মাথায় ফাংগাল ইনফেকশন জনিত খুশকি হতে মুক্তি পাবেন যেভাবে

ফাংগাল ইনফেকশন জনিত খুশকি প্রচন্ড অস্বস্তিদায়ক ও হতাশাজনক হয়ে উঠতে পারে খুব সহজেই। যত যাই করুন সাধারণ খুশকির মত এটি চলে যায় না। সাথে চুলকানী, মাথার ত্বকে ফুঁসকুড়ি, ব্যাথা, জ্বলুনীর মত সমস্যা গুলো অবস্থা আরো ভয়াবহ করে তোলে। অতিরিক্ত এন্টিমাইক্রোবিয়াল প্রডাক্ট ব্যাবহার ফাংগাস সহ অন্যান্য অনুজীবদের শক্তিশালি করে তুলছে, ফলে এদের থেকে মুক্তি পাওয়াও ক্রমেই কষ্টকর হয়ে উঠছে।

চুলের সৌন্দর্যই মানুষের সৌন্দর্যের একটি বড় অংশ দখল করে রাখে। তাই চুল নিয়ে মানুষের আবেগেরও কমতি নেই। এটি আমাদের এমন এক সম্পদ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেকোন মূল্যে ধরে রাখতে চায়। তাইতো মাথায় কিছু হলে দুঃশ্চিন্তার শেষ থাকে না।

বর্তমান সময়ে মাথার ত্বকের সমস্যা গুলোর মধ্যে ফাংগাস জনিত ইনফেকশন খুব সাধারণ হয়ে উঠেছে। ফাংগাস হলো একপ্রকারের অনুজীব যা যা জৈব বস্তু থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে। সহজ কথায় ব্যাঙের ছাতা বা ছত্রাক। ছত্রাকের অনেক প্রজাতি প্যারাসাইটের মত অন্য প্রাণীর দেহ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে বসবাস করতে পারে। 

মানুষের মাথার ত্বকেও সে ধরণেরই কিছু ছত্রাক এর আক্রমন হতে পারে। অনেক ধরণের ছত্রাকই মানুষের মাথার ত্বকে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। কিন্তু মূলত তিন থেকে চার ধরণের ছত্রাকের সংক্রমণ খুব বেশি দেখা যায়। প্রায় সব ধরণের ফাংগাস ইনফেকশনেই অনিয়ন্ত্রন যোগ্য খুশকি, চুলকানী ইত্যাদি হয়ে থাকে।

সাধারণ খুশকি কেন হয়?

অস্বাভাবিক খুশকি সম্পর্কে জানার আগে প্রয়োজন স্বাভাবিক খুশকি কেন হয় তা জানা। খুশকি হওয়ার প্রক্রিয়াটি সহজ ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করছি। খেয়াল করুন,

আমাদের শরীরে অসংখ্য ব্যাক্টেরিয়া ও ফাংগাস সাধারণ ভাবেই বসবাস করে। তারা সাধারণত কোন ক্ষতি করে না। তেমনই এক ধরনের অনুজীব হচ্ছে Malassezia. এটি একধরণের ইস্ট যা আমাদের মাথার ত্বকে চুলের গোড়ার খাঁজে বসবাস করে। 

মাথার ত্বক এক ধরণের তেল নিঃসরণ করে যা আমাদের চুল সুন্দর রাখতে সাহায্য করে, যার নাম সিবাম। মেলাসিজিয়া সিবাম তেল খেয়ে বেঁচে থাকে। 

মেলাসিজিয়া সিবাম তেলের উপর একটা এনজাইম প্রয়োগ করে। সেই এনজাইম তেলকে ভেঙে ফেলে মেলাসিজিয়ার খাওয়ার উপযোগী করে। কিন্তু তেলের যে অংশটি মেলাসিজিয়া খায় না, তা জমাট বেধে আমাদের মাথার ত্বক ভেদ করে ঢুকে যেতে চায়। যার ফলে চুলকানী ও জ্বলুনীর মত সমস্যা হয়। 

আমাদের শরীর খুব তাড়াতাড়ি সেই ক্ষতিগ্রস্থ ত্বক থেকে মুক্তি পেতে চায়। তাই ক্ষতিগ্রস্থ ত্বকের নিচে নতুন ত্বক তৈরি হয় ও ক্ষতিগ্রস্থ ত্বক খসে যায় যা খুশকি হিসেবে পরিচিত।

পৃথিবীর সব মানুষের এটি হয়ে থাকে। যাদের ত্বকে তেল নিঃসরণ বেশি হয় তাদের খুশকি বেশি হয়। অর্থাৎ খুশকি বেশি হওয়া মানেই যে ক্ষতিকর ছত্রাকের সংক্রমণ হয়েছে তা ঠিক না। সাধারণ খুশকিও ছত্রাকের কারণে হয়ে থাকলেও, তা ক্ষতিকর নয়। কিন্তু অন্য ক্ষতিকর প্রজাতির সংক্রমণ খুবই অস্বস্তিকর খুশকির জন্ম দেয়। আসুন একে একে সেগুলো জানা যাক।

Seborrheic dermatitis জনিত খুশকি

Seborrheic dermatitis একটি অনুবীক্ষনিক ছত্রাক যা মাথার ত্বক ও শরীরের অন্যান্য জায়গায় সংক্রমণ ঘটায়। তবে মাথার ত্বক ও অন্যান্য তৈলাক্ত স্থানে সংক্রমনের হার সবচেয়ে বেশি। এটি মাথার ত্বকে ছাড়া মুখে, নাকে, কানে ইত্যাদি জায়গায় দেখা দিতে পারে। 

এই ধরণের ছত্রাকের সংক্রমণ অত্যান্ত সাধারণ। প্রায় সব মানুষেরই জীবনে একবার না একবার এ ধরণের ছত্রাক সংক্রমণ হয়ে থাকে। কিন্তু আশার ব্যাপার হলো এ ধরণের ছত্রাকে চুল পড়ে না। তাই আশঙ্কার কোন কারণ নেই। অনেক ক্ষেত্রেই এই ধরণের খুশকি নিজে নিজেই চলে যায়। কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। 

উপসর্গ

  • চামড়ায় হলুদাভ খোসা ওঠা

  • চোখে ও নাকে সাদা প্রলেপ লেগে থাকা

  • মাথায় খুশকি ও সাদা সাদা চামড়ার অংশ উঠে আসা

  • চুলকানী ও জ্বলাভাব

চিকিৎসা

Seborrheic dermatitis জনিত খুশকির চিকিৎসা সাধারণত সহজ ও বাড়তি ঔষুধের প্রয়োজন হয় না। সাধারণ সাবান বা শ্যাম্পু সহ নিয়মিত গোসলেই এটি সেরে যায়।

কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এটি জটিল আকার ধারণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে এন্টিফাংগাল ক্রিম ও শ্যাম্পু ব্যাবহারের মাধ্যমে এ রোগ থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া যায়। এ ধরণের চিকিৎসায় কাজ না হলে বা অস্বস্তি বাড়লে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।

Candidiasis জনিত খুশকি

Candidiasis মূলত এক ধরণের ইস্ট যা মানুষের মাথার ত্বকে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। মজার ব্যাপার হলো এটি আমাদের দেহের একটি সাধারণ অনুজীব যা আমাদের, মুখে, গলায়, পেটে ও ভ্যাজাইনাতে বসবাস করে। এসব জায়গায় এরা ইনফেকশন ঘটায় না কিন্তু সুযোগ পেলে এরা মাথার ত্বকে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এদের সংক্রমনের সম্ভাবনা বেড়ে যায় যখন মাথার ত্বকের স্বাভাবিক অনুজীব (মেলাসিজিয়া ও অন্যান্য) অনুপস্থিত থাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে এরা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে, এদের ব্রেইন, কিডনী ও হার্টে সংক্রমন ঘটানোর রেকর্ডও পাওয়া যায়। 

তবে চিন্তা নেই, এইডস বা অন্য রোগে রোগ প্রতিরোধ একেবারে কমে না গেলে অমন হবার সম্ভাবনা নেই। Candidadid অন্ধকার ও তৈলাক্ত জায়গায় খুব ভালো বেড়ে উঠতে পারে। তবে এটি সংক্রমক নয়।

