গলা ও বুক জ্বালাপোড়া করছে? সমস্যা GERD নয় তো!

খাবার গ্রহনের পরেই যদি গলা ও বুক জ্বালাপোড়া করে তবে আপনি খুব সম্ভবত GERD সমস্যায় ভুগছেন। এই সমস্যায় আপনার পাকস্থলীর অ্যাসিড ক্রমাগত খাদ্যনালী বেয়ে গলা বা মুখে চলে আসে। ফলে আপনি বুকজ্বালা, বদহজম,গিলতে সমস্যা সহ আরো নানা জটিলতায় ভুগতে পারেন। সময়মত চিকিৎসা গ্রহন না করলে মারাত্বক জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। এই প্রবন্ধে GERD সংক্রান্ত সমস্যাগুলি নিয়ে আমরা আলোচনা করবো।

ভোজন রসিক বাঙালিরাই যে কেবল গলা ও বুক জ্বালাপোড়ায় ভুগি তা কিন্তু নয়। বিশ্বজুড়েই  এই সমস্যায় মানুষ কমবেশি ভুগে থাকেন। আর এই কারনে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নভেম্বর ২১-২৭, ২০২১ পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব GERD সচেতনতা দিবস। Gastroesophageal Reflux Disease কে সংক্ষেপে GERD বলে। গলা ও বুক জ্বালাপোড়া সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ মিলিয়নেরও (পঞ্চাশ লক্ষ) বেশি মানুষ চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। আর এই কারনেই ১৯৯৯ সাল থেকে প্রতি নভেম্বর মাসে বিশ্বজুড়ে GERD সচেতনতা সপ্তাহ পালন করা হয়ে আসছে।

আমরা বাঙ্গালীরা প্রচুর তেলেভাজা ও মশলাযুক্ত খাবার খেতে ভালোবাসি। আর এরপর যখন শুরু হয় বুকজ্বালা, গলায় অস্বস্তি তখন নিজে নিজেই সাধারন কোন গ্যাসের বড়ি খেয়ে সমস্যাকে সাময়িক ধামাচাপা দেই। কিন্তু আপনি জানেন কি এই সাধারন সমস্যাটিকে গুরুত্বের সাথে না বিবেচনা করলে পরে হয়ে উঠতে পারে প্রাণঘাতীও। চলুন সমস্যাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি।   

Gastroesophageal Reflux Disease কি?

আগেই বলেছি Gastroesophageal Reflux Disease এর সংক্ষিপ্ত রূপ হল GERD। GERD হল এমন একটি অবস্থা যখন আপনার পেটের অ্যাসিড যুক্ত খাদ্যকণা ক্রমাগতভাবে আপনার পাকস্থলী থেকে অন্ননালী ও গলাতে উঠে আসে। ফলে মুখে তৈরি হয় টক স্বাদ। 

Acid reflux হওয়ার কারন হল, যখন খাদ্য পাকস্থলীতে পৌঁছায়, তখন অনেক সময় খাদ্যনালীর শেষ প্রান্তের ভাল্ভ কিছুটা খোলা থেকে যায়। ফলে পাকস্থলীর অ্যাসিড খাদ্যনালী এবং গলা দিয়ে মুখে চলে আসে। 

মাঝে মাঝে Acid reflux হওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এই সমস্যা যদি প্রতি সপ্তাহে দুইবারের বেশী হতে থাকে এবং সাধারন ঔষধ সেবনের পরেও এর লক্ষনগুলি প্রকাশ পেতে থাকে তবে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। 

GERD কেন হয়?

