লিভার সিরোসিস (পর্ব-২): এই রোগে রোগীরা কতদিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে?
লিভার সিরোসিস রোগীদের কি আদৌ চিকিৎসা আছে? রোগীরা সাধারণত কতদিন বাঁচতে পারে? লিভার সিরোসিস প্রতিরোধ করবেন কীভাবে? এসব জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।
লিভার সিরোসিস হওয়ার পর রোগী সাধারণত কতদিন বাঁচতে পারে?
লিভার সিরোসিস ধরা পড়ার পরপরই রোগীর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায় এরকম ভাবার কারণ নেই। সিরোসিস দুই ধরণের-
১. কম্পেনসেটেড সিরোসিস
কম্পেনসেটেড সিরোসিসের কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়না এবং বায়োপসি ছাড়া অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষায় তেমন অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়না। কম্পেন্সেটেড সিরোসিসে আক্রান্ত এরকম ৫০% রোগী সাধারণত ৯-১২ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।অন্যদিকে ৫০% রোগী ৯-১২ বছরের কম বাঁচে।
২. ডিকম্পেনসেটেড সিরোসিস
অপরদিকে, ডিকম্পেনসেটেড সিরোসিসের ক্ষেত্রে রোগীর লিভার এতোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় যে সিরোসিসের সাধারণ লক্ষণ গুলো প্রকাশ পেতে থাকে। রোগী জন্ডিস, অ্যাসাইটিস, হেপাটিক এনকেফ্যালোপ্যাথি, হেপাটোরেনাল সিনড্রোম, ভ্যারিসিয়াল রক্তপাত, লিভার ক্যান্সার এগুলোর যে কোনটায় আক্রান্ত হতে পারে। এই পর্যায়ের সিরোসিসে আক্রান্ত ৫০% রোগীরা ২ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে, অনেকেই এর আগেই মারা যায়।
লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা কি, খরচ কেমন? বাংলাদেশে কি সিরোসিসের চিকিৎসা সম্ভব?
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লিভার সিরোসিস থেকে সৃষ্ট জটিলতাগুলোর উপসর্গ দেখে এর চিকিৎসা করা হয়। যেমন সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীর জন্ডিস থাকলে প্রথমে জন্ডিসের চিকিৎসা দেয়া হবে। রোগীর পেটে বেশি পানি জমলে পানি অপসারণ করার ব্যবস্থা নেয়া হয়। রক্তবমি, কালো পায়খানা হলে সেগুলো কমানোর ব্যবস্থা করা হয়। কোন ইনফেকশন দেখা দিলে সেটা কমানোর চিকিৎসা দেয়া হয়।
প্রকৃতপক্ষে লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া এর স্থায়ী ও সুনির্দিষ্ট তেমন কোন চিকিৎসা নেই। লিভার ফেইলিওর এর ক্ষেত্রে লিভার প্রতিস্থাপন করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। বাংলাদেশেই এখন সফলভাবে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন করা হচ্ছে তবে এই চিকিৎসায় প্রায় ২০-২৫ লাখ টাকা খরচ হয়। লিভার প্রতিস্থাপনের চিকিৎসা একদিকে যেমন ব্যয়বহুল অন্য দিকে যকৃত ম্যাচ করবে এরকম উপযুক্ত দাতা খুঁজে পাওয়াও কষ্টসাধ্য।
লিভার সিরোসিস হলে কি করবেন?
লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীদের লিভারের যে ক্ষতি ইতোমধ্যে হয়ে গেছে তা নিরাময় করা সম্ভব নয়। তবে সিরোসিসের সম্ভাব্য কারণ নির্ণয় করতে পারলে লিভারের আর যেন ক্ষতি না হয় সেজন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমন-
-
অ্যালকোহল সেবন থেকে সিরোসিসের সৃষ্টি হয়ে থাকলে অ্যালকোহল বর্জন করা
-
ক্রনিক হেপাটাইটিস থাকলে এর সঠিক চিকিৎসা করানো
-
লিভারের ক্ষতি করে এমন ঔষধ সেবন বন্ধ করা
-
সুষম ও স্বাস্থ্য সম্মত খাবার গ্রহণ করা। মেন্যুতে ফ্যাট জাতীয় খাবার কম রাখা।
-
নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার এ আক্রান্ত হয়ে থাকলে ওজন কমাতে হবে। ওজন কমানোর জন্য একটি সুষম ও স্বাস্থ্যকর ডায়েটের পাশাপাশি ব্যায়াম ও শরীর চর্চা করতে হবে। ডায়াবেটিস থাকলে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
লিভার সিরোসিস যেভাবে প্রতিরোধ করবেন
লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা থেকে যেহেতু আরোগ্য লাভের নিশ্চয়তা কম এবং এটি খুবই ব্যয়বহুল, চিকিৎসকেরা সবসময় পরামর্শ দেন আগে থেকেই সিরোসিস ও যকৃতের অন্যান্য রোগগুলো প্রতিরোধ করতে। তাই লিভার সিরোসিস প্রতিরোধে দেরি না করে নিম্নোক্ত ব্যাবস্থা গুলো গ্রহণ করুন-
-
শাক-সবজি, ফলমূল ও চর্বিহীন প্রোটিনের সমন্বয়ে খাবার মেন্যু নির্ধারণ করতে হবে। ফ্যাট জাতীয় খাবার কম খেতে হবে।
-
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। শরীরে চর্বি জমা থেকেই পরবর্তীতে লিভারে চর্বি জমতে থাকে।
-
খাবারে লবণের পরিমাণ পরিমিত হতে হবে।
-
পর্যাপ্ত ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে।
-
ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড এবং ভালো ও খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
-
হেপাটাইটিস বি বা সি থেকে সিরোসিস হয়ে থাকলে হেপাটাইটিস বি/সি এর চিকিৎসা করাতে হবে।
-
এছাড়া বংশগত লিভার রোগ, অটোইম্যুউন হেপাটাইটিস থাকলে সেগুলোর জন্য নির্দিষ্ট চিকিৎসা করাতে হবে।
-
মদ্যপান ও ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে।
-
হেপাটাইটিস বি ও সি হওয়ার ঝুঁকি আছে এমন কাজ যেমন একই সূচ ব্যবহার করে মাদক সেবন বা অরক্ষিত শারীরিক মিলন থেকে বিরত থাকতে হবে।
-
একই সিরিঞ্জ পুনরায় ব্যবহার করে রোগীকে রক্ত দেয়া যাবেনা।
-
রক্ত নেয়ার আগে অবশ্যই রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে হবে রক্তদাতার হেপাটাইটিস বি বা সি আছে কিনা।
-
সেলুনে চুল ও দাঁড়ি কাটার সময় প্রতিবার কাঁচি ও রেজর জীবাণু মুক্ত করতে হবে।
-
হেপাটাইটিস বি এর প্রতিষেধক নিতে হবে।
লিভার সিরোসিস সম্পর্কে আরো কিছু প্রশ্ন
লিভার সিরোসিস নির্মূল করা সম্ভব নয় কেন?
লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার অর্থ হলো রোগীর অন্য কোন চূড়ান্ত পর্যায়ের লিভার ডিজিজ আছে। লিভারের অন্য কোন রোগের কারণে লিভারের ইতোমধ্যেই স্থায়ী ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে। লিভারের এসব জটিলতা বা রোগ আগে ধরা পড়লে এবং তার সঠিক চিকিৎসা হলে ঐ রোগগুলো নির্মূল করা বা আরো অবনতি হওয়া থেকে বাঁচানো যেত।
লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সার কি একই?
যদিও লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত অধিকাংশ মানষের লিভার সিরোসিস ও হয়ে থাকে, লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যান্সার এক নয়।তবে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হলে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
মূলত হেপাটাইটিস বি বা হেপাটাইটিস সি তে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের লিভার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায় কারণ এ রোগগুলো থেকে পরবর্তীতে লিভার সিরোসিস হয়। যদি আপনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত না ও হয়ে থাকেন, অনেক সময় হেপাটাইটিস বি ও ফ্যাটি লিভারের কারণেও আপনি লিভার ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকতে পারেন।
লিভার সিরোসিস কি বংশগত?
না, লিভার সিরোসিস বংশগত রোগ নয় এবং বাবা-মা সিরোসিসে আক্রান্ত হলে সন্তানেরও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
সিরোসিস কি যন্ত্রণাদায়ক?
হ্যাঁ, সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার পর রোগ বৃদ্ধির সাথে সাথে এটি যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠতে পারে। সিরোসিসে আক্রান্ত রোগীদের অধিকাংশের মতে এটি যন্ত্রণাদায়ক এবং এই যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী। লিভার ডিজিজে আক্রান্ত অনেক রোগী পেটে ব্যথার কথা উল্লেখ করে থাকেন। পেটে ফ্লুইড জমা হওয়ার কারণে পেট ফুলে যাওয়া এবং যকৃত ও প্লীহা আকারে বড় হয়ে যাওয়ার কারণে ও এধরনের ব্যথা হতে পারে। এখানে ব্যথার কারন সিরোসিস হতে পারে বা সিরোসিসের কারণে পূর্বের রোগগুলো বেড়ে ব্যাথা হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ-যাদের স্থূলতা, অস্টিওআর্থারাইটিস ও তার সাথে সাথে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ আছে, লিভার সিরোসিস হলে তাদের ক্ষেত্রে হাড় ও অস্থিসন্ধির ব্যথা আরো বেড়ে যেতে পারে। ব্যথা ছাড়াও সিরোসিসের কারণে পুরো শরীরে প্রদাহ ও হতে পারে।