উপসর্গ

  • সাদা খোসা ওঠা চামড়া

  • চুলকানী

  • চামড়ায় আঁইশ এর মত ওঠা

  • অনেক জায়গায় গ্রিসের মত সাদা সাদা জমা হওয়া

  • ফুুঁসকুড়ি ওঠা

চিকিৎসা

এ ধরণের ফাংগাল ইনফেকশনে আক্রান্ত স্থান সবসময় পরিষ্কার ও শুকনো রাখতে হবে। আক্রান্ত স্থানে এন্টিফাংগাল ক্রিম ব্যাবহার করলে দ্রুত উপকার পাওয়া যায়। নিয়মিত গোসলের সাথে এন্টিফাংগাল শ্যাম্পু ব্যাবহারও উপকারী। আর্টিকেলের শেষ অংশে কিছু এন্টিফাংগালের নাম উল্লেখ থাকবে। তবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যাবহারই সর্বউত্তম।

কিছু ক্ষেত্রে এই ছত্রাক সমুহ ড্রাগ রেজিস্টেন্স বৈশিষ্ট অর্জন করে যে কারণে ঔষধ ব্যাবহার করলেও সারতে চায় না না। তেমন দেখা গেলে একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। ডাক্তার উপসর্গ ও আক্রান্ত স্থান পর্যবেক্ষন করে এন্টিবায়োটিক ঔষধ প্রেসক্রাইব করতে পারেন।

Psoriasis জনিত খুশকি

এ ধরণের খুশকি দীর্ঘদিন ভোগাতে পারে আর সহজে সারতেও চায় না। এতে আক্রান্ত হলে মাথার ত্বকে জমাট বাঁধা প্লাকের মত খুশকি হতে দেখা যায়। মাথার ত্বকের চামড়া বিবর্ণ হয়ে উঠে আসে। মাথার ত্বকের সাথে সাথে কপালে, ঘাড়ে, এটি দেখা যেতে পারে। এলকোহল সেবন, ধুমপান, ডিপ্রেশন জনিত কারণে এটির সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে চুল পড়ে যেতে দেখা যায়। 

উপসর্গ

  • মাথার ত্বকে বিবর্ণ ময়লার মত জমা

  • মৃত ত্বক উঠে আসা

  • ত্বক থেকে আঁইশ এর মত ওঠা

  • কপালে ও ঘাড়ে সাদাটে আবরণ পড়া

  • ত্বক রুক্ষ হয়ে পড়া

  • চুলকানী

  • ত্বক ফাটা

  • রক্ত বের হওয়া

চিকিৎসা

এ ধরণের ফাংগাস সংক্রমণ হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করতে হবে। ডাক্তার বিভিন্ন টেস্টের পর মুখে সেবনের ঔষধ ও ফটোথেরাপি প্রেসক্রাইব করবেন।

খুশকির ঘরোয়া টোটকা

সাধারণ খুশকি খুব সহজেই সাধারণ শ্যাম্পু দিয়ে দূর করা সম্ভব। কিছু ঘরোয়া জিনিস দিয়েও খুশকির ক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যায়। এলোভেরা, বেকিং সোডা, নারকেল তেল, অলিভ তেল ও ভিনেগার ব্যাবহারের মাধ্যমে খুশকির প্রকোপ দূর করা যায়।

স্ক্যাল্প ইনফেকশনের ঔষধ

স্ক্যাল্প ইনফেকশনে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী griseofulvin জাতীয় ঔষধ গ্রহণ করতে হয়। তাছাড়া itraconazole, fluconazole জাতীয় ঔষধও মাথায় ছত্রাক ইনফেকশন সারাতে ব্যাবহার হরা হয়। ওভার দ্যা কাউন্টার এন্টিফাংগাল ক্রিম ছাড়া যেকোন ঔষধ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করবেন।

শেষ কথা

অনেক ধরণের স্ক্যাল্প ইনফেকশন হতে পারে, তবে নিশ্চিত না হয়ে কখনোই চিকিৎসা গ্রহন করবেন না, এতে মাথার ত্বকে স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হবে। নিয়মিত গোসল করা ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকাই যেকোন ফাংগাল ইনফেকশন থেকে রক্ষা করতে পারে।

আরও পড়ুনঃ

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles