কিডনির পাথর প্রতিরোধের ১০টি উপায়
এমন কিছু কাজ আমরা মাঝে মাঝেই করি, যা কিডনিতে পাথর হবার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাছাড়া আছে কিছু ভুল ধারণাও। তাই আসুন কিডনিতে পাথর প্রতিরোধের উপায়গুলি বিস্তারিত জেনে নেই।

-
আপনার কখনো কিডনিতে পাথর না হয়ে থাকলেও জীবনকালে এটি হওয়ার সম্ভাবনা ১০%
-
৯% নারী ও ১১% পুরুষ কিডনিতে পাথর রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন
-
একবার কিডনিতে পাথর হলে দ্বিতীয়বার ৫-৭ বছরের ভেতর পুনরায় হবার সম্ভাবনা ৫০%।
-
কিছু স্বাস্থ্যকর নিয়ম মানলে এটি হবার সম্ভাবনা কমে আসে অনেক গুন।
কিডনিতে পাথর অনেকাংশেই আমাদের স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের সাথে সংযুক্ত। কিডনিতে পাথর নিয়ে এর আগের প্রবন্ধে আমরা আলোচনা করেছিলাম-
“কিডনিতে পাথর কেন হয়? চিকিৎসা করবেন কীভাবে?”
আর আজকের প্রবন্ধে আমরা কিডনিতে পাথর প্রতিরোধের দশটি উপায় নিয়ে আলোচনা করব। এই নিয়ম গুলো যেমন রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করবে, তেমনি জীবন হবে অনেকখনি স্বাস্থ্যকর।
কিডনিতে পাথর প্রতিরোধের উপায়
১. প্রচুর পানি পান
পর্যাপ্ত পানি পান যেমন সুস্থ দেহ ও স্বাভাবিক দেহক্রিয়া সম্পাদনের জন্য জরুরী, তেমনি এটি কিডনিতে পাথর রোধ করার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপায়। ঠিক কতটুকু পানি পান করবেন তা নির্ভর করে আপনি কি কাজ করছেন ও আবহাওয়ার উপর। দৈনিক ৮ গ্লাস পানি পান করতে হবে এমনটা অনেক জায়গাতেই শোনা যায়। কিন্তু আসলে ৮ গ্লাস নয়, ততটুকু পানি পান করা উচিত যাতে ২ লিটার মূত্র উৎপাদন হয়। প্রচণ্ড গরমের দিনে, কিংবা কায়িক পরিশ্রম করলে অতিরিক্ত পানি পান করতে হবে। লেবু বা কমলার জুসও দেহে পানির চাহিদা পূরণ করে সেই সাথে এতে থাকা সাইট্রিক এসিড কিডনিতে পাথর হওয়া রোধ করে।
বিশুদ্ধ ও পরিমিত পানি পানের ১০টি উপকারিতা
২. পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম গ্রহণ
একটা ভুল ধারণা হলো ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার বেশি খেলে কিডনিতে পাথর হতে পারে, কিন্তু আসলে তা নয়। ক্যলশিয়াম শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি পুষ্টি উপাদান যা হাড় গঠনে সাহায্য করে এবং ক্যলশিয়াম স্বল্পতায় হাড়ের বিভিন্ন রোগ হতে পারে। বরং ক্যালসিয়াম স্বল্পতার কারণেই ক্যালশিয়ামের মেটাবোলিজমে ত্রুটির কারণে কিডনিতে ক্যালসিয়াম স্টোন তৈরি হতে পারে। দুধ, দই ও অন্যান্য দুগ্ধজাত খাদ্য ক্যলশিয়ামের ভালো উৎস।
সুস্বাস্থ্যে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর সম্পর্ক কী?
