরা রোদে না বের হয়, সেটির দায় পরোক্ষভাবে হলেও মোবাইল-টিভির উপর পড়ে।

চশমার পাওয়ার কেন ঘন ঘন বেড়ে যায়?

মায়োপিয়ায় আক্রান্ত হলে চশমা ব্যাবহার একটি সহজ সমাধান। কিন্তু চশমার পাওয়ার ঘন ঘন বেড়ে যাওয়ার বেশ হতাশাজনক। আপনার সাথে যদি এমনটি হয়ে থাকে, হতে পারে আপনার বয়স ২০ এর কম। মোটামুটি ২০ বছর বয়সের পর থেকেই মায়োপিয়া সাধারণত বৃদ্ধি হতে দেখা যায় না। ২০ এর আগে দেখা যায় চশমা নেওয়ার কিছু মাস পর আবার সামান্য ঝাপসা দেখা শুরু হয়। আস্তে আস্তে দূরের জিনিস আরো ঝাপসা হতে থাকে। এমন অবস্থায় চোখ পরীক্ষা করে বেশি পাওয়ারের চশমা ব্যাবহার করার প্রয়োজন পড়ে। এভাবে পুনরাবৃত্তি হওয়াটা সাধারণ। কিন্তু ২০-২২ বছর পার হলে সাধারণত চোখ আর খারাপ হয় না।

ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিন এর ক্ষতিকর প্রভাব দূর করতে করণীয়

পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, সাধারণত ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিনের কারণে মায়োপিয়া হয় না। কিন্তু মায়োপিয়া বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ২০ এর আগে চশমার পাওয়ার বাড়া স্বাভাবিক, কিন্তু খুব বেশি ইলেক্ট্রনিক স্ক্রিন ব্যবহারের ফলে চোখের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে, যা মায়োপিয়া আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়িয়ে তুলতে পারে। এটি প্রতিরোধে,

  • ব্লু লাইট ফিল্টার সমৃদ্ধ লেন্স ব্যাবহার করা

  • প্রতি ২০ মিনিট স্ক্রিনে তাকানোর পর ২ মিনিট রেস্ট নেওয়া

  • অন্ধকারে টিভি বা মোবাইল না চালানো

  • ও পর্যাপ্ত পানি ও সবুজ শাকসবজি খাওয়া চোখ আরো খারাপ হওয়া থেকে বাঁচাতে পারে।

শিশুদের মায়োপিয়া রোধে করনীয়

মায়োপিয়ার রোগের শুরুটি মূলত শৈশবে হয়ে থাকে। পর্যাপ্ত সূর্যের আলো ও বাইরে খেলাধুলার করা শিশুদের মায়োপিয়া প্রতিরোধে সবচেয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শিশু অবস্থাতেই মায়োপিয়ার চিকিৎসা করা গেলে এটি সহজে দমন করা সম্ভব। চলুন দেখে আসি কিভাবে বুঝবেন আপনার শিশুর মায়োপিয়া থাকতে পারে,

  • চোখ পিটপিট করা

  • দূরে দেখতে চোখ ছোট করা

  • অসংলগ্ন ভাবে তাকানো

  • টিভি বা ব্লাকবোর্ড দেখতে কাছে গিয়ে বসা।

এই লক্ষন গুলো দেখা গেলে চক্ষু ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরী।

মায়োপিয়া রেগের ধাপ

মায়োপিয়া রেগের তিনটি ধাপ রয়েছে। ধাপগুলো হলো,

  • Low myopia (৩.০০ ডায়োপ্টার পর্যন্ত)

  • Moderate myopia (৩.০০ থেকে ৬.০০ ডায়োপ্টার পর্যন্ত)

  • Severe myopia (৬.০০ থেকে ১২.০০ ডায়োপ্টার পর্যন্ত)

সাধারণ মায়োপিয়ায় চশমা বা লেন্স দিয়ে ঠিকঠাক দেখা সম্ভব। কিন্তু গুরুতর মায়োপিয়াতে রেটেনাল ডিটাচমেন্ট থেকে দৃষ্টি হারানোর সম্ভাবনা থাকে, তাই মায়োপিয়াকে অবহেলা করার কোন অবকাশ নেই। লেজার ট্রিটমেন্ট সহ বিভিন্ন চোখের সার্জারির মাধ্যমে স্থায়ী ভাবে মায়োপিয়া মুক্ত হওয়া যায়। সার্জারির মাধ্যমে সারা জীবনের মত মায়োপিয়াকে বিদায় জানানো যায়, সে যুক্তিতে এর সার্জারি সাধারণত খুব বেশি ব্যায়বহুল নয়।

চোখের যত্নে পুষ্টিকর খাবার

চোখের যত্নে ও মায়োপিয়া প্রতিরোধে পুষ্টিকর খাবারের কোন বিকল্প নেই। আসুন চোখের জন্য উপকারী খাবার গুলো জেনে নেই।

  • মলা, ঢেলা সহ সকল ছোট মাছ চোখের যত্নে পর্যাপ্ত মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট প্রদান করে

  • চিনাবাদাম, আখরোট সয়াবিন, ডিমের কুসুম ইত্যাদি ভিটামিন ই প্রদান করে

  • লেবু, আনারস, জাম, কাচামরিচ ও পুদানা ভিটামিন সি প্রদান করে

  • মাংস, কুমড়া, মটর ইত্যাদি জিংক প্রদান করে।

  • ডিমের কুসুম, কলিজা, মৌসুমী হলুদ ফল প্রচুর ভিটামিন এ প্রদান করে।

উপরের সবগুলো খাবারই চোখের সুস্বাস্থ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শেষ কথা

আমাদের প্রজন্মে মায়োপিয়া যাদের হবার তা হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা চাইলেই পরবর্তি প্রজন্মের সুন্দর দৃষ্টি নিশ্চিত করতে পারি। আসুন বাচ্চাদের মাঠ তৈরি রাখি, তাদের সূর্যের আলোয় খেলতে দেই। শিশু অবস্থায় পর্যাপ্ত সূর্যের আলো ও শারিরীক সক্রিয়তা মায়োপিয়া ও চোখের অন্যান্য অসুখ থেকে মুক্ত রাখে।

আরও পড়ুনঃ

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles