গরমে বয়ষ্কদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ৮টি টিপস

এই গরমে আপনার পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিটির সঠিক যত্ন নিচ্ছেন তো? বয়ষ্ক আর স্বাস্থ্য সমস্যা থাকা ব্যক্তিদের জন্য খুব বেশি গরম বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গরম থেকে দ্রুত স্বস্তি পাওয়া জরুরি। যদি না হয়, তবে বয়ষ্ক ব্যক্তিরা বিভ্রান্ত বা অজ্ঞান বোধ করতে শুরু করতে পারেন। তাই আসুন, আপনার পরিবারের মুরব্বীদের, প্রতিবেশী এবং আশেপাশের মানুষদের - তাপপ্রবাহের সময় নিরাপদ এবং শীতল রাখতে সাহায্য করতে পারে এমন কয়েকটি টিপস জেনে নেই।

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরীজীবী লুতফর সাহেবের বয়স ৭০। এই বয়সেও বেশ স্বাস্থ্যবান ও সক্রিয়। বাসা থেকে একটু বাজারের উদ্দেশ্যে বের হয়েছেন কিছু সদাই কেনার জন্য। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে তিনি হেঁটেই চলে গেলেন, ভাবলেন আসার সময় রিক্সা করে আসবেন। কিন্তু ফিরতি পথে আর রিক্সা পেলেন না। তাই আবার হেঁটেই রওনা দিলেন। কিন্তু মাঝ রাস্তায় এসে হঠাত তার মাথা ঘোরাতে লাগল ও দুর্বল বোধ করতে লাগলেন এবং এক সময় মাটিতে মসে পড়লেন।

লুতফর সাহেবের মত যেন এই ঘটনা না ঘটে তার জন্য আমাদের জানতে হবে গরম থেকে নিরাপদ থাকার উপায়। আসুন জেনে নেই বিস্তারিত।

চলছে বৈশাখ মাস, চারিদিকে প্রখর রোদ আর দাবদাহ জনজীবনকে এখনি কষ্টদায়ক করে তুলেছে। এই গরমে শিশুদের সাথে সাথে বয়স্কদেরও বিশেষ যত্ন নেয়া প্রয়োজন। কারন অতিরিক্ত গরম যেমন  শিশুদের নানাবিধ স্বাস্থ্য জটিলতার সৃষ্টি করে তেমন বয়স্কদের জন্যেও অনেক বেশী ঝুকিপূর্ন। তাই তাদের সুস্থ রাখতে কেবল বেশি পানি পান করাই একমাত্র সমাধান নয়, তাদের প্রয়োজন আরো কিছু বিশেষ যত্নের। 

অতিরিক্ত গরমে হিটস্ট্রোক সহ বয়স্কদের নানারকম শারীরিক সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। আর পরিবারের গুরুজনের যদি দীর্ঘমেয়াদি কোন রোগ যেমন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ অথবা হার্টে ব্লক জনিত কোন সমস্যা থাকে তবে তাদের নিয়মিত ডাক্তারের ফলোআপ করানো অনেক বেশী জরুরি। তাছাড়া এমনিতেই বয়স চল্লিশ হয়ে গেলে বছরে অন্তত একবার চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত। 

গরমে যেসব অসুস্থতা দেখা দেয়

আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে গ্রীষ্মকালীন তাপদাহের সাথে শারীরিকভাবে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতাটা কমে যেতে শুরু করে। এই কারণে গরমের মাসগু্লোতে বয়স্ক লোকেরা তাপ সম্পর্কিত অসুস্থতার উল্লেখযোগ্য ঝুঁকিতে থাকে, যা সম্মিলিতভাবে হাইপারথার্মিয়া নামে পরিচিত। 

হাইপারথার্মিয়াতে হিট স্ট্রোক, হিট এডিমা (অতিরিক্ত গরমে পায়ের গোড়ালি এবং পা ফুলে যাওয়া), হিট সিনকোপ (গরমে ব্যায়াম করার পর হঠাৎ মাথা ঘোরা), হিট ক্র্যাম্প এবং ক্লান্তি অন্তর্ভুক্ত।

হিট স্ট্রোক

গরমে বয়স্কদের সবচেয়ে বেশী যে ঝুঁকি থাকে তা হল হিট স্ট্রোক হওয়া। যারা ঘরের বাইরে কাজ করে অথবা এসির ঠান্ডা বাতাসে থাকার পর হঠাৎ ঘরের বাইরে আসলে হিট স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা কনেক বেড়ে যায়। হিট স্ট্রোকের লক্ষন-

  • শরীরে অতিরিক্ত তাপমাত্রা। এটা ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট থেকে তার বেশিও হতে পারে।

  • গরম, লালচে, শুষ্ক অথবা আদ্র ত্বক।

  • দ্রুত পালস রেট।

  • মাথা ব্যাথা ও মাথা ঘোরা।

  • বমি বমি ভাব।

  • বিভ্রান্তি ও চেতনা হারানো।

তাপ নিঃশেষন (Heat Exhaustion)

অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া, অনেক বেশী শারীরিক পরিশ্রম ইত্যাদির কারনে heat exhaustion হতে পারে। এর লক্ষনগুলো হল-

  • ঠান্ডা, ফ্যাকাসে, ও আঠালো ত্বক।

  • অনেক বেশী ঘাম নির্গত হওয়া।

  • দ্রুত ও দুর্বল পালস রেট।

  • বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া।

  • পেশিতে টান লাগা।

  • মাথা ব্যাথা, মাথা ঘোরা ও দুর্বলতা অনুভব করা।

  • চেতনা হারানো।

হিট ক্র্যাম্প

হাতের বা পায়ের পেশীতে যন্ত্রনাদায়ক টান বা খিঁচুনিকে হিট ক্র্যাম্প বলে। গরমে হিট ক্র্যাপের প্রধান কারন হল পানি শূন্যতা। হিট ক্র্যাম্পের লক্ষনগুলো হল-

  • অতিরিক্ত ব্যায়ামের পর তীব্র ঘাম।

  • মাংসপেশীতে তীব্র ব্যাথা অথবা খিঁচুনি। 

সানবার্ন

অতিরিক্ত কড়া রোদে দীর্ঘসময় কাটালে ত্বকে লালচে ভাব তৈরি হয় সাথে প্রদাহ থাকতে পারে। একেই সানবার্ন বা রোদে পোড়া বলে। যারা দীর্ঘসময় রোদে কাজ করে তাদের এই সমস্যা বেশি হয়। বয়স্কদের ত্বক অনেক বেশী নরম ও সংবেদনশীল হওয়ার কারনে তীব্র রোদ তাদের জন্য আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ন। সানবার্ন এর লক্ষন-

  • ব্যাথাযুক্ত, লালচে, এবং উষ্ণ ত্বক।

  • ত্বকের উপরিভাগে ফোস্কা।

হিট র‍্যাশ

আমরা সচরাচর যেটাকে ঘামাচি বলি সেটাই মূলত হিট র‍্যাশ। যদিও ঘামাচি যে কোন বয়সেই হতে পারে তবে বয়স্কদের ত্বক যেহেতু অনেক বেশি সংবেদনশীল তাই ঘামাচি তাদের জন্য অনেক বেশী যন্ত্রনাদায়ক হয়ে উঠে। ঘামাচির লক্ষন-

  • ত্বকে ছোট ছোট লাল র‍্যাশ।

  • ত্বক রুক্ষ ও খসখসে ভাব।

  • প্রচন্ড চুলকানি থাকে এবং জলুনি অনুভুত হয়।

বয়স্কদের সুস্থ থাকার উপায়  

গ্রীস্ম কালীন সর্বোচ্চ তাপদাহের মধ্যদিয়ে এখন সময় যাচ্ছে। এই সময়টা বয়স্কদের জন্য অনেক বেশি ঝুকিপূর্ন। তবে একটু সচেতন থাকলে এবং কিছু নিয়ম মেনে চললে আপনি আপনার বাসার মুরুব্বী ব্যক্তিটিকে সুস্থ রাখতে পারবেন। চলুন দেখি এই গরমে বয়ষ্কদের ভালো থাকার উপায়গুলো কি কি- 

১) হাইড্রেটেড থাকতে হবে

কম বয়সীদের তুলনায় বয়স্কদের শরীরে পানি সংরক্ষণের ক্ষমতা অনেক কমে যায়। এই কারনে তাদের পর্যাপ্ত পরিমানে পানি পান করা প্রয়োজন। অনেকসময় তারা পিপাসার্ত থাকলেও পানি পান করার ব্যাপারে অনাগ্রহী থাকে। তাই বাড়ীর অন্যান্য সদস্যদের সচেতন থাকতে হবে তাদের পর্যাপ্ত পানি পান করানোর ব্যাপারে। 

২) ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখুন

এই গরমে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে নিয়মিত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখুন। যে কোন স্বাস্থ্য সমস্যায় ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহন করুন।

৩) সতর্কতার সাথে ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় নির্বাচন করুন

