লিভার সিরোসিস (পর্ব-১): ভয়ঙ্কর এই রোগটি সম্পর্কে আপনাকে যা জানতে হবে
লিভার সিরোসিস রোগটি কেন এত মারাত্মক! কি কারণে এই রোগ হয় এবং কাদের ঝুঁকি বেশী? এই রোগের লক্ষণই এবং এর থেকে সৃষ্টি জটিলতাসমূহ কি কি? এসব জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।
_ভয়ঙ্কর_এই_রোগটি_সম্পর্কে_আপনাকে_যা_জানতে_হবে_jpg_16699019235062.jpg)
লিভার সিরোসিস যকৃতের বিভিন্ন রোগের চূড়ান্ত অবস্থা যা থেকে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব হয় না। লিভারের রোগগুলোর প্রথমদিকে তেমন কোন লক্ষণ প্রকাশ পায়না। তাই যখন সিরোসিস ধরা পড়ে তখন আর ক্ষতিগ্রস্ত লিভারকে সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়না এবং লিভার ক্রমেই অকার্যকর হতে থাকে-যার চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে রোগীর মৃত্যু হয়ে থাকে। এজন্য লিভার সিরোসিসের প্রতিকার বা চিকিৎসার উপর নির্ভর না করে যকৃতের মারাত্মক এই রোগ যাতে না হয় সেজন্য সতর্ক হওয়া জরুরি।
লিভার সিরোসিস কি?
লিভার সিরোসিস হল দীর্ঘদিন ধরে লিভারের বিভিন্ন রোগের ফলে লিভারে সৃষ্ট স্থায়ী ক্ষত। সিরোসিসের ফলে যকৃতে সূক্ষ্ তন্তুর জাল বা ফাইব্রোসিসের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে যকৃতের টিস্যুগুলো দানাদার ও শক্ত হয়ে যায়। এই ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যগুলো আর লিভারের স্বাভাবিক কাজগুলো করতে পারেনা।
লিভার সিরোসিস হেপাটাইটিসের মত মারাত্মক অবস্থা থেকে সৃষ্টি হয়ে থাকে যা ইতোমধ্যেই লিভারের যথেষ্ট ক্ষতি করে ফেলেছে। একারণে সিরোসিসকে সাধারণত শেষ পর্যায়ের লিভারের রোগ ধরা হয়। সিরোসিস হওয়ার পরও লিভার তার কাজ করতে পারে। কিন্তু সময়মত সঠিক চিকিৎসা না নিলে সিরোসিস থেকে লিভার ফেইলিওর এবং অন্যান্য প্রাণঘাতী মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
লিভার সিরোসিসে আসলে কি ঘটে?
লিভারের বিভিন্ন রোগ এর সুস্থ কোষগুলোর ক্ষতি করে। একপর্যায়ে কোষে প্রদাহ দেখা দেয় এবং কোষের মৃত্যু ঘটে। কিছু কোষ সেরে ওঠে কিন্তু এই সেরে উঠার প্রক্রিয়ায় কোষে স্থায়ী ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
এই ক্ষতিগ্ৰস্ত টিস্যুগুলো যকৃতে রক্ত পরিবহনে বাঁধার সৃষ্টি করে। এর সাথে সাথে যকৃতের অন্যান্য কার্যক্ষমতা যেমন- পুষ্টি উপাদান, বিভিন্ন হরমোন, ঔষধ ও প্রাকৃতিক টক্সিন প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদির গতি মন্থর করে দেয়। এছাড়া সিরোসিস যকৃতের প্রোটিন ও অন্যান্য উপাদান তৈরির ক্ষমতাও হ্রাস করে। মোট কথা, সিরোসিস ধীরে ধীরে লিভারের সঠিকভাবে কাজ করার ক্ষমতা নষ্ট করে ফেলে এবং এক সময় লিভার পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়ে।
লিভার সিরোসিসের কারণ
