OCD বা শুচিবাই রোগ চেনার উপায়
ওসিডি, শুচিবাই বা চিন্তাবাতিকগ্রস্ত যে নামেই ডাকা হোক না কেন একজন স্বাভাবিক মানুষ পৃথিবীকে যেভাবে দেখেন, ভাবেন ও কাজ করেন, OCD আক্রান্ত মানুষের জগৎ তার থেকে অনেকটাই ভিন্ন। বিশ্বের প্রায় ২ শতাংশ মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময় এই রোগে ভুগে থাকেন। সংখ্যাটা সামান্য মনে হলেও, বৃহৎ জনগোষ্ঠির ভেতর দেখতে গেলে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। অথচ বেশিরভাগ মানুষই রোগটি সম্পর্কে জানেন না এবং যারাও জানেন, তাদেরও ওসিডি সম্পর্কে অনেক ভূল ধারণা রয়েছে।
“চিন্তাবাতিকগ্রস্ত নন তো! চিন্তা ও কাজের উপর নিয়ন্ত্রণহীনতা হতে পারে OCD এর লক্ষণ”
মাহফুজ সাহেব একজন চাকরিজীবী। করোনা মহামারীর পর তাকে বাসায় বসে অফিস করতে হয়। এর মাঝেই উনার একটি অদ্ভুত সমস্যা তৈরি হয়। কোন কিছু হাত দিয়ে স্পর্শ করলেই তাকে যেন কোন এক অজানা শক্তি তাকে হাত ধুতে বাধ্য করছে বলে মনে হয়। এমন কি তার বাসার যে কোন কিছু ধরার পর, তাকে হাত ধুতে হয়।
তাও একবার হাত ধুলে এক রকম হত। উনি প্রায় প্রতি সময়ই ৩ বা ৫ বা ৭ বার হাত ধোন। এখানে আরেকটি ব্যাপারও আছে, উনার সবকিছু বিজোড় সংখ্যা হতে হবে। বিজোড় না হলে যেন সেটাকে বিজোড় করার জন্য উনার সমস্ত মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়ে যায়।
মাহফুজ সাহেবের এই সমস্যাটি বেশ পুরোনো। উনি বিবাহিত ও দুই সন্তানের জনক। পরিবার ছেড়ে উনি ঢাকায় চাকরি করেন। সেখানেও সমস্যা, দূরে থাকার কারণে তিনি সবসময় চিন্তায় থাকেন, বলতে গেলে এক প্রকার নিশ্চিতই থাকেন যে তার স্ত্রী তার সাথে বেঈমানী করছেন। যদিও এমন কোন সূত্র বা কারণ উনার কাছে নেই। প্রতি ঘন্টায় উনি স্ত্রীকে ফোন দিয়ে কঠিন ভাষায় কথা বলেন। তার দূরে থাকারও একটি কারণ রয়েছে। উনার ২য় সন্তানের জন্ম হবার পর অকল্পনীয় সহিংস চিন্তা তার মাথায় আসতে থাকে, কারণ তার বিজোড় সংখ্যা পছন্দ! তার নিজের জন্য সন্তানের কোন ক্ষতি হবে ভেবে তিনি দূরে চলে আসেন।
আসলে মাহফুজ একজন ওসিডি বা শুচিবাই রোগী যার রোগটি জটিল আকার ধারণ করেছে। আশা করি উপরের গল্পটির মাধ্যমে কিছুটা ধারণা করতে পেরেছেন ওসিডির বাস্তব রূপ কেমন হতে পারে। মাহফুজ সাহেবের আচরণে ওসিডি রোগের মাত্র কয়েকটা লক্ষন প্রকাশ পেয়েছে, যদিও এ রোগের লক্ষণ অগণিত। অসংখ্য লক্ষণ থাকলেও ধরণের উপর নির্ভর করে কিছু ভাগে ভাগ করা যায়। প্রবন্ধটির পরবর্তি অংশে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানাব।
ওসিডি (OCD) কি?