GERD সমস্যার তেমন কোনো একক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে আপনার শরীরে এমন একটি প্রক্রিয়া রয়েছে যা সঠিকভাবে কাজ না করলে এটি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে।

নিম্ন খাদ্যনালীর স্ফিঙ্কটার (LES) হল খাদ্যনালীর শেষপ্রান্তের পেশীর একটি বৃত্তাকার ব্যান্ড। আমরা যখন খাবার খাই তখন এই পেশীটি আলগা হয় এবং খুলে যায়। খাবার গেলা হয়ে গেলে এই আবার পূর্বের ন্যায় শক্ত হয়ে যায় এবং পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।  

যখন এই LES সঠিকভাবে শক্ত বা বন্ধ হয় না তখন Acid reflux ঘটে। ফলে আপনার পাকস্থলী থেকে পাচক রস এবং অন্যান্য খাদ্যকণা খাদ্যনালীতে উঠে আসে।

তবে এর বাইরেও আরো কিছু বিষয়কে Acid reflux এর কারন হিসেবে দায়ী করা হয়। যেমনঃ

  • পেটে অত্যধিক চাপ- প্রায় সকল গর্ভবতী মহিলারা শুধু পেটে বাড়তি চাপের কারনেই প্রায় প্রতিদিনই Acid reflux এ ভুগে থাকেন। 

  • হাইটাল হার্নিয়া- এই সমস্যায় পেটের উপরের অংশ ডায়াফ্রামে ফুলে যায় যেটা স্বাভাবিক খাবার গ্রহণের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে LES ঠিক মত কাজ করতে পারে না।  

  • অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া- বিশেষ ধরনের খাবার যেমন দুগ্ধজাত, মশলাদার বা পোড়া তেলে ভাজা খাবার খাওয়ার অভ্যাস এই রোগকে বাড়িয়ে দিতে পারে।

  • একসাথে বেশি খাবার খাওয়া- আপনি যদি ঘন ঘন একসাথে বেশী খাবার গ্রহন করেন তবে আপনার এই অভ্যাস পেটের উপরের অংশকে প্রসারিত করে ফেলতে পারে। এর ফলে LES ঠিকভাবে বন্ধ হতে পারে না। 

  • খাবার গ্রহনের সাথে সাথে শুয়ে পড়া- ভরপেট খেয়েই অনেকেই শুয়ে পড়েন। ফলে খাদ্যনালীর ভাল্ভ পুরপুরি বন্ধ হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত চাপ তৈরি হয় না। ফলাফল এসিডিটি। 

  • বিশেষ কিছু ঔষধ সেবন- কিছু ঔষধ আছে যেগুলো Acid reflux সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন হাঁপানি, উচ্চ রক্তচাপ এবং অ্যালার্জির ঔষধ। এছাড়াও ব্যথানাশক, সিডেটিভ এবং অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্টস এর ঔষধও Acid reflux ঘটায়। 

কাদের এটি হবার ঝুঁকি বেশি?

আগেই বলেছি যে GERD সমস্যার নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই তবে জীবনযাত্রার কিছু ভুল পদ্ধতি এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক কিছু কারণ রয়েছে যাতে এই রোগ সৃষ্টির বা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

চলুন দেখি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কাদের সবচেয়ে বেশী- 

  • যারা ওজনাধিক্য বা স্থুলতায় ভুগছেন

  • গর্ভাবস্থা

  • যারা ধূমপান করেন

  • যারা ঘন ঘন অধিক পরমাণে খাবার খান

  • খাবার গ্রহনের পরেই যারা শুয়ে পড়েন

  • যারা অধিক পরিমানে পোড়া তেলে ভাজা খাবার, সোডা জাতীয় পানীয়, এবং কফি বা অ্যালকোহল পান করেন।

  • এছারাও যারা নিয়মিত অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেনের মতো প্রচুর পরিমাণে ননস্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগ (এনএসএআইডিএস) ব্যবহার করেন। 

কখন ডাক্তার দেখাবেন?