লিভার সিরোসিসের কারণ স্থান অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। যেমন উন্নত দেশগুলোতে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ হল অ্যালকোহল বা মদ্যপান। মদ্যপানের কারণে সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আগের থেকে কিছুটা বেশি পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে লিভার সিরোসিসের প্রধাণ কারণ হচ্ছে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস। এছাড়া গত কয়েক বছর ধরে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজের কারণে আমাদের দেশে সিরোসিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।
দীর্ঘদিন ধরে অ্যালকোহল সেবনের ফলে লিভারের অন্যান্য অসুখ থাকা, স্থূলতা, ডায়াবেটিস বা ফ্যাটি লিভার, নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটোহেপাটাইটিস-মোটকথা লিভারের ক্ষতি করে এরকম যেকোন রোগ থেকে সিরোসিস হতে পারে। এছাড়া কিছু বংশগত রোগ থেকেও লিভার সিরোসিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
লিভার সিরোসিসের অন্যান্য কারণগুলো হল-
-
লিভারে একটি অস্বাভাবিক প্রোটিন জমার কারণে সৃষ্ট আলফা-১ অ্যান্টিট্রিপসিন ডেফিসিয়েন্সি
-
হেমোক্রোমাটোসিস বা লিভারে অতিরিক্ত আয়রন জমে যাওয়া
-
লিভারে অতিরিক্ত কপার জমে যাওয়া (উইলসন ডিজিজ)
-
সিস্টিক ফাইব্রোসিস ( লিভারে ঘন, আঠালো শ্লেষ্মা জমা হওয়া)
-
লিভারে গ্লাইকোজেন জমা হওয়া
-
অটো ইম্যুউন হেপাটাইটিস
-
প্রাইমারি বিলিয়ারি কোলানজাইটিস ( পিত্ত নালী স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া)
-
প্রাইমারি স্কেলেরোসিন কোলানজাইটিস(পিত্তনালীর ক্ষত ও সংকুচিত হয়ে যাওয়ার কারণে লিভারে পিত্ত জমা হওয়া)
-
অ্যালাজিল সিনড্রোম (স্বাভাবিকের চাইতে কম পিত্তনালী নিয়ে জন্মগ্ৰহণ করা যা পিত্তের স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্ৰস্ত করে যার কারণে জন্ডিস হয়)
-
পিত্তনালী ব্লকড হয়ে যাওয়া বা শিশু অগঠিত বা ব্লকড পিত্তনালী নিয়ে জন্ম গ্রহণ করা (বাইলিয়ারি অ্যাটরেসিয়া) যা পরবর্তীতে লিভারে দাগ, ক্ষত বা লিভার টিস্যুর মৃত্যু এবং সিরোসিস এর কারণ হয়
-
এমিলইডোসিস ( লিভারে এমিলয়েড নামক এক অস্বাভাবিক প্রোটিন জমা হওয়ায় লিভারের স্বাভাবিক ক্রনিক হার্ট ফেইলিওর যাতে লিভারে ফ্লুইড জমে যায় এবং শরীর অন্যান্য অংশ ফুলে যায়)
লিভার সিরোসিসের ঝুঁকি কাদের সবথেকে বেশী?
যারা দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত অ্যালকোহল পান করেন তাদের সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবথেকে বেশী । এছাড়া আরো কিছু রোগ এবং অসচেতনতার কারণে লিভার সিরোসিস হয়ে থাকে। যেমন-
-
ভাইরাল হেপাটাইটিস থাকলে
-
ডায়াবেটিস থাকলে
-
অতিরিক্ত ওজন
-
লিভারের অন্য কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকলে
-
একই সুঁচ ব্যবহার করে মাদক সেবন করলে
-
অনিরাপদ যৌন মিলন করলে।
লিভার সিরোসিসের লক্ষণগুলো কি কি?