ওসিডি এমন একটি মানসিক রোগ যেখানে আপনি এমন একটি কাজ করবেন যা আপনি জানেন যে করে লাভ নেই, তাও করবেন। এমন চিন্তা এসে জুড়ে বসবে যার কারণ ও নিয়ন্ত্রণ আপনার কাছে নেই। এটি এমন একটি মোহগ্রস্থ অবস্থা যা আপনার ব্যাক্তিগত ও সামাজিক জীবন বেহাল করে ফেলবে। আপনি এমন কাজকে বাধ্যতামূলক ভাববেন যার কোন যুক্তি নেই।
এর ইংরেজী পূর্নরূপ হলো, Obsessive Compulsive Disorder, যার আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, মোহগ্রস্থ-বাধ্যতামূলক রোগ। বাংলায় এই রোগটিকে শুচিবায়ু বলা হয়, যদিও শুচিবায়ু ওসিডি রোগটিকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করে না। শুচিবায়ু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ময়লা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কিত একটি সমস্যা বোঝানো হয়, কিন্তু ওসিডি এর সাথে আরও অনেক কিছুই জড়িত। চলুন ওসিডি এর কিছু উপসর্গ জানা যাক।
ওসিডি চেনার উপায়
ওসিডির অসংখ্য ধরণ রয়েছে। তার মধ্যে নিন্মক্ত আচরণ গুলো খুব বেশি দেখা যায়।
নিশ্চিত বিষয়ের উপর সন্দেহ করা
কোন কিছু বারবার চেক করা, এবং চেক করার পর সে সম্বন্ধে নিশ্চিত না হওয়া। এটা চাবি, সুইচ, ওভেন, চুলা, প্রেগনেন্সি যে কোন কিছু হতে পারে। ধরুন বাসা থেকে বের হলেন, অনেক দূর আসার পর মনে হলো, বাসার তালাটা ঠিকমতো লাগিয়েছি তো? অথচ এমন কখনো হয়নি আপনি বাসার তালা লাগাতে ভুলে গেছেন, এমনকি চাবিও আপনার সাথেই আছে। এমন পরিস্থিতিতে আপনাকে আবার বাসায় তালা চেক করতে ফেরৎ যেতে হবে। এমন উদ্বিগ্ন থাকার স্বভাব ওসিডির প্রধান লক্ষণ।
অতি পরিষ্কার থাকার চেষ্টা
সামান্য বাইরে বের হলেই গোসল করা, কিছু ধরলেই হাত ধোওয়া, বিশেষ কোন মানুষ বা নিজের ছাড়া অন্য কারো রান্না করা খাবারে রুচি না হওয়া, কোন কিছু বারবার বারবার করে ধোয়া। এরূপ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা জনিত কোন আচরণের উপর যদি আপনার নিয়ন্ত্রন না থাকে বা অযৌক্তিক ভাবে বাধ্যতামূলক মনে হয় সেটি ওসিডির উপসর্গ হতে পারে। এটি ওসিডির অন্যতম প্রধান ও সহজে নির্ণয়যোগ্য উপসর্গ।
সামঞ্জস্য ও ক্রম সংক্রান্ত গোঁড়ামি
মাহফুজ সাহেবের মত বিজোড় সংখ্যা পছন্দ করাটা এই ধরণের উপসর্গের অন্তর্গত। সবসময় কোন কিছু বড় ছোট বা থেকে ক্রম অনুসারে সাজাতে হবে বা বিশেষ কোন সংখ্যার হতে হবে, রাস্তায় সামনের লোকটার সাথে পা মিলিয়ে চলতে হবে এরূপ স্বআরোপিত বাধ্যবাধকতা ওসিডির লক্ষণ।
আজেবাজে অপ্রয়োজনীয় অমূলক চিন্তা
রাস্তা পার হবার সময় এক্সিডেন্টের চিন্তা করে মানসিকপীড়া পাওয়া, বিরক্তিকর যৌন চিন্তা, সহিংস বাজে চিন্তা হঠাৎ মনের ভেতর চলে আসা ও এর উপর নিয়ন্ত্রন না থাকা ওসিডি এর লক্ষণ। ওসিডিতে আক্রান্ত মানুষ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণহীন কাজের চেয়ে নিজের নিয়ন্ত্রনহীন চিন্তা গুলোর জন্য বেশি দুর্ভোগ পোহান ও নিজের মনের সাথে দ্বন্দে ব্যাহত হয় তার ব্যাক্তিগত ও সামাজিক জীবণ।
নিখুঁত করার চেষ্টা
কোন কাজ নিখুঁত ভাবে করা ভালো কিন্তু কত নিখুঁত? চারটা শার্ট নিঁখুত ভাবে ভাঁজ করতে যদি আপনি এক ঘন্টা লাগান, সেটা আপনার জন্য সমস্যাই বটে। এরকম সবজায়গায় অপ্রয়োজনীয় ভাবে নিঁঃখুত হওয়ার চেষ্টা করা একজন ওসিডি রোগীর লক্ষন।
ওসিডি কেন হয়?
ওসিডি এর কোন নির্দিষ্ট কারণ এখনো পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নি। মূলত মানব মস্তিষ্ক এতটাই জটিল যে তাতে সৃষ্ট কোন সমস্যার সঠিক কারণ বের করা আজকের চিকিৎসা বিজ্ঞানেও অনেক কঠিন। তবুও বিশেষজ্ঞেরা ওসিডি হওয়ার কিছু সম্ভাব্য কারণ নির্দিষ্ট করতে পেরেছেন।
-
পরিবারে পিতামাতা বা পূর্ব প্রজন্মের কারো ওসিডি থাকলে।
-
কোন কারণে মস্তিষ্কের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হলে।
-
ডিপ্রেশন, উদ্বিগ্নতা সহ অন্যান্য মানসিক রোগ।
-
কোন প্রকার ট্রমার ইতিহাস থাকলে।
-
শৈশবে শারিরীক ও যৌন নির্যাতন এর স্বীকার হলে।
-
শিশু অবস্থায় ব্যাক্টেরিয়া সংক্রমনে আক্রান্ত হলে।
ওসিডি হলে করণীয় ও চিকিৎসা
ওসিডি সহ যেকোন মানসিক সমস্যার সবচেয়ে কার্যকর ব্যাবস্থা হলো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের স্বরনাপন্ন হওয়া। এমনও হতে দেখা যায় প্রাথমিক অবস্থায় সাইকোথেরাপির মাধ্যমে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের একটি সেশনেই আপনার চিন্তাভাবনার ধরণ ও কাজের উপর নিয়ন্ত্রণ এনে দিতে পারেন।
ওসিডি হলে ভয়ের কিছু নেই, খুব সহজেই কয়েকটি সাইকোথেরাপি, ঔষধ ও ধ্যানের মাধ্যমে এ রোগটি খুব সুন্দরভাবে সামলে চলা যায়। সম্পুর্ণভাবে এই রোগটি থেকে নিস্তার সম্ভব নয়, কিন্তু এই রোগের উপর আপনার নিয়ন্ত্রন রাখা সম্ভব।
কারো ভেতর ওসিডির সমস্যা থাকলে এটা যে একটা রোগ, অন্তত এটুকু জেনে রাখাও অনেক ক্ষেত্রে উপকারী।
শেষ কথা
যেকোন ব্যাধিই, যার ব্যথা সে ছাড়া কষ্ট টা আর কেউ টের পায় না। মানসিক ব্যাধির জন্য এটা যেন খুব বেশি সত্য। কারো অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে মজা করা তার মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা আরো খারাপ হতে পারে। ওসিডি অনিরাময় যোগ্য হলেও খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য। আপনার আসে পাশে কারো ভেতর ওসিডির লক্ষণ দেখা গেলে তাকে সুন্দরভাবে জানাতে পারেন ও একজন মনরোগ বিশেষজ্ঞের স্বরনাপন্ন হতে বলতে পারেন।