হাঁটু ব্যাথার কারণ ও প্রতিকার
বর্তমান সময়ে হাঁটুর ব্যাথা যেন বাঙালীর পাতে ডাল-ভাতের মতো। বাচ্চা থেকে বুড়ো, প্রতিটি পরিবারে এমন কাউকে প্রায় পাওয়া যায় না বললেই চলে যারা এই হাঁটু ব্যাথার সমস্যায় ভুগছে না। অতিরিক্ত ভয় পেতে পেতে একসময় যেমন মানুষ ভয়ের ঊর্ধ্বে চলে যায়, ঠিক তেমনি এই হাঁটু ব্যাথাও এতো বেশী সহজলভ্য হয়ে গেছে যে আমাদের কাছে এর ভয়াবহতা গেছে কমে। তবে ভয় না পেয়ে আসুন এর সমাধান বের করার চেষ্টা করি।

হাঁটু ব্যাথা বাড়লে সাধারণত যে চিত্রটা দেখা যায় – আমরা মোড়ের মাথায় কোন এক ওষুধের দোকানে যেয়ে বলি হাঁটুতে ব্যাথা হচ্ছে, কি খাওয়া যায়? দোকানদার খুব বোদ্ধার মতো শুনেটুনে শেষে ডাইক্লোফেনাক বা এসিক্লোফেনাক গ্রুপের একটা দামী ওষুধ ৬ টা ধরায়ে দেয় ৩ দিন সকাল-রাত খাওয়ার জন্য। আর সাথে দেয় গ্যাসের ওষুধ। আমরা ওষুধ নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। রাতে খেয়ে ঘুম দেই, সকালে উঠে দেখি – আরে! ব্যাথা তো সেরে গেছে। তারমানে আমি ভালো হয়ে গেছি।
ঘরের ধুলাময়লা ডাস্টবিনে না ফেলে কার্পেটের নীচে চাপা দিলে যেমন ঘর সত্যিকার অর্থে পরিষ্কার হয় না, তেমনি আসল কারণের চিকিৎসা না করে শুধুমাত্র ব্যাথা চাপা দিলেই হাঁটুর সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। তাই চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক যে কি কি কারণে হাঁটুতে ব্যাথা হতে পারে এবং সেগুলোর প্রতিকার কি।
হাঁটু ব্যাথার কারণসমূহ
হাঁটু ব্যাথার কারণগুলোকে আমরা মোটা দাগে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করতে পারি –
১) মেডিক্যাল ইস্যু
২) নন-মেডিক্যাল ইস্যু
এখানে মেডিক্যাল ইস্যু বলতে আমরা মূলত বোঝাচ্ছি কোন রোগের কারণে হাঁটুতে ব্যাথা হওয়াকে। আর নন-মেডিক্যাল ইস্যু হচ্ছে রোগের বাইরে অন্যান্য কারণসমূহ। এখানে আমরা মেডিক্যাল ইস্যুগুলো নিয়ে পরিচয় করানোর সাথে সাথে এগুলো থেকে পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কেও আলোচনা করব।
হাঁটু ব্যাথার মেডিক্যাল কারণসমূহ
কারণ ১ - অস্টিওআরথ্রাইটিস
এটি হাঁটু ব্যাথার সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে একটা। মাঝবয়সী থেকে বয়স্কদের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা খুব বেশী দেখা যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে এই রোগ একেবারেই জেনেটিক। আবার যারা ভারী কাজ করেন, বা যাদের ওজন অতিরিক্ত তাদের মাঝেও এই রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। তবে মহিলাদের ক্ষেত্রে এই রোগ আরও বেশী কমন। মহিলাদের ৪৫ বছর বয়স পার হবার পরে বা তাদের মাসিক বন্ধ হয়ে যাবার পরে অস্টিওআরথ্রাইটিসের আশংকা থাকে।
অস্টিওআরথ্রাইটিস কিভাবে হয়?
আমাদের হাঁটু দুটি হাড়ের সংযোগস্থল বা জয়েন্ট। এই দুই হাড়ের মাথায় থাকে কার্টিলেজ নামক এক পদার্থ যা হাড়কে পিচ্ছিল রাখে এবং জয়েন্টের মধ্যে নরমাল মুভমেন্ট করতে সহায়তা করে। এই কার্টিলেজ যখন ক্ষয়ে যায় তখন দুটি হাড়ের ঘর্ষণে প্রচণ্ড ব্যাথা হয়।
অস্টিওআরথ্রাইটিস এর ক্ষেত্রে করনীয়
আপনার অস্টিওআরথ্রাইটিস হয়েছে কিনা বা হলেও সেটি এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে তা একমাত্র একজন ডাক্তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরেই বলতে পারবেন। তবে সাধারণত অস্টিওআরথ্রাইটিস নিরাময়ের ক্ষেত্রে ডাক্তাররা প্রথমেই বলেন শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে যাতে হাঁটুর উপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে। এছাড়াও তারা বেশী করে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার কথা বলেন। প্রয়োজনবোধে ডাক্তার ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি এর সাপ্লিমেন্টও সাজেস্ট করতে পারে। এছাড়াও তারা হাঁটু কম ভাঁজ করা, সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে ওঠানামা করা, চেয়ারে বসে নামাজ পড়া, এবং হাই কমোড ব্যাবহার করার পরামর্শও দিয়ে থাকেন।
কারণ ২ – অস্টিওপোরোসিস
অস্টিওপোরোসিস মূলত হাড় ক্ষয়ের কারণে হয়। জন্মের পর থেকেই আমাদের হাড় একদিক থেকে গড়ে ওঠে, আরেকদিক থেকে ক্ষয় হতে থাকে। এখন কোন কারণে যদি গড়ে ওঠার তুলনায় ক্ষয়ের পরিমাণ বেশী হয়ে যায় তখন একে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় আমরা বলি অস্টিওপোরোসিস।
অস্টিওপোরোসিস নিরাময়ে করনীয়
অস্টিওপোরোসিস ঠেকাতে হলে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যেন হাড়ের গড়ে ওঠার হার কমে না যায়। এজন্য সঠিক নিয়মে নিয়মিত ব্যায়াম করা, পরিমিত আহার গ্রহণ করা, আহারে হাড়ের গড়ন মজবুত করার উপাদান অর্থাৎ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি বেশী রাখার চেষ্টা করা, এবং শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। এবং এ সবই করতে হবে ৩০ বছর বয়সের ভেতরেই, কারণ এই বয়স পর্যন্তই মানুষের হাড়ের গড়ন হয়।
কারণ ৩ – রিউম্যাটয়েড আরথ্রাইটিস
আমরা প্রায় সবাই জানি যে আমাদের শরীরে একটা রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থা আছে যাকে আমরা ইমিউন সিস্টেম নামে চিনি। এই সিস্টেমের কাজ হচ্ছে আমাদের শরীরকে বিভিন্ন রোগব্যাধি থেকে মুক্ত রাখা। কিন্তু এই ইমিউন সিস্টেমই রোগের কারণ হয়ে যায় যখন রিউম্যাটয়েড আরথ্রাইটিস হয়। কেন যে এমনটা হয় সে বিষয়ে চিকিৎসাবিদদের হাতে খুব একটা পরিষ্কার কোন কারণ নেই। তবে ধারণা করা হয় যে শরীরে কোন একটা ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের আক্রমণের কারণে ইমিউন সিস্টেম ‘বিভ্রান্ত’ হয়ে যায়। তখন সে নিজেই শরীরের বিভিন্ন জয়েন্টে আক্রমণ করা শুরু করে।
রিউম্যাটয়েড আরথ্রাইটিস এর চিকিৎসা