৩. অক্সালেট সমৃদ্ধ খাবার কম খাওয়া
কিডনিতে উৎপন্ন পাথরের একটি অন্যতম উপাদান হলো অক্সালেট যা ক্যালসিয়ামের সাথে যুক্ত হয়ে ক্যলসিয়াম অক্সালেট পাথর তৈরি করে। তাই অক্সালেট সমৃদ্ধ খাবার কম খেলে কিডনিতে পাথর হবার ঝুঁকি অনেকাংশেই কমবে। কিছু অক্সালেট সমৃদ্ধ খাবার হলো, পালং শাক, চিনাবাদাম, বিট, কফি, মিষ্টি আলু ও চকলেট। তবে ক্যলসিয়াম ও অক্সালেট সমৃদ্ধ খাবার একসাথে গ্রহণ করলে তা কিডনিতে পৌঁছানোর আগেই পাকস্থলীতে যৌগ গঠন করে, যা কিডনি স্টোন প্রতিরোধের একটা উপায় হতে পারে।
৪. লবণ খান পরিমিত
আমরা খাবারের সাথে যে ক্যালসিয়াম গ্রহণ করি তা মূত্রে পরিশোধিত হয়ে শরীরে ফিরে আসে। কিন্তু অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করলে শরীর তা পুনরায় ঠিকভাবে শোষণ করতে পারে না। যে কারণে মূত্রে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ও কিডনিতে পাথর হবার সম্ভাবনা বাড়ে। বিশেষ করে যাদের একবার কিডনি স্টোন হয়ে গেছে, তাদের লবণ খাবার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। খাবারের সাথে বাড়তি লবণ, লবণ যুক্ত স্ন্যকস ও ক্যানড ফুড থেকো সতর্ক থাকলে ঝুঁকি কমানো যায়।
অতিরিক্ত লবণ খেলে কি হয়! লবণের ব্যবহার কমানো যায় যেভাবে
৫. কম মাংস খান
মাংস খাবার পরে খেয়াল করবেন প্রস্রাবের রং কিছুটা হলুদ হয়ে থাকে। মাংস খেলে মূত্রের এসিডিটি বৃদ্ধি পায় ও ইউরিক এসিড স্টোন তৈরি হবার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই মাংসের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দুধ ও উদ্ভিজ্জ আমিষ বেশি বেশি গ্রহণ করুন।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়িয়ে যেভাবে মাংস খাবেন
৬. কামরাঙ্গার জুসকে না বলুন
একটি কামরাঙ্গায় ৮০ থেকে ৭০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত অক্সালেট থাকতে পারে। আমাদের দেহে দৈনিক অক্সালেট এর পরিমাণ ২০০-৩০০ মিলি এর বেশি হওয়া উচিত নয়। এমনিতে কামরাঙ্গা খেলে হয়ত একটা খাবেন, কিন্তু এর জুস হিসেবে খেলে ৩-৪ টা কামরাঙ্গা চিনি ও অন্যান্য অন্যান্য উপাদানের সাথে খুব সহজেই খেয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু এটা হতে পারে মারাত্মক বিপদজনক, কারণ অতিরিক্ত অক্সালেট ছাঁকতে গিয়ে কিডনি ফেইলর পর্যন্ত হতে পারে, আর কিডনি স্টোনের ঝুঁকি তো আছেই।
৭. ওজন কমানোটা দরকারি
ওজন বৃদ্ধি মানে আপনার কিডনিকে বড় শরীরের দূষিত পদার্থ ছাঁকতে হয়। এতে যেমন কিডনির উপর চাপ পড়ে, কিডনিতে পাথর হবার ঝুঁকিও বাড়ে অনেক গুন। শুধু তাই নয় অতিরিক্ত ওজন হতে পারে হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও উচ্চ-রক্তচাপ এর কারণ। ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা সুস্বাস্থ্যের অন্যতম চাবিকাঠি।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং - দ্রুত ওজন কমানোর সেরা উপায়।
৮. চিনি ও ফ্রুক্টোজ কম খান
চিনি ও ফ্রুকটোজ মূত্রের ঘনত্ব, এসিডটি ও ক্যলসিয়ামের পরিমাণ অনেকাংশেই বাড়িয়ে তোলে যা কিডনি স্টোন তৈরির কারণ হতে পারে। চিনি ও চিনিযুক্ত খাবার কমিয়ে আনা স্বাস্থ্যের জন্য যেমন উপকারী তেমনি কিডনি স্টোন প্রতিরোধেও গুরুত্ব বহন করে। অন্যদিকে ফ্রুক্টোজ বা মিষ্টি ফল একবারে খুব বেশি খাওয়া উচিত নয়, এবং পূর্বে কিডনিতে পাথর হয়েছে তাদের ফল খাবার ব্যাপারে আরো বেশি সতর্কতা প্রয়োজন।
৯. ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করুন
যাদের একবার কিডনিতে পাথর হয়েছে তাদের পরবর্তীতে পাথর হওয়া প্রতিরোধে ডাক্তারই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতে পারবেন। আপনার পূর্ববর্তী পাথর এর ধরণ ও প্রকৃতি বিবেচনা করে ডাক্তার আপনাকে কিছু খাবার থেকে বিরত থাকতে বলতে পারেন।
১০. কিডনি স্টোন প্রতিরোধী খাবার খান
যেকোনো সাইট্রিক এসিড সমৃদ্ধ খাদ্য: লেবু, কমলা, মাল্টা, ক্যলসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার: দুধ, দই, পনির, পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার: ব্রকলি, ইত্যাদি খাবার কিডনিতে পাথর প্রতিরোধে সহয়তা করে। সেই সাথে লাল আটা, লাল চাল এমন ধীর পাচ্য কার্বোহাইড্রেট যুক্ত খাবার সঠিক ওজন ধরে রাখতে সাহায্য করে, যা কিডনি স্টোন প্রতিরোধে কার্যকরী।
পরিশেষ
প্রবন্ধটির মূল তথ্য গুলো আরেকবার দেখে নিন,
-
কিডনিতে পাথর প্রতিরোধে প্রতিদিন ২ লিটার মূত্র তৈরি হবার মত পানি পান করতে হবে
-
ক্যলসিয়াম কিডনিতে পাথর তৈরি করে না, বরং ক্যলসিয়াম স্বল্পতা এর জন্য দায়ী
-
পরিমিত লবণ, চিনি, মাংস ও ফল গ্রহণ করতে হবে।
-
কামরাঙ্গা খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত ও ধীর-পাচ্য শর্করা জাতীয় খাবার কিডনিতে পাথর প্রতিরোধে কার্যকর।