যেহেতু এখন তীব্র তাপদাহ চলছে তাই ঘরের বাইরে যতটা কম যাওয়া যায় ততটায় নিরাপদ। তবে একান্ত প্রয়োজন হলে ঘরের বাইরে যাওয়ার সময়টি সতর্কতার সাথে নির্বাচন করতে হবে। সকালে বা সন্ধ্যায় রোদের তাপমাত্রা কমে গেলে বাইরে বের হওয়া অনেকটা কম বিপদজনক হবে।

৪) ত্বকের যত্ন নিন

গরমে সবথেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয় ত্বক। আর বয়স্কদের ত্বক অনেক বেশি সংবেদনশীল তাই এই সময় ত্বকের বিশেষ যত্ন নেয়া জরুরি। ত্বক শুষ্ক হতে দেয়া ঠিক হবে না তাই গোসলের পর ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা উচিত।

৫) ঘরের আবহাওয়া ঠান্ডা রাখুন

আপনার পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিটির শোবার ঘর, স্টাডি, লিভিং রুম ইত্যাদি ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সরাসরি সুর্যালোক থেকে রক্ষার জন্য জানালায় ভারি পর্দা ব্যবহার করা যেতে পারে। 

৬) আরামদায়ক পোশাক পড়ুন

তীব্র তাপদাহ থেকে বাঁচতে আরামদায়ক পোশাক পড়া জরুরি। দিনের বেলা ঘরের বাইরে গেলে হালকা রঙ্গের, সুতি এবং ফুল স্লিভ পোশাক পড়ুন। 

৭) হালকা ব্যায়াম করতে হবে

গ্রীষ্মের এই চরম গরমে শরীরকে ফিট রাখতে সকল বয়সীদেরই শরীর চর্চা করা জরুরি। বয়স্কদেরও নিয়মিত কিছু হালকা শরীরচর্চা করা দরকার। শরীরচর্চার সময় প্রয়োজনীয় বিরতি নিন এবং পর্যাপ্ত পানি পান করুন।

৮) গ্রীষ্মকালীন স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে জানুন

গ্রীষ্মের তাপদাহ বয়স্কদের জন্য অনেক বেশি ঝুকিপূর্ন। তাই এই স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান থাকা অনেক জরুরি। এই স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে ধারনা থাকলে যে কোন জরুরি অবস্থার মোকাবেলা করা সহজ হবে। তবে জরুরি অবস্থায় ঘরেই চিকিৎসা সীমাবদ্ধ না রেখে অতি দ্রুত নিকটস্থ্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে হবে। 

কিছু প্রশ্নের উত্তর

১। বয়স্কদের জন্য ঝুকিপূর্ন তাপমাত্রা কোনটি?

যখন তাপমাত্রা ৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠে যায়, তখন বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের ঝুকিপূর্ন হয়ে যায়

২। এসি কি বয়স্কদের জন্য উপকারী?

বয়স্কদের ত্বক অনেক বেশী সংবেদনশীল হওয়ায় ঠান্ডা এবং গরম উভয় তাপমাত্রাই ঝুকির কারন হতে পারে। তাই তাপমাত্রার ব্যালান্স রক্ষায় এয়ার কন্ডিশনিং তাদের জন্য বেশ উপকারী। 

৩। গরমে কোন পোশাক বয়স্কদের জন্য উপকারী?

ঢিলাঢালা, সুতি এবং ফুল-স্লিভ পোশাক বয়স্কদের জন্য সবচেয়ে উপকারী।

শেষকথা

প্রখর রোদ বা গরম বয়ষ্কদের জন্য অসুস্থতার কারন হতে পারে। আপনার পরিবারে যদি বয়স্ক কোন সদস্য থেকে থাকে তাহলে প্রথমেই তার প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে নিন। এতে জরুরি অবস্থা মোকাবেলা করা সহজ হবে। আপনি নিজে, ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে বয়স্কদের গ্রীষ্মকালীন স্বাস্থ্যঝুকি সম্পর্কে জানুন এবং সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহন করুন। এতে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি থেকে বেচে যাবেন। স্বাস্থ্যকর খাবার ও পর্যাপ্ত পানীয় গ্রহন এবং নিয়মিত শরীর চর্চা অব্যাহত রাখুন। সর্বোপরি যে কোন জরুরি অবস্থায় সবার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহন করুন।

Default user image

সানজিদা আলম, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি একজন ফ্রিল্যান্স কন্টেন্ট রাইটার। বাংলা এবং ইংরেজী উভয় ভাষাতেই লেখি। টেকনোলজি, স্বাস্থ্য, প্রোডাক্ট রিভিউ এবং ইনফরমেটিভ কন্টেন্ট নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি। লেখালেখির পাশাপাশি ভালোবাসি পড়তে।

Related Articles