রিউম্যাটয়েড আরথ্রাইটিস এর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তাররা সাধারণত ওষুধ, বিশ্রাম, ব্যায়াম, বা সার্জারির পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আরথ্রাইটিস স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকলে ডাক্তাররা সাধারণত ইবুপ্রোফেন, ন্যাপ্রক্সেন, কর্টিকোস্টেরয়েড, বা অ্যাসিটামিনোফেন জাতীয় ওষুধ সাজেস্ট করে থাকে। তবে রোগের তীব্রতা যদি বেশী হয় সেক্ষেত্রে মেথোট্রিক্সেট, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, লেফ্লুনোমাইড, বা সালফাস্যালাজিন জাতীয় ওষুধও প্রেসক্রাইব করা হতে পারে। এর পাশাপাশি ডাক্তাররা ফিজিকাল বা অকুপেশনাল থেরাপি নেবার পরামর্শও দিতে পারে।
কারণ ৪ – গাউট
আমাদের শরীর যখন অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে এবং কিডনি যখন সেই ইউরিক অ্যাসিড প্রোসেস করে শরীর থেকে বের করে দিতে পারে না, তখন এই ইউরিক অ্যাসিড ক্রিস্টালের মতো আমাদের জয়েন্টগুলোতে জমা হয়। আর এরই নাম গাউট।
গাউট এর প্রতিকার
গাউট থেকে মুক্ত থাকবার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে ইউরিক অ্যাসিড উৎপন্ন হয় এমন খাবার কম খাওয়া। এমন কয়েকটি খাবারের উদাহরণ হচ্ছে লাল মাংস, সী ফুড, মিষ্টি পানীয়, অ্যালকোহোল ইত্যাদি।
হাঁটু ব্যাথার নন-মেডিক্যাল কারণসমূহ
১) আঘাত
২) অ্যাকসিডেন্ট
৩) অস্বাভাবিক ভার বহন
৪) অনিয়ন্ত্রিত ব্যায়াম
৫) স্পোর্টস ইনজুরি
আপনার হাঁটুর ব্যাথার কারণ কোন রোগ হোক বা আঘাত, নিরাময়ের সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া এবং সেই অনুযায়ী চলা। তবে একান্তই যদি সেটা সম্ভব না হয় বা ডাক্তারের সাথে দেখা করতে কোন কারণে দেরী হয় সেক্ষেত্রে কিছু ঘরোয়া পদ্ধতির দ্বারা আপনারা ব্যাথার তীব্রতা কিছুটা কমিয়ে আনতে পারেন।
হাঁটুর ব্যাথা নিরাময়ে ঘরোয়া পদ্ধতি
সেঁক দেয়া
দীর্ঘমেয়াদী বাতের ব্যাথা নিরাময়ে সেঁক দেয়া খুবই কার্যকর একটি পন্থা। তবে মনে রাখতে হবে যে হাঁটুতে কোন ইনফেকশন বা জ্বালাপোড়া থাকলে সেঁক দেয়া যাবে না।
বরফ ব্যাবহার করা
খেলাধুলা বা অন্যান্য আঘাতজনিত ব্যাথার জন্য বরফের ব্যাবহার খুবই উপকারী।
আদা
আদাতে রয়েছে জিনজেরল নামক উপাদান যা জ্বালাপোড়া এবং ব্যাথা নিরসনে অত্যন্ত কার্যকরী।
হলুদ
শরীরে ব্যাথা হলে আমাদের দাদী-নানীরা সেই আদি আমল থেকেই দুধে হলুদ মিশিয়ে খাইয়ে আসছেন এবং এটা আজও সমান কার্যকর।
রসূন
Central Council for Research in Ayurveda and Siddha (CCRAS) এর এক গবেষণা অনুসারে প্রতিদিন এক চা চামচ রসুনবাটা খাবার বা মধুর সাথে মিশিয়ে খেতে পারলে জয়েন্ট এর ব্যাথায় বিশেষ উপকার পাওয়া যায়।
লাল মরিচ
উদ্ভট মনে হলেও সত্য যে লাল মরিচে যেই ক্যাপসাইসিন নামক উপাদান রয়েছে তা ব্যাথানাশক হিসাবে খুবই কার্যকর।
তবে মনে রাখতে হবে, এসব ঘরোয়া পদ্ধতিতে ব্যাথা হয়ত শুধুমাত্র সাময়িকের জন্য কমতে পারে, তবে হাঁটুর সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান পেতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ আবশ্যক।