বিভিন্ন পর্যায়ের লিভার সিরোসিস আলাদা আলাদা লক্ষণ প্রকাশ করে। লিভার সিরোসিসের প্রথম ধাপগুলোতে তেমন কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না ।অনেক সময় কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখা যায় যেগুলো অন্যান্য অনেক রোগের ক্ষেত্রেও দেখা যায়।
লিভার সিরোসিসের প্রাথমিক লক্ষণ গুলো হল-
-
ক্ষুধামন্দা
-
ক্লান্তি ও দুর্বলতা
-
বমিভাব
-
জ্বর
-
অস্বাভাবিক ওজন হ্রাস
লিভারের কার্যক্ষমতা কমার সাথে সাথে আরো কিছু সাধারণ লক্ষণ প্রকাশ পায় যা থেকে বুঝতে পারবেন আপনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত কি না। যেমন-
-
সহজে ক্ষত ও রক্তপাত হওয়া
-
চামড়ায় ও চোখের সাদা অংশে হলুদ ছোপ দেখা দেয়া(জন্ডিসের লক্ষণ)
-
চামড়ায় চুলকানি হওয়া
-
হাতের তালু লালচে হয়ে যাওয়া
-
ত্বকে ছোট, লালচে ছোপ ছোপ দাগ দেখা দেয়া
-
পা, পায়ের পাতা ও হাঁটু ফুলে যাওয়া
-
পেটে এবং তলপেটে তরল জমা হওয়া
-
হলুদ বা বাদামি রঙের প্রশাব হওয়া
-
পায়খানার রঙ ফ্যাকাশে হওয়া এবং পায়খানার সাথে রক্ত আসা
-
ব্যাক্তিত্বে পরিবর্তন আসা
-
স্মৃতি শক্তি হ্রাস, চিন্তা করতে সমস্যা হওয়া, বিভ্রান্ত হওয়া
-
পুরুষ দের ক্ষেত্রে-যৌনশক্তি হ্রাস পাওয়া, ব্রেস্ট এর আয়তন বৃদ্ধি পাওয়া (গাইনোকোমাষ্টিয়া), শুক্রাশয় কুঁচকে যাওয়া
-
মহিলাদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বয়সের আগেই মেনোপজ হওয়া ইত্যাদি।
লিভার সিরোসিস থেকে সৃষ্টি হওয়া জটিলতাসমূহ
লিভার সিরোসিস থেকে সৃষ্টি হওয়া জটিলতাগুলো হল-
পোর্টাল হাইপারটেনশন
সিরোসিসের গুরুতর জটিলতা গুলোর মধ্যে এটি সবথেকে বেশী দেখা যায়। পোর্টাল শিরায়(সবথেকে বড় রক্তবহিকা যা হজমকারী অঙ্গ গুলো থেকে যকৃতে রক্ত বহন করে) রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া কে পোর্টাল হাইপারটেনশন বলে। লিভার সিরোসিসের কারণে লিভারে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ার ফলে এই শিরায় রক্তচাপ বেড়ে যায়, ফলে শিরাগুলো ফেটে গুরুতর রক্তপাত ও হতে পারে।
হাইপারস্প্লেনিজম বা প্লীহা অতি সক্রিয় হয়ে যাওয়া
এর ফলে রক্ত কোষগুলো খুব দ্রুত ধ্বংস প্রাপ্ত হয়ে যায় যার কারণে কিছু জটিলতা দেখা দেয় যেমন, প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, অল্প কিছু খেলেই পেট অস্বাভাবিক ভর্তি অনুভব করা, অ্যানিমিয়া, বিভিন্ন ইনফেকশনে সহজেই আক্রান্ত হয়ে যাওয়া।
জটিল ইনফেকশন দেখা দেয়া
সিরোসিসের কারণে বিভিন্ন জটিল ইনফেকশনে (যেমন-ব্যাকটেরিয়াল পেরিটোনাইটিস) আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
অপুষ্টি
সুস্থ লিভারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল পুষ্টি উপাদান প্রক্রিয়াজাত করা যা সিরোসিসে আক্রান্ত ক্ষতিগ্রস্ত লিভার করতে পারেনা। যার ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ওজন ও অস্বাভাবিক ভাবে হ্রাস পায়।
লিভার ফেইলিওর ও লিভার ক্যান্সার
লিভার তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে না পারলে লিভার ফেইলিওর হয়ে থাকে। লিভারের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হল সিরোসিস। এছাড়া লিভার সিরোসিস থেকে লিভার ক্যান্সার হয়ে থাকে।
শেষকথা
যদিও লিভার সিরোসিস থেকে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব নয়, যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগের বৃদ্ধি ও অন্যান্য জটিলতাগুলো থামানো বা অন্তত কমানো সম্ভব। সিরোসিসের সঠিক চিকিৎসা না চললে পর্যায়ক্রমে লিভারে ক্ষতের পরিমাণ বাড়তে থাকে এবং লিভারের কার্যক্ষমতা কমতে থাকে। একসময় লিভার ফেইলিওর হতে পারে যা রোগীর জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই লিভারের কোন রোগ ধরা পড়লে দেরি না করে সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে এবং সিরোসিস প্রতিরোধে একটি সুস্থ ও সঠিক জীবনাচরণ মেনে চলতে হবে।