অনেকেই হার্টবার্ন এবং হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলোকে এক করে ফেলেন। যদিও দুটি সমস্যার পৃথক কিছু উপসর্গ রয়েছে। তবে আপনার বুকে ব্যথা হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। বিশেষ করে যদি আপনার শ্বাসকষ্ট থাকে এবং বুকে ব্যথার সাথে তা চোয়াল বা হাতে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে এগুলো হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ ও উপসর্গও হতে পারে। তবে এর বাইরেও আরো কিছু সমস্যা থাকলে আপনার উচিত ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। এগুলো হল-

  • ঘন ঘন Acid reflux এর লক্ষনগুলো প্রকাশ পেতে থাকলে

  • সপ্তাহে দুইবারের বেশী এসিডিটি বা বুক জ্বালাপোড়ার ঔষধ সেবনের প্রয়োজন হলে। 

এই রোগটি অন্য কি কি জটিলতা তৈরি করে

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই GERD তেমন কোন বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে না। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী GERD গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে। চলুন দেখি সেগুলো কি-

  • খাদ্যনালীর প্রদাহ- এর থেকে আপনার খাদ্যনালীতে আলসার, বুকে ব্যথা, এবং খাবার গিলতে সমস্যা হতে পারে। 

  • Barrett's esophagus- দীর্ঘদিন GERD সমস্যায় ভুগতে থাকলে ব্যারেটের খাদ্যনালী সমস্যাটি হতে পারে। 

  • খাদ্যনালীর ক্যান্সার- GERD সমস্যা দীর্ঘমেয়াদী হলে ধীরে ধীরে তা খাদ্যনালীর ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।  

  • স্ট্রিকচার- GERD অনেকসময় খাদ্যনালীকে সংকুচিত করে ফেলে। এই সমস্যাকে বলে স্ট্রিকচার। 

চিকিৎসা

GERD-এর উপসর্গ গুলোকে নিরাময় করতে সাধারনত ডাক্তার স্বাস্থ্যকর জীবনধারা মেনে চলতে বেশী উৎসাহিত করে। তবে স্বাস্থকর জীবনযাপন কেবল GERD নয়, আরো অনেক শারীরিক সমস্যাকেই দূরে রাখতে সাহায্য করে। 

  • ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখুন

  • ধূমপান ত্যাগ করুন

  • সন্ধ্যার পর ভারী ও অতিরিক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন 

  • খাওয়ার পর কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করে শুতে হবে

  • ঘুমের সময় আপনার মাথা বিছানার মাথা ৬-৮ ইঞ্চি উঁচু করে ঘুমাতে হবে

জীবনযাবনের স্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে GERD সমস্যার অনেকটায় দূর করা সম্ভব। তবে এর পরেও যদি এই সমস্যার সমাধান না হয় তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া জরুরি। এক্ষেত্রে ডাক্তাররা সাধারনত অ্যান্টাসিড জাতীয় ঔষধ সেবন করতে দেন। তবে এতেও সমস্যা দূর না হলে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পরবর্তী চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন।  

ডায়গনসিস বা রোগ নির্ণয়

GERD সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের জীবনধারা পরিবর্তনের পরেও যদি উপসর্গগুলোর উপসম না হয় তবে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগের জটিলতা নির্ধারনের চেষ্টা করা হয়। চলুন দেখি সেগুলো কি- 

  • আপার গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল GI এন্ডোস্কোপি এবং বায়োপসি- ডাক্তার আপনার মুখ ও গলা দিয়ে ছোট লাইট যুক্ত একটি লম্বা টিউব প্রবেশ করাবে যা দিয়ে অন্ননালী, পাকস্থলী এবং ডুওডেনাম পরীক্ষা করে দেখবেন। প্রয়োজন হলে একটি ছোট টিস্যু কেটে নেন বায়োপসি করার জন্য। 

  • অ্যাম্বুলেট্রি 24-ঘন্টা পিএইচ প্রোব- একটি ছোট টিউব নাক দিয়ে খাদ্যনালীতে প্রবেশ করানো হয়। টিউবের ডগায় একটি pH সেন্সর খাদ্যনালীতে কতটা অ্যাসিড এক্সপোজার হচ্ছে তা পরিমাপ করে এবং একটি পোর্টেবল কম্পিউটারে ডাটা পাঠায়। একজন ব্যক্তি প্রায় ২৪ ঘন্টা এই টিউবটি পরে থাকেন। এই পদ্ধতিটিকে সাধারণত GERD নির্ণয়ের জন্য "গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড" হিসাবে বিবেচনা করা হয়। 

  • Esophogram টেস্ট- এটা এক ধরনের এক্স-রে। এই টেস্টের আগে রোগীকে নির্দিষ্ট পরিমানে বেরিয়াম পান করানো হয়। এর পর আপার ডাইজেস্টিভ ট্র্যাক্ট এর এক্স-রে করা হয়। 

  • খাদ্যনালী ম্যানোমেট্রি- আপনার খাদ্যনালীর পেশীর শক্তি পরিমাপ করতে একটি নমনীয় টিউব নাক দিয়ে আপনার খাদ্যনালীতে প্রবেশ করানো হয়।

  • খাদ্যনালী পিএইচ মনিটরিং- আপনার খাদ্যনালীতে একটি ছোট মনিটর ঢোকানো হয় যেটা পূর্বের কয়েকদিন কিভাবে আপনার শরীর অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ করেছে তা মনিটর করে। 

কিভাবে বুঝবেন এটি হার্টবার্ণ, হার্ট অ্যাটাক নয়?

বুক জ্বালাপোড়ার কারণে সৃষ্ট ব্যথায় আপনি হয়তো ভয় পেতে পারেন যে আপনি হার্ট অ্যাটাক করছেন। যদিও আপনার হার্টের সাথে হার্টবার্নের কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু যেহেতু বুকে অস্বস্তি রয়েছে, এই সময় হার্টবার্ন এবং হার্ট অ্যাটাকের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হতে পারে। তবে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণগুলি হার্টবার্ন থেকে আলাদা।   

হার্টবার্ন হলে আপনার বুকে অস্বস্তিকর জ্বালাপোড়া অনুভূতি বা ব্যথা হবে যা আপনার ঘাড় এবং গলা পর্যন্ত যেতে পারে। অপরদিকে হার্ট অ্যাটাকের কারণে হাত, ঘাড় এবং চোয়ালে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, ঘাম, বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা, চরম ক্লান্তি, উদ্বেগ, ইত্যাদি লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে পারে।

যদি আপনা্র সাধারন বুক জ্বালাপোড়ার ঔষধ সেবনের পরেও বুকে অস্বস্তি না সারে এবং ব্যথার সাথে উপরে উল্লেখিত লক্ষনগুলো প্রকাশ পেতে থাকে তাহলে অবিলম্বে চিকিৎসাকের সাথে দেখা করুন।

শেষ কথা

গলা ও বুক জ্বালাপোড়ার রোগী আপনি একা নন। সাধারন অ্যান্টি-অ্যাসিড জাতীয় ঔষধ এবং জীবনযাত্রার কিছু পরিবর্তনের সাথে এই সমস্যার সমাধান অনেকটাই হয়ে যায়। তবে আপনি যদি দেখেন যে লাগাতার প্রতি সপ্তাহে ২ দিনের বেশী আপনি এই সমস্যায় ভুগছেন তাহলে ধরে  নিতে হবে আপনি GERD এ আক্রান্ত। তবে ভয়ের কিছু নেই। বিভিন্ন ডায়াগনোসিসের মাধ্যমে সঠিক রোগ নির্নয় করতে পারলে চিকিৎসক আপনার রোগ পুরোপুরি নিরাময় করতে পারবেন।

Default user image

সানজিদা আলম, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি একজন ফ্রিল্যান্স কন্টেন্ট রাইটার। বাংলা এবং ইংরেজী উভয় ভাষাতেই লেখি। টেকনোলজি, স্বাস্থ্য, প্রোডাক্ট রিভিউ এবং ইনফরমেটিভ কন্টেন্ট নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি। লেখালেখির পাশাপাশি ভালোবাসি পড়তে।

Related Articles