কাশির সঙ্গে রক্ত মানেই যক্ষ্মা নয়! টিবি রোগের লক্ষণ কী?

কাশির সাথে হঠাৎ রক্ত আসলে ভয় পাবেন না এমন মানুষ নেই এই কথা হয়ত নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়। বিশেষ করে আমাদের সিনেমা-নাটকে যেভাবে কাশির সাথে রক্ত আসাকে যক্ষ্মার মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে তা ভয়াবহই বটে। আসলে তা কতটুকু বাস্তবিক? এই প্রবন্ধে কফের সাথে রক্ত আসার সম্ভাব্য করণ ও যক্ষ্মার রোগের লক্ষণ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব।

  • কফের সঙ্গে রক্ত গেলেই যক্ষা নয়।

  • নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস ও অন্যান্য কারণেও কফের সাথে রক্ত হতে পারে।

  • মোটামুটি  ২০% সময়ে কাশিতে রক্তের কোন কারণ পাওয়া যায় না।

  • ৩ সপ্তাহের বেশি কাশি হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।

  • শঙ্কিত না হয়ে ডাক্তার দেখানো ও রোগ নির্ণয় গুরুত্বপূর্ণ।

 

পৃথিবীতে যে ৩০ টি দেশে যক্ষ্মা বা টিবি রোগের প্রকোপ অনেক বেশি তার ভেতর বাংলাদেশ অন্যতম। প্রায় প্রতি ১ লক্ষ মানুষের ভেতর ২২১ জন যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। এই সমস্যা তুলনামূলক ভাবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে বেশি। আমরা প্রায় সবাই জানি যক্ষা এখন নিরাময়যোগ্য রোগ ও দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসায় এ রোগ ভালো হয়। এর পেছনে বাংলাদেশের যক্ষা সম্পর্কিত সচেতনতা ক্যাম্পেইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলেই আমার ধারণা।

এই রোগটি নিরাময় যোগ্য হলেও, গোটা পৃথিবীতে ১৮৭,০০০ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, যা মৃত্যুহার বিবেচনায় ১৩ তম। অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন, চিকিৎসা থাকলেও যক্ষাকে অবহেলা করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। 

 

যক্ষা (টিবি) রোগের জীবাণু কীভাবে ছড়ায়?

যক্ষা একটি বায়ুবাহিত রোগ। যক্ষার রোগীর হাঁচি-কাশি থেকে যক্ষার জীবাণু (Mycobacterium tuberculosis) সুস্থ মানুষের নিশ্বাসের সাথে ফুসফুসে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে। কিন্তু ফুসফুসে প্রবেশ করলেই যক্ষা হবে এমন নয়। 

প্রায় সব টিবি ইনফেকশনের শুরুটা হয় নিষ্ক্রিয় অবস্থা থেকে। আমাদের ফুসফুসের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এই ইনফেকশন রোধ করে ঠিকই কিন্তু সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস করতে পারে না। দেখা যায় টিবির জীবাণু বছরের পর বছর ধরে মানুষের শরীরে সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে।

সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলোপৃথিবী জুড়ে প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে সুপ্ত-অবস্থায় যক্ষ্মার জীবাণু আছে। ২ বিলিয়ন মানুষ বলতে সম্পূর্ণ পৃথিবীর ৪ ভাগের ১ ভাগ জনসংখ্যা! কিন্তু প্রায় ৯৫% ভাগ ক্ষেত্রেই রোগটি দীর্ঘকাল সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কারো কারো টিবির জীবাণু নিষ্ক্রিয় অবস্থায় যাওয়ার পর তা আর কখনোই সক্রিয় অবস্থায় আসতে পরে না।

অন্য কোন রোগ বা বার্ধক্য জনিত কারণে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যখন কমে যায় তখন যক্ষ্মার জীবাণু পুনরায় সক্রিয় হয়ে পড়ে যার ফলে কাশি, দুর্বলতা ও অন্যান্য সমস্যা দেখা দেয়। 

যক্ষ্মার জীবাণু আমাদের ফুসফুসের কোষকে আক্রান্ত করে। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সেই সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য ইনফেকশনের জায়গার চারপাশে একটা আবরণ তৈরি করে যাতে করে জীবাণু নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এই আবরণের জন্য গুটির মত তৈরি হয় যা এক্সরে করলে ধরা পড়ে। আসুন যক্ষ্মা রোগের লক্ষণগুলো দেখা যাক। 

 

যক্ষা রোগের লক্ষণ

টিবি রোগের লক্ষণ কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। আসুন বিস্তারিত জেনে নেই-

১. প্রথমবার যক্ষ্মার উপসর্গ

  • হালকা জ্বর

  • দুর্বলতা

  • কাশি

প্রথমবার যক্ষার জীবাণুর সংস্পর্শে আসার পর প্রায় সব ক্ষেত্রেই তা সুপ্ত অবস্থায় চলে যায়। সুপ্ত অবস্থায় কোন রকম উপসর্গ দেখা যায় না। যদিও একজন সুপ্ত যক্ষা রোগী বছরে আরো ৩-৪ জন মানুষে যক্ষা ছড়াতে পারে।

২. যক্ষ্মার জীবাণু সক্রিয় হওয়ার উপসর্গ

কয়েক মাস থেকে বছর পর্যন্ত যক্ষ্মা বা টিবি এর জীবাণু সুপ্ত অবস্থায় থাকার পর, যক্ষ্মা সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। সক্রিয় যক্ষ্মা রোগ কাশি ও দুর্বলতা থেকে শুরু হয়ে কয়েক সপ্তাহের ভেতর ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। নিচে সক্রিয় যক্ষ্মা রোগের উপসর্গ গুলো দেওয়া হলো।

  • কাশি

  • কফের সাথে রক্ত

  • বুকে ব্যথা, নিশ্বাস বা কাশির সময়

  • রাতে হঠাৎ ঘেমে যাওয়া

  • দুর্বলতা 

  • জ্বর

  • শারীরিক ভাবে অশান্তি লাগা।

৩. ফুসফুসের বাইরে সংক্রমণ ছড়ালে

যক্ষ্মার জীবাণু ফুসফুস থেকে রক্তের মাধ্যমে অন্যস্থানে ছড়াতে পারে। কার্যত এমন কোন অঙ্গ নেই যেখানে যক্ষ্মা ছড়ায় না। এটি সংক্রমণ ঘটাতে পারে যকৃত, কিডনি, হাড় এবং শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। এ ধরণের সংক্রমণের লক্ষণ গুলো জেনে নিন।

  • জ্বর

  • ক্ষুধামন্দা

  • দুর্বলতা

  • রাতে হঠাৎ ঘেমে যাওয়া

  • অসুস্থ বোধ করা

  • চলাফেরায় বল না পাওয়া।

 

কখন ডাক্তার দেখাবেন?

  • কাশির সাথে বুকে ব্যথা, দুর্বলতা ও বিভ্রান্তি বোধ করলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

  • তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাশি ও দুর্বলতা দেখা দিলে একজন নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে পারেন।

  • সমস্যা গুরুতর হলে, যেমন শ্বাসকষ্ট, কফের সাথে রক্ত আসলে একজন  pulmonologist ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।

  • ডাক্তার উপসর্গ জেনে প্রয়োজন মত টেস্ট দেবেন।

ভালো ব্যাপারটি হলো বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যথেষ্ট যক্ষা বা টিবি পরীক্ষা কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে ৫০০-৬০০ টাকার ভেতরে যক্ষা পরীক্ষা করা হয়। তাছাড়া যক্ষ্মার ঔষধ ও বিভিন্ন চিকিৎসা একদম বিনামূল্যে দেওয়া হয়। ৬ মাস ঔষধের কোর্সের মাধ্যমে যক্ষা কার্যকরী ভাবে সেরে ওঠে।

এরপরও আমাদের দেশে যক্ষায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে। বিশেষকরে ঔষধ প্রতিরোধী টিবি এর জন্য অবস্থা আরো ভয়াবহ দিকে মোড় নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। 
 

কোন রোগের জন্য কোন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিৎ?

 

অন্য যে কারণে কাশিতে রক্ত আসতে পারে

শুধু যক্ষাই নয়,অন্য কিছু রোগের কারণেও কাশিতে রক্ত আসতে পারে। যেমন,

  • ব্রঙ্কাইটিস

  • নিউমোনিয়া

  • ফুসফুসে সংক্রমণ

খুব কম দেখা গেলেও এই করণগুলোও হতে পারে-

  • ফুসফুসে ক্যান্সার

  • ফিব্রিওসিস

  • কোকেন এবিউজ

  • লিম্ফনেডে কম্পিকেশন।

  • আর্টারিতে ইনজুরি

  • COPD ইত্যাদি।

 যেকোনো প্রকার শারীরিক সমস্যায়, নিজে নিজে চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয় করতে যাওয়াটা বোকামি। এতে এন্জাইটি, মানসিক ও শারীরিক সমস্যাও হতে পারে। 

 

পরিশেষ

কাশি একটি সাধারণ রোগ হলেও এটি হতে পারে যক্ষা সহ অন্যান্য জটিল রোগের প্রাথমিক পর্যায়। তাই তিন সপ্তাহের বেশি কাশি হলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কাশিতে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার সেবা প্রদানকারীদের ফেইস মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। সর্বোপরি, নিজের শরীর ও উপসর্গ সম্পর্কে সচেতন থাকলে ও যথাসময়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে অনেক রোগ ব্যাধি শুরুতেই সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়।

 

আরও পড়ুনঃ